somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা এবং কিঞ্চিৎ বিয়োগান্তক অনুরণন

৩০ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ১১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ফার্মগেট।

তেজকুনিপাড়ার প্রবেশমুখ থেকে আনুমানিক ১০০ গজ উত্তরের ফুটপাতে কিঞ্চিৎ জটলা। শিশুর কান্না শুনে এগিয়ে যায় তানহা। একটি শিশুকে ঘিরে মানুষের ভিড়। ৮/৯ বছরের একটি মেয়ে। পড়নে ফ্রক এবং হাতে একটি পলিথিনের শপিং ব্যাগ। মেয়েটি চিৎকার করে বলছে,

“আমি মার কাছে যামু, ও মাগো তুমি কই?”

আশেপাশের মানুষদের কাছ থেকে জানা গেলো বেচারি হারিয়ে গেছে। মুহূর্তেই ভিড় বাড়ছে। আশেপাশের মানুষজন বিক্ষিপ্তভাবে ওকে প্রশ্ন করছে- কি হইছে, বাড়ি কই, সাথে কে ছিল ইত্যাদি। এত মানুষের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে আরও ভীত হয়ে আর্তচিৎকার করছে। তানহা এগিয়ে গিয়ে বিক্ষিপ্ত প্রশ্নমালা থামিয়ে দেয়। তারপর শিশুটির মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করে-

“আপু, কি নাম তোমার?”
বাচ্চাটি তানহার দিকে তাকায়। তারপর বলে-
“মুক্তা”
“বাসা কোথায়?”
“বউরানুদ্দি”
তানহা বুঝতে পারেনা। আবার জিজ্ঞেস করে। শিশুটি একই উত্তর দেয়। তখন পাশের এক ভদ্রলোক বলে-
“কি, বোলা বউরানুদ্দি ?”
এবার শিশুটি বলে, “জে”

তানহা বুঝতে পারে মেয়েটির বাড়ি ভোলার বোরহানুদ্দিন। ও এবার জিজ্ঞেস করে-

“এখানে আসছ কোথায়?”
“আঙ্কলগো বাইত”
“তোমার আঙ্কেলের বাসা কোথায়?”
“সাততলাত থাহে, পাকা মসজিদের সামনে”
“মানে এলাকাটার নাম কি?”
“জানিনা, সামনে একটা মাংসের দোয়ান আছে।”
“কারও মোবাইল নাম্বার আছে?”
“না”

তানহা ভাবছে, ভারী মুশকিলের ব্যাপার।ফার্মগেটের হাজার হাজার মানুষের মাঝে ওর মাকে কিভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে।

“তোমার আঙ্কেলের নাম কি? উনি কি করেন?”
“কবির,হেইতের জুতার দোয়ান।”
“দোকানটা কোথায় বলতে বলতে পারবা?”
“ভাই,মার্কটো।”
“কোন মার্কেট,জানো?”
“না।”
“আপু,তোমার সাথে কে ছিল?”
“আঙ্গ মায়,আমার বইনে,ভাই,বইনঝি,খালায় আছিল... ভাই আমি মার কাছে যামু”

তানহা বুঝতে পারছে না কি করবে। এর মাঝেই সুদর্শনা দুই তরুণীর আগমন। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী তরুণী ভীতবিহবল মেয়েটিকে কাছে টেনে নিলো। ওকে আশ্বাস দিল মাকে খুঁজে দিবে।

“তোমার বাসা কোথায় আপু?”
“ পাকা মসজিদের সামনে।”
“আসো আমার সাথে, এখানে একটা মসজিদ আছে, দেখোতো এইটা নাকি?” এই বলে তাঁর সাথে নিয়ে গেলো। তানহা তরুণীদ্বয়কে বলল-

“আমি কি আপু, আপনাদের সাথে থাকতে পারি?”
কনিষ্ঠ তরুণীর উত্তর –
“আসুন।”

গলির পাশেই তরুণীদের বাসা। সেই বাসা ছাড়িয়ে একটা মসজিদের সামনে এসে জিজ্ঞেস করল-
“এটা?”
“না”

এদিকে চারতলার ফ্ল্যাট থেকে তরুণীর মা বারবার ফোন দিচ্ছে তাঁকে চলে আসার জন্য। তরুণী বলছে, বাচ্চাটির মাকে খুঁজে বের করেই ও চলে আসবে। তরুণীর মায়ের কথা- বাচ্চাটিকে যেখানে পাওয়া গেছে,সেখানেই রেখে আসা উচিত। তাছাড়া তরুণী যেহেতু একজন মেয়ে,সুতরাং সে বেশি কিছু করতে পারবেনা।

কিছুক্ষনের ভেতর আবারও জটলা। এর মধ্যেই শিশুটির বর্ণনা শুনে কয়েকজন আনুমানিকভাবে একমত হলেন মসজিদটি তেজকুনিপাড়া বড় মসজিদ। অনেকে আবার বললেন ছাপড়া মসজিদও হতে পারে । যাইহোক উৎসাহী কয়েকজন স্থির করলেন শিশুটিকে নিয়ে ওখানে নিয়ে যাওয়া উচিত। এদিকে শিশুটিতো তরুণীকে ছাড়বেইনা। তরুণীও মেয়েটিকে পথচারীদের হাতে ছাড়তে চাচ্ছিলনা। কিন্তু এই রাতের বেলা কিইবা করতে পারবে সে। তারপরও বলল-

