বেশকিছুদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে আরাফাত শাওন এবং তার মৃত্যু নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। নানা মুনির নানা মত।অনেকেই অনেক রকম ভাবে ঘটনাটিকে নিরীক্ষণ করেছেন। কারও মতে এটা অপরিপক্ব বয়সের অপরিণত সিদ্ধান্ত আবার কেউ বা সেই হতভাগ্য ছেলেটিকেই দুষছেন। আমি একটু ভিন্নভাবে বিষয়টা ভাবার চেষ্টা করছি।
আমাদের শিক্ষকেরা সবসময়ই বলেন ছাত্ররা তাদের কাছে সন্তানতুল্য। সন্তানের মতোই নাকি তারা আমাদের দেখেন। বাস্তবে তো আমাদের শিক্ষকেরা এই কথার প্রতিফলন দেখান না। একটা শিক্ষকের অনুপ্রেরণা যে ছাত্রের কাছে কতবড় টনিক তা হয়তো অনেক শিক্ষকই ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারেন না। খারাপ ফলাফল হলে কমবেশী শিক্ষকদেরই ছাত্রদের গালমন্দ করতে দেখা যায়। নিরুতসাহিত করতে দেখা যায়। কিন্তু কয় শিক্ষক তার ছাত্রের ভাল রেজাল্টে বাহবা দেন?খুবই বিরল প্রজাতির শিক্ষরাই এমন করেন। এখানে আরাফাতের শিক্ষকেরা কী ভূমিকা রেখেছেন তা জানতে খুবই ইচ্ছা হয়। তাদের সামান্য অনুপ্রেরণা হয়তো এই অভাগা ছেলেটির প্রাণ রক্ষা করতে পারতেন। শিক্ষকেরা আমাদের সন্তানতুল্য বলেন বলেই এমন চিন্তা মাথায় আসলো। নতুবা একথা বলার অবকাশ পেতাম না।
আরাফাত শাওন তার সুসাইড নোটে যেসব কথা বলে গিয়েছে আমি বাজী ধরে বলতে পারি আমাদের দেশের অধিকাংশ কিশোরের এই অবস্থা। প্রায় সব পরিবার থেকেই কিশোরদের খেলার সময় দেয় না। প্রাইভেটে যেতে বাধ্য করে। বাড়ীর স্যারের কাছে পড়তেই হবে নতুবা ভাল রেজাল্ট সম্ভব নয় এমন মানসিকতাও আছে আমাদের পিতামাতাদের মাঝে। আর টাকার খোটার দেওয়ার বিষয়টি মধ্যবিত্ত সব পরিবারের মাঝেই আছে বলে আমার ধারণা। বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবেই নিতে হবে। কারণ মা-বাবা রা তাদের রক্ত জল করা টাকায় তার সন্তানের খারাপ রেজাল্ট দেখতে চান না। কিন্তু এক্ষেত্রে সন্তানের ধারণ ক্ষমতা, চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি মাথায় রাখতে হবে। প্রমথ চৌধুরী তার বইপড়া প্রবন্ধে বলেছেন -"আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা মনে করেন শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোই শিশুর স্বাথ্যরক্ষা ও বলবৃদ্ধির একমাত্র উপায়। দুগ্ধ অতিশয় উপাদেয় খাদ্য,কিন্ত তার উপকারিতা যে ভোক্তার জীর্ন করার শক্তির উপর নির্ভর এ জ্ঞান মাতৃশ্রেণির নেই"। দুধ যে উচ্চ প্রোটিন সম্পন্ন খাদ্য এতে সন্দেহ নেই কিন্তু এই খাদ্য যদি জোর করে গেলানো হয় তবে তা তখন খাদ্য থাকে না,অখাদ্য হয়ে যায়। তাতে তো ভোক্তার উপকার হয়ইনা বরং ক্ষতি হয়। আমাদের মা বাবাও ঠিক সেই কাজটিই করে সন্তানের এবিলিটির দিকে খেয়াল না করে তার উপর পড়াশোনার বোঝা চাপিয়ে দেয়। যে ছাত্রের সায়েন্সে মন নেই তার কানে জপে দেয় " সায়েন্স ছাড়া দুনিয়া অচল,চাকরি পাবি না। ভাত পাবি না"। কিন্তু মাতাপিতা তার সন্তানের ধারণক্ষমতা সমন্ধে ওয়াকিবহাল থেকেও জোর করে বোঝা চাপিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে চেতন ভগতের আরেকটি কথা মনে পড়ে গেল " প্রত্যেক মা বাবাই চায় তার সন্তান আইন্সটাইনের মত থিওরি আবিষ্কার করে হইচই ফেলে দিক, কিন্তু তারা বোঝে না তারা আমাদের সে জীন দিয়েছে তা দিয়ে আর যাইহোক আইন্সটাইন হওয়া সম্ভব না"।
আশ্চর্যের বিষয় এ বিষয়টা আমাদের মিডিয়াতে অতটা গুরুত্ত্ব পায়নি যতটা পাওয়ার কথা। যে বয়সে মাথায় নানা রকম আইডিয়া কিলবিল করবে,দুরন্ত পাখির মত মুক্ত আকাশে পাখা ঝাপটাবে সেই বয়সের একটি ছেলে কতটা মানসিক ভাবে ভেংগে পড়লে আত্মহত্যা করে তা কি আমাদের সুশীল সমাজের কাছে চিন্তার খোরাক নয়?
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৫ রাত ১০:৪১