ইসলাম এমন এক ধর্ম, মুসলিম এমন এক উম্মাহ তারা পরাধীন দেশে কিংবা অমুসলিম শাসিত দেশে সম্পূর্ণ মুসলিম হয়ে থাকতে পারেনা। মুসলিমদেরকে সম্পূর্ণ মুসলিম হয়ে থাকলেও স্বাধীন থেকে বাস করতে হবে। আর এই জন্য ই মুসলিমদের রাজনীতি করা আবশ্যক। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা ফরজ।
ইতিহাস পড়ে জেনে নিন, রাসুল সা; যখন জন্ম ভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় আসেন তখন মুসলিমরা সংখ্যায় কম ছিলো। মদিনার স্থায়ী বাসিন্দা ইহুদীদের মধ্যে জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত ব্যক্তি কম ছিলেন না। রাসুল সা: তো ঐ সব পণ্ডিত ব্যক্তিদের উপর মদিনা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে তিনি ইসলামের তবলীগী কাজে নিয়োজিত থাকেননি।
তাকে শাসক হিসাবে মেনে নেবে এই শর্তে মদিনায় গমন করেছিলেন। মদিনায় গিয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদী সমাজকে তাকে শাসক হিসাবে মানে নিবে কিনা জিজ্ঞাসা করে তাদের অনুমোদন নিয়েই তিনি সেখানে ইসলামী শাসনের শুভ সূচনা করেছিলেন। নিজ হাতে মদিনার সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা শুরু করেন। আল্লাহর কাছ থেকে যে আদেশ এসেছে তা সাথে সাথে বাস্তবায়ন করেছিলেন।
রাসুল সা: জীবিত অবস্থায় সারা আরব উপদ্বীপের মানুষ (মুনাফিক) ভিতরে ভিতরে ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মেনে না নিলেও রাষ্ট্র নেতা হিসাবে রাসুল সা: এর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছিল।
রাসুল সা: এর রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আবু বকর রা: উমরা রা: উসমান রা: আলী রা: ইসলামী খেলাফতকে বিস্তার ঘটিয়েছিলেন । মাত্র একশত বছরের মধ্যে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা মহাদেশের দেশে দেশে খেলাফতের বিস্তার ঘটেছিলো।
উন্নত জীবন দর্শনের আলোকে লক্ষ কোটি মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলো এবং যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি তারাও ইসলামি খেলাফতের অধীনে বিশ্বস্ত নাগরিক হয়ে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা সহকারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সুখ শান্তিতে বাস করে আসছিলো।
ঐ সময় মুসলিমরা শুধু পর দেশ শাসন বা নামাজ রোজা হজ জাকাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলোনা তারা জ্ঞান বিজ্ঞানেও নিয়োজিত ছিলো। বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছে, নিত্য নতুন আবিষ্কারও করেছে। কারণ আল কোরানে আল্লাহতালা নামাজ কালামের সাথে সাথে বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে , দিবারাত্রি আবর্তন সম্পর্কে দুই সাগরের মিলন স্থল সম্পর্কে ,প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করতে বার বার মুসলিমদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
ঠিক সেই সময়ে খৃষ্টান বিশ্বে বিজ্ঞান সাধনার কারণে বৈজ্ঞানিকদেরকে খৃষ্টান পাদ্রীরা পুড়িয়ে হত্যা করতো।
কালক্রমে যখনই মুসলিম শাসকরা ইসলামী শাসন থেকে ধর্ম সমন্বয় সাধনের পথে পা বাড়ালেন তখন তারা আর খলিফা হিসাবে থাকতে চাইলেন না, তারা বিধর্মীদের শাসকদের মত নিজেরা রাজা বাদশাহর বনে গেলেন, বিলাস বেসনে মত্ত হয়ে পড়লেন। তখন থেকেই ইসলামের পতনের যুগের সূচনা শুরু হয়ে থাকে।
মুসলিম শাসকরা যতক্ষণ খলিফা হিসাবে ছিলেন তখন রাষ্ট্রের জনগণ প্রবল প্রতাপান্বিত খলিফা উমর রা: কে তার রাষ্ট্রীয় ভাষণে মধ্যে ভাষণ থামিয়ে জিজ্ঞাস করতে দ্বিধা বোধ করতোনা, খলিফা কোথায় থেকে অতিরিক্ত কাপড় পেয়েছেন যার দ্বারা তিন এত লম্বা পোশাক বানাতে পারলেন?
