somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তিথী এবং আমার প্রত্যাবর্তন।

২২ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৩:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

--থাবড়া চিনো, থাবড়া? একটা থাবড়া মেরে তোমার নাক একদম আমি ভচকায় দিবো, রাসেল।
-পান থেকে চুন খসলেই তুমি মারপিটের কথা তুলে আনো। খুবই খারাপ লক্ষণ।
-লেকচার দিবা না। খবরদার লেকচার দিবা না। ফোন রাখো। রাইট নাও, ফোন রাখো। আমি এখন এক থেকে তিন গুনবো, এর মাঝে ফোনের লাইন কেটে দিবা।
এক,
দুই,
পৌনে তিন এবং তিন......

তিথী নিজেই ফোনের লাইন কেটে দেয়। আমি মুঠোফোন হাতে নিয়ে একদম চুপ মেরে যাই। আসলেই এখন মুখে কুলুপ আঁটা ছাড়া কোন উপায় নাই। তিথী রেগে আছে সুতরাং এখন কোন ধরণের কথাই সে শুনবে না এবং ওকে ফোন করেও কোন লাভ হবে না। বাস্তবে আমাকে সামনে পেলে বিশাল এক রাম থাবড়া মারলে হয়তো ও শান্ত হবে। এর আগে আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আমাকে থাবড়া দেওয়ার পেছনের কারণ যে খুব বিশাল কিছু, ঠিক তা নয়। আজ দুপুরে জুমার নামাজ পড়ি নাই তাই এই পড়ন্ত বিকেলে তিথীর কাছ থেকে থাবড়া খাবার হুমকি শুনতে হচ্ছে।

আমি মুঠোফোনটা পকেটে রেখে হাঁটতে শুরু করলাম। আজ সকাল থেকে প'ড়ে প'ড়ে যখন টানা ঘুমাচ্ছিলাম তখনই মনে হচ্ছিলো, এত্ত আরামের ঘুম দিচ্ছি, এত সুখ কপালে সইলে হয়! এরপর দুপুরের দিকে মুঠোফোনে এলার্ম বাজতে শুরু করলো। উঠবো উঠবো, এই উঠি উঠি করেও আর বিছানা ছাড়া হলো না আমার। বরং আমি হাতড়ে হাতড়ে বালিশের নিচ থেকে মুঠোফোনের অস্তিত্ব আবিস্কার করে সেটাকে বন্ধ করে দিলাম। তারপর হালকা ঘুম ঘুম চোখে ঘরের চারপাশে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাবলাম এখন ওঠা দরকার। আলসেমি করা ঠিক হচ্ছে না। নামাজটাও পড়া উচিৎ। তারপর হঠাৎ মনে হলো, কী আছে জীবনে! আরেকটু ঘুমিয়ে নিই। ওই যে বলে না শর্ট ন্যাপ! শর্ট ন্যাপের ঠ্যালায় যখন চোখ খুলেছি তখন বেলা গড়িয়ে অনেকদূর। তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে সবার আগে মুঠোফোন অন করলাম। আর সাথে সাথেই টুনটুন করে বেশ কিছু মেসেজ এলো। মিসড কল এলার্টের মেসেজ। বিগত ক’ঘন্টায় তিথী মাত্র ৯৬ বার ফোন করেছে। নিজের বাপ দাদার চৌদ্দ গুষ্ঠির নাম মনে করতে করতে আমি বিরস বদনে হাত মুখ ধুতে চলে গেলাম। তিথী নিশ্চয় খুব ক্ষেপে আছে, অতিরিক্ত রাগে সে আমার বাপ-দাদার নাম ভুলিয়ে দিতে পারে। সুতরাং আগে থেকে নাম মনে করে রাখাই শ্রেয়।

তিথীকে ফোন করলাম আরো প্রায় মিনিট বিশেক পর। ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয়ে ওকে ফোন করে খুব মধুর গলায় বললাম-কেমন আছো আমার মেঘ রঙ! তার উত্তরে ও আমাকে থমথমে গলায় বলতে শুরু করে-থাবড়া চিনো, থাবড়া? একটা থাবড়া মেরে তোমার নাক আমি একদম ভচকায় দিবো, রাসেল...আমি মিনমিন করে বললাম--পান থেকে চুন খসলেই তুমি মারপিটের কথা তুলে আনো। খুবই খারাপ লক্ষণ।

২.

