(১)
ফ্যাসিবাদ নন্দলাল সরকার
ফ্যাসিবাদ এমন একটি রাজনীতি, এমন এক মতাদর্শ, এমন এক বিশ্বাস যা মানুষকে হিংস্র অমানুষে পরিণত করে। ফ্যাসিবাদ সভ্যতার দুঃস্বপ্ন। ফ্যাসিস্তরা কোন বিপ্লব করেনা, ফ্যসিবাদ পুঁজিবাদকেই রক্ষাকরে, তাকে প্রসারিত করে। শ্রেনী শাসনে চরিত্রকে অক্ষুন্ন রেখেই ফ্যাসিবাদ সম্পুর্ণ নতুন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্হা।
পুঁজিবাদের কেন্দ্রে বাস করে স্বৈরশাসক। সেখানে ধনীদের গণতন্ত্রকে মূল্যায়ন করা হয়। অথচ দরিদ্র দেশগুলোকে লুণ্ঠন করে ফ্যাসিবাদকে টিকিয়ে রাখা হয়। স্বৈরাচারের অবস্থান গরিব অনেক দেশে অনেক বেশি নগ্ন এবং নিষ্ঠুর। যেখানে সাম্রাজ্যবাদী ধনী দেশগুলো সরাসরি গরিব দেশগুলোকে শাসন করছে।ফ্যাসিবাদী হিটলারের পতনের ইতিহাস থেকে আমরা কেউ শিক্ষা নেইনি। তাই ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পতন ঘটানো এখনো সম্ভব হয়নি। ফ্যাসিবাদ তো শুধু হিটলার কিংবা মুসোলিনি নয়, এটি কোনো ব্যক্তি নয়,কোনো দেশও নয়। ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয়স্তরে এবং বিভিন্ন রাজ্যে আর পশ্চিমবাংলায় নখদন্ত বিস্তার করে আবারও ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে শুরু করেছে।আগ্রাসন চলেছে সরকারি প্রতিষ্ঠানে। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দে। আগ্রাসন চলেছে অর্থের লুটপাটে।
দীর্ঘ সশস্ত্র যুদ্ধের পর লাখ লাখ মানুষের আত্মাহুতি আর কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত ভিয়েতনাম আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা। কিন্তু তার পরে স্বাধীন বাংলাদেশের ভেতরেই সৃষ্টি হয়েছে আর এক অন্য রূপের ফ্যাসিবাদ। শোষণের রূপ, ধরন এবং অবকাঠামো পাল্টে স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ বছর ধরে চলছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ফ্যাসিবাদ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবকে ১৫ আগস্টে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে হিটলারের চেয়ে বাংলাদেশের আগ্রাসন নীতি কতটা আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। পশ্চিমবাংলায় ১৯৭২-৭৫ সালে একইভাবে উত্থান ঘটানো হয়েছিল ফ্যাসিবাদী শক্তির। বিরুদ্ধমত দমন রাজনৈতিক নিপীড়ন, সহিংসতা নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন বাহিনীর উত্থান, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, চিন্তার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া, বিচার বিভাগ পদদলিতকরণ, সরকারি দল ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার মধ্যদিয়ে তার অভিষেক ঘটেছিল। সাধারণ মানুষ বন্দি হয়ে পড়েছিল স্বদেশেই। ফ্যাসিবাদের সেই অভিযাত্রা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ তা পছন্দও করেনি। প্রায় অঙ্কুরে তার বিনাশ ঘটেছিল।
এখন পশ্চিমবাংলায় নবপর্যায়ে আবার সেই ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটতে শুরু করেছে। হিটলারও যেমন তার ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য তরুণদের সকল রকম অপকর্ম করার লাইসেন্স দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন স্টর্ম ট্রুপার বাহিনী। তেমনিভাবে বর্তমান সরকারের স্টর্ম ট্রুপারে পরিণত হয়েছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ প্রভৃতি লীগের সশস্ত্র কর্মীরা সমাজের ভেতরে হেন কোন অপকর্ম নেই যা তারা করছে না। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন-ধর্ষণসহ সকল রকম অপরাধই তারা নির্বিঘ্নে করে যাচ্ছে। কিন্তু দুই একটি শাসানোমার্কা কথা বলা ছাড়া সরকারের তরফ থেকে এসবের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। ফলে এই স্টর্ম-ট্রুপারের দৌরাত্ম্য সকলসীমা ছাড়িয়ে গেছে। যেহেতু অন্যারাও দেখতে পাচ্ছে যে, এ ধরনের গুরুতর অপরাধ করে রাতারাতি বিত্তবান হওয়া যায় এবং সরকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাতে মদদই দিচ্ছে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না সেহেতু তারাও বিপুল উৎসাহে ঐসব অপরাধমূলক কর্মকান্ডে বেশি সংখ্যক জড়িয়ে পড়ছে। আগ্রাসন চলেছে সরকারি প্রতিষ্ঠানে। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দে। আগ্রাসন চলেছে অর্থের লুটপাটে। আগ্রাসন চলেছে মানসিকতায়। বাঘা বাঘা পয়সাওয়ালারা, সরকারের মদতপুষ্ট সাধারণ সমর্থকরা দখল করেছে সাধারণের সম্পত্তি। ফ্যাসিবাদের ছোঁয়া লেগেছে ত্রাণের শিবিরে, শীর্ণ অনাহার ক্লিষ্ট শরীরে, বনের হরিণ আর পাখির গায়ে। মনকে বোঝানোর জন্য কেউ কেউ নেলসন ম্যান্ডেলার জেল জীবনের সঙ্গে নিজেকে তুলনাও করতেও ভুল করেন না। নিজেকে নিজে বিশ্বাস করার ক্ষমতাও অনেকে হারিয়ে ফেলেছেন। অবস্থা এ রকম- সবাই এখন নিজেই নিজের আগ্রাসনের শিকার।
বামপন্হীরা বারবার সতর্ক করার চেষ্টা করেছি যে, ফ্যাসিবাদী শক্তির এই উত্থান ঘটতে দিলে এক সময় সে আগুনে নিজের ঘরও পুড়বে।এখন আগুন ফ্যাসিবাদিদের দিকেও আঁচড় দিচ্ছে। শুধু তাই নয় রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করার জন্য অন্যের মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়ার জন্যে সভা-সমাবেশ ভন্ডুল করার জন্যে শাসকগোষ্ঠী ঐ স্টর্ম-ট্রুপারদের ব্যবহার করছে, লেলিয়ে দিচ্ছে, পুরস্কৃত করছে। ফলে সমাজের ভেতরে এক অসহনীয় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতেও শাসকগোষ্ঠীর বিপদে এ ধরনের স্টর্ম-ট্রুপাররা যে কোন কাজে আসবে না সেটাও নিশ্চিত করেই বলা যায়। এছাড়া মানুষের প্রতিরোধ শক্তির ওপরও আস্থা থাকা ভাল। শাসকগোষ্ঠীর আচরণে সে ধরনের কোন বিবেচনা বোধের লক্ষণ দেখিনা। এছাড়া সরকার ইতিহাস বদলে দিয়ে গোটা জাতিকে এক অজানা অন্ধকারের দিকে টেনে নিতে চাইছে। যা কিছুতেই মূখ্যমন্ত্রী মমতার সমালোচনা আছে কিংবা তার স্তাবকতা নেই তার সবকিছুকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অপসারণ করে দিতে চাইছে সরকার।আর তাতে নিরব সমর্থন রয়েছে কেন্দ্রীয় সারকারের, এখন পর্যন্ত তা মূখ্যমন্ত্রী মমতার বন্দনায় সীমাবদ্ধ থাকলেও ধারণা করি অচিরেই তা ঘৃন্য বন্দনায় পর্যবসিত হবে। সে ক্ষেত্রে বিপদও কম নয়। কিছুদিন আগে মূখ্যমন্ত্রী মমতা জোর গলায় বলেছিলেন যে, গ্যাস, বিদ্যুৎ সারের দাম বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারই দায়ী। এসবের জন্য মিটিং, মিছিল করতে হলে তা সে সরকারের বিরুদ্ধেই করা উচিত। আবার ক'দিন আগে বললেন, শহরে ধর্ষন কান্ড সম্পূর্ণ সাজানো ঘটনা, এক্ষেত্রে তার স্তাবকেরা কোনটিকে সত্য বলে গ্রহণ করবেন সেটাও দেখবার বিষয়। কেউ কোন কিছুতে প্রতিবাত করলে তাকেই মাও বাদী আখ্যা দিয়ে জেল ভরতেও দ্বিধা বোধ করছেনা মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়, কিন্তু আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর গৃহীত এসব পদক্ষেপ ভুল। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ই সর্বোত্তম পথ। দেশ ও জনগণের স্বার্থে এবং সরকারের নিজের স্বার্থেই সে পথ অনুসরণ করাই উত্তম।
আধুনিক পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদের ইতিহাস এক ঘৃণিত অধ্যায়ের ইতিহাস।
নন্দলাল সরকার