somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্রাচের কর্নেলের ব্যার্থ ক্যু , ইতিহাসের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে কার লাভ?

২৬ শে জুলাই, ২০১৩ ভোর ৪:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাসদ-গণবাহিনীর সৈনিক
সংস্থার ব্যর্থ বিপ্লবের নায়ক কর্নেল (অবঃ)
তাহের বলেছিলেন : ‘‘জাসদের
গণসংগঠনগুলো থেকে যে সাড়া আশা করেছিলাম,
সেটা তারা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন
এলাকার গণসংগঠনের
যে ধারণা আমাকে দেয়া হয়েছিল, তার
পুরোটা হয়তো ঠিক না। আর আমার
তো মোবিলিটির একটা রেস্ট্রিকশন আছে,
নিজে সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখবার সুযোগ
আমার ছিল না। আমাকে বিশ্বাস করতে হয়েছে।’’
শাহাদুজ্জামানের সম্প্রতি লেখা ‘ক্রাচের
কর্নেল' শীর্ষক বইয়ে কর্নেল তাহেরের এই
বক্তব্যটির উদ্ধৃতি আছে। [পৃষ্ঠা-৩০৮, ‘ক্রাচের
কর্নেল' শাহাদুজ্জামান, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা]
এ বইয়ে কর্নেল তাহের, জাসদ-গণবাহিনী, সৈনিক
সংস্থার বিপ্লব-প্রস্তুতি থেকে বিপ্লবের
আদ্যপান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। এর ঐতিহাসিক
বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবে এ
বইয়ে উদ্ধৃত ঘটনাবলী বেশ চমকপ্রদ ও
আকর্ষণীয়। সাম্প্রতিক সময়ে কর্নেল তাহেরের
সামরিক আদালতের গোপন কক্ষে বিচার
নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এ নিয়ে মামলা হয়েছে।
আদালতের কাজ তার নিজস্ব গতিতে চলবে। এ
ব্যাপারে কারই কোন বক্তব্য থাকতে পারে না।
তবে লক্ষ্য করছি, তাহেরকে গোপন সামরিক
আদালতে বিচার করে ফাঁসি দেয়ার জন্য জেনারেল
জিয়ার মরণোত্তর বিচার করার
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তাহেরের ফাঁসির
প্রতিশোধ নিতে চাওয়া হচ্ছে।
তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন,
বিপ্লবের অগ্নিকুন্ডে সৈনিক সংস্থার সদস্যদের
এবং কর্নেল তাহেরকে ঠেলে দিয়ে জাসদ-এর
তাত্ত্বিক পুরুষ সিরাজুল আলম খানের গোপন
আস্তানায় আত্মগোপন থেকে শুরু
করে পরিকল্পনা মতো সিভিলিয়ান
মবিলাইজেশনে জাসদের রাজনৈতিক
ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য মহাজোট সরকারের
অংশীদার জাসদ-ভগ্নাংশ দীর্ঘ ৩৫ বছর পর
ইতিহাসের প্যান্ডোরার বাক্স খুলতে শুরু
করেছেন। জনমত সংগঠন এবং সৈনিক সংস্থার
সামরিক অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ-বিপ্লবের
পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থনের বাতাবরণ
তৈরি করায় জাসদ-এর শোচনীয় ব্যর্থতা, তাদের
পরিকল্পিত প্রতারণা নাকি সাংগঠনিক দুর্বলতা,
নাকি ভিন্দেশী নীলনকশার প্রোক্সী,
তা নিয়ে স্বয়ং কর্নেল তাহেরও ঘোরের
মধ্যে ছিলেন। জীবন দিয়ে তাহের
জাসদকে বিশ্বাস করার মূল্য শোধ করেছেন।
সিরাজুল আলম খান, হাসানুল হক ইনুসহ সাতই
নবেম্বর সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান
