১৫ এপ্রিল ২০০১
হাসান আনমনে দিগন্তের দিকে তাকাল। লাল হয়ে আছে। সিগারেটটা হাত থেকে ফেলে একটা গাল দিয়ে উঠলো। কদিন ধরে কিছুই ভাল লাগছে না কেন যেন। পাদুয়া একদম অজপাড়াগা। মাসখানেক হল এখানে এসেছে সে। বিনুকে ছাড়া প্রথম প্রথম একবারেই ভাল লাগতো না তার। এখন প্রতিদিন একঘেয়ে একই কাজ করতে করতে যন্ত্র হয়ে গেছে যেন। আবেগ অনুভূতির কোন বালাই নেই। ক্যাম্প কমান্ডারের ডাকে সচকিত হয়ে দাঁড়াল হাসান। ২ দিন ধরে কি যেন হয়েছে। শুনেছে বিএসএফ শালারা নাকি বাংলাদেশের ভিতরেই ওদের রাস্তা বানাচ্ছে। উপর মহলের অফিসাররা সব তাঁবুর ভিতর মিটিং করছেন কিছুক্ষন পর পর। সবারই মেজাজ কেমন যেন তিরিক্ষি হয়ে আছে। বিডিআর এ যোগ দিয়েছিল পেটের দায়ে। এখনো চাকরিটা তার কাছে জীবিকা মাত্র। দেশরক্ষা, সীমান্তরক্ষা এসবই কেন যেন ফাঁকা বুলি মনে হয় তার কাছে। কই, যশোরে যখন ছিল, হাবিলদার ব্যাটা তো অবাধে ফেন্সিডিলের বোতলের চালান ঢুকতে দিতো। তখন দেশপ্রেম কোথায় ছিল? অবশ্য সে এসব নিয়ে কিছু বলে নাই। কারন সে নিজেও কিছুটা ভাগ পেত।
ক্যাম্প কমান্ডার শরীফ স্যার লোকটাকে একদমই পছন্দ করে না হাসান। করবেই বা কেন? সারাক্ষণ ঝাড়ির উপর রাখলে কারই বা ভাল লাগবে? শরীফ স্যার চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “কানে কি পোকা ঢুকসে নাকি সোলজার??” কাঁচুমাচু করে হাসান জবাব দেয়, “সরি স্যার, সরি স্যার...” তার কথা হারিয়ে যায় শরীফ স্যারের গর্জনে। “অ্যাটেএএএএএএনশন”। খটাশ করে অস্ত্রে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় হাসান। মনে মনে নিজের কপালকে গালি দেয় আরেকবার।
স্যার যেতেই মনে হতে থাকে বিনুর কথা। নতুন বউটা তার বড়ই লাজুক। তাকে আপনি করে ডাকে। অনেক চেষ্টা করেছে তুমি করে বলার অভ্যাস করাতে কিন্তু বিনু বলে না। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে হাসান। বিনুর কথা মনে হলে হাসানেরও কেমন যেন লজ্জা লজ্জা হতে থাকে। শেষবার চলে আসার কথা মনে পড়ে যায় তার। বিনু ঘরের খুঁটিতে ভর দিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছিল। মনে হতেই বুকটা হুহু করে ওঠে কেমন যেন। কবিরের ডাকে হুঁশ ফেরে তার। ছুটি হয়েছে। এখন কবিরের ডিউটি। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে নিজের তাঁবুর দিকে রওয়ানা দেয় হাসান।
১৬ এপ্রিল ২০০১
ভোরবেলা
সবার ভেতর কেমন যেন একটা উত্তেজনা। সাজ সাজ রব। সবাই পুরো কমব্যাট ইউনিফরমে আছে। মেজর স্যার তাদের ক্যাম্পে এসেছেন। মেজর স্যারকে হাসানের খুব ভাল লাগে। কি অমায়িক ব্যাবহার। উনি এমন ভাবে কথা বলেন মনে হয় যেন আপন ছোট ভাইএর সাথে কথা বলছেন। স্যার তাদেরকে বললেন বিএসএফ ৩০ বছর ধরে পাদুয়ার বিরাট অংশ দখল করে রেখেছে অন্যায় ভাবে। তারা গত কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের ভিতরের অংশেও রাস্তা বানান শুরু করেছে যাতে করে আর বেশি এলাকা দখলে নেয়া যায়। বিএসএফ এর উপর হাসানের এম্নিতেও রাগ আছে। মাঝে মাঝে শুধু শুধু ওরা মজা করার জন্য এদিকে গুলি ছোঁড়ে। যদিও রেঞ্জের অনেক বাইরে তবুও হাসান রাগে দাত কিরমির করে, কেন রে বাবা, তোদের মজা করার কোন অন্য উপায় নাই? চোরাচালানকারীদের কাছ থেকে ঘুষও খাবে আবার খারাপ ব্যাবহার ও করবে। মেজর স্যারের কথা শুনতে শুনতে কেমন যেন একটা অসহ্য রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে হাসানের। বুকের ভিতর কেমন যেন করে ওঠে তার। মনে হয় যেন বিএসএফের একটা জওয়ানকে পেলেও এখন ছিঁড়ে ফেলবে খালি হাতে। ওরা বাংলাদেশের ভূমি দখল করতে চাইছে। ও থাকতে ওরা বাংলাদেশের জমি নিজেরা নিয়ে নিবে?? অসহ্য রাগে চোখ লাল হয়ে উঠে তার। হাসানের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। গরিব হলেও দেশপ্রেম একেবারে টনটনে। বিডিআরে জয়েন করার সময় তার বাবা তাকে দেশ নিয়ে বিশাল একটা লেকচার দিয়েছিলেন। তখন তার কাছে এটা কেন যেন বিরক্তিকর লেগেছিল। এখন মনে হচ্ছে বাবার প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। মেজর স্যার সবার শেষে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি নিজের জীবন দেশের জন্য কুরবানি করতে রাজি আছ? বুকের ভিতর থেকে যেন উঠে আসে চিৎকার... “স্যার ইয়েস স্যার”
