ঠিক করেছিলাম, ছাত্রলীগ বা ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আর কিছু লিখব না। প্রথমে এসব লিখে কিছুই হয় না, আর এ ব্যাপারে যাঁদের গুরুত্ব দেওয়ার কথা, তাঁরা গুরুত্ব দেওয়ার তেমন একটা প্রয়োজন মনে করেন না। কিছুদিন আগে দৈনিক প্রথম আলোয় ছাত্রলীগ নামধারীদের দুর্বৃত্তপনা নিয়ে লিখেছিলাম। যেদিন লেখাটি প্রকাশিত হলো, সেদিন প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। সকালবেলা ঘুম ভাঙল সরকারদলীয় এক নেতার টেলিফোনে। বেশ উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, লেখাটি কি আজ প্রকাশ না করলে হতো না? তাঁর কাছে জানতে চাই, সমস্যা কী? জবাবে বলেন, ওই লেখা তো প্রধানমন্ত্রী পড়বেন। বলি, তিনি পড়বেন সেই আশাতেই তো লেখাটি আজ ছাপা হলো। কারণ, এখনো আমি বিশ্বাস করি, ছাত্রলীগ প্রসঙ্গে কেউ যদি কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা প্রধানমন্ত্রীই নিতে পারেন। কিছু পরে সিলেট অঞ্চলের আরও একজন বড়মাপের নেতা ফোন করে আমাকে একহাত নিলেন। বললেন, কোন আক্কেলে আমি ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে এত প্রশংসাসূচক মন্তব্য করলাম? তিনি ওবায়দুল কাদেরের চেয়ে কম কী? বলি, তিনি এখন রাজনীতি থেকে অনেকটা স্বেচ্ছানির্বাসিত। যদিও নতুন প্রজন্মের একজন ভালো রাজনৈতিক নেতা হওয়ার সব গুণাবলি তাঁর ছিল। দুর্ভাগ্যবশত তিনি সংস্কারবাদীদের দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছেন। সেদিন দুপুর নাগাদ আমার পূর্ববর্তী কর্মক্ষেত্র থেকে সংবাদ পাই, ছাত্রলীগ নামধারীরা আমাকে ওই ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। অথচ এই ক্যাম্পাসে তাদের পূর্বসূরিদের আমার মতো আমার অনেক সহকর্মী দীর্ঘ দুই দশক ধরে নিজেদের জীবন বাজি রেখে ক্যাম্পাস দখলে রাখা এক বড় অপশক্তি থেকে আগলে রেখেছিলেন। আমার বাড়িতে যখন এই অপশক্তি মধ্যরাতে বোমা নিক্ষেপ করল, আমাকে হত্যার হুমকি দিল, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুবার ফোনে আমার আর আমার পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমার নিজস্ব বাড়িতে প্রায় এক বছর সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করেছিল। পরে অবশ্য ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা টেলিফোনে আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। অনেকটা বিবেকের তাড়নায় ছাত্রলীগ নিয়ে না লিখে পারলাম না। কারণ, তাদের সাম্প্রতিক দুর্বৃত্তপনা অনেকের মতো আমাকেও দারুণভাবে বিচলিত করেছে। তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে যে একটা মহাবিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা অনুমান করার জন্য কোনো বড়মাপের গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই কর্মটি তারা বর্তমানে বেশ আনন্দের সঙ্গেই করেছে।
আমাকে কয়েক দিন আগে সম্পূর্ণ ছাত্রশিবির-নিয়ন্ত্রিত একটি ক্যাম্পাসের একজন ছাত্র প্রশ্ন করল, তাদের ক্যাম্পাসে বর্তমানে ছাত্রশিবির কেন এত শান্ত, অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে? বিষয়টা নিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করি। জানতে পারি, শিবির এ মুহূর্তে চুপচাপ থাকলেও তাদের কর্মকাণ্ড মোটেও থেমে নেই। ছাত্রসংগঠন হিসেবে তারা অন্য যেকোনো সংগঠনের চেয়ে শত গুণ বেশি পেশাদার। এ সময় তারা বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হলে তাদের করণীয় সম্পর্কে নিখুঁত পরিকল্পনার ছক তৈরিতে ব্যস্ত। মাসে তারা কমপক্ষে দুটি বৈঠক করে। সেখানে দলের সব নেতা উপস্থিত থাকেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের নেতাদের বিচারের রায় ঘোষণা করা