কিন্তু যখন মুসলিম শাসকরা রাজা বাদশাহ বনে গেলেন তখন থেকে রাষ্ট্রে জনগণ তাদের প্রজাতে পরিণত হয়ে পড়লেন। প্রজারা রাজা বাদশাহের কাছে ঘেঁষা দুরের কথা রাজকর্মচারীদের কাছে আসতে অক্ষম হয়ে গেলেন।
যে রাষ্ট্রের নাগরিক নিজদেরকে রাষ্ট্রের অংশীদার বলে জানতেন তখন থেকে তারা রাজা বাদশাহের অনুগত প্রজাতে রূপান্তরিত হওয়ার কারণে তাদের আত্মসম্মান বোধ হ্রাস পেতে থাকে, তার সাথে সাথে রাষ্ট্রে প্রতি দায় দায়িত্বের অনুগতেও ভাটা পড়ে।
কালে কালে একদিকে মুসলিমদের মধ্যে বিজাতীয় আচার প্রথার পালক লাগতে শুরু করে, অন্যদিকে মুসলিমদের মনের মধ্য থেকে নিজকে মুসলিম বলে গৌরব বোধ, আত্মসম্মান বোধ হ্রাস পেলো। জ্ঞান বিজ্ঞান গবেষণা আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষায় স্থবিরতা নেমে আসে।
এরপর কয়েক শতাব্দীর মধ্যে মুসলিম দেশগুলোর পতনের সূচনা শুরু হলো রাসুল সা: এর সময়ের মাত্র এক হাজার বছরের মধ্যে প্রায় সকল মুসলিমদেশ ইউরোপের দ্বারা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়লো।
একটি কথা এখন প্রায় শুনা যায় ইউরোপ হচ্ছে ইউরোপ সভ্য মানুষদের আবাসভূমি বর্বর মুসলিমরা কেন আসছে আমাদের এখানে? এখানে আসলে আমাদের কোর ভ্যালুকে মান্য করে চলতে হবে।
অথচ ইসলামের উত্থান থেকে ১২/১৩ শত বছর কোন মুসলিম কি না এসেছিলো ইউরোপে না আমেরিকা কানাডায়? কেন আসবে? কিসের জন্য আসবে? তখনকার অন্ধকার জগতে? হত দরিদ্রদের দেশে?
কিন্তু যখন থেকে ইউরোপ একের পর এক মুসলিম দেশ গুলো জবর দখল করে নিতে শুরু করে। মুসলিম দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে তাদের দেশে শিল্পে বিকাশ জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটিয়ে উন্নত দেশে উন্নীত হয়।
অন্য দিকে মুসলিম দেশের লোকেরা চরম দরিদ্রতার মধ্যে নিপতিত হয়। সেই সময় থেকেই মুসলিমরা ইউরোপ আমেরিকার দেশে দেশে আসা শুরু করে। যদি তারা লুণ্ঠন করে আমাদেরকে ফকির না বানাতো তাহলে এই সব দেশে যাওয়ার কথা মুসলিমরা কখনো মনে আনতোনা।
কারণ একটিই ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী অমুসলিম দেশে বাস করতে হলে তাকে অসম্পূর্ণ মুসলিম হিসাবে বাস করতে হবে।
আমাদের বাংলাদেশ ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশের পায়ে স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়। এর একশত বছরের মধ্যে গোটা ভারত গ্রাস করে নিয়ে যায় ব্রিটিশ।
মাত্র ৫০ বছরের মাথায় এসে ব্রিটিশরা এই দেশে ৫শত বছরের মোগলদের প্রচলিত সব ব্যবস্থা বাতিল করে তাদের স্বার্থ এবং হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করে এই সব ব্যবস্থা প্রচলন শুরু করে।
মোগল আর নবাবদের আমলে রাজার জাতি হিসাবে মুসলিমরা লেখা পড়া চালিয়ে যাবার জন্য রাজ পৃষ্টপোষকতা পেয়ে আসছিলো, তাতে করে মুসলিমদের চাকুরী বাকুরীর ক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছিলো।
বিশেষ করে ৩শত বছরের মুসলিম নবাবদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ভূমি ব্যবস্থা সরকারী ভাষা খাজনা আদায়ের ধরন পরিমাণ বাতিল করে তাদের স্বার্থ হাসিল হয় সে ব্যবস্থা প্রচলন করে। শুধু ব্রিটিশরা দয়া পরবশ হয়ে মুসলিমদের বিবাহ, তালাক আর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পদ বণ্টনের আইন কানুন চালু রাখে। বাকি সব ক্ষেত্রে তাদের আইন চালু করে।
