নির্দিষ্ট সময়ের ঠিক দশ মিনিট পর বিমান ছাড়ে। দুবাইয়ের উদ্দেশ্য। আগেই পরিকল্পনা ছিল যে একদিন দুবাই থাকবো। যাত্রা বিরতি হিসেবে। পর দিন ভোরে কাবুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব। অনেকটা রথ দেখা এবং কলা বেচার মতো। সেমতে সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ (সাইপ) এর আফগান মিশনে দায়িত্বরত প্রশাসনিক সমন্বয়কারী মিস্টার রেজা হাবীব আগেই দুবাই থেকে কাবুল যাবার টিকিট বুকিং দিয়ে রেখেছেন এবং ই-মেইলে টিকিটের স্কেনড কপি পাঠিয়েছেন। এও বলেদিয়েছেন যে, দুবাই এয়ারপোর্টে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে স্কেনড কপি দেখালেই আমাদের মূল টিকিট দেয়া হবে। ঢাকা থেকে দেরিতে উড্ডয়ন করলেও নির্দিষ্ট সময়েই দুবাই এয়ারপোর্টে এ্যামিরেটস এর উড়োজাহাজটি অবতরণ করে। কথা ছিল বস আগেই পৌছাবেন। তিনি আসছেন ইন্ডিয়া থেকে। কমলওয়েলথ আয়োজিত একটি কর্মশালা শেষ করে। ঢাকা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্মকর্তার মারমুখি জেরা থেকে ছাড়া পাবার পর মোবাইলে তাঁকে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছিলাম। জানিয়েছিলাম আমার ইমিগ্রেশন থেকে ছাড়া পাবার কথা। ফিরতি বার্তায় আশ্বস্থ করে বসও জানিয়েছিলেন যে, তিনি দিল্লী এয়ারপোর্ট থেকে রওয়ান দিচ্ছেন...। কিছুৃক্ষণের মধ্যে।
দুবাই এয়ার পোর্টে আমি এ প্রথম নয়। আগেও এসেছি। কয়েকবার। তবে ট্রানজিট হিসেবে। স্বাভাবিকভাবেই এর আলোঝলমল চাকচিক্যের মোহ কিছুটা আগেই কেটেছে। তবে এবার একটু শংকা আছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে যেসব শ্রমিক কাজ করেন আমার বয়স ও চেহারার অবয়ব তাদের সাথে অমিল থেকে মিলই বেশি। সে সাদৃশ্যের সূত্র খুঁজে যদি সন্দেহের ডালপালা গজায়। ’দুবাই শহরে একবার ঢুকতে পারলে হয়তো আর বেরুবু না, বরং পালিয়ে যাব, থেকে যাব’ এসব ভাবনায় যদি দুবাইয়ের ইমিগ্রেশন পুলিশ আটকে দেয়। তবে শত শংকার মাঝেও একমাত্র ভরসা চৌকস বস। বাংলাদেশের যে কয়জন নারী বার মাসেরই কোন না কোন সময় আকাশ পথ ফাঁড়ি দেন, চষে বেড়ান বিদেশের মাটি, তিনি তাঁদের একজন। দুবাই বিমানবন্দরের নাড়ি-নক্ষত্র তার চোখের সীমানায়। বাঞ্ছিত-অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় তার জুড়ি মেলা ভার। অন্তত আমার অভিজ্ঞতায়।
অনুসন্ধানী চোখ এদিক ওদিক ঘুরতেই দেখি এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকে অনেকটা পথ আগে এক কোণে বস দাঁড়িয়ে আছেন। হাসছেন আর হাত নাড়ছেন। মালিকের হাসি দেখলে কামলারা খুশী হয়। আমারও অখুশী হওয়ার কারণ নেই। বরং শংকাও দূর হয়। ইমিগ্রেশনের মুখোমুখি হয়ে আর কোন ঝামেলাই হল না। কিছুটা অবাক হতে হলো এই দেখে যে, আমি যে ট্রানজিট ভিসা নিয়ে দুবাই থাকছি, কোন্্ হোটেলে উঠছি সব খবরই আগে থেকেই তাদের তথ্য-ভান্ডারে জমা আছে। মুহুর্তের জন্য ঢাকার ইমিগ্রেশন কাউন্টারটারটি চোখের সামনে ভেসে উঠল। যারা আমি শেষবার কবে ইমিগ্রেশন সীমারেখা অতিক্রম করেছিলাম সে তথ্য খুঁজেপেতে হিমশিম খেয়েছিল। আফগানিস্তান যাচ্ছি বলে সন্দেহের সব চোখই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত।