এবং পরবর্তী পর্যায়ের নানা ঘটনা প্রবাহের
ধারাবাহিকতায় কর্নেল তাহের এবং জাসদ
নেতৃত্ব মিলে জেনারেল জিয়া ও তাঁর
সরকারকে উৎখাত করার ধারাবাহিক তৎপরতাও
চালিয়েছেন। তাতে তারা সফল হতে পারেননি।
জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী জাসদ-
গণবাহিনী-সৈনিক সংস্থার ক্যু ব্যর্থ
করে দিয়ে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠায় সফল
হয়েছেন। সামরিক কালচার ও সাধারণ রাজনৈতিক
বিচারে পরাজিত পক্ষের টিকে থাকার কথা নয়।
বন্দীদশা থেকে কর্নেল তাহের জেনারেল
জিয়াকে মুক্ত করে তাদের রাজনৈতিক
স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছেন।
তাতে তারা সফল হননি।
শাহাদুজ্জামান লিখেছেন : ‘‘রহস্যময় মানুষ দলের
চিন্তাগুরু দাদা সিরাজুল আলম খান
তাহেরকে মাঠে নামিয়ে দিয়ে চলে যান অজ্ঞাত
স্থানে। যদিও সেখান থেকে তিনি যোগাযোগ
রাখেন তাহেরের সঙ্গে। কিন্তু মূল দৃশ্যপট
থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন তিনি।’’ [প্রাগুক্ত-
পৃ-২৭৪] তাহেরের বড়ো ভাই ইউসুফের সন্দেহ
ছিল, জাসদ-এর লিডাররা ‘পিপল মবিলাইজ'
করতে পারবে কিনা এবং কেবলমাত্র সৈনিক
সংস্থার সিপাহীদের দিয়ে একটা বিপ্লব সম্পন্ন
করা সম্ভব হবে কিনা।' এ সন্দেহের
জবাবে তাহের বলেছেন : ‘আমি জানি, ইউসুফ
ভাই। কিন্তু সেটা তো তাদের দায়িত্ব।
আমি যে দায়িত্বটা নিয়েছি, সেটা থেকে আমার
পেছানোর কোন সুযোগ নাই।’’ [ প্রাগুক্ত-
পৃ-২৭৫]
ডাকসু'র সাবেক ভিপি ও প্রাক্তন জাসদ
নেতা এবং অধুনা আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর
রহমান মান্না শহীদ জিয়ার ওপর তাদের সকল
ক্ষোভ ও ক্রোধ চাপিয়ে সম্প্রতি বলেছেন :
‘‘নিজের ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করতে জিয়াউর
রহমান কর্নেল তাহেরকে ফাঁসী দেয়ার জন্যই
ক্যাঙ্গারু আদালত বানিয়েছিলেন। তাহেরের
মৃত্যুই ছিল ওই বিচারের প্রধান লক্ষ্য। একই
বিচারে মেজর জলিলকেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তার
সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেয়া হয়। এটি ছিল
সাজানো মামলা।’’ জাসদ-এর নেতারাও একই মত
পোষণ করেন। মজার কথা হচ্ছে,
আওয়ামী লীগসমর্থিত স্ব-ঘোষিত জেনারেল
খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের
নেতৃত্বদানকারী কর্নেল তাহেরের
ভুয়া উত্তরসূরীদের সাথে হাত
মিলিয়ে আওয়ামী লীগ শহীদ জিয়ার মরণোত্তর
বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে তারাই লাভবান
হবে যারা সৈনিক সংস্থা-গণবাহিনীর
বিপ্লবে ব্যর্থ হয়েছিল। সেনাবাহিনী সংস্কারের
প্রশ্নে কর্নেল তাহেরের
বিপ্লবী পরিকল্পনা শেখ মুজিবও পছন্দ করেননি।
যদিও তাহেরের বিশাল স্বপ্ন ছিল, শেখ সাহেব
তার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবেন।
প্রথমে তাহেরকে চিকিৎসার জন্য
বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। তাহের
তাতে সম্মত হননি। কুমিল্লা ব্রিগেড