যার ফলে হিন্দুরা মুসলিমদের হটিয়ে সকল যায়গা জমি সরকারী চাকুরী ব্যবসা বাণিজ্য দখল করে নিয়ে যায়। অচিরে সব হারিয়ে রাজার জাতি ভিখারির জাতিতে পরিণত হয়।
হিন্দুরা যখনই অর্থ বিত্ত এবং রাজনৈতিক শক্তির অধিকারী হয়ে উঠার সাথে সাথেই তারা শুরু করে কেমন করে ইসলাম ধর্মের বিকাশ বন্ধ করা যায় সেই প্রচেষ্টা।
সেই যে ব্রিটিশ অনুকূল্যের হিন্দু মধ্যবিত্তের উত্থান হলো সেই সময় থেকে এই দেশ থেকে মুসলিম বিতাড়ন আর ইসলামী ভাবধারা বিকাশের রাস্তা রোধ করার চেষ্টা শুরু করেছিলো আজো সমান তালে তারা সে প্রচেষ্টা বজায় রেখে যাচ্ছে।
রাজত্ব হারিয়ে ফেলার পর থেকে মুসলিমরা ধর্ম কর্মকে সংকুচিত করে আনতে বাধ্য হয়। অধিকাংশ মসজিদ বন্ধ হয়ে যায়। মুসলিমরা এই দেশকে দারুল হারব মনে করে জুম্মার নামাজ বাদ দিতে বাধ্য হয়। তখন থেকে মুসলিমরা রাষ্ট্র পরিচালনা, সমাজ পরিচালনার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে শুধুমাত্র নামাজ রোজার মধ্যে তাদের মুসলিমত্বকে সীমাবদ্ধ করতে বাধ্যহয়।
মুসলিমরা সুদ ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে মেনে নিতে বাধ্যহয়। এইটি সম্ভব হয়েছিলো পরাধীনতার জন্য।
১৯৪৭ সালে মুসলিমরা ভৌগলিক স্বাধীনতা লাভ করতে পারলেও ইসলামকে স্বাধীন করতে পারেনি। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের যারা শাসক হয়েছিলেন তারা কেউই ইসলামিক রাষ্ট্র পরিচালনা করার মত যোগ্যতা সম্পন্ন ছিলেন না। যাদের নেতৃত্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের উপর পতিত হয়েছিলো তারা ছিলেন ব্রিটিশদের শিক্ষায় শিক্ষিত তাদের মানসপুত্র।
ফলে ব্রিটিশরা বিতাড়িত হলেও তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, তাদের সুদ ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা , তাদের বিচার ব্যবস্থা, তাদের বস্তুবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহাল থেকে গেল। তার মানে আম গাছে আমই ফলবে আমড়া ফলবেনা।
সেই সময় যদি মুসলিমলীগের মত দল না হয়ে মিশরের ইখওয়ানের মত কোন দল থাকতো তাহলে ব্রিটিশরা কখনো ভারত ভাগ করতে রাজী হতোনা।
সময়ের সাথে সাথে আম গাছে সারা দেশ ভরে গেল। আর ইসলাম যে ১৭৫৭ সালে ক্ষমতা হারিয়ে ছিলো এখন স্বাধীন বাংলাদেশের এই পর্যন্ত ক্ষমতা ফিরে পায়নি।
ক্ষমতা ফিরে না পাওয়াতে আমরা এই দেশের মুসলিমরা কোনদিন পূর্ণ মুসলিম হতে পারছিনা বরং এতদিন পোকা খাওয়া যে মুসলিমত্ব ছিলো তাও এখন যাওয়ার পথে।
১৭৫৭ সালের পর থেকে হিন্দুরা যে মিশন শুরু করেছিল, আর ১৪ শত বছর আগে খ্রিষ্টান আর ইহুদিরা যে মিশন শুরু করেছিল এখন তারা সম্মিলিত ভাবে সে মিশন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে বর্তমান সময়ে যোগ দিয়েছে সমাজতন্ত্রী নাস্তিকরা।
তারা মুসলিমদের খাসি বানানোর প্রক্রিয়ায় প্রথমে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদী বানাচ্ছে তবে তাদের পরবর্তী টার্গেট মুসলিমদেরকে নাস্তিককে পর্যবেশিত করা। এই কাজ সম্মিলিত ভাবে জোরের সাথে চলছে।
এখন প্রতিটি মুসলিমকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা পূর্ণ মুসলিম হিসাবে বেচে থাকতে চায় কিনা!
পূর্ণ মুসলিম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলে জাতীয়তাবাদী দর্শন ছুড়ে ফেলে দেশে দেশে ইসলামকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করে আনতে হবে। বুঝতে হবে ইসলাম টিকে থাকলে মুসলিমরাও টিকে থাকবে; না হলে অন্যান্য জাতির মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৩