ঘড়ির কাটার কৃত্রিম গতির হিসেবে বিকেল হওয়ার কিছুক্ষন আগেই পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে পৌছে গেলাম। যদিও এখন হেমন্তের শেষাংশ, তাই দুপুর এবং বিকেলের মাঝে তেমন কোনো শত্রুতা নেই, যে কারনে দুপুরকে বিকেল হতে পৃথক করা যায় না, উত্তরের হিমালয় হতে ভেসে আসা শীতল বায়ু এবং মাথার উপরে সূর্যের আমাদের এ পৃথিবী থেকে কিছুকালের জন্য দূরে সরে যাওয়ার ফলে তাপের তীব্রতা কমে যাওয়া এ দুটি সময়কে একত্রে মিলিয়ে দিয়েছে। এখন অফ সিজন, তাই পতেঙ্গায় পর্যটকের সংখ্যাও একদম নেই বললেই চলে। যে কারনে, আমি আর সাদিক ভাই খুব আরাম করেই সমুদ্রতীরের সৌন্দর্যস্নান করতে পারছিলাম! সাদিক ভাই আমার থেকে খাতা কলমের হিসেবে এক বছরের বড়, কারন উনি গত বছর উনার মাস্টার্স শেষ করেছেন, আর আমি আজকে করলাম। হ্যা, আজকে আমার মাস্টার্স পরীক্ষার রেসাল্ট দিয়েছে, এবং তাতে আমি আবারও ফার্স্ট ক্লাসেরই যাত্রী হতে পেরেছি। এর চাইতেও বড় খবর হলো, আমি এবারও ফার্স্ট হয়েছি। এবারও বলছি কারন, দুই বছর আগে গ্রাজুয়েশন পরীক্ষার ফলাফলেও নিজেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টের অবস্থানেই খুজেঁ পেয়েছিলাম ডিপার্টমেন্টের নোটিশ বোর্ডে। সাদিক ভাই ঢাকা থেকে এসেছিলেন আমার ক্যাম্পাস ঘুরতে এবং চট্টগ্রামের বিশুদ্ধ বায়ু প্রানভরে গ্রহন করে হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে জমাট বেধে থাকা সকল কলুষতার জঞ্জালের বোঝা হালকা করতে! তাই তাকে নিয়েই ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম রেসাল্ট দেখতে, রেসাল্ট দেখেই বেশীক্ষন না থেকে সোজা চলে এলাম বাসে করে পতেঙ্গা আমি আর সাদিক ভাই, সুর্যাস্ত দেখার আশায়। কারন আজ রাতের টিকেট কাটা হয়ে গেছে আমাদের, আজ রাতেই আমরা বাড়ি ফিরছি।
চট্টগ্রাম আমার বাসস্থান নয়, আমার শিক্ষাকেন্দ্র! আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, ঢাকা থেকে এসেছিলাম পড়তে আজ থেকে সাত বছর আগে। সাত বছর ধরে আমি আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্নই বলা চলে, কেননা অনেক বন্ধ পাওয়া সত্ত্বেও আমি খুব একটা যাই নি চিরচেনা পরিবেশে ফিরে, বছরে দুই-তিনবার গিয়েছি ছুটিতে, তাও কেবল পরিবার আর এই সাদিক ভাই ছাড়া আর কারও সাথেই খুব একটা দেখা করি নি। পরিবারের পর সবচাইতে কাছের মানুষ ছিলেন সাদিক ভাই, তাই তার সাথে দেখা না করে থাকা যায় নি! যাই হোক, অফিশিয়ালি আমার চট্টগ্রামে একাকী জীবনের পাট চুকে গেলো এবার, কারন রেসাল্ট দেয়ার আগেই এক জায়গায় আমার চাকুরী কনফার্ম হয়ে গেছে। একটি জাতীয় দৈনিকে আপাতত শিক্ষানবিশ সহ-সম্পাদকের চাকুরী, ছয় মাস পর পূর্নকালীন সহ-সম্পাদক। উপরি পাওনা হিসেবে রয়েছে শুক্রবারের সাহিত্য পাতার সম্পাদনা করা এবং নিজের লেখা গল্প-কবিতা প্রকাশ করবার ক্ষমতা। বলা বাহুল্য, আমি সাংবাদিকতারই ছাত্র ছিলাম। গত সাত বছরে বেশ কিছু সাহিত্য পত্রিকা এবং দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় আমার স্বরচিত কবিতা প্রকাশিত হয়েছে, এবং প্রায় তিনবার বইমেলায় আমার কবিতা সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। যার ফলে অনেকেরই সুনজরে ছিলাম, তাই হয়তোবা রেসাল্ট হওয়ার আগেই আমার কাছে আমার চির আকাঙ্খিত কর্মস্থলে যোগদানের সুযোগ এসে গিয়েছে। ডিপার্টমেন্টের ডিনও একদিন তার রুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মাস্টার্সের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যেতে চাই কিনা? যদি চাই তাহলে তিনি আমার জন্য প্রভাষকের একটা পদ খালি করে দিতে পারেন, পাশাপাশি বিদেশে স্কলারশীপের জন্য রিকমেন্ডশানও করতে পারেন। সেদিন আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তার এই লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, কারন প্রথমত আমি আমার বাবার কাছে ফিরে যেতে চাই, চাই যে তিনি আমার সাথে থেকে আমার একের পর এক সফলতার দেয়ালগুলো টপকে যাওয়া চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করুন। এবং দ্বিতীয়ত এবং তার চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ এই জন্যে যে, আমি লেখক হতে চাই, লিখতে চাই, অর্থের পরিমান কম হলেও যেজন্য পত্রিকার সাংবাদিক হওয়াটা প্রভাষক হওয়ার চাইতে অনেক বেশী উপযুক্ত হবে আমার জন্য। এবং, এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে আসার পর বুঝতে পারলাম, আমি এবং আমার ভাগ্য এখন একই পথের পথিক।।