“ঠিক আছে নিয়ে যান। ওর মাকে খুঁজে না পেলে এই বাসায় নিয়ে আসবেন। দয়া করে থানায় দিবেননা।” বলতে বলতে সে কেঁদেই ফেলল।
তানহা ভাবছে,সত্যিই বাঙালী নারীর মমত্ববোধের কোন তুলনা হয়না। অজানা অচেনা একটি শিশুর জন্য এরকম দুশ্চিন্তাগ্রস্থ নিষ্পাপ কান্না এই দেশের নারীদের পক্ষেই বোধহয় সম্ভব।

শিশু মুক্তাকে একরকম জোর করেই তাঁর ‘আফা’র কাছ থেকে নিয়ে বড় মসজিদপানে যাত্রা শুরু হল। পঞ্চাশ গজ না এগোতেই তরুণী দৌড়ে এসে বলল-

“যারা সাথে যাচ্ছেন তাদের কারও একজনের ফোন নাম্বারটা দয়া করে দিন, আমি ওর খোঁজ নিবো”
তানহা ওর নাম্বার বলতে যাবে,তখনি আরেকজন দ্রুত বলে উঠলো – ০১৯১৩ .........।

বড় মসজিদে এসে দেখা গেলো এটা মুক্তার আকাঙ্ক্ষিত পাকা মসজিদ নয়। তারপর একে একে তেজকুনিপাড়া,নাখালপাড়া,মনিপুরীপাড়ার প্রতিটি মসজিদ,মাংসের দোকান এমনকি বর্ণিত সাততলা বাড়িও খুঁজে দেখা হলো। কিন্তু হদিস মিললনা। আশেপাশের এলাকাতে খুঁজে দেখার কারণ হলো, ও বলেছিলো হেঁটে ফার্মগেটে এসেছে। তারমানে আশেপাশের কোথাওই হবে।

ইতিমধ্যে আশেপাশের বেশকিছু মসজিদে ঘটনাটি প্রচার করা হয়েছে এবং ফোনে পরিচিতদের দ্বারা ফার্মগেটের আশেপাশে যতদূর সম্ভব বিস্তার ঘটানো হয়েছে। রাত তখন ১০টা বেজে ৩৩ মিনিট। সিদ্ধান্ত হলো একটি মাইক নিয়ে ফার্মগেটের আশেপাশে জানানো হবে। বাচ্চা মেয়েটি এর ভেতর কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছে। এক ফোঁটা পানিও কেউ খাওয়াতে পারেনি। মাকে না পেলে ও পানি খাবেনা। আল্লাহর কাছে বারবার প্রার্থনা করছে-
“আমার মারে আইনা দাও আমি ১০ রাকাত নমাজ পরমু।
মাইকের ব্যবস্থা করতে দুজনকে পাঠানো হল। কনিষ্ঠা তরুণী ইতিমধ্যে পাশের লোককে চারবার ফোন দিয়েছে। মুক্তার জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ওই তরুণী বাসায় থেকেও যেন আমাদের সাথেই আছে।

একটি ফোন এলো। জানা গেলো ফার্মগেটে এরকম একটি শিশুর সন্ধানপ্রার্থীকে পাওয়া গেছে। তাঁরা মানুষজনের কাছে খোঁজ পেয়ে ওই তরুণীর বাসার নিচে অপেক্ষা করছে। আবার সেই বাসার নিচে সবাই মিলে যাত্রা।
বাসার নিচে মানুষের ভিড়। তরুণীদ্বয়ের সাথে কনিষ্ঠার মাও এবার আছেন। শিশুটির ব্যাগটি ছিল তানহার কাছে। তরুণীদ্বয় এসে ব্যাগ চেক করে দেখল চামচ আছে কিনা। কেননা মুক্তার খালার মতে ওর ব্যাগে সদ্য কেনা চামচ ছিল। চামচ পেয়ে ওরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

কান্না। সুখের কান্না,মিলনের কান্না। তরুণীর মা মুক্তার মা ও খালাকে ঈষৎ বকাঝকা করলেন। এভাবে বাচ্চাটির হাতছাড়া হওয়া তাদের কাণ্ডজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা হিসেবেই উল্লেখ করলেন।

এবার তানহার যাবার পালা। ওর বাসা খানিকটা দূরে। রাতও একেবারে কম হয়নি। শিশুটির কাছ থেকে বিদায় নিল। তাঁর স্বজনদের কাছ থেকেও। কনিষ্ঠা তরুণীকে ধন্যবাদ জানালো সে। বিনিময়ে ঈষৎ লজ্জিত হাসি উপহার দিলো তরুণী। সাধারণ হাসি নয়। পাগল করা হাসি।
“হায় এই হাসিটি না দিলেই কি হতোনা, এর আগপর্যন্ততো ভালই ছিলাম...” ৬ নাম্বার বাসে করে ফিরতে ফিরতে ভাবছে তানহা।

আচ্ছা, মুক্তাতো তাঁর স্বজনদের কয়েকঘণ্টার ব্যবধানে ঠিকই ফিরে পেলো কিন্তু তানহা কি কিছু হারালো?

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১:৪০
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×