থেকে তাহেরকে ঢাকায় সেনাবাহিনীর ডিফেন্স
পারচেজে পরিচালক পদে বদলী করা হয়। এসবই
ছিল তাহেরের মার্কসবাদী ধারায়
সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের ধ্যান-ধারণা ও তার
সংক্রমণ থেকে সেনাবাহিনীকে মুক্ত
রাখতে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রয়াস।
ব্যক্তিগত
কারণে লন্ডনে চিকিৎসা নিতে অপারগতার
কথা জানিয়ে রেহাই পেলেও তাহেরকে এরপর
জেনারেল সফিউল্লাহ ডেকে ঢাকায় ডিরেক্টর
ডিফেন্স পারচেজ বদলীর কথা জানান।
এতে তাহের হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন। এর আগে তাহের
বঙ্গবন্ধুকে আর্মির ভেতরে কন্সপিরেসের
কথা জানিয়েও সাড়া পাননি। এতেও তার ক্ষোভ
ছিল। শেখ মুজিব তাহেরকে কোন প্রশ্রয়
না দিয়ে বলেন: ‘‘যাও, তোমার জায়গায় কাজ
করো, এসব তোমাকে ভাবতে হবে না।’’ শেখ
মুজিবের সাথে দেখা করে তাহের জানতে চান:
‘‘আমি একটা একটিভ কমান্ডে আছি,
আমাকে কেন বদলী করা হলো?’’ শেখ সাহেবের
জবাব: ‘ঐখানে একজন সৎ লোক দরকার।
নানা চুরিচামারী হয়। তুমি গেলে ভালো হবে।'
তাহের বুঝতে পারেন, কুমিল্লায়
তিনি সেনাবাহিনীর গঠন
চরিত্রকাঠামো বিন্যাসের যে এক্সপেরিমেন্ট
করেছেন, তা অধিকাংশ সিনিয়র
আর্মি অফিসারের অপছন্দনীয় ছিল
এবং সেটা চীফ অব স্টাফেরও পছন্দ না।
আর্মি থেকে রিজাইন করার সিদ্ধান্তের
প্রান্তিকতায় এসে তাহের তার ভাই-
ইউসুফকে বলেন: ‘‘হোয়াই স্যুড আই ওয়েস্ট মাই
টাইম ইন দি আর্মি এনিমোর?
আমি তো আর্মিতে ঢুকেছিলাম ওয়ার
ফেয়ারটা শেখার জন্য। আমার সেই নলেজের
চূড়ান্ত ব্যবহার আমি করেছি। কুমিল্লায় পিপলস
আর্মির একটা মডেল করতে চাইলাম, কেউ
তা সাপোর্ট করছে না। আমি ভেবেছিলাম,
জেনারেল জিয়া এটাকে ব্যাক করবেন। কিন্তু
উনিওতো কোনো উচ্চবাচ্য করেন না।’’ তাহের
এই পিপলস আর্মির র্যা প্লিকেট অন্য
ক্যান্টনমেন্টেও চালু করতে চেয়েছিলেন। তাঁর
ইচ্ছা ছিল, স্টেট স্ট্রাকচারের ভেতরে থেকেই ঐ
স্ট্রাকচারের ওপর আঘাত হানবেন। সিরাজ
সিকদার ও মেজর জিয়াউদ্দীনের মতের সাথেও
তাঁর মত মিলছে না। আর্মি থেকে রিজাইন
দিতে তাহেরকে সেনাবাহিনীর যেসব সিনিয়র
শুভাকাঙ্ক্ষী বারণ করেন তার মধ্যে জেনারেল
জিয়া ও মঞ্জুরও ছিলেন। কিন্তু তাহের
মনে করেন, অন্যরা তার মতো পলিটিক্যাল
এজেন্ডা নিয়ে মাথা ঘামান না। তারা স্রেফ
ক্যারিয়ারিস্ট। ১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর
তাহের সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ
করেন। দীর্ঘ পদত্যাগপত্রে এর প্রেক্ষাপট
বর্ণনা করে এক স্থানে লিখেন:
‘‘আমি সেনাবাহিনী ত্যাগ করে জনগণের
কাছে ফিরে যেতে চাই।
যারা মুক্তিযুদ্ধকালে আমার
চারদিকে জড়ো হয়েছিল।’’ পঁচাত্তরের ৭ নবেম্বর
পর্যন্ত তাহের বছর তিনেক সেনাবাহিনীর
বাইরে থেকে সেনাবাহিনীর সৈনিকদের
নিয়ে ‘সৈনিক সংস্থা' গঠন করেন, যা ছিল কার্যত
জাসদ-এর অঙ্গ সংগঠন। সিরাজ সিকদারের
ব্যাপারে তাহেরের মূল্যায়ন : ‘‘সিরাজ সিকদার
সোস্যালিস্ট রেভ্যুলেশনের কথা বলছে। কিন্তু ঐ