হঠাৎ করে শরীফ স্যার মেজর স্যারের কানে কানে কি যেন বলেন। মেজর স্যার বলে উঠেন, বয়েজ, তোমাদের মাতৃভূমি আজ আক্রান্ত। ভারতীয় বাহিনী পাদুয়া আক্রমন করেছে। তাদের দেখিয়ে দাও তোমরা কি পার... হুংকার দিয়ে উঠে পাদুয়া ব্যাক ক্যাম্পের ৪৫ জন জওয়ান।
১৬ এপ্রিল ২০০১
দুপুর ২ টা
পাদুয়া ফ্রন্টলাইন
যতদুর চোখ যায় খালি বিএসএফের ইউনিফরম চোখে পরছে। বৃষ্টির মত গুলি ছুটে আসছে হাসানদের দিকে। মাটি কামড়ে পরে আছে তারা। মরবে, তবু পেছাবে না। আচমকা হাসান দেখল কড়ই গাছের আড়ালে একটা বিএসএফের জওয়ান হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে। দেরি না করে ট্রিগার টিপে দিল সে। একটা ছোট আর্তচিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পরল ওই ভিনদেশি কুত্তাটা। জীবনে এই প্রথম মানুষ খুন করল হাসান। রক্তের নেশায় যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে সে। অবিরাম গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটু পরেই দেখতে পেল আরও প্রায় শ’খানেক শত্রুসৈন্য এসে হাজির হয়েছে যুদ্ধময়দানে। একটু দমে গেলেও হাল ছাড়ল না। এমন সময় শরীফ স্যার অর্ডার করলেন ডান সাইডে সরে যেতে। একটু ইতস্তত করল হাসান। ওদিকটাতে গুলির প্রচণ্ডতা একটু কম। তিনি কি বিপদ থেকে তাকে সরিয়ে দিচ্ছেন? তাদেরকে সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে বিএসএফের মেশিনগানটা। ওটা বন্ধ না করা গেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সবাই মারা যাচ্ছে এটুকু নিশ্চিত। পিছনে আর্তনাদে চোখ ফিরিয়ে দেখল বুক চেপে ধরে কবির লুটিয়ে পরেছে। মানে কি?? কবির কি মারা যাচ্ছে? তার সাথে আর কখনও দেখা হবে না? কখনও আর এসে ডিউটি থেকে তাবুতে যেতে বলবে না?? মাথায় আর যেন কিছু ঢুকছেই না। না, হবে না, হতে পারে না। গুলির মধ্যেই সে দৌড় দেয় মেশিনগানটা উদ্দেশ্য করে। পেছনে শরীফ স্যার চিৎকার করে বলেন, “হাসান ইউ বাস্টার্ড, কাম ব্যাক, কাম ব্যাক” কিন্তু আজ সে ফিরবে না... আজ তার ফেরার দিন নয়... গ্রেনেডের সীমানায় এমজিপোস্টটা আসতেই সর্বশক্তি দিয়ে গ্রেনেডটা ছুঁড়ে দিল সে। কিন্তু আর একটুর জন্য মিস হল। হতাশায় গলা দিয়ে গোঙানি বের হয়ে এল। খুব দ্রুত শরীরটা ঝাঁকি খেল কয়েকবার। বুকের দিকে তাকিয়ে দেখল লাল কিছু বৃত্ত। সে কি মারা যাচ্ছে? মৃত্যু কি এটাকেই বলে? চোখের কোন দিয়ে দেখতে পারছে শরীফ স্যারের হাত থেকে একটা গ্রেনেড উড়ে গেল সেই মেশিনগান পোস্টের উপর। একটা বিস্ফোরণ হল। মেশিনগান পোস্টের ওখানে এখন খালি কালো ধোঁয়া। শরীফ স্যারও ঝাঁকি খেলেন কয়েকবার। মাটিতে পরে গেলেন কেন স্যার? বুঝতে পারছে না হাসান। কেন যেন খুব আপন মনে হচ্ছে এখন স্যারকে। বিনুর চেহারাটা মনে ভাসছে। ওর চেহারাটা স্পষ্ট হচ্ছে না কেন?? কেমন যেন আরামদায়ক একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে শরীরে। দুপুরের রোদে কি চোখ ঝাপসা হয়ে গেল নাকি? কিছুই তো স্পষ্ট দেখতে পারছে না এখন। হাঁটুতে কেন শক্তি পাচ্ছে না? পড়ে যাচ্ছে কেন সে? এটাই কি মৃত্যু??
(২০০১ সালের ১৬-১৯ এপ্রিল বিডিআর-বিএসএফ সংঘর্ষে ৩ জন বিডিআর জওয়ান শহীদ হন। ১৬ জন বিএসএফ সৈন্য নিহত হয়। এটা একটি কাল্পনিক কাহিনী কিন্তু মূল ঘটনা সত্যি। আমরা কি মনে রেখেছি সেই বীর সেনাদের? ইন্ডিয়া কিছু হলেই সেটা নিয়ে মুভি বানায়। আমরা কত ক্ষেত্রেই ভারতকে নকল করার অপচেষ্টা করি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে কেউ একটা কোন কথাও বলল না এই শহীদদের স্মরণীয় করে রাখার জন্য। তারা যেন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন দেশের জন্য জীবন দিয়ে। এ লজ্জা রাখি কোথায়?????)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১৩ রাত ২:১২