somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দাবায় প্রত্যাবর্তন

০৪ ঠা মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শৌখিন লেখকদের সমস্যা হলো তাদের দিয়ে জোর করে কোনো কিছু লেখানো যায় না। লেখালেখিটা নির্ভর করে তাদের মেজাজ মর্জির উপর। আর এই মেজাজ মর্জির অনিচ্ছার কারনে বেশ কিছুদিন লেখালেখি থেকে দূরে ছিলাম। যাহোক উনি আবার সহৃদয় হওয়াতে ফিরতে পেরেছি। কি লেখা যায়? ভেবে দেখলাম আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনার কথাটাই লিখি। যেটা সুযোগ পেলেই আমি সবাইকে বলি এবং বলে খুব গর্বও অনুভব করি।
২০০৫ সালের কথা। সেই সময় আমার খেলার অবস্থা তথৈবচ। ৪ বছর আগে ফিদে মাস্টার খেতাব অর্জনের সময় রেটিং ছিল ২২৭৬। সেই রেটিং বানরের তৈলাক্ত বাস বাওয়ার মতো উঠা-নামা করতে করতে ২০০৫_এ এসে ঠেকেছে ২২৪৬_এ। এর মাঝে টানা ২ বছর আবার জাতীয় খেলোয়াড় হতে পারিনি। খেলোয়াড়দের জীবনে উত্থান-পতন থাকেই কিন্তু আমার খারাপ সময় আর কাটছিল না। সবকিছু ফেলে দাবাকেই আপন করে নিয়েছিলাম কিন্তু দাবা যেন আমাকে আর চাচ্ছে না। বয়সও তখন কম হয়নি। তাই কিছু একটা প্রমান করার তাগিদ অনুভব করতাম সবসময়। অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম সামনে মাত্র দুটো পথ খোলা আছে, হয় নিজেকে দ্রুত প্রমান কর আর নয়তো অন্য পথ দেখো। দাবাড়ুদের অন্য পথ দেখার সহজ মানে দাড়ায় জীবিকার সন্ধানে কোনো উন্নত দেশে পাড়ি জমানো। দ্বিতীয় পথটা বেছে নেওয়া আমার জন্য ছিল খুব কষ্টকর কারন আমার জগত জুড়ে ছিল শুধুই দাবা, দাবাই আমার প্রেম, দাবাই আমার ধর্ম। তাই পথ আসলে একটাই ছিল “হয় কিছু কর নয়ত মর”।
প্রতি বছর ইউকে’তে ব্রিটিশ চেস চ্যাম্পিয়নশিপ এর পাশাপাশি মেজর ওপেন নামে একটা দাবা প্রতিযোগিতা হয় যেখানে ২৩৫০ এর নিচের খেলোয়াড়রা খেলতে পারে। আমি আর আমিন ভাই (ফিদে মাস্টার খন্দকার আমিনুল ইসলাম) তখন “মুক্তিযোদ্ধা সংসদ” এর খেলোয়াড়। ক্লাবকে বুঝালাম যে এই প্রতিযোগিতায় আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে, আর সেটা হতে পারলে ক্লাবেরও একটা সুনাম হবে। উনারা বুঝতে পেরে আমাদের টিকেট এর টাকা দিতে রাজি হলো। তাদের ভরসায় সব প্রস্ততি যখন সম্পন্ন করলাম তখন তারা বেঁকে বসলো, কে বা কারা তাদের বুঝিয়েছে আমরা টুর্নামেন্টও খেলবো না এবং দেশেও ফিরব না। কিন্তু টাকা না পেলেও আমাদের আর পিছু ফেরার সময় ছিল না, তাই সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত খরচেই আমরা ইংল্যান্ড এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কথায় আছে না, “বিপদ যখন আসে তখন তার ডালপালা সাথে নিয়েই আসে”। আমাদেরও বিপদ পিছু ছাড়ছিল না। দুবাইতে যাওয়ার পর বাংলাদেশ বিমানের তথাকথিত টেকনিক্যাল প্রবলেম এর কারনে আমাদের ফ্লাইট ১ দিন পিছিয়ে গেলো । আমরা ছিলাম একদম টাইট শিডিউলে, তাই ১ দিন পিছিয়ে যাওয়ায় আমাদের প্রথম রাউন্ড বাই দিতে হলো। এরপর না ঘুম, না খাওয়া এই অবস্থায় প্রথমে লন্ডন, তারপর সারারাত বাস জার্নি করে লিভারপুল, সেখান থেকে জাহাজে আড়াই ঘণ্টার ভ্রমন শেষে আইল অফ ম্যানে পৌঁছলাম। আমাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা তখন অবর্ণনীয়। ব্রিটিশ চেস ফেডারেশনের এর বদান্যতায় ২য় রাউন্ড আমরা নিজেদের মধ্যেই খেলে ড্র করে নিলাম। থাকার জন্য খুজতে লাগলাম সবচেয়ে কম খরচের হোটেল। কিন্তু আইল অফ ম্যান আসলে খুবি ব্যায়বহুল একটা পর্যটন এলাকা, অনেকটা আমাদের দেশের সেন্তমার্টিনের মতো। তাই আমরা যা আন্দাজ করেছিলাম তার চেয়েও প্রায় দিগুন ভাড়া দিয়ে হোটেল ঠিক