তিথির সাথে আমার পরিচয় হয় বছরখানেক আগে। রাব্বিকে নিয়ে নীলক্ষেতের গাউসুল আযম থেকে বের হয়ে ঢাকা কলেজের উল্টো পাশের মার্কেটে যাচ্ছিলাম কিছু টি শার্ট কিনবো বলে। কুরবানি ঈদের কিছুদিন আগের কথা। বেশ ভীড় রাস্তায়। মিষ্টির উপর পিপীলিকার দল যেভাবে লেপ্টে থাকে, ঈদের আগের সময়গুলো মানুষও ঠিক তেমন করে শপিং মল আর মার্কেটগুলোতে চিপকে থাকে। পিপীলিকার সারির দুজন বাসিন্দা হয়ে আমি আর রাব্বি কোন রকমে আগাচ্ছি। খুব সাবধানে আগাতে হচ্ছে, সামনে পেছনে মহিলা এবং বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের দীর্ঘ লাইন। বাই এনি চান্স যদি কারো গায়ে ফুলের টোকাও লাগে তাহলেই আমাদের সানডে মানডে ক্লোজ করে দিবে পাবলিক। আমি খুব সাবধানে রাব্বিকে শেল্টারে রেখে রেখে আগাচ্ছি আর মাঝে মাঝি বলছি- শালা, আজকের দিনে এখানে আসাটাই ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। রাব্বি একই কথা এতবার শুনেও মনে হয় বোর হচ্ছে না। সে মূলত এই লাইনে দাঁড়িয়ে গুটিগুটি পায়ে একটু একটু এগিয়ে যেয়ে মেয়ে দেখায় ব্যস্ত। লুইস আর কারে বলে! আমার বিরক্তি যখন চরম সীমানায় পৌছে গেছে তখনি আচমকা একটা ঘটনা ঘটলো। পেছন থেকে সবাইকে ঠেলেঠুলে বেশ দ্রুত ঝড়ের বেগে দৌড়ে একটা লোক চলে গেলো। তারপরেই শুনলাম আমার পেছনে কেউ বাজখাই গলায় বলছে- বেটাকে ধরেন। আমি হতচকিত হয়ে কী করবো বুঝে ওঠার আগেই অনুভব করলাম পেছনের বাজখাই গলার মেয়েটি ভীড় ঠেলে নিজেই সেই পালিয়ে যাওয়া লোকের পিছু নিয়েছে। মানুষজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। সেই লোক কী করেছে আমার আর বুঝতে বাকি থাকলো না। আমি গলা উঁচিয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে একটা বিচিত্র দৃশ্য দেখতে পেলাম। এক লোক বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার সবকিছু কে উপেক্ষা করে বিপদজনকভাবে পড়িমরি করে রাস্তা পার হচ্ছে।

রাব্বি এক গাল হেসে বলল-মাইয়ার স্পিরিট কী দেখসোস? পুরাই সুপারওম্যান। কেমন টর্নেডোর মত ঐ ফাযিল বেটারে ধাওয়া করলো। বেটা গাড়ীর তল থেকে, মরতে মরতে বাঁচছে। এরপর ভিড়ের মধ্যে আবারো কোন মহিলা বা মেয়ের সাথে বেদ্দপি করার আগে চিন্তা করবো। ভালোই ভয় পাইসে আজকে।

আমি বিস্মিত কন্ঠে বললাম-এতগুলো লোকের মধ্যে আর কেউ বেটারে ধরতে গেলো না?