হলে তাদের করণীয় কী হবে, তা-ও তাদের সভায় আলোচনা হয়। এ মুহূর্তে তারা ছাত্রলীগ বা অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের কর্মকাণ্ড নিয়ে মোটেও বিচলিত নয়। তারা দেখছে ক্যাম্পাসে তাদের কোনো দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড না থাকলেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পরস্পর পরস্পরের মাথা ফাটাফাটিতে ব্যস্ত আছে। তারা এ-ও দেখছে, কিছুসংখ্যক শিক্ষক কীভাবে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। জাতির জন্য এটি একটি বড় ধরনের দুর্ভাগ্য।
এ মুহূর্তে কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয় ঘটানোর জন্য কারা কারা ওভারটাইম কাজ করছে। উত্তরে বলব, বিরোধী দল তো করছেই। কারণ, এটি তাদের কাজ। এতে আমি তেমন খারাপ কিছু দেখি না। করছেন একশ্রেণীর সুশীল সমাজের সদস্য। কারণ, তাঁরা মনে করেন আওয়ামী লীগ হচ্ছে চাষাভূষাদের দল। এখানে তাঁদের মতো সুটেড-বুটেডদের জন্য কোনো জায়গা নেই। করছেন দলের অভ্যন্তরে অবস্থান নেওয়া কিছু অপরিণামদর্শী নেতা-নেত্রী, যাঁরা মনে করেন, ভবিষ্যতে আর সুযোগ পাওয়া যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সুতরাং এ মুহূর্তে যতটুকু ক্ষমতার দাপট দেখানো যায়, ততই নিজের জন্য মঙ্গল। দল গোল্লায় গেলে অসুবিধা নেই।
সম্প্রতি গফরগাঁও থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগদলীয় সাংসদ ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসউদ্দিন আহমেদ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তবে আওয়ামী লীগ যেন আগামী দিনে কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতায় যেতে না পারে, তার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে সারা দেশে রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছে ছাত্রলীগ নামধারী দুর্বৃত্তরা। যার সর্বশেষ বলি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ বছর বয়সী শিশু রাব্বি। আর একশ্রেণীর মিডিয়া তো আছেই, যারা সব সময় গ্লাসের অর্ধেক খালিকে সংবাদ বা সংবাদ বিশ্লেষণে প্রধান পুঁজি করতে ব্যস্ত। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেকগুলো ইলেকট্রনিকস মিডিয়া অনুমোদন পেয়েছে সত্য কিন্তু তার কয়টি আওয়ামী লীগপন্থীদের হাতে আছে বা থাকবে, তা খোঁজ নিলে আঁতকে উঠতে হবে। এটি সম্পূর্ণ মিডিয়াজগতের বেলায় সত্য। সেদিন একজন গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জানালেন, বর্তমানে যাঁরা বিভিন্ন পেশায় উচ্চপদে আছেন, তাঁদের অনেকেই জামায়াত-ঘেঁষা রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। এর একটি প্রধান কারণ যখন ছাত্রলীগ নামধারীরা দুর্বৃত্তপনায় নিয়োজিত, তখন ছাত্রশিবির টার্গেট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের তাদের দলে টানার জন্য। তারা তাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে আর প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা করে। অনেককে আর্থিক সহায়তাও করে। যখন সেই ছাত্রটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বের হন, তখন তাঁর আনুগত্য সব সময় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির প্রতি থাকবে। বর্তমানে জামায়াতের সহায়তায় কয়েক শ তরুণ বিদেশে আইনশাস্ত্র নিয়ে লেখাপড়া করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক দশক পর দেশের উচ্চ আদালতে আইনজীবীদের নেতৃত্বে আর কখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দেখা যাবে না। অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
