somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অসমাপ্ত......

১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


“ How many loved your moments of glad grace,
And loved your beauty with love false or true,
But one man loved the pilgrim soul in you,
And loved the sorrows of your changing face”


Yeates এর When You Are Old কবিতার এই অংশটুকু যতবারই পড়ি ততবারই মনের আয়নায় কোন একজনকে অনুভব করি। কিন্তু সেটা ওইটুকুই, বাস্তবজীবনে প্রেম ভালবাসা ব্যাপার গুলো নিয়ে কখনই তেমন মাথা ঘামাইনি। মূলত Domestic love বা প্রেম করে সংসার করা বলতে যা বুঝায় তাতে কখনই বিশ্বাসী ছিলাম না। দেখতাম আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা ডেটিং এ যায়, মোবাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে কিন্তু এই ব্যাপার গুলো কখনই আমাকে তেমন আকর্ষণ করত না। কেন জানি আমি জীবন নিয়ে তেমন খুশি ছিলাম না। হয়ত শৈশবেই মা বাবার সেপারেশনই এর মূল জ্বালানী। কোর্টের রায়ের ফলে আমার শৈশবের মূল সময়ই কেটেছে মায়ের সাথে। বর্তমানে রয়েছি বাবার সাথে কিন্তু কারো কাছেই আদর বা ভালবাসা ব্যাপার গুলো তেমন উপভোগ করিনি উল্টো কেউ আদর করলে আমার কাছে বিষের মত লাগত। কিন্তু ভালবাসা ভালোলাগা নিয়ে আমার হিসাব নিকাশ সবই ভুল হয়ে গেল ভার্সিটির নবীন বরণ প্রোগ্রামে এক মেয়েকে দেখে। মেয়েটি যে আহামরি সুন্দর বা এক বার দেখলে চোখ ফেরানো দায় তেমন কিন্তু নয়। পরনে ছিল হালকা লাল রঙের সেলোয়ার কামিজ, ডান হাতে একটি ঘড়ি ও বা হাতে একটি পার্স। তবে ওর প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণের মূল কারণ ও অন্যান্য মেয়েদের সাথে থাকলেও কেমন যেন চুপচাপ ছিল যা হটাৎ কেউ দেখলে মনে করবে মেয়েটার মন খারাপ। তবে আমি কিছুক্ষণ লক্ষ করে বুঝলাম আসলে ওটাই ওর সহজাত ধরন। কিন্তু মেয়েটা ওকে নিয়ে গবেষণার বেশি সময় দিল না, দেখলাম আমার দিকেই হেঁটে আসছে। আমি আমার জায়গাতেই কেমন যেন পাথর হয়ে গেলাম যেন কেউ আমার পা মাটির সাথে সুপার গ্লু দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে। যা হোক মেয়েটা আমার দিকেই আসছিল তবে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তবে এবার আমি আর ওর পিছু নিলাম না। কেন নিলাম না জানি না হয়ত পা আবার আটকিয়ে যাবার ভয়েই।
জানুয়ারির দুই তারিখ ছিল আমাদের ক্লাসের প্রথম দিন। ক্লাসে ঢোকা মাত্রই আমার চোখ পড়লো আবার ওই মেয়েটার দিকেই। সেদিন ও ওকে কেমন বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তবে কিছুক্ষণ পরই স্যার চলে এলেন তাই আর বিশেষ খেয়াল করা হয় নি। প্রথম ক্লাস, প্রথম দিন তাই পরিচয় পর্ব দিয়েই ক্লাস শুরু হল। আর তখনই আমি ওর নাম জানতে পারি “পাপড়ি”।