অভাবিত সহজ প্রক্রিয়ায় দুবাই ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম। দুবাই শহরের দিকে আমার এ প্রথম পা ফেলা। মরুর দেশের নামী শহর দুবাই। অন্যরকম নতুন অভিজ্ঞতার হাতছানির আনন্দ মুহূর্তে মনের কোনায় দোলখেয়ে উঠে। কেউ একজন মি: শামীম, শামীম বলে ডাকছিলেন। কাছে গিয়ে বুঝতে দেরি হলো না যে, আমরা যে হোটেলে বুকিং দিয়ে গেছি তিনি সে হোটেলেরই প্রতিনিধি। হোটেলের গাড়ি আমাদের জন্য অনেক আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিল। ভদ্রলোক আনুষ্ঠানিক ওয়েলকাম জানালেন। কাগজপত্র নিরীক্ষার আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমাদের নিয়ে গেলেন গাড়ির কাছে। যৎকিঞ্চিত আলাপচারিতায় নিশ্চিত হলাম গাড়ির চালকের দেশ ভারত। অনেক দিন ধরে দুবাই আছেন। ভাল ইংরেজি বলেন। সম্ভবত আরবিও পারেন। আচরণে স্মাট এবং বিনয়ী। আমাদের নিয়ে তার গাড়িটি ছুটতে থাকলো গন্তর্ব্যে দিকে। আমি জানালার পাশে বসে নিবিষ্ট মনে মরু শহর দুবাইয়ের শহুরেপনা পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মরুবালির বুকে ইটপাথরের স্থাপত্য সৌন্দর্য্যরে তন্ময়তা ভেঙ্গে হঠাৎ চালক জানান দেয়-আমরা এসে গেছি। তাঁকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে নেমে পড়ি। হোটেলের নির্ধারিত কক্ষে যাবার আগেই ঠিক হয় আমরা বিকেল চারটার দিকে বেরুবো। দুবাই শহর ঘুরে দেখার দুর্নিবার আকাংখা ইতোমধ্যে শুধু পেয়ে বসেনি। রীতিমতো কাবু করে ফেলেছে। পারলেই এখনই নেমে পড়ি। যদিও কয়েক ডজনবার দুবাই সফরকারী বসের ওসবে আগ্রহ নেই। একদম না। তবে আমি যাতে দুবাই শহর ঘুরে দেখতে পারি এ ব্যাপারে মনে হলো বস শতভাগ আন্তরিক। আমাদের পরিচালনা বোর্ডের এক সাবেক সদস্য, যিনি এখন বরের বহুজাতিক তেলকোম্পানীতে চাকরির সুবাদে নিজ কন্যা সহ দুবাই থাকেন, বস তাঁকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। এ মুহূর্তে আমার বিশ্রামে আগ্রহ নেই আবার বাইরে যাবারও সুযোগ নেই। কী আর করা! বিছানায় শুয়ে শুয়ে আপাতত নিজ কক্ষে থাকা টিভির পে আর নন-পে চ্যানেলের লিস্ট দেখা শুরু করি। এসব পাঁচতারা হোটেলে পে চ্যানেল মানেই ডিজিটাইজড ভিজ্যুয়াল যৌনতার বিকিকিনির ফাঁদ। পা দিলেই চেক আউটের সময় একটা অতিরিক্ত বিল। ইলেক্ট্রনিক যৌনতার ভোক্তা হিসেবে। এখানে দেখলাম তালিকায় এ্যরাবিক এডাল্ট চ্যানেলও আছে। একটি নয়, কয়েকটি। আরবী ভাষায় পর্ণোগ্রাফি? কিছুটা অভাবিত। হয়তো শৈশবের সামাজিকায়নের উৎস থেকে এ ভাবনার উৎপত্তি। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে যে ভাষা স্বর্গীয় প্রতিরূপে মহিমান্বিত সে ভাষায় পর্ণোগ্রাফী? সহজ-সরল গ্রাম-বাংলার ধর্মভীরু মানুষদের কাছে এ গল্প দিলে বিশ্বাসতো করবেই না, উল্টো নিজের পিঠ বাঁচানো দায় হয়ে পড়বে। অথচ সর্বগ্রাসী মুনাফার দেবতার কাছে সে আরবী ভাষার মহিমাও পরাজিত। শৃঙ্খলিত। সাথে আরবের নারীরাও। স্বয়ং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম পুঁজিপতিদের হাতেই। যুদ্ধ থেকে যৌনতার বিকিকিনি, গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র, মৌলবাদ, উগ্রবাদ, কোন কিছুতেই যেন পুঁজিবাদের আপত্তি নেই। যদি পুঁজির বিকাশটা নিশ্চিত হয়। এসব এলোমেলে দরকারি-বেদরকারি ভাবনায় যখন মনের নৌকা টালমাটাল ঠিক তখনই ইন্টারকমে বসের ফোন। সাথে মৃদু স্বরের সাবধান বানী- ‘আমি নিশ্চিত তুমি জানো, তবু মনে করিয়ে দেয়া, এ সব হোটেলে পে-চ্যানেলের চার্জ মাত্রাতিরিক্ত। আনএফোর্ডেবল’। আমার প্রতি আস্থা না থাকার কারণ দেখি না। মনে হলো যতো অবিশ্বাস আমার বয়সের প্রতি। কিন্তু নিজের সাধ ও সাধ্যি নিয়েতো আমার মধ্যে সন্দেহ থাকার কথা নয়। ছিলও না। সে যাই হোক, ঠিক চারটায় আমাদের সে সাবেক পরিচালনা বোর্ডের সদস্য আপা তার বরসহ হাজির। আমিতো খুশিতে আটখানা। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে নেমে পড়ি। সাথে বসও। আমার উদ্দেশ্য দুবাই শহর চোখে দেখা, চেখে দেখা। যতটুকু সম্ভব।