-ধরতে কে যাইবো? কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তো বেটা ফুরুৎ হইয়া গেসে। শুধু ওই সুপারওম্যান ধাওয়া করসে।

আমি ডানে বামে মাথা নাড়তে থাকি। সামনে শত শত মানুষের মাথা দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমি কোন নরকের গভীর খাঁদে পা দিতে যাচ্ছি। কোন রকমে মার্কেটে ঢুকলাম। দোকানে দোকানে ঘুরতে শুরু করেছি কেবল, এমন সময় দেখি নীল জিন্স আর বেগুনী ফতুয়া পড়া এক মেয়ে কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বার কয়েক ভাবার চেষ্টা করলাম। মেয়েটা কে? আমি কী আগে একে দেখেছি? কোন এক জীবনের ক্র্যাশ ছিলো নাকি? এত এত ক্র্যাশের লিস্টে কেমনে একে খুঁজে পাবো? ভেবে চিনতে কূল কিনারা পাবার আগেই দেখি মেয়েটি আমার সামনে এসে কড়া গলায় বলছে-বলসিলাম না আপনাকে যে বেটাকে ধরেন? আপনার পাশ দিয়েই তো গেলো। একটা ল্যাং মেরে ফেলে দিতে পারতেন না, কিংবা কলার চেপে ধরতে পারতেন না বদমাশটার? রাস্তায় বের হলে কী অ্যাই বল দুটো পকেটে রেখে দেন? আর কানগুলোর ডোর শাট ডাউন করে রাখেন?

আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। ইনি হলেন রাব্বির সেই সুমারওম্যান, কিংবা বলা যায় আমার পেছনে থাকা সেই বাজখাই গলার স্বরের অধিকারিণী। আমি কিছুটা বিব্রত হয়ে ভদ্র গলায় বললাম-আমি আসলে বুঝতে পারিনি। ট্রুলি স্যরি।

-এখন স্যরি বলে কী হবে? ঐ বদমাশ বেটা তো পেছনের মহিলাটাকে হ্যারেজ করেই ফেলেছে। বেটাকে পাইলে ওর ঠ্যাং ভেঙে হাতে ঝুলায় দিতাম আমি। হারামি একটা...

রাব্বি পাশ থেকে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই উসখুস করছিলো এবার কথা বলেই ফেলল-এক্সকিউজ মী আপু, আমি আপনার সাহস দেখে মুগ্ধ। ইয়ে মানে আমি সাহসী মেয়েদেরকে খুবই এপ্রিশিয়েট করি। আপনার নামটা?

-আপু বলছেন কেন? থমথমে গলায় বলল মেয়েটা। আমাকে কী আপনার চেয়ে বয়সে বড় মনে হয়? নাকি আপু বলে বোঝাতে চাইছে যে আপনি নারীদেরকে বড্ড সম্মান করেন। এতই যদি সম্মান করেন তাহলে একটু আগে যখন একটা বিদেশী মেয়ে যাচ্ছিলো তাঁর দিকে ওমন ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে ছিলেন কেন?

আমি বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে রাব্বির দিকে থাকালাম। এত বড় একটা কট খাবার পরে ওর যে এক্সপ্রেশন হবে আমি সেটা কিছুতেই মিস করতে চাই না। রাব্বির চেহারা দেখে মনে হলো কিছু মুহূর্তের জন্যে ও পঙ্কজ উদাসের ছোট ভাই জুনিয়র উদাস হয়ে গিয়েছে। কেমন উদাস উদাস দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাচ্ছে যেন মেয়েটার কথা বুঝতে পারে নাই।

মেয়েটা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল-মানুষ মানুষের জন্যে কথাটা জানেন তো? কিন্তু শুধু জানলে হবে না। মানতেও হবে এবং প্রয়োগও করতে হবে। তারপর গটগট করে হেঁটে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো। আমি আর রাব্বি দুজনেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। মেয়ে তো নয় যেন মূর্তিমান বিভীষিকা! রাব্বিকে শুধু একটা কথাই বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম-“ছোট মরিচের ঝাল বেশি”।

৩.