ভার্সিটির প্রথম দিককার ক্লাস তেমন জোরালো হয় না। পড়াশোনার কোন চাপ থাকে না। বিশেষত সে সময় ভার্সিটিতে যাওয়াটা পড়াশুনার চেয়েও সবার সাথে ভাল মত পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে দাড়ায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় পাপড়ির কারো সাথেই পরিচিত হবার তেমন ইচ্ছা নেই। কেউ সেধে কথা বললে বলে, না হয় ক্লাসের কোনার টেবিলটাতে চুপ করে বসে থাকে। এই কারনেই আমার আর সাহস হল না সেধে ওর সাথে পরিচিত হতে। কিন্তু স্যার এর পরোক্ষ সহযোগীতায় একটা উপায় বের করে ফেললাম। আমাদের ডিপার্টমেন্টটি ইংরেজি সাহিত্য হওয়ায় স্যার সবাইকে Oxford Dictionary of English কিনতে বলে গেল। স্যার চলে যাবার পরই আমি সবাইকে বললাম, “আমার বাসার কাছেই আমার পরিচিত একটি বুক ষ্টোর রয়েছে, আমি তোমাদের সবার জন্য বাজার রেট এর চেয়ে কম দামে এনে দিতে পারি তবে তোমরা যদি রাজি থাকো” ।
সত্যি কথা বলতে আমার তেমন কিছু পরিচিতই ছিল না। যা হোক দু এক জন ছাড়া ক্লাসের প্রায় সবাই রাজি হয়ে গেল। তাই যারা আমার থেকে বই নিবে তাদের আমি একটি পৃষ্ঠায় নাম লিখে দিতে বলি। সবার হাত ঘুরে লিস্টটা যখন আমার হাতে আসলো তখন সেখানে পাপড়ির নাম দেখে মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি কারণ সমগ্র নাটক তো ওকে কেন্দ্র করেই।

পরদিন নিজের পকেট থেকে ভর্তুকি দিয়ে ২৮টি বই কিনলাম এবং বইয়ে সুন্দর করে সবার নাম লিখে দিলাম যদিও বই আমি দুটো কম কিনেছি। ক্লাসে যাওয়া মাত্র সবাইকে নাম অনুসারে বই গুলো দিয়ে দিলাম। যখন পাপড়ি দেখল সব বই শেষ কিন্তু ওকে বই দেই নি তখন ও উঠে এলো এবং বই চাইলো। এই প্রথম ও আমার সাথে কথা বলল। তাই মনের মাঝে এক সাগর খুশি নিয়ে ওকে বললাম, “ আসলে আমি দুঃখিত। দোকানদারকে ৩০টা বইয়ের কথাই বলেছিলাম কিন্তু সে আজ দিলো ২৮ টা। বাকি দুই টা বলেছে আজ বিকালে দিবে। আর দোকানদারের কাছে আমাদের নামের লিস্টটা রেখে এসেছিলামতো, তাই বেটা প্রতিটা বইতে নাম লিখে রেখেছে। লিস্টতে তোমার আর আমার নাম নিচে ছিল বলে, আমরা বাদ পড়ে গেছি। তবে কালই পেয়ে যাবে” ।
ব্যাপারটি যদিও পুরোটা চাপা তবুও ও বিশ্বাস করেই ওর সিটে চলে গিয়েছিল। তখনই স্যার চলে এল এবং যারা বই এখন ও কিনে নি তাদের দাঁড়াতে বলল। আর লজ্জার বিষয় সমগ্র ক্লাসে আমি আর পাপড়ি ই দাঁড়ালাম। স্যার কারণ জিজ্ঞেস করলে, আমি স্যারকে ওই বানানো গল্পটিই আবার শুনিয়ে দিলাম। স্যার শুনল এবং আমাকে দায়িত্ব দিল, আজ বিকালের ভিতরই যেন বইটা পাপড়িকে পৌঁছে দেই কারণ পরবর্তী ক্লাসের জন্য word & pronunciation এর উপর কিছু কাজ দিবেন।
ক্লাস শেষ হবার পরই পাপড়ির থেকে ওর বাসার ঠিকানা জেনে নিলাম এবং বাসা যদি না খুঁজে পাই তাই ফোন নাম্বারটাও নিয়ে নিলাম। ওর থেকে নাম্বার ও ঠিকানা নিয়ে ফিরে আসার সময় মনে মনে ফকিরকে ৫০ টাকা দান করার মানত করে ফেললাম। যদিও ফকিরের এখানে কোন ভুমিকা নেই তবুও যুগযুগান্তর হতে এ এক অলিখিত রীতি চলে আসছে।