আন্ডারগ্রাউন্ড টেরোরিজম
দিয়ে সেটা হবে না।’’
‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ' নামের
নিউক্লিয়াসের তাত্ত্বিক গুরু সিরাজুল আলম
খান বাংলাদেশে প্রথম র্যা ডিকাল বিরোধীদল--
জাসদ নিয়ে আবির্ভূত হন। মজার কথা হচ্ছে,
‘মুজিব বাহিনীর' সামরিক-তাত্ত্বিক দীক্ষাগুরু
যে ভারতীয় জেনারেল ওবান, তিনি জাসদ-এরও
দার্শনিক-তাত্ত্বিক। মেজর জলিল ও তাহের
দু'জনই জাসদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন। সিরাজুল
আলম খান-হাসানুল হক ইনুর সাথে দীর্ঘ
আলোচনার পর তাহের জাসদ-রাজনীতির
সাথে যুক্ত হন। জাসদ-দৃশ্যত আওয়ামী লীগের
বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী ধারা উচ্ছেদ করে বৈজ্ঞানিক
সমাজতন্ত্রের বিপ্লব সাধনে লিপ্ত ছিল।
তাহের ‘দাদা' সিরাজুল আলমের কনসেপ্ট পছন্দ
করেন। ‘দাদা' বলেন: ‘মাস মুভমেন্টের
পাশাপাশি এক পর্যায়ে সশস্ত্র
একটা গণবাহিনীও তৈরি করতে চাই। আপনাকে ঐ
গণবাহিনীর নেতৃত্বে দেখতে চাই।' তাহের বিশ্বাস
করতেন, মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের আস্থা অর্জন
করলেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের
অভাবে সে আস্থা নষ্ট হয়েছে। ক্রমশ
রাজনৈতিক দল হিসেবে জাসদ মুজিব সরকারের
প্রতিপক্ষ জঙ্গি বিরোধীদল হিসেবে আবির্ভূত
হয়। এক পর্যায়ে জাসদ তদানীন্তন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর (সাবেক
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমের পিতা) মিন্টো রোডের
বাড়ি ঘেরাও ও স্মারকলিপি পেশের মধ্য
দিয়ে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি করে।
এতে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর গুলীবর্ষণে ১২ জন
জাসদ কর্মী নিহত হয়। ভারতের
হাইকমিশনারকে অপহরণ করে জিম্মি- নাটকের
পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন দাদা সিরাজুল আলম
খান।
এ সময় জাসদকে দিল্লীর আশীর্বাদপুষ্ট দল
বলে বিবেচনা করা হতো। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত,
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শেখ মুজিবকে সংহত
হয়ে দেশ পুনর্গঠনের সময় না দিয়েই জাসদ-এর
মতো জঙ্গি দলকে মাঠে নামিয়ে দেয়ার
পেছনে কোন সুস্থ চিন্তা ছিল না।
শেখ মুজিবের জরুরি অবস্থা ঘোষণা, একদলীয়
বাকশাল গঠন এবং তাঁর রাজনৈতিক
কর্মসূচি হিসেবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভিনব
কর্মসূচিকে র্যা ডিক্যাল সমাজতন্ত্রী জাসদ
এবং আন্ডারগ্রাউন্ড
বিপ্লবী বামপন্থীরা তাদের ইস্যু হাইজ্যাক
করে কার্যত তাদের রাজনীতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র
বলেই মনে করেন। বাকশাল গঠনের পর সরকারের
ক্রোধ জাসদ এবং সিরাজ সিকদারের
সর্বহারাদের ওপর গিয়ে পড়ে। অজস্র জাসদ
কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এ পর্যায়ে সিরাজুল
আলম খানের মূল্যায়ন : ‘‘আমরা ওপেন