ফিরে আসি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রসঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তিন দিন ধরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘাত চলছিল। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাড়াও যথেষ্টসংখ্যক পুলিশ ছিল। এই তিন দিন তারা অপেক্ষা করেছিল সম্ভবত একটি লাশ পড়ার জন্য। লাশ অবশেষে পড়ল এবং দুঃখজনক হলো, তা রাব্বি নামে এক অবুঝ শিশুর। যার সঙ্গে ছাত্ররাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না । তারপর যা হলো তা রুটিন কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ আর ছাত্রলীগের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদককে দল থেকে বহিষ্কার। বাস্তবতা হচ্ছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি এখন কোনো শাখা-সংগঠনকে আর নিয়ন্ত্রণ করে না। এরা সবাই স্থানীয় দলীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণে; তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এবং যেহেতু কোনো কোনো স্থানে স্থানীয় নেতাদের মাঝে চরম কোন্দল আর দলাদলি বিরাজমান, সেহেতু এই কোন্দল আর দলাদলি তাদের ছাত্রসংগঠনের মাঝেও সংক্রমিত হয়েছে। এবং এর ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।
আমি সেই ছাত্রলীগকে খুঁজছি, যেটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওই ছাত্রলীগকে খুঁজছি, যে ছাত্রলীগ আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ওই ছাত্রলীগ আমার প্রয়োজন, যে ছাত্রলীগ আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছে। ওই ছাত্রলীগকে জাতি খুঁজছে, যে ছাত্রলীগ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সব ধরনের বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করেছে। ওই ছাত্রলীগকে দেশের মানুষ খুঁজছে, একসময় যার নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, খালেদ মাহমুদ আলী, আবদুর রউফ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু, ওবায়দুল কাদের, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, এনামুল হক শামিম প্রমুখেরা। যত দিন পর্যন্ত এই ছাত্রলীগের খোঁজ পাওয়া না যাবে, বন্ধ থাক না দুর্বৃত্তকবলিত
ছাত্রলীগ নামধারী সংগঠনটি। তাতে জাতির বা অন্য কারও কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই।
সবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাঁর একটি সামান্য আবেদন। সাম্প্রতিক একাধিক জরিপে দেখা গেছে আপনার প্রতি এখনো সাধারণ মানুষের আস্থা অন্য যেকোনো নেতা-নেত্রীর চেয়ে বেশি। অন্তত দুই বছরের জন্য ছাত্রলীগ নামের সংগঠনটির সব কর্মকাণ্ড বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন, তখন দেখা যাবে আপনি এবং আপনার দলের জনপ্রিয়তা কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। এই দুই বছর ব্যবহার হোক ছাত্রলীগকে সত্যিকার অর্থে একটি আদর্শ ছাত্রসংগঠন হিসেবে তৈরি করতে। যেমনটি জাতির জনক করেছিলেন। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে বর্তমানে যারা দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে, এ মুহূর্তে তারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য একটি পর্বতসমান বোঝা বৈ আর কিছু নয়। আপনি বা আপনার দল ক্ষমতায় না থাকলে ছাত্রলীগ নামধারী কাউকে হারিকেন দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। আর বর্তমানে যেমনটি চলছে তেমনটি চলতে থাকলে তাহলে অবস্থাটা হবে তিন টাকার ছাগল লাখ টাকার খেত খাওয়ার মতো। গত চার বছরে বর্তমান সরকারের অনেক অবদান আছে, তবে তার সবটুকুই নস্যাৎ করে দিচ্ছে ছাত্রলীগ নামধারী এই সংগঠনটি। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।