বিকেলে বইটা কিনে বাবার থেকে গাড়ির চাবিটা চেয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। পাপড়ি ওর বাসার ঠিকানা দেবার সময় বলেছিল, উত্তর খুলশি, ৪নং রোড এর একমাত্র দশ তলা বাড়ি। তাই খুঁজে পেতে কোন অসুবিধাই হয় নি। বাসার নিচে এসে গাড়িটা থামিয়েই ওকে ফোন দিলাম। বেশ কয়েকটা রিং বাজার পরই ও কলটি রিসিভ করল এবং সাথে সাথে আমি বললাম, “হ্যালো আমি রবিন। চিনেছ তো?? তোমার বইটা নিয়ে এসেছি। আমি নিচে আছি” । কথাগুল সম্ভবত এক নিঃশ্বাসেই বলেছিলাম।
পাপড়ি বলল, “আরে তুমি নিচে কেন!! ছয় তলার D6 নম্বর ফ্লাটে চলে এস। আমি ইন্টারকমে দারোয়ানকে বলে দিচ্ছি”

আসলে পাপড়ির কণ্ঠটা বাস্তবের চেয়ে মোবাইলেই কেমন যেন বেশি সুন্দর লাগলো। যা হোক আমিও ভনিতা না করে ওর বাসাতে বই হাতে চলে গেলাম। কলিং বেল দেবার সাথে সাথেই পাপড়ি দরজা খুলে দিল। দরজা খোলার সাথে সাথেই আমি যেন এক অন্য পাপড়িকে দেখলাম। যে মেয়ে সব সময় মুখ গোমড়া করে থাকে, কারো সাথে কথাও ঠিক মত বলে না সেই মেয়ের মুখে কিনা হাসি !!
ঘরের ভিতর প্রবেশের পড়েই বুঝলাম আসলে ঘরে ও একা, তাই বাসার সবার কথা জিজ্ঞেস করি আর এতেই কেন যেন ওর মুখ আবার গোমড়া হয়ে গেল। বলল ওর বাবা বেঁচে নেই আছে বলতে মা ই। তবে সে এখন বাহিরে। আমি দুঃখিত বলে বইটা ওর হাতে বাড়িয়ে দিলাম এবং চলে যাবার উদ্যোগ নিলাম। কিন্তু পাপড়ি আমাকে উঠে যেতে দিল না। আমাকে বসিয়ে কিছুক্ষনের মাঝেই কতগুলো নাস্তা নিয়ে এল। আমার সাথে খেতে খেতেই পাপড়ি আমার ফেসবুক আইডিটা চেয়ে নিল আর চলে আসবার সময় বই এর জন্য টাকা দিতে চাইলো কিন্তু “ পরে না হয় শোধ করে দিও” বলে হাসি মুখে বিদায় নিয়ে এলাম।


রাতে ফেসবুক চেক করার সময় ই হটাৎ পাপড়ির একটি স্ট্যাটাস চোখে পড়ল।
“ সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাক জানি-
এই নদী নক্ষত্রের তলে
সেদিনো দেখিবে স্বপ্ন-
সোনার স্বপ্নের সাদ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
আমি চলে যাব বলে
চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশির জলে
নরম গন্ধে ঢেউয়ে?
লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তবে?
সোনার স্বপ্নের সাদ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
চারিদিকে শান্ত বাতি- ভিজে গন্ধ-মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকাগুলো এসে লেগেছে চোরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল; -
এশিরিয়া ধুলো আজ – বেবিলন ছাই হয়ে আছে”

