আজ সকালে ঘুমটা বোধহয় একটু তাড়াতাড়িই ভেঙেছে।মনের ভিতরে একটা অস্থির অনুভূতি কাজ করছে বলে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। কারন অবশ্য একটাই, আজ আমি মুক্তি পাচ্ছি। সকাল ৯ টায় অন্য সব কয়েদিরা যেমন খাবার পায়, আজ আমার খাবারটা তার থেকে একটু ভিন্ন এবং ভালো মানের।
দুপুর হতে না হতেই পাশের ওয়ার্ডের জহির,কবির ভাই, সালাম চাচা এবং রশিদ ভাই হাজির আমার রুমে।সবাই খুব দু:খ করছে আমার জন্যে। সবথেকে মজার বিষয় হচ্ছে যে জহিরুলের সাথে আমার দা-কুমড়া সম্পর্ক, সেই জহিরুলও আজ আমার পাশে বসে ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁদে দিয়েছে। আমারও খুব খারাপ লাগছে কারন দীর্ঘ ৮ বছর যাদের সাথে নিজের জীবনের অনেক গুলো মুহুর্ত ভাগ করে নিয়েছিলাম তাদের থেকে আজ চলে যাচ্ছি অনেক দূরে।
বিকাল বেলায় জেলার স্যার আমার রুমে এসে আমাকে একদম জড়িয়ে ধরলেন, আমাকে আড়াল করে নিজের চোখ মুছলেন। এই জেলখানায় অনেক জেলার এসেছেন আবার বদলি হয়েছেন তবে মনির স্যার সবার থেকে আমাকে বেশি ভালবাসতেন কারন আমার পরিবার বলতে কিচ্ছু নেই। তাছাড়া আমার ব্যবহারের কারনে আমাকে অন্য চোখে দেখেন তিনি একথাটাও সবাই জানে।
পাশের বিল্ডিংএর মুকুল ভাইয়ের কবুতর গুলো আজ বারান্দা ছেড়ে উড়াতে বের হয়নি। একবার মুকুল ভাইয়ের বারান্দায় ১ টা আহত কবুতর এসেছিল, মুকুল ভাই কবুতরটাকে সুস্থ করে। তারপর জেলার স্যারকে বলার পরে জেলার স্যার তাকে আরো কবুতর এনে পালার অনুমতি দেন এবং এরপর থেকে মুকুল ভাইয়ের বারান্দায় এখন প্রায় ৩০ জোড়া কবুতর আছে।
প্রতিদিন বিকালে কয়েদীদের ১ ঘন্টার জন্যে খোলা মাঠে ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যান্য দিন সবাই এই সময়টায় খেলাধুলা বা গল্পগুজব করলেও আজ সবাই আমার পাশে এসে বসেছে গোল হয়ে। নিজেকে কুরবানির পশু মনে হচ্ছে। জবাই করার আগে যেমন পশুগুলোকে সমাদার করা হয় আমার ক্ষেত্রেও সেরকম কিছুই হচ্ছে। সবাই খুব কাদছে আমার জন্য। কেউ কেউ তো হঠাৎ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরছে। আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে বুকের একদম বাম পাশে। হঠাৎ করে চোখের কোনায় পানি চলে আসছে মাঝে মাঝে। সবাইকে লুকিয়ে পানি মোছার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে আমাদের এখানকার ইমাম রকিব ভাই এসে আমাকে নামাজ পড়ালেন। তারপর অনেক গুলো দোয়া পড়লাম তার সাথে। শুনলাম ওপাশে সব কিছু রেডি করাই আছে। রকিব ভাই বললেন
এইটুকু সময়ে যত পারো কলেমা পড়ে নাও।
রাত ১১:৩০ এ পুরো জেলখানায় কান্নার রোল পড়ে যায়। আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনেক সৃতিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি। পা দুটো আমার মস্তিষ্কের ইশারা শুনতে চাচ্ছেনা। কয়েদি নাম্বার ৪৪০ এর অস্তিত্ব কিছুক্ষণ পরেই হারিয়ে যাবে। আর কখনো আমি ছোট ভাই শিমুলের খাবার চুরি করে খেতে পারবনা।আর কখনো জহিরুলের সাথে আমার গেঞ্জাম হবেনা। শফিকের বাড়ি থেকে আসা আমার প্রিয় পায়েস আর খাওয়া হবেনা। আর কখনো সবার জন্যে রান্না করতে পারবনা। মনের সাথে যুদ্ধ করে হেটে চলেছি আর উপলব্ধি করছি আসলেই জীবন অনেক ছোট।
ফাঁসির মঞ্চে এসে পৌঁছলাম। শুনেছি এটা এই জেলখানার একদম নতুন ফাঁসির মঞ্চ। প্রথম ফাঁসি আমারই হচ্ছে। কতজনের ভাগ্যে এগুলো থাকে?
হাহাহা। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে জল্লাদ কবির ভাই আমার মুখে কালো কাপড় পরিয়ে দিলেন। কবির ভাইয়ের হাত কাঁপছিল বুঝতে পারছিলাম। তারপর হাত বাধা হলো। যখন ফাঁসির দড়ির নিচে নেওয়া হলো আমাকে তখন ইচ্ছে হচ্ছিল এগুলো সব ছিড়ে মনে প্রানে ছুটে পালাই। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
সামনে ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে সময় গুনতে শুনছি। ঘিড়ির কাটার টিক-টক টিক-টক আওয়াজটা কানের ভিতরে বিষ ঢালছে। ৩ ২ ১!!
তারপর ছ্যাত করে একটা শব্দ শুনলাম। আমার হাত পা ছটফট করতে লাগলো। দুই মিনিট পর নিচে নামানো হলো আমাকে। আমি সেগুলো চোখে দেখতে পাচ্ছি তবে কিছু অনুভব করতে পারছিনা। হাত পায়ের রগ কেটে ফেলা হলো। ওপাশ থেকে কালো একটি অবয়ব আমাকে ইশারা করছে। মরার পর মানুষের চোখ সচল থাকে ৭-৮ মিনিটের জন্যে। এইসময়টুকুতে আমি যা দেখার দেখে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সাথে সাথেই আমার চোখের সামনে কালো অন্ধকারে ছেয়ে যায়। ব্যাসস এটুকুই। তারপর আর কিছু ঠাওর করতে পারিনি।