করতে হল। হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়েই এক ঘুম দিলাম, উঠলাম পরদিন সকালে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি তখন অন্য মানুষ। মনে হচ্ছিল আমি যেনো স্বর্গে চলে এসেছি। হোটেলের সাথেই ছিল সমুদ্র, সমুদ্রের অতল গভীরে আমার সব টেনশন, ক্লান্তি, দুঃখ,ক্ষোভ যেনো নিমিষেই হারিয়ে গেল। অসাধারন সুন্দর লাগছিলো সবকিছু। ৩য় রাউন্ডে আমরা দুজনেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল খেলোয়াড়দের সাথে ড্র করে ফেললাম। খেলা শেষে রুমে ফিরে আমাদের ২ জনের টাকা একসাথে করে হিসেব করে দেখি সব মিলিয়ে আমরা ৫ দিনের বেশি কোনো অবস্থাতেই থাকতে পারিনা আবার খেলাতে পয়েন্টও ৩ খেলায় মাত্র ১.৫। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ৫ দিন পরেই দাবাকে বিদায় জানিয়ে চলে যাবো স্কটল্যান্ডে আমাদের সিনিয়র খেলোয়াড় মিন্টু (সাবেক জাতীয় রানার-আপ আলী আমজাদ মিন্টু) ভাইয়ের কাছে। জাহাজের টিকেটও কেটে ফেললাম প্লান মতো মিন্টু ভাইকে ফোন দিয়ে সবকিছু জানালাম। উনি সব শুনে প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেন, সাথে সাথে ২০০ পাউন্ড পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, টুর্নামেন্ট শেষ না করে কোথাও যেনো না যাই। হঠাত করেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো। এখন শুধু খেলার দিকে মন। কি যে আনন্দ লাগছিলো খেলতে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এর প্রভাব পড়লো খেলাতেও। ৩ খেলায় ১.৫ পয়েন্ট নিয়ে খেলতে নেমে টানা ৫ খেলা জিতে ৮ খেলায় ৬.৫ নিয়ে শীর্ষে চলে আসলাম। এরপর ৯ম রাউন্ডে ড্র এবং ১০ম রাউন্ডে ইউক্রেনের আন্তর্জাতিক মাস্টার পিটার মারুজেনকোকে পরাজিত করে আমার টুর্নামেন্ট জয় নিশ্চিত করে ফেললাম। শেষ রাউন্ডে ড্র করে ১১ খেলায় ৮.৫ পয়েন্ট পেয়ে আমি “ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ ২০০৫” এর মেজর ওপেন গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হলাম। প্রাইজমানি হিসেবে বাংলাদেশি টাকায় পাই দেড় লক্ষ টাকা। সবচেয়ে বড় পাওয়া আরেকবার সুযোগ পেলাম দাবাকে নিজের পথ হিসেবে বেছে নেয়ার। এইবার দাবাও আমার থেকে আর মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। হিন্দিতে একটা কথা আছে, “দেনে ওয়ালা জাবভি দেতা, দেতা ছাপ্পর ফারকে”। দেশে ফেরার পর আমার ভাগ্যের তালা যেনো খুলে গেলো। “মুক্তিযোদ্ধা সংসদ” তাদের টিকেটের যে টাকাটা দেওয়ার কথা ছিল সেটা দিয়ে দিলো। তিন মাস পরেই পেলাম জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে দাবা প্রশিক্ষক হিসেবে সরকারি চাকরি। পরের বছর জাতীয় দাবায় ৬ষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশ দাবা দলের অন্তর্ভুক্ত হলাম। প্রথমবারের মতো সুযোগ পেলাম ইতালিতে অনুষ্ঠিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের। এরপর ২০০৮ এবং ২০১০ সালেও জার্মানি ও রাশিয়াতে বাংলাদেশ দাবা দলের হয়ে অলিম্পিয়াড খেলতে যাই। ২০১১ সালে শ্রীলঙ্কায় জোনাল দাবা প্রতিযোগীতায় অর্জন করি আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব। কিন্তু যত অর্জনই হোক আমার সবচেয়ে বড় অর্জন হয়ে থাকবে আইল অব ম্যান এর মেজর ওপেন গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্মৃতি। কারন সেই অর্জনটা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে আমাকে আবার দাবার জগতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১:৩৮
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×