পাপড়ির দেয়া স্ট্যাটাসটি আসলে জীবনানন্দের কবিতা। তবে বড়ই মর্মান্তিক কবিতা। কবিতাটি পড়ার পর আসলে কেমন যেন হয়ে গেল মন। তবে আশ্চর্যের বিষয় ওর পুরাতন স্ট্যাটাস গুলোর বেশির ভাগ হয় মৃত্যু বিষয়ক কোন লেখা বা কবিতা।
মানুষ সাধারনত মৃত্যু বিষয়টা এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে কেউই আসলে চলে যেতে চায় না তবুও চলে যেতে হয় ঠিকই। তাই সবাই কমবেশি চায় ব্যাপারটাকে ভুলে থাকতে। এক্ষেত্রে পাপড়িকেই দেখলাম ব্যতিক্রম।
যাহোক দেখতে দেখতে কেমন করে যেন ছয়টি মাস পার হয়ে গেল। পাপড়ির সাথে আমার যোগাযোগটাও ঘনিষ্ঠ হতে লাগলো। এখন পাপড়ির সম্পর্কে অনেক বেশি কিছু জানি। পাপড়ির বাবা মারা যাবার পর ওর মা যা যা করে বেড়ায় আর সেই কারণে পাপড়ির যে কি পরিমাণ মানুষিক কষ্ট পেতে হয় তার কোন কিছুই এখন আর অজানা নয়।


আগস্টের ৬ তারিখ পাপড়ির জন্ম দিন। তাই সে দিন বিকালে আমি পাপড়ির বাসায় কিছু ফুল নিয়ে উপস্থিত হই। তবে ফুল গুলো ছিল প্লাস্টিকের কারণ পাপড়ি আমাকে একবার বলেছিল ফুলে নাকি ওর ব্যাপক এলার্জি।
ফুলগুলো হাতে নিয়ে ওদের বাসার লিফট এর সামনে দাড়াই কিন্তু লিফট সার্ভিসিং করছিল বলে হেঁটে হেঁটে ছয় তলার উপর উঠি। হেঁটে হেঁটে উঠার কারণে বেশ হাপিয়ে যাই। তাই কিছুক্ষন বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে পাপড়িদের বাসার কলিং বেল বাজাই। বেল বাজার সাথে সাথেই সবসময় পাপড়ি এসে দরজা খুলে দেয় কিন্তু আজ বেল বাজার পর অনেকক্ষন কোন সাড়া শব্দ নেই। তারও কিছু সময় পর দরজা খোলা হল কিন্তু আজ আর পাপড়ি দরজা খুলল না খুলল ওর মা।
ওর মার সাথে আমার আগেও কয়েকবার দেখা হয়েছে কিন্তু সেদিন ওর মার চোখে পরিষ্কার বিরক্তির আভাস দেখেছিলাম।
ঘরে ঢোকা মাত্র পাপড়ির মা ওর রুমের দরজায় টোকা দিল আর দরজা বন্ধ থাকা অবস্থায়ই পাপড়ি জানতে চাইলো, “কে”। ওর মা আমি এসেছি বলার পর পাপড়ি দরজা খুলে দিল। দরজা খোলার পর আমি যেন এক বিধ্বস্ত পাপড়িকে দেখলাম। মনে হচ্ছিল অনন্ত কাল ধরে কোন গুহায় বন্দী থেকে এইমাত্র ছাড়া পেয়ে এলো। আমি রুমে ঢোকার পরই পাপড়ি আবার ধরজা বন্ধ করে দিল।
আমি পাপড়ির ইজি চেয়ারে এবং পাপড়ি ওর খাটে বসা। ওর জন্য আনা ফুল গুলো তখন ও আমার হাতেই ছিল। এমন পরিস্থিতির জন্য ফুল গুলো দিতে মোটেও মন সায় দিচ্ছিল না। তারপর ও Happy Birthday বলে ফুল গুলো ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। ও ফুল গুলো স্বাভাবিক ভাবেই হাতে নিল। ফুলগুলোর দিকে এক পলকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হটাৎ ই কেঁদে উঠল। যেন কেঁদে উঠার জন্য এই মুহূর্তটারই অপেক্ষায় ছিল। কাঁদলে নাকি মানুষের মন হালকা হয় তাই আমি ওর কান্নায় বাঁধা দিলাম না। কান্না থামার পরই কি হয়েছে তা খুলে বলার অনুরোধ করি। কিন্তু ওর মুখ থেকে আমি যা শুনলাম তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ওর মা ওর বিয়ে ঠিক করেছে !! কিন্তু যার সাথে করেছে সে মোটেও ভাল কোন ছেলে নয়। বদ্ধ মাতাল বাজে টাইপের একটা ছেলে। মোট কথা ওর মা’র অপকর্মে পাপড়ি বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাই পাপড়ির ভবিষ্যতের কোন চিন্তা না করে ওকে অন্ধকারে ফেলে দিতে চাচ্ছে।
এরই মাঝে পাপড়ির মা দরজার ওপাশ থেকে জোরে জোরে বেশ কিছু অরুচিকর মন্তব্য করতে থাকে। বাজে কথা গুলো শুনার পর আমি আর পাপড়ির সাথে বদ্ধ রুমে থাকতে পারলাম না। পাপড়িকে বলে বেড়িয়ে পড়লাম। বের হবার আগে পাপড়ির মা শুনিয়ে দিল আর যেন তাদের বাসায় না আসি। আমি কোন উত্তর না দিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম তবে বের হতে হতে পাপড়ির একটি কথা শুনলাম। ও ওর মাকে বলছে, “ তোমাকে মা বলে ডাকতে আমার লজ্জা হয়” ।

