কিন্তু বাবার পুরো অবস্থার সুক্ষ বিশ্লেষনের মেজাজ ছিল না। 'আহ' বলে যেভাবে শব্দ করে ঘরে ঢুকলেন তিনি, মনে হতে পারে, তিনি একাধারে ক্ষুব্ধ ও সেইসাথে আনন্দিত। গ্রেগর তার মাথা দরজা থেকে তুলে বাবার দিকে তাকালো। বাবা তাকে এভাবে দেখবেন আশা করেন নি। আর গ্রেগর গত ক'দিন তার লাফালাফিতেই ব্যাস্ত থাকায় বাড়ীতে কি ঘটছে, সেদিকে নজন রাখতে পারেনি। পারলে টের পেত যে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে অনেকখানি। তারপরও তার বিশ্বাস হতে চাচ্ছিল না, এই কি সেই বাবা! এ কি একটি লোক, যাকে গ্রেগর প্রতিবার ট্যুর থেকে ফিরে শোবার পোষাকে ইজিচেয়ারে এলিয়ে থাকতে দেখতো। চেয়ার ছেড়ে ওঠার শক্তিও ছিল না। আনন্দের প্রকাশ শুধুমাত্র হাত তুলে জানাতে পারতেন। মাঝে মাঝে রবিবার ও বিশেষ বিশেষ বেড়াতে বেরুতেন। মা নিজেও ভালো চলতে পারতেন না, তারপরও মা ও গ্রগরের মাঝখানে থেকে নিজেকে ওভারকোটে ঢেকে লাঠিতে ভর দিয়ে একটু একটু এগোতেন। কোন কথা বলতে চাইলে থেমে পড়তেন ও অন্যরাও থামলেই শোনা যেত তার কথা। এখন ওনি দাড়িয়েছেন ঋজু ভঙ্গীতে, ব্যাঙ্কের পাহাদারের মতো সোনালী বোতামের নীল রং এর ইস্ত্রী করা পোষাকে। সার্টের উঁচু কলারের উপর তার শক্তিমদমত্ত দোভাঙ্গা থুতনী। ঘন বাদামী ভ্রুর নীচে চোখের দৃপ্ত ও সতর্ক দৃষ্টি। আগের উস্কোখুস্কো চুল আচড়ে অতি যত্নে সিথি কাটা হয়েছে। তিনি তার সম্ভবতো কোন ব্যাঙ্কের সোনালী মনোগ্রাম আঁকা টুপিটা পুরো ঘর পেরিয়ে বাক্সের উপর ছুড়ে দু্থহাত পকেটে পুরে বিরক্ত মুখে এগিয়ে গেলেন গ্রেগরের দিকে। কি করবেন, তা হয়তো নিজেই জানতেন না, কি একটি পা আস্বাভাবিক উঁচুতে তুললেন। তা জুতোর তলার বিরাট আকৃতি দেখে অবাক হলো গ্রেগর। তার নতুন জীবনের শুরুতেই বুঝতে পেরেছিল গ্রেগর, তার বাবা তার প্রতি কঠিন থাকাই জরুরী মনে করেন। সে বাবার সামনে থেকে দৌড়ে পালালো, বাবা যখন থামলেন, থামলো সে ও, তিনি আবার এগিয়ে এলে সে ও অন্যদিকে সরে গেল। কোন গুরুতর কিছু ঘটার আগে, কয়েকবার চললো ঘরের ভেতরে এই দৌড়াদৌড়ি। একসময় কিছুক্ষনের জন্যে থামলো গ্রেগর। যদি সে দেয়ালে বা কড়িকাঠের উপর ওঠে, বাবা তা বদমাইসী মনে করে আরো বেশী রেগে যেতে পারেন। তাছাড়া সময়ের সাথে সাথে তার ক্লান্তিও বাড়ছিল। বাবা যদি এক পা হাটেন, তাকে এদিক সেদিক নড়াচড়া করে অনেকবার পা ফেলতে হচ্ছিল। নি:শ্বাসে কষ্ট হচ্ছিল খুব, ছোটবেলা থেকে ভোগা ফুসফুসের দুর্বলতা মাথা চাড়া দিলো আবার। সে আরেকবার দৌড়ের জন্যে সমস্ত শক্তি সঞ্চয়ে করলো, ক্লান্তিতে চোখও খুলতে পারছে না, অন্যকোন উপায়ে নিজেকে রক্ষা করার পথও ভাবতে পারছে না। ঠিক সে মূহুর্তে তার অতি কাছেই একটি অপেল মাটিতে পড়ে তার শরীল ঘেসে অন্যদিকে গড়িয়ে গেল। পরমূহুর্তেই আরেকটি এসে পড়লো, গ্রেগর থমকে গেল ভয়ে। দৌড়ে কোন লাভ হবে না বুঝলো, বাবা তাকে আপেলের বোমা মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপেলের একটি থালা ছিল উঁচু খাবার টেবিলের ছোট্ট একটি টেবিলে, সেখান থেকে পকেটে ভরে নিয়েছেন এবং একটা পর একটা পুরো লক্ষস্থির না করে ওর দিকে ছুড়ছেন। ছোট ছোট লাল আপেল বিদ্যুতের মতো একটা সাথে আরেকটির ধাক্কায় ছড়িয়ে পড়ছে সারা মেঝেতে। একটা গ্রেগরের পিঠ পিছলে বেরিয়ে গেল আঘাত না করেই। পরেরটি এসে সরাসরি ওর পিঠে আঘাত করলো। জায়গা থেকে সরেই যেন এই হঠাৎ অবিশ্বাস্য ব্যাথার উপশম হবে ভেবে সরতে চাইলো গ্রেগর। কিন্তু মনে হলো, পেরেকে আটকে আছে মেঝেতে আর ও পুরোপুরি অবিন্যস্ত অন্ধকারে ডুবে। শুধুমাত্র শেষ মূহুর্তে এক পলকে মায়ের পেছনে বোনকে ওর ঘরে থেকে চিৎকার করে বের হতে দেখল। মায়ের পরনে শুধু লম্বা অন্তর্বাস । উপরের পোষাক জ্ঞান হারানোর পর নি:শ্বাসের সুবিধার জন্যে খুলে নিয়েছ বোন। লুটানো ঘাগড়ায় হোঁচট খেতে খেতে ছুটছে মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে গ্রেগরের জীবন ভিক্ষা চাইলেন। এরপর কি হলো, তা দেখার মতো দৃষ্টিশক্তি আর গ্রেগরের রইল না।
তিনটি খন্ডের দ্বিতীয় খন্ড সমাপ্ত....
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