পলিটিকসের একটা সুযোগ নিতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু সব পার্টি ব্যান্ড
হয়ে গেলে সুযোগটাতো আর থাকছে না। এখন
আমাদের এগ্রিসিভ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
গণআন্দোলনের সুযোগ যখন আর নেই, আমাদের
হার্ডকোর গ্রুপটাকে সক্রিয় হতে হবে এখন,
সশস্ত্র গণবাহিনী তৈরির
গতি বাড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের গণবাহিনীর
কমান্ডার-ইন-চীফ কর্নেল তাহের এ
ব্যাপারে আমাদের লিড করবেন।’’ [প্রাগুক্ত :
পৃ-২১৪] ১৯৭৪'র ২৬ নবেম্বর আওয়ামী লীগের
বিরুদ্ধে হরতালও ডাকে জাসদ। আগের
রাতে সরকারের
বিরুদ্ধে বোমা বানাতে গিয়ে মারা যান
মেধাবী বুয়েট শিক্ষক জাসদ কর্মী লিখিল রঞ্জন
সাহা। জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার,
কর্নেল তাহেরের মামলার পুনর্বিচার হলে জাসদ
বোমারু নিখিল সাহাকেও ক্ষুদিরাম
বা মাস্টারদা সূর্যসেনের তালিকায় তুলে আনার
প্রশ্ন উঠতে পারে। ১৯৭৪-এর ১৬ ডিসেম্বর
সিরাজ সিকদারের ডাকে দেশব্যাপী সফল হরতাল
পালিত হয়।
৩ জানুয়ারি ১৯৭৫ জাতীয় দৈনিকের খবর :
‘বন্দী অবস্থায় পালানোর সময় পুলিশের
গুলিতে নিহত হন পূর্ব
বাংলা সর্বহারা পার্টি নামে পরিচিত একটি গুপ্ত
চরমপন্থী দলের প্রধান সিরাজুল হক সিকদার
ওরফে সিরাজ সিকদার।' এরপর শেখ মুজিব
জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন :
‘আমি লালঘোড়া দাবড়ায়ে দিছি... কোথায় সেই
সিরাজ সিকদার?'
সিরাজ সিকদারের বন্ধু কমরেড
তাহেরকে রীতিমতো বিচার করেই মৃত্যুদন্ড
দেয়া হয় এবং মৃত্যুর আগে তিনি আত্মপক্ষ
সমর্থন করে বক্তব্য প্রদানের
অনুমতি পেয়েছিলেন। সিরাজ
সিকদারকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়
বলে গোটা দেশের মানুষ জানে। তাহের হত্যার
পুনর্বিচার হওয়ায় তাঁকে ভাগ্যবানই বলতে হবে।
কর্নেল তাহেরের বিচার প্রক্রিয়ার
সাথে সামরিক-অসামরিক ব্যক্তিদের
আদালতে ডেকে সাক্ষী নেয়া হচ্ছে।
সাক্ষীরা বিজ্ঞ বিচারকের মতোই মুক্তাছার
বয়ানে জানিয়েছেন যে, গোপন সামরিক
আদালতে তাহেরের বিচার করা যুক্তিযুক্ত হয়নি।
জটিল আইনী বিষয়কে এমন সরলীকরণ
করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফাঁসীর
মঞ্চে ওঠার আগে কর্নেল তাহের বলেছেন :
‘লং লিভ মাই কান্ট্রিমেন।'
মুক্তিযোদ্ধারা সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক।
সুতরাং দেশের মানুষের প্রতি তাহেরের এমন
ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ থাকা খুবই স্বাভাবিক।
এ রকম নিখাদ দেশপ্রেমের জ্বলন্ত চেতনার
কমরেড সিরাজ সিকদারসহ আরও ত্রিশ হাজার
দেশপ্রেমিককে হত্যা করা হয়েছে। জাসদের
র্যা ডিক্যাল রাজনীতিতে উদ্দীপ্ত হয়ে যেসব
প্রতিবাদী-টগবগে তরুণ-যুবা আওয়ামী ফ্যাসিস্ট
বাহিনীর হাতে জীবন দিয়েছেন, তাদের হত্যার
বিচার জাসদ নেতারা চাইছেন না কেন? অসমাপ্ত-
অপরিপক্ক বিপ্লবের অগ্নিশিখায় যারা জ্বলে-
পুড়ে নিঃশেষ হয়েছেন, তাদেরকে তো ওরা স্মরণও
করেন না!