৫।
বাসায় আসার পর আমার আর কিছু ভাল লাগলো না। নিজের উপর রাগ লজ্জা মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। কারণ এত দিনেও আমি ওকে আমার ভালো লাগার কথা বলতে পারলাম না এমনকি আজ পাপড়ির এমন দুর্দিনেও কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। নিজেকে এতটা অসহায় আগে আর কখনও বোধ করি নি।
রাতে বাবা এসে ভাত খাবার জন্য ডাকলো কিন্তু বাবাকে খিদে নেই বলায় বিশেষ জোর করল না। হয়ত আমার মনের অবস্থা আঁচ করতে পেরেছিল।
ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম ঠিক মনে নেই। তবে ঘুম ভেঙ্গে যায় বাবার প্রবল ডাকে। বাবা বলল, “রবিন তাড়াতাড়ি উঠ, তোর ফ্রেন্ড শামিম বাসায় এসেছে। তোদের কোন ফ্রেন্ড নাকি সুইসাইড করেছে”।
ঘুম কাঁতর চোখে বাবার সব কথা কানে ঠিক মত ঢুকেনি তবে সুইসাইড কথাটা কেন জানি কানে প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। চট করে উঠে শামিম এর থেকে কে সুইসাইড করেছে শোনার পর আমার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পাপড়ি সুইসাইড করেছে!!!
এত বড় আঘাত পাবার পরও কেন জানি আমার কান্না পাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল সব আসলে স্বপ্ন, সব মিথ্যা। তারপর ও ঘোর এর মধ্যেই শামিমকে নিয়ে পাপড়ি দের বাসায় উপস্থিত হই। যেয়ে দেখি বাসায় অনেক মানুষ। অনেক এ বলাবলি করছে কীভাবে পাপড়ি সুইসাইড করেছে। সেখানেই শুনেছি, পাপড়ি নাকি মধ্য রাতে বাসার ছাদ হতে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে। লাফানোর আগে গায়ে নাকি ওড়না পেচিয়ে নিয়েছিল যাতে কিছু আঁকড়ে ধরতে না পারে। ওর মাথাটা নাকি থেতলে গিয়েছিল এবং সাথে সাথেই মারা যায়। মারা যাবার আগে ওর পড়ার টেবিলে একটি নোট রেখে গেছে। নোটে বিশেষ কিছু লেখা নেই তবে লেখা ছিল ওর প্রিয় কবির কিছু কবিতার লাইন।
“কোনদিন জাগিবেনা আর
জাগিবার গাঢ় বেদনায়
আবিরাম- আবিরাম ভার
সহিবে না আর”



