তখন সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দিন এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাত্র শিশুকাল। জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। প্রত্যাশার ঢেউ সকাল-বিকাল আছড়ে পড়ছে। এখানে-ওখানে। প্রবাসীদের মধ্যেও আগ্রহের কমতি নেই। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় রাজনৈতিক রাঘব বোয়ালদের কথিত কূকীর্তির নানা ফিরিস্তি রেরুচ্ছে। মাত্র কয়েকদিন আগেও যারা দেশটাকে নিজেদের জন্য চিরস্থায়ী বন্দবস্ত বলেই ভেবে নিয়েছিল। কতিপয় ব্যবসায়ী-আমলা আর রাজনীতিবিদের অশুভ ত্রিমাত্রিক ঐক্যে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অর্জনগুলো প্রায় ডুবুডুবু। মরুশহর দুবাই এর বুকচিরে ঘুরতে ঘুরতে এসব আলাপও বাদ যায় না। নিটক আত্মীয়-স্বজন আর শ্যামল বাংলার চিরায়ত হাতছানিকে মাড়িয়ে নিছক অর্থনৈতিক অস্তিত্বের উপায় হিসেবে যারা প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছেন, দেশ নিয়ে, দেশের গণতন্ত্র নিয়ে, দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে তাদের বুকের ভেতরে নিয়ত প্রবাহমান উদ্বেগ দেখে শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে আসে। দু’একজন তথন পর্যন্ত বিপুল জনপ্রিয় ড. ফখরুদ্দীন সরকার নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেন। মনে করিয়ে দেন বাংলাদেশের অতীতের অনির্বাচিত সরকারসমূহের কার্যকলাপ। যাদের প্রত্যেকেই দুর্নীতির রিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেই শুরু করেছিলেন। জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। পরে কারোরই কার্যক্রম সে ধারায় এগোয় নি। দীর্ঘ আলোচনায় অতীত অভিজ্ঞতালব্ধ কিছু ভয়ও প্রকাশিত হলো। কেউ কেই যা বললেন তার সারসংক্ষেপ করলে যা দাঁড়ায় তার অর্থ হচ্ছে দীর্ঘ দিনের অনির্বাচিত সরকার জনগণের জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়েই আবির্ভূত হয়। চলমান আলোচনার কোনটাই যেন ফেলে দেয়ার নয়। পরবর্তীতে এ ধারণার কিছু কিছু সত্যও প্রমাণিত হয়েছিল। সে যাই হোক, আমাদের রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে। কিন্তু রাজনৈতিক আলোচনা-সমালোচনা যে, আমাদের প্রাত্যহিক গল্প-গুজবের অনিবার্য অংশ সেটি আবারও টের পেলাম।
এতসব উচ্ছল-প্রাণবন্ত আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেও মাথা থেকে তালেবানী ভয়টা কাটছে না। কাবুল যাবো সে উত্তেজনাটা আছে। আবার যদি কিছু ঘটে যায় এ রকম ভাবনাও মন থেকে দূর করতে পারছি না। মনে হলো এয়ারপোর্টে যাই। একটু খোঁজ-খবর নেই। আগামী কালের কাবুলগামী ফ্লাইট এর সময় ঠিক আছে তো। নাকি ইতোমধ্যে পাল্টে গেছে! দুবাই বিমানবন্দরের তথ্যকেন্দ্রে গিয়ে সাথে থাকা বিমানের স্কেনড টিকিটটা দেখিয়ে জানতে চাই সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস এর অফিসটা কোন দিকে। ডেস্কে বসে থাকা ভদ্রলোক আমার হাত থেকে টিকিট দু’টো নিলেন। নেড়েচেড়ে দেখলেন। তারপর যে উত্তরটি দিলেন তাতে মনে হলো, আমি বোধহয় তার ইংরেজি উচাচরণ ভুল শুনছি। অথবা বুঝতে পারছি না। বিরক্ত হতে পারেন এমন আশংকা মাথায় নিয়েও আমি আবার জিজ্ঞেস করি। আবারও একই উত্তর। ‘এ নামে কোন এয়ারলাইন্স সম্পর্কে আমার জানা নেই। তাদের কোন অফিসও নেই এখানে’। যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মাথায়। এক মুহূর্তে। অন্য একজন ভরসা দিলেন। বললেন, কিছু কিছু ছোট ছোট এয়ারলাইন্স আছে। ওগুলোর অফিস নেই। ফ্লাইট এর দু’তিন ঘন্টা আগে ওরা ছোট ছোট টেবিল নিয়ে বসে। তোমরাও ফ্লাইটের আগে এসো। দেখবে ঠিক ঠিক ওরা আছে। এ যেন তালেবানী ভয়ের সাথে নতুৃন কাবুলীভুত যুক্ত হলো। সে ভুতের আছর নিয়েই বেরিয়ে পড়া। এয়ারপোর্ট থেকে। রাতের খাবার সেরে যখন হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই তখন সমগ্র দুবাই শহর নতুন আবেগ-উত্তেজনায় মাতোয়ারা হওয়ার অপেক্ষায়। রাত যত গভীর হয়, আঁধার যতখানি নেমে আসে, দুবাই নাকি ততখানিই উত্তেজনাময় হয়ে উঠে। আরব-অনারব উচ্চবিত্তদের জন্য। কোথাও কোথাও সারারাত চলে বেলে নৃত্য। প্রবাসী আপার আন্তরিক প্রস্তাব পেয়েও আলো-আঁধারী দুবাই এর বেলে নৃত্য দেখা হয়নি। ঘুমে বসের দু’চোখ ঢুলুঢুলু ছিল বলে।
কাবুলের উদ্দেশ্যে আমাদের নির্ধারিত উড্ডয়নের সময় সকাল ছ’টা। আমরা ভোর চারটায় পৌছাই। বিমানবন্দরে। দূরুদূরু বুকে। আশেপাশে কাবুলি জুব্বা আর বোরখা পরা নারী-পুরুষের উপস্থিতি দেখে আশ্বস্থ হতে থাকি। ভেতরে পা রেখেই দেখি আগের দিন পাওয়া ধারণামত কয়েকটি এয়ারলাইন্স পেছনে ব্যানার ঝুলিয়ে, ছোট ছোট টেবিল সাজিয়ে বসে আছে। আমাদের নির্দিষ্ট এয়ারলাইন্স এর ব্যানারও চোখে পড়ে। দ্রুত এগিয়ে যাই। স্কেনড টিকিট দেখিয়ে মূল টিকিট সংগ্রহ করি। এবং আপত: হাপছেড়ে বাঁচি। এক ফাঁকে নিজের ভয়টা বসকে বলি, আপা, এ উড়োজাহাজ আকাশে উড়লে বোধহয় আর নামবে না। অথবা গন্তব্যের আগেই নেমে পড়বে। বস মৃদু ধমকের সূরে বলেন, এ সময় এসব অলক্ষণে কথা বলতে নেই। হয়তো ঠিক, আমি মাথা নাড়ি, কিন্তু ভয় দূর হয় না। ভয়কাতুরে এ আমাকে সহ দেড়শোর মতো যাত্রী নিয়ে ঠিক সকাল ছয়টায় কাবুলের উদ্দেশ্যে বিমানটি উড়াল দেয়। এবারের মতো সমাপ্তি ঘটে কযেকখন্ড দুবাইনামার। আলো-আঁধারীর দুবাইনামা........................... (চলবে)
আগের পর্বের জন্য
Click This Link