সেই থেকে আমি তিথীকে চিনি। এ ঘটনার কিছুদিন পরেই আবিস্কার করি তিথীর বাসা আমাদের পাশের এলাকায়। পরিচিত হতে এরপর আর সময় লাগেনি। সাদামাটা চেহারার বদমেজাজি, প্রচণ্ড আত্নবিশ্বাসী এই মেয়েটিকে আমার প্রথম দিনই ভালো লেগে গিয়েছিলো। জীবনে কোনদিন কোন মেয়ের সামনে এসে নিজেকে অসহায় বা কম বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বলে মনে হয়নি। শুধুমাত্র তিথীই এর ব্যতিক্রম। তিথীর সামনে আসলেই আমার সব কথা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। গা ঘামতে থাকে। ভবঘুরে আর বাউন্ডুলে এই আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ ধমক ধামক দিয়ে সাফল্য লাভ করতে পারেনি শুধুমাত্র তিথী বাদে। পরিচয়ের প্রায় মাসখানেক পরেই আমি বুঝতে পারলাম তিথীর প্রতি ভালোলাগাটা হিপোপটমাসের মত তীব্র আকার ধারণ করে অনুরাগ বা প্রেমের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বেশ ক’বার ভাবলাম নাহ, এই কথা তিথীকে বলে নিজের ঠ্যাং ভাঙ্গার ব্যবস্থা করে পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কোনই মানে হয় না। কিন্তু ওই যে কথায় বলে না, প্রেমে পড়লে মানুষের মনে বসন্তের প্রজাপতি উড়াউড়ি শুরু করে। আমার মনে প্রজাপতির উড়াউড়ি না শুধু, রীতিমতো হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেলো কিন্তু তিথীর সামনে গিয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করলেই হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যেত, মাথা ফাঁকা হয়ে যেতো। নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা মনে হতো। মাথায় শুধু একটা হাস্যকর গানের লাইন ঘুরতো- “girl when you are around, my world goes upside down…”

তিথীকে আমি আমার ভালোবাসার কথা বলেছিলাম একদিন সন্ধ্যায় ছবির হাটের পাশে টঙের দোকানে চা খেতে খেতে। বেশ ক’বার মনের কথাগুলো সাজিয়ে নেওয়া চেষ্টা করতে করতে এক সময় আবিস্কার করলাম আমি গলা খাঁকারি দিয়ে মিনমিনে গলায় বলছি-আচ্ছা মানে তিথী... তুমি আর আমি...মানে আমি আর তুমি আর কী... একসাথে থাকি কী বলো?

তিথী নির্বিকার ভঙ্গিতে সশব্দে চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলল- একসাথে থাকবে কীভাবে? আমি আমার বাসা থেকে আমার সব কিছু নিয়ে এসে তোমার বাসায় উঠে পড়বো? এইটাই বলতে চাও?

সাথে সাথেই আমার গলা শুকিয়ে গেলো আমি কোনক্রমে ঢোক গিলে বললাম-না না... তা হবে কেন? বলতে চাইছিলাম। মানে তুমি আর আমি এবং আমি আর তুমি...এখন থেকে আর এভাবে না থাকি... আমি আবারো কথা হারিয়ে ফেললাম।

তিথী এবার আমার কথা না শোনার ভান করে চায়ের কাপে তার সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দিলো। আর এদিকে আমি মনে মনে নিজেকে সহস্র লাথিএবং গালি দিতে থাকলাম। আমার মনে হলো আমি তিথীর সামনে থেকে পালিয়ে যাই। ধুৎ কেন যে বলতে গেলাম এসব। এখন নিশ্চয় এই প্রেম নিবেদনের চিপায় পড়ে বন্ধুত্বটাকেও হারাতে হবে।

আমি চুপচাপ বসে আছি। তিথী বেশ সময় নিয়ে চা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত সুন্দর করে হেসে বলল-আমি মানে তুমি আর তুমি মানে আমি টাইপের বস্তাপঁচা কথাগুলো আরো মাসখানেক আগেই বলতে যখন থেকে অনুভব করা শুরু করেছ। Jack of all traits হতে গিয়ে তুমি আসলে master of none হয়ে যাচ্ছ বুঝলে?