ড্রয়িং রুমের ছোফার এক কোনে পাপড়ির মা হাউ মাউ করে কাঁদছে। সেটা দেখা মাত্রই নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলাম না। ওনার মুখে এক গাদা থু ছিটিয়ে যা জানি তা চিৎকার করে বলতে বলতে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। ওখান থেকে শামিম টেনে হিঁচড়ে আমাকে বাসায় নিয়ে এলো।

তিন দিন পর......
আজ বাসায় পুলিশ এসেছিলো। আমি যা জানি তা সব লিখে নিয়ে গেল। হয়ত পাপড়ির মা’র বিচার হবে কিন্তু আমি তো আমার পাপড়িকে ফুলের পরিস্ফুটিত পাপড়ির মত সুবাস ছড়াতে দিতে পারলাম না। হটাৎ মনে পড়ে গেল আমিও তো সুখী নয়। সুখ পুরটাই আপেক্ষিক বিষয়, মাঝে আমি পাপড়িকে কেন্দ্র করে সুখের বাগানের সন্ধান পেয়েছিলাম কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন সেই তো আজ নেই। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হল, “তুচ্ছ এ জীবনের জন্য কেন এতো আয়জন,এত হাহাকার!!”
তাই আমিও পাপড়ির পথ ধরতে উদ্যোগ নিলাম তবে একটু ভিন্ন ভাবে। পৃথিবীতে সব মানুষকেই একদিন মৃত্যু বরণ করতে হবে। কিন্তু কজনের মৃত্যু সমগ্র পৃথিবীকে নাড়া দিতে পারে? আমি হয়ত স্বাভাবিক ভাবে মরে গেলে আমার পরিচিত জনরাই কাঁদবে কিন্তু যদি বরণীয় কোন ব্যাক্তিত্ত হতাম তখন?
আমি যখন তেমন কিছুই হতে পারলাম না এমন কি আমার ভালবাসার মানুষটি মৃত্যুর আগেও জানলো না আমি তাকে কতটা ভালবাসি, সেই আমিকে বাঁচিয়ে রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই। তবে যে আমি বেঁচে থাকতে দুনিয়ায় তাক লাগানর মত কিছুই করতে পারিনি সে আমি মৃত্যুর মাধ্যমে সমগ্র দুনিয়ায় আলোচিত হবার উপায় বের করে ফেলেছি।