তাহেরের বিপ্লব সফল হলে জেনারেল জিয়াকেও
ফাঁসীতে ঝুলতে হতো। সৈনিক সংস্থার সশস্ত্র
সিপাহীদের হাতে বেশ কয়েকজন অফিসারের
বিনাবিচারে মৃত্যু হয়েছে। এদের পরিবার এসব
হত্যার বিচার পাবেন কিনা? অফিসার নিধন ছিল
তাদের বিপ্লবেরই অন্যতম লক্ষ্য। অফিসারশূন্য
পিপলস আর্মির কাঠামোতে কোন
সেনা অফিসারেরই বেঁচে থাকার কথা ছিল না। এক
কর্পোরাল তাহেরকে বলেন : ‘অফিসারদের দিন
শেষ স্যার, আপনি অর্ডার দেন। এবার স্যার
আমরাই ক্ষমতা দখল করবো।' [প্রাগুক্ত-
পৃ-২৫৭]
শাহাদুজ্জামান লিখেছেন : ‘দ্বিতীয়বারের
মতো রাজনীতির গতিপথ বদলে দেবার জন্য
আবির্ভূত হয়েছেন খালেদ মোশাররফ। এবার
জাসদ তার সম্পূর্ণ
শক্তি নিয়ে মোকাবিলা করতে চায় এ পরিস্থিতি।
আর জাসদের প্রধান শক্তি তখন গণবাহিনী ও
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। দুটি অঙ্গ সংগঠনেরই
কমান্ডার ইন চীফ তাহের’’ [পৃ. ২৬৫]
ক্যান্টনমেন্ট দখল করে সৈনিক সংস্থার
মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলই চূড়ান্ত
লক্ষ্য। এর সামরিক নেতৃত্ব তাহেরের। সিরাজুল
আলম খান ও জাসদ এবারও রাজনৈতিক
নিউক্লিয়াসের নেপথ্য শক্তি। তাহেরের
সাথে জাসদ-এর তাত্ত্বিক গুরু সিরাজুল আলম
খানের যোগাযোগ হবার পর তাঁর পক্ষ
থেকে অপর জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু ছিলেন
সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যম। এক
পর্যায়ে ইনু তাহেরকে বলেন তারা ভারতের
শিবদাস ঘোষের অনুসারী হিসেবে সরকার
উৎখাতের লক্ষ্যে একটা গণঅভ্যুত্থানের
দিকে এগিয়ে যেতে চান। আর এই অভ্যুত্থানই
এক পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের
লক্ষ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের স্তরে উপনীত
হবে। সেনাবাহিনীতে জাসদের গণবাহিনীর
একটি সশস্ত্র ক্যাডার ভিত্তি গড়ে তুলতেই
কর্নেল তাহেরকে তারা রিক্রুট করেন। তাহেরের
পিপলস আর্মির কনসেপ্টকে তারা সেনা অফিসার
হত্যার কর্মসূচিতে পরিণত করেন। বাংলাদেশের
শুরু থেকেই যারা একটি স্বাধীন ও
শক্তিশালী সেনাবাহিনীর
অবকাঠামো নির্মাণকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত
করে আসছিল, তারা অসংগঠিত ও
প্রস্তুতিকালীন সেনাবাহিনীকে অফিসারশূন্য
করার যে ভয়ংকর রাজনীতির নিষ্ঠুরতা শুরু
করেছিল, তাতে জেনারেল জিয়ার
সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড
ফিরিয়ে আনা এবং জাতীয় পর্যায়ে ঐক্য ও
স্থিতি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে সফলতায় ছেদ
পড়ে।
১৯৭৫-এর সামরিক অভ্যুত্থান এবং ৩
নবেম্বরে খালেদ মোশাররফের কাউন্টার ক্যু'র
ফলে কার্যত: আর্মি ডিভাইড হয়ে যায়। যদিও