তিথী শব্দ করে হাসছে। আমার মাথা ঝিমঝিম করা শুরু করেছে। মনে হচ্ছে ছবির হাটের ল্যাম্পগুলোর কমলা রঙের আলো আর তিথীর হাসি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি, মনে হচ্ছে আমার জীবনে আজ পর্যন্ত পছন্দ করা বা ভালো লাগা সব মেয়েদের চেহারা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে; শুধু তিথীর চেহারা আর তিথীর হাসি একটু একটু করে ভোরের আলোর মতো উজ্জ্বল আর স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করছে-

"জগতে সকলেই মিথ্যা, সব মায়াময়, স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়।"

আমি দেখেছি মানুষে মানুষে দুরত্ব কমে আসলে সংকট বৃদ্ধি পায়। মুগ্ধতা কমে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে কেটেও যায়। কিন্তু তিথীর ব্যাপারে আমার সাথে এমন কিছুই হলো না। তিথীর সাথে আমার সম্পর্ক গন্তব্যহীন এক ট্রেনের মত কু ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ছন্দ তুলে অবিরাম চলতে থাকলো।

এরমাঝে একদিন রাব্বিকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানালাম। স্টার কাবাবে কাচ্চিও খাওয়ায় দিলাম। দুই প্লেট কাচ্চি খেয়ে, দৈ খেয়ে, সাথে গোটা তিনেক পেপসি গিলে রাব্বি আমাকে অবশেষে জানালো তিথী আমার টাইপের মেয়ে না। এই সম্পর্ক টিকবে না। ওর ভাষ্যমতে, অতি দ্রুত এই পাখি পালাবে। আর আমি কিছুই করতে পারবো না। আমি রাব্বির কথায় পাত্তা দিলাম না। শালা জেলাস। মনে মনে হিংসায় পুড়ে কাবাব হয়ে যাচ্ছে অথচ মুখে মাখন মার্কা হাসি দিয়ে রাখসে। তবে বাসায় আসার পথে রাব্বির কথা ভাবালো বেশ। “অতি দ্রুত এই পাখি পালাবে” কথাটা কেন জানি হজম হচ্ছিলো না। বার বার কানে বাজছিল।
৪.উ
তিথীর সাথে দুরন্ত সময় কাটছিলো। সেই সাথে ভার্সিটির পড়ালেখায় আগের চেয়েও বেশ মনযোগ দিয়েছিলাম। মানুষ হতে শুরু করেছিলাম আর কী। সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে- মানুষ আর বাদ যাবে কেন? তিথীর কাছ থেকে শিখেছিলামও অনেক কিছু। এই মেয়ে জন্মদিন উপলক্ষে কোন গিফট নেয় না। বরং সবার কাছ থেকে নগদ টাকা নেয়। প্রথমে ভেবেছিলাম এই টাকা দিয়ে কি করবে? শপিং করবে নাকি? আমার মোটা চিন্তাকে ভুল প্রমাণিত করে তিথী তার জন্মদিন উপলক্ষে পাওয়া টাকা দিয়ে অনেকগুলো বই কিনে একটা এতিমখানার লাইব্রেরীতে দান করেছিলো। রোড এক্সিডেন্টে আহত হওয়া ইডেন কলেজের এক ছাত্রীর জন্যে টানা দু সপ্তাহ ব্লাড জোগাড় করতে দেখেছি ওকে। টিএসসি তে ছয়জন পথশিশু কে নিয়ে একটা গ্যাং ছিলো তিথীর। গ্যাং-এর নাম ছিলো "গ্যাং সিক্স"। এই পথ শিশুগুলোকে বিনা বেতনের স্কুলে পড়ানোর জন্যে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলো তিথী। পিচ্চিগুলো তিথীকে ডাকতো “মাদার”। পুরান ঢাকা থেকে মামুনের তেহারি এনে গ্যাং সিক্সের মাঝে দিয়ে দিতো ও। “মানুষ মানুষের জন্যে” কথাটা তীব্রভাবে বিশ্বাস করতো তিথী। একসময় আমি আবিস্কার করলাম ওর সাথে থেকে থেকে জীবনবোধ বদলে গেছে আমার। গ্যাং সিক্স আমাকে ডাকা শুরু করেছে- “ফাদার” আমি অনুভব করলাম এক জীবন কেন তিথীর সাথে শত শত জীবন পার করলেও আমি ক্লান্ত হবো না। কোন দিনই না......