সেপ্টেম্বর ১,২০১২
আজ আমার জন্মদিন এবং দিনটি মৃত্যু দিনেও পরিণত হবে। কারণ আজই আমি আমার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে পুরো পৃথিবীর মিডিয়ায় আলোচ্য হয়ে উঠবো। একে তো সেই আনন্দ তার উপর পাপড়ির কাছে চলে যাব, এটা ভেবেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছি। এরই মাঝে একটা মেসেজ আসে মোবাইলে। অন করে দেখি মেসেজটা পাপড়ির!!
তবে মেসেজটা আমি খুলি করি নি। প্রথমে অবাক হয়েছিলাম অবশ্য কিন্তু পরে বুঝে যাই টাইমার এস এম এস এর কল্যানেই মেসেজটা এসেছে। পাপড়ি তাহলে মৃত্যুর আগেই মেসেজটা সেট করে রেখেছিল। আর মেসেজটা না খোলার মূল কারণ, মৃত্যুর পূর্বে এটাই হবে আমার শেষ সারপ্রাইজ।
রাত ১০ টা ৪২মি।
অনেক বছর পর আজ আমার জন্মদিন উপলক্ষে বাবা মা একত্রে হয়েছে। যদিও একই ছাদের নিচে এসে তারা কেউ কারো সাথে কথা বলে নি তবুও মৃত্যুর পূর্বে এটি আমার এক বড় পাওয়া। যা হোক, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় এসে গেছে। ১২ টা বাজতে খুব বেশি দেরি নেই। আমি মরবো আমার জন্মদিনেই তাই যা করার তা ১২টার আগেই করতে হবে। এটা কোন সাধারণ সুইসাইড না যে টুপ করে মরে গেলাম, পরিকল্পনাটি একটু দীর্ঘ তাই প্রতিটি মিনিটই অত্যন্ত মূল্যবান।
আমি আগেই বলেছি আমি আমার মৃত্যুর মাধ্যমে দুনিয়ায় একটি তাক লাগাবো তাই নিজেকে নিজে মারবো খুব বিদঘুটে ভাবে। প্রথমে হাতের রগ কাটবো তারপর সেই রক্ত বোতলে ভরবো। এভাবে শরীরের বিভিন্ন দিক ছুরি দিয়ে কাটবো। চিৎকার যাতে না করতে পারি সে জন্যে আগে থেকে মুখে কাপড় ভালো ভাবে পেচিয়ে রাখবো। সর্বশেষ ১পাতা ঘুমের ট্যাবলেট দিয়ে বানানো শরবত খেয়ে পাপড়ির কাছে চলে যাবো। আমার মৃত্যুর প্রতিটা মুহূর্ত যাতে সবাই দেখতে পারে সেজন্য ওয়েবক্যাম অন থাকবে এবং Youtube এ লাইভ স্ট্রিমিং হতে থাকবে। ফলে আগামী কালই আমি দেশিও মিডিয়ার আলোচ্য হয়ে উঠবো। Youtube এ ভিডিওটির হিট লিস্ট দিনে দিনে বড় হবে। কোন কোন দেশ হয়ত এমন বিভস্য দৃশ্য Youtube থেকে তুলে নেবার জন্য প্রতিবাদ করবে। তরুনরা ভিডিওটি মোবাইলে বয়ে বেড়িয়ে নিজের পৌরুষ স্বত্বার প্রমাণ দিবে। ধীরে ধীরে পুরো বিশ্বে আমি বনে যাব আলোচনার অন্যতম বিষয়। সবাই তরুন সমাজ নিয়ে ভাবনায় পড়ে যাবে। দিকে দিকে “দুনিয়াটা রসাতলে গেল বা শেষ জমানার নজির” বলে রব উঠবে।

ভাবতেই কেমন যেন একটা পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। যা হোক সব কিছু ঠিক ঠাক করে আমার শেষ সারপ্রাইজ ‘পাপড়ির’ মেসেজটি পড়ার জন্য মোবাইল হাতে নিলাম।
“ শুভ জন্মদিন রবিন। হয়ত তুমি যখন মেসেজটা পড়ছ তখন আমি তোমাদের কাছে নেই। তবে অল্প দিনের মাঝেই তোমাকে আমি খুব ভালো করে বুঝেছি। তুমি একটা আস্ত ভিতুর ডিম। তুমি যে আমাকে পছন্দ করতে তা আমি ভালো করেই বুঝতাম। কিন্তু আমি এমন একটা অবস্থায় আছি যেখান থেকে আমি ভবিষ্যতের কোন কিছু চিন্তা করতে পারছি না। মনে হচ্ছে সমস্ত অন্ধকার আমাকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে। আমি যেন এক বিন্দুতেই স্থির হয়ে পড়ছি তাই মুক্তির জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছি। আমাকে ক্ষমা কর। আর একটা প্রশ্ন তোমাকে করে যাচ্ছি, ধর একটা জিনিসের কোন শুরুই হয় নি টার শেষটা কি বিশেষ প্রয়োজন??
Love u nd take care urself ”
মেসেজটা পড়েই হাতে ছুরি নিলাম কিন্তু আশ্চর্য নিজের হাত কাটার সাহস পাচ্ছি না.........


তখনই পাপড়ির থেকে শোনা একটি কবিতার কয়েকটা লাইন কানে বাজতে লাগলো,
“Just open your eyes
Just open your eyes
And see that life is beautiful”


০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×