দুবাই শহরের বুক চিরে, এ রাস্তায়-ও রাস্তায়, কখনও পাতাল পথে আমাদের নিয়ে গাড়িটি ছুটে যাচ্ছে। আমিও দেখছি আর দেখছি। টাকা থাকলে হাতে চাঁদও পাওয়া যায়, বাঘও কেনা যায়; অনেক পরিচিত প্রবাদ। যেন তারই শতভাগ প্রমাণ নিয়ে চলমান এ দুবাই শহর। অর্থের জোরে মরুশহর দুবাইয়ের বুকেও কোথাও কোথাও ঘন সবুজ ইতিউতি মারছে। আপা, আমদের গাইড, নিশ্চিত করলেন এগুলো প্রাকৃতিক নয়, শহর কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে বনায়নের ব্যবস্থা করেছে। বোধহয় সফল হতেও চলেছে। কিছুক্ষণ পরপর আপা বলে যাচ্ছেন, এটা এই, ওটা ওই। ঐটি একমাত্র সাততারা হোটেল। কিছুক্ষণ পর সে সাততারা হোটেলের সামনে দিয়েই এক পলক ঘুরে আসা। ছোটকালে পকেটে পয়সা না থাকলে বারান্দা শো দেখতাম। মানে সিনেমা হলে না ঢুকে বারান্দায় লাগানো পোস্টার দেখে ফিরে আসা। অনেক দিন পর সে স্মৃতিই মনে পড়লো। আমারও অনেকটা দুধের সাধ ঘোলে মিটিয়ে সাততারা হোটেলের ভেতরে নয়, সামনে দিয়েই একপলক ঘুরে আসা।
দুবাই শহরে এসেছি। আলোঝলমল দুবাই। এ সময়ে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ এ শহর। সে শহরের বাজার-ঘাটে একটু আধটু ঢু মারবো না, এমন লোভ সামলানো দায়। পকেটের স্বাস্থ্য যতই খারাপ থাকুক, দুবাই শহরের উপযোগী না হোক, তাতে কি। রুগ্ন পকেট নিয়েও মার্কেট ব্রাউজিং অনায়াসে করা যায়। মানুষটি যদি আমার মতো ভবঘুরে হয় তাহলেতো কথাই নেই। শুরু হলো ঘুরাঘুরির দ্বিতীয় ধাপ। ততক্ষণে দিনের আলো রাতের বুকে সমর্পিত হয়েছে। কিন্তু তার ছাপ নেই যেন এ নগরে। দু’একটি রাস্তা বাদ দিলে এখানে দিনের আলোও যেন হার মানে রাতের কৃত্রিম উজ্ঝলতার কাছে। ঘুরছি এ মার্কেট থেকে ও মার্কেট। এ দোকান থেকে ও দোকান। যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি একটি বিষয় নিয়ে। প্রায় প্রতিটি দোকানে থরে থরে ঝুলে থাকা, সাজিয়ে রাখা পোষাক-পরিচ্ছদ। বেশিরভাগই ইন্ডিয়ান। কৌতুহলী মন। কতক্ষণ চেপে রাখা যায়। ক্রেতার ছলে নানা প্রশ্ন উঠাই। জিজ্ঞাসার জবাবে দোকানীরা জানালেন, ওসব পণ্যের ক্রেতা আরব-অনারব উভয়ই। বললাম আরবদেরতো এসব পোষাক-পরিচ্ছদ এর সাথে পরিচয় থাকবার কথা নয়। পছন্দ-অপছন্দ পরের কথা। দোকানীদের ভাষ্যমতে আসল মাজেজা টা হিন্দী সিনেমার। সারা দুবাই-এ হিন্দু সিনেমা ভীষণ জনপ্রিয়। এটি তার প্রভাব। একটি শক্তিশালী সিনে ইন্ডাস্ট্রিও যে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের বিভিন্ন পণ্যের বাজার সৃষ্টিতে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তার একটি আদর্শ নিদর্শন নিজ চোখে পর্যবেক্ষণ করার অভিজ্ঞতা হলো। পরে আফগান রাজধানী কাবুলের বিভিন্ন দোকানেও শাড়ি বিক্রি হতে দেখে আমার এ ধারণা ও অভিজ্ঞতা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। কাবুল শুধু আরব্য মুসলিম সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত নয়, গ্রহণ-বর্জনেও পশ্চাদপদ। হিন্দী সিনেমা সেখানেও শাড়ি নিয়ে গেছে। স্রেফ ফ্যাশন হিসেবে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় পণ্যের বাজার সৃষ্টিতে এটি ক্যারিশমাই বটে।
আফগানিস্তানে এক সপ্তাহ সিরিজের ধারাবাহিক হিসেবে। আগের পর্বের জন্য..
Click This Link
চলবে...........

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