এর কিছুদিন পর থেকে মাঝেমাঝে তিথীকে অন্যমনস্ক দেখতাম। সব সময় হৈ হুল্লোড় করা তিথী যেন মাঝে মাঝে নিজের ট্র্যাক হারিয়ে ফেলতো। ওকে আমি জিজ্ঞেস করতাম কী হয়েছে? বাসায় কোন সমস্যা? মন খারাপ নাকি? ও সব সময়ই হেসে আমার কথা উড়িয়ে দিতো। আমিও আর ওকে ঘাঁটাতাম না। ভাবতাম মুড ভালো হলে ও নিজেই আমাকে সব বলে দিবে। অথচ একদিন হুট করেই কোন কিছু না জানিয়ে তিথী গায়েব হয়ে গেলো। হ্যাঁ জলজ্যান্ত তিথী গায়েব হয়ে গেলো। মুঠোফোন বন্ধ। ওর বাসার বিল্ডিং চিনলেও ফ্ল্যাট চিনতাম না। নিজের পরিবারের ব্যাপারে তেমন কিছু বলেওনি কোন দিন। ওর বাবা দেশের বাইরে আছেন, ও বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান এটুকুই শুধু জানতাম।তিথী হঠাৎ সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় আমি বিহ্বল হয়ে গেলাম। তিথীদের এপার্টমেন্টে রাব্বির পরিচিত এক পাড়াতো ছোট বোন ছিলো তার মাধ্যমে জানতে পারলাম, তিথীর খুব বড় কোন পারিবারিক সমস্যা হয়েছে। ও দেশের বাইরে গিয়েছে। খুব সম্ভবত ওর বাবার কাছে। কবে দেশে ফিরে আসবে কেউ জানে না। ওর মা নাকি অনেক আগে তিথী আর ওর বাবাকে ফেলে আলাদা হয়ে চলে গিয়েছিলেন। তিথী এখানে থাকতো ওর এক ফুপির সাথে।

তিথীর খবর জেনে মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো আমার। উদ্ভট এবং আবল তাবল সব চিন্তা মাথায় কাজ করতে শুরু করলো। আবোল-তাবোল ভাবনাগুলোর অবশ্য একটা সুন্দর বৈশিষ্ট্য আছে। সেগুলো হুট করে আসে আবার হুট করে মিলিয়ে যায়। আমার প্রাথমিক রাগ, ক্রোধ সব মিলিয়ে গিয়ে একসময় আমার মধ্যে থেকে গেলো শুধুই বিষণ্ণতা। দিন পেরিয়ে মাস হয়ে গেলো। রাব্বি অনেকবার চেষ্টা করলো আমার মধ্যে আগের সেই রাসেলকে ফিরিয়ে আনতে। আগের রাসেল অর্থাৎ তিথীকে চেনার আগে আমি যেই রাসেল ছিলাম। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম আগের রাসেলের রুপান্তর ঘটেছে। আমি চাইলেও সেই রুপে আর ফিরে যেতে পারবো না। কিংবা হয়তো আমি চাইও না ফিরে যেতে।

৫.

