শিমু চলে যাবার পর একটা সিগারেট ধরালাম। এই মেয়েটার সাথে আমার দিনের সম্ভবত সবচেয়ে বিরক্তিকর সময়টুকু কাটে। প্রতিদিন সেই একঘেয়ে নীতিবাক্য শুনিয়ে ব্যর্থ অনুরোধ করে ঘণ্টা পার। সবশেষে কেঁদে বিদায় নেয়া। প্রতিদিন একই রুটিন। কিন্তু তারপরও প্রতিদিন এই সময়টুকুর জন্য আমি অপেক্ষা করি। অদ্ভুত নেশার মত একটা ব্যাপার। আর শিমু মেয়েটাও এত বোকা কেন কে জানে। সবকিছু জানা সত্ত্বেও আমার মত ক্রমশ: নষ্ট হয়ে যাওয়া একটা ছেলের সাথে কেন ঝুলে আছে সেটা ওই ভাল বলতে পারবে।
সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে শিমুর কান্নার কথা কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। নাহ! কাল থেকে ঠিক বদলে যাব। কাল থেকে ঠিক ভাল হয়ে যাবো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে খিটখিটে মেজাজের বুড়ো বাপটাকে চমকে দেব। সেই শেষ কবে সকালে ঘুম থেকে উঠেছি? কাল ঠিক আবার উঠে পড়ব। কাল থেকে সকালে বুড়ো বাপটার কথামতো দৌড়াতে শুরু করব। শরীরটা ঠিক করে ফেলব। অবশ্য আমাকে বাজারে পাঠানোর ব্যাপারেই বোধহয় আমার বাপটার আগ্রহ বেশি। দৌড়ে শরীর ঠিক রাখা স্রেফ ফালতু কথা।
ক্যাম্পাসে গেলেও ঠিকমতো ক্লাস করা হচ্ছে না। অবশ্য সেজন্য ক্লাসে অনুপস্থিত নেই। প্রেজেন্স ঠিক ঠিক পড়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ক্লাসরুমে চেহারা দেখাতাম। কাল থেকে নিয়মিত হয়ে যাব। আর প্রক্সি নয়। প্রফেসরদের লেকচার এ মনোযোগ দেব, রোল নাম্বার ফোর্টি থ্রি-র শরীরের দিকে নয়।
পাড়ার মেয়েগুলোকে দেখে সিটি বাজানোর অভ্যাসটা ছেড়ে দিতে হবে। মোড়ের আড্ডাটাই ছেড়ে দেব ভাবছি। এমনিতেই ইদানীং পাড়ার বাজে ছেলেদের তালিকায় নামটা অমোচনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। সেটা মুছে দেখিয়ে দেব।
ক্যাম্পাসে শ্যামলের দোকানে অনেকদিন যাবৎ বাকিতে খেয়ে যাচ্ছি। ও শালা অবশ্য ভয়েই কিছু বলে না। ওই ছোট্ট ঝুপড়ি দোকানটাই একমাত্র আয়ের উৎস। কে চায় অহেতুক ঝামেলা করে নিজের একমাত্র সম্বলটাও হারাতে? শ্যামল জানে আমাদের কাছে খাবারের দাম চাওয়াটা নেহাৎ বোকামী ছাড়া অন্যকিছু নয়। এটাও ছেড়ে দেব। শ্যামলের কাছে কত টাকা বাকি হয়েছে জানতে চাইবো কি? তাতে অবশ্য পকেট খসবে। সেটা জোগাড় করতে আবার কি করতে হয় কে জানে?
গত পরশু চারজন মিলে যে ছেলেটাকে হাসপাতালে পাঠালাম তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেব। স্বপনদের সাথে গাঁজা টানাও ছেড়ে দেব। ওদের সঙ্গই ছেড়ে দিতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়। অবশ্য এসব দলে একবার জড়িয়ে পড়লে ছুটতে চাওয়াটা রিস্কি। তবু... চোখ লাল করে ঘরে ফিরতে শুরু করার পরই তো মা ধীরে ধীরে কথা বলা বন্ধ করে দিল। নাহ! মা, আর বেশিদিন নয়। তুমি শিগগীরই আবার কথা বলতে শুরু করবে।
রাস্তায় অন্ধ ভিখিরীটার কাছ থেকে একবার কিছু টাকা সরিয়েছিলাম। কাল থেকে ঠিক বদলে যাবো। কাল থেকে প্রতিদিন ভিখিরীটাকে দু'টো টাকা দেব।
শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। বুঝলে শিমু? কাল থেকে ঠিক বদলে যাবো। বুঝলে বোকা মেয়ে! কি দেখে যে তুমি আমার মত ক্রমশ: নষ্ট হয়ে যাওয়া একটা ছেলের জন্য কাঁদো। কিন্তু দেখো, কাল থেকে আর কোন কান্না নয়। আগামীকাল থেকে সব বদলে যাবে। তুমি দেখে নিও।
প্রতিদিন বদলায়। শুধু আগামীকাল আসে না।