[*ছবি- গুগল]
হলে ওঠার আগে দুই মাসের মতো বাইরে ছিলাম। প্রথমে কাওরান বাজার বসুন্ধরা সিটির পেছনে, পরের মাসে বড় মগবাজার। মেস ভাড়া ছিল ৯০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। মেসের পরিবেশ নিয়ে বলা বাহুল্য। এ সময় কাওরান বাজার থেকে সহজেই বাসে করে ক্যাম্পাসে আসা যেত। তবু কানাগলি কম ঘোরা হয়নি।
প্রজাপতি গুহার পশ্চিম দিকে বসুন্ধরা সিটির পেছন দিয়ে যে গলিটি চলে গেছে সেটি পেরিয়ে ফার্মগেটের দিকে সহজেই যাওয়া যায়। এ রাস্তাটি যে রাস্তার সাথে
মিশেছে তার পশ্চিম পাশে আইবিএ হোস্টেল অবস্থিত। হোস্টেলে ঢুকতে গিয়ে হাতের ডান পাশে গ্রিন সুপার মার্কেট। মার্কেটের নিচতলায় ফিটিংস সামগ্রীর দোকান। মার্কেটের সামনে দিয়ে যতবার গিয়েছি চোখ পড়েছে সেলসম্যানের উপর। বসে বসে মাছি মারা ছাড়া তাদের কোনো কেনা-বেচা আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু তাদের দোকানের চাকচিক্যময় সামগ্রী দেখে আমার দুচোখ মুগ্ধ হয়ে যেত। ভাবতাম, মানুষ এত দামী দামী জিনিস কেনার জন্য এত্ত টাকা কই পায়?
আইবিএ হোস্টেলের সীমানা ঘেঁষে ডান দিক দিয়ে একটি চিকন গলি চলে গেছে। সারি সারি টিনের ঘর। কোনোটা একতলা, কোনোটা আবার দোতলা। আইবিএ হোস্টেল ও মার্কেটের কারণে এ বিশাল বস্তিটি একপ্রকার আড়ালেই পড়ে আছে। ফার্মগেটে যে বস্তি থাকতে পারে তা আমি পরবর্তীতে অনেককেই বিশ্বাস করাতে পারিনি। স্বচক্ষে না দেখলে আমিও হয়ত বিশ্বাস করতাম না। বস্তির রাস্তাগুলোর একপাশে খোলা ড্রেন। প্রতিটি বাসা থেকে একটা নল ড্রেনের সাথে সংযুক্ত। কোনো ভদ্র সম্প্রদায় এই ড্রেনের দিকে তাকালে তার বমি আসতে বেশি সময় লাগবে না। প্রায় সব বস্তিরই মনে হয় কমন কিছু বিষয় থাকে। আর তা হল, এই খোলা ড্রেন। আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় হল, এখানে দারিদ্র্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলে শিশুদের সংখ্যা।
ফার্মগেটে কুতুববাগ দরবার শরীফের কথা অনেকেই হয়ত জেনে থাকবেন। তার সামনে একটি পার্ক আছে। বেশ লম্বা। সকাল বিকাল ডায়াবেটিস রোগীদের আনাগোনা বেড়ে যেত। আমিও খুব সকালে এখানে আসতাম। তবে হাঁটার জন্য নয়। একাকিত্ব উপভোগ করার জন্য। প্রথম যেদিন আসলাম একটা বেঞ্চে বসতেই দেখি চারপাশে প্যানথারের খালি প্যাকেটের ছড়াছড়ি। দ্রুত উঠে গেলাম সেখান থেকে। বারবার তাকাতে গিয়েও যেন চোখ ফিরে আসছিল। কী দেখছি এসব? আরও খেয়াল করলাম, মানুষজন দিব্যি এগুলো দেখছে কিন্তু কারো মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। লজ্জাবোধ নেই। আস্তে আস্তে ঢাকার মানসিকতা বুঝতে চেষ্টা করলাম।
মগবাজারের রেল লাইন ধরে অনেক হেঁটেছি। এর আগে কখনও রেল লাইন দেখার সুযোগ হয়নি। হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম কাওরান বাজার রেলগেটে। সেখান থেকে যেতাম সোনারগাঁও হোটেলে। তাকিয়ে থাকতাম গোবেচারার মতো। কারা এখানে বসবাস করে এই চিন্তায় মাথা ঘুরপাক খেত।
মগবাজার থেকে প্রতিদিন হেঁটে ক্যাম্পাসে আসতাম। দূরত্ব যাই হোক মগবাজার মোড়ের ওভার ব্রিজ পেরিয়ে মিন্টু রোড ধরে রমনা পার্কের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে আসতাম ক্যাম্পাসে। মিন্টু রোড ধরে হাঁটার সময় গা ছমছম করত। দুপাশের নিরিবিলি বাড়িগুলোর কোনো নামফলক নেই। শুধু নম্বর বসানো। রাস্তাগুলো ছিমছাম, পরিষ্কার আর নীরব। যেন একটা শুকনো পাতা পড়লেও টুং করে কলিজার মধ্যে শব্দ করে ওঠে।
রমনার মধ্য দিয়ে নিয়মিত যাওয়া-আসায় অনেক কিছুই চোখে পড়া শুরু করল। চোখ ফিরিয়ে নিতাম বাধ্য হয়ে। আশেপাশে শত শত মানুষের আনাগোনা। অথচ এসব দেখেও তারা না দেখার ভান করে থাকে। মনে মনে চিন্তা করতাম, এসব কি তাদের কাছে পাপ বলে গণ্য হয় না? কেউ প্রতিবাদ করে না কেন? কিছুক্ষণ পরেই চোখে পড়ল, পার্কের গেটে সেঁটে দেওয়া নোটিশ বোর্ড "স্কুল কলেজের পোষাকে আপত্তিকর অবস্থায় পার্কে অবস্থান নিষেধ। -অনুরোধক্রমে কর্তৃপক্ষ।"
এইসব দিনগুলো এখন মনে পড়লে নিজেকে মনে হয় সেদিন কত বোকা ছিলাম। কারণ সময়ের আবর্তনে এগুলো এখন “মামুলি” বিষয় হয়ে গেছে সবার কাছে। এমনকী নিজের কাছেও। তাই এগুলো আর কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। পাপকে যখন পাপ বলে স্বীকার করা না হয় তখন কাউকে পাপী বলে ভর্ৎসনা করা তাকে উপহাস করার শামিল।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৩