কংক্রীটের পোড়ামুখো জীবন চলছে নিজের গতিতে। এদিকে তিথীকে হারানোর আট মাস হয়ে গিয়েছে। আমি বদলে গেছি। নিজেকে আমি আর খুঁজে পাবো এমন কোন আশা আমি রাখি না। এই শহর সারাদিনে আমার ভেতরে অজস্র ধূলিকণা ঢুকিয়ে দেয় আর আমি সেগুলো প্রতিদিন ধারণ করি। যেমন আছি, এই তো বেশ আছি। গতমাসে নিজের জন্মদিন উপলক্ষে পাওয়া গিফটের সব টাকাগুলো দিয়ে গ্যাং সিক্স-দেরকে নতুন ক্লাসের নতুন বই আর শীতের জন্যে গরম জামাকাপড় কিনে দিয়েছি। ওদের “ফাদার আর মাদার” দুটোই এখন আমি। মাঝে মাঝে সময় পেলে ওদের সাথে সময় কাটিয়ে আসি। সপ্তাহে দু দিন ঢাকার বাইরের একটা সাদামাটা এবং গরিব স্কুলে গিয়ে নিজ গরজে পড়িয়ে আসি। ছেলেমেয়েগুলোর চোখ দিয়ে স্বপ্ন দেখতে অনেক ভালো লাগে। খুব বড় একটা প্ল্যান কাজ করছে মাথায়। “মানুষ মানুষের জন্য” কনসেপ্টকে ঘিরে অনেক ভালো কিছু করার উদ্যোগ নিতে হবে আমাকে। জীবনে করার মত যে কত কিছু আছে তিথী দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছে আমাকে। ভালো কাজ করে আর মানুষের পাশে থেকে তাদের মাঝেই তিথীকে খুঁজে নিতে চাই আমি। বেশ অনেকদিন হল তিথীর ফুপিরা বাড়ি বদলে অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন। তিথীর আর কোন খবর আমি পাইনি। তবুও মাঝে মাঝে গভীর রাতে যখন তিথীকে প্রচণ্ড মনে পরে তখন ওদের পুরনো বাড়ির সামনে গিয়ে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। আমার মন তখন আর ছটফট করে না। শান্ত হয়ে আসে।

***
-রাসেল, এই রাসেল দেখো আমি তোমার জন্যে একটা সাইকেল কিনেছি। এখন থেকে যেখানেই যাবে সাইকেল চালিয়ে যাবে। এতে যাতায়াত খরচ বাঁচবে, ব্যায়াম হবে এবং পরিবেশ দুষণও হবে না।
-আমি সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাবো?
-অবশ্যই যাবে। তোমাকে তো ঠ্যালাগাড়ি চালিয়ে অফিসে যেতে বলছি না। নাকি সাইকেল বাদ দিয়ে ঠ্যালাগাড়ি কিনে দিবো? বলো...বলো...
- আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সাইকেল চালিয়েই অফিসে যাব। কিন্তু তোমার সাথে দেখা করতে আসলে কি হবে বলো তো। রিকশায় তো আর পাশাপাশি বসতে পারবো না আমার সাইকেল নিয়ে বের হলে।
-হাহ, রিকশায় আমি একা থাকবো আর তুমি সাইকেল চালিয়ে পাশে পাশে যাবে। তারপর কোন কফিশপের বাইরে সাইকেল রেখে আমরা গল্প করবো আর কফি খাবো... কী আইডিয়াটা কেমন?
-ইয়ে মানে... আসলেই একটা অভিনব আইডিয়া।
-কালই আমরা এভাবে কফিশপে যাবো। বুঝলা?
-অবশ্যই অবশ্যই...কালই যাবো।

শীতের ক্ষণস্থায়ী বিকেল। ব্যস্ত নগরী। শেষ বিকেলের চঞ্চল সোনালী রোদটা বার বার সবুজ গাছের পাতাগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তিথী রিকশায় বসে হুড খুলে আমার সামনে ঠিক কয়েক গজ দূরে চলে যাচ্ছে। বাতাসে তিথীর চুল উড়ছে। তিথী একটু পর পর পেছনে তাকিয়ে আমাকে দেখছে আর একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। আমি প্রাণপণে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিচ্ছি। তিথীর রিকশার পাশে পাশে আমাকে চলতে হবে। তিথী আবারো পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। আমি চেঁচিয়ে তিথীকে বললাম-"মেঘ রঙ, আমি আসছি..."

শেষ বিকেলের সোনালি রোদ বার বার তিথীকে স্পর্শ করছে। তিথীর চেহারাটা একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি জানি আমি স্বপ্ন দেখছি কিন্তু আমার জাগতে ইচ্ছে করছে না। শুধু বারবার বলতে ইচ্ছে করছে- "তিথী, আমি খুব ভালো আছি। বেঁচে আছি। তুমিও ভালো থেকো। বেঁচে থেকো।"


সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৩:১৩
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×