খালেদ মোশাররফ আর্মিতে চেইন অব কমান্ড
প্রতিষ্ঠার অজুহাতে নিজেই চেইন অব কমান্ড
ভেঙ্গেছেন। এ সময় সিরাজুল আলম খান বলেন:
‘‘এই যে আর্মি ডিভাইডেড হয়ে আছে, এর
সুযোগটা কিন্তু আমাদের নিতে হবে।’’ মূলত: ১৫
আগস্ট '৭৫-এ শেখ মুজিবের মৃত্যুর আগেই
সিরাজুল আলম খানরা তাঁকে উৎখাতের
পরিকল্পনা করেন।
জাসদের সৈনিক সংস্থা সেদিন তাদের
তালিকা অনুযায়ী সেনা অফিসারদের
হত্যা পরিকল্পনা রূপায়ণ করতে না পারলেও
২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর
জওয়ানদের প্ররোচিত, প্রলুব্ধ ও
বিপথগামী করে ৫৭ জন সেনা অফিসার হত্যার
মধ্য দিয়ে যেন জাতীয় সেনাবাহিনীর মেরুদন্ড
ভেঙ্গে দেয়া সম্ভব হয়েছে। এক পর্যায়ে সিরাজুল
আলম খান এক সাক্ষাৎকারে সরাসরি বলেন যে,
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা রাখার কোন
প্রয়োজন নেই। সীমানা বিলোপের রাজনীতির
পূর্বশর্ত হিসেবে বিডিআর ও সেনাবাহিনীসহ
জাতীয় প্রতিরক্ষার স্ট্রাকচারসমূহ
ভেঙ্গে ফেলার প্রয়োজন ছিল এবং ১/১১
থেকে এটা শুরু হয়ে এখনও চলছে। বিডিআর
বিদ্রোহের সময়ও জওয়ানরা লিফলেট
বিলি করে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। এর লক্ষ্য ছিল
সামরিক অফিসার হত্যা। জাসদ- পরিকল্পিত
তাহেরের নেতৃত্বাধীন সৈনিক সংস্থা ও
তথাকথিত বিপ্লবের সূচনায়
ক্যান্টনমেন্টে তারা লিফলেট বিলি করে। এর
লক্ষ্যও ছিল সেনাবাহিনীকে অফিসারশূন্য করা।
জেনারেল জিয়ার প্রশ্নে তাহেরের মূল্যায়ন :
‘‘... তিনি (জিয়া)
ইতোমধ্যে আর্মি থেকে রিজাইন করেছেন।
বসে আছে বন্দী হয়ে। তাকে মেরেও
ফেলা হতে পারে যে কোন সময়ে।
আমরা তাকে মুক্ত করতে পারলে তাকে এক রকম
মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করা হবে।... হি উইল
বি আন্ডার আওয়ার ফুট। তাকে ক্ষমতায়
বসিয়ে প্রথমে আমাদের সব পার্টি লিডারদের
কারামুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।... আমাদের
অবস্থাটা খানিকটা অর্গানাইজ্ড
হলে সুবিধামতো তাঁকে সরিয়ে দেয়া হবে।’’ (প্রাগুক্ত-
পৃ- ২৭২]
তাহের সৈনিকদের কাছে অভ্যুত্থানের যে ১২
দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন, তার ১০, ১১ ও
১২ দফায় রয়েছে, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার
ইউনিট ও নেতাদের নিয়ে বিপ্লবী পরিষদ
বা রেভ্যুলেশনারী কমান্ড কাউন্সিল গঠন,
সামরিক অফিসারদের বিপ্লব সমর্থন করার
আহবান জানানো। যারা করবে না।
তাদেরকে গ্রেফতার এবং কর্নেল তাহেরের
বিপ্লবের সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ।
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×