somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মরক্কো ভ্রমন, পৃথিবীর পথে পথে

২৮ শে জুন, ২০২৫ ভোর ৫:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পৃথিবীর পথে পথেঃ মরক্কো (টাকার খুসস্ট ) ২০১৮ ,ভ্রমণ কাহিনী 

"Morocco is a place where a piece of your soul remains forever"


আবার দীর্ঘ শীত দোর গোরায় । পাঁচ মাস ধরে চলবে এর দাপট। সাথে বরফ আর কনকনে ঠাণ্ডা। শীত থেকে পালাতে আবার মরক্কো ।

টাকারখুসস্ট

তবে এবার মরক্কোর ম্যারাকেস নয়। ম্যারাকাস থেকে ৪০ কিমি দূরে আগাফায় সেমি মরুভূমির কাছে লাল্লা (Lalla) লেকের ধারে একটা স্থান । যেখান থেকে এটলাস মাউন্টেনের বরফ ঢাকা চূড়া দেখা যায় যা বেশি দূরেও নয়। স্থান টির নাম টাকারখুস্ট (Teakarkhust।

এই সুন্দর জায়গাটি বেছে নেয়ার  কারন ম্যারাকাসের মতো ভিড়ভাট্টা নাই,  রিসোর্ট এর ভাড়া বেশ সস্তা। আছে কুকিং ফ্যাসেলিটি ।  মাঝে মাঝে নিজে রান্না করে খেতে চাই ।  প্রকৃতির খুব কাছে আর এখান থেকে কোয়াড বাইকিং করা যাবে।

মেনারা এয়ারপোর্ট  (Menara Airport)  থেকে রিসোর্টের মালিক নিজে তার গাড়ি নিয়ে  আমরাকে নিতে এসেছিল ।অবশ্য তা বুকিং দেয়া ছিল আগেই । আমাদের মেয়েরা যখন ছোটো ছিল আমি তারাকে একলা দেশে নিয়ে গেছি আর এখন আমার মেয়েরাই আমরাকে নিয়ে যায় । টেকনোলজি পাল্টে দিয়েছে,  নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার গুলোকে। তারা সব কিছু করে অনলাইনে।   সকালে ব্রেকফাস্ট ছিল ইনক্লুডেড । খুব মজার হাতে বানানো মরক্কোর নিজস্ব স্টাইলের  খাবার ।প্রতিদিন সকালে আমরা রিসোর্টের দুইতলার খোলা ছাদে বসে  নাস্তা খেতাম আর দূরের সাদা বরফের ক্যাপ পরা এটলাস মাউন্টেনের দৃশ্য উপভোগ করতাম । প্রায় ঘুঘু অথবা কবুতর নিজের মনে গান করতো কাছা কাছি বসে।   বিকালে হোটেল মালিক তার গাড়িতে করে আমাদের আশপাশে সব কিছু দেখিয়ে আনলো  । খুব ছোট্ট একটা  লোকালয়। তার পরেই প্রকৃতি ।প্রকৃতি মানে আধা মরুভূমি অঞ্চল ,অল্প গাছ আর ধুধু প্রকৃতির পরিবেশ । এই রকম গাছ আর  ফুল আমরা কোথাও দেখি নাই ।

সেটি ফাতমা এবং সাতটি ওয়াটার ফলস 

কোথায় যাবো আর কি করব তার আইটেনারি আগেই করে রেখেছিলাম গুগল সার্চের কল্যাণে । ট্যাক্সি ঠিকঠাক করা ছিল। তাই বেরিয়ে পড়লাম 'সেটি ফাতমা ওয়াটার ফলস'   দেখার উদ্দেশ্যে । দুই ধারের নীরব লোকালয় ,লাল মাটির পাহাড় অলিভ বাগান আর কমলালেবুর বাগান দেখতে দেখতে গাড়ি ছুটে চলছে সামনে ।

এক পৃথিবীর কত বৈচিত্র্য বিধাতা বানিয়ে রেখেছে। যখন কাছে চলে আসলাম তখন আমাদের রাস্তা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলা আরম্ভ করেছে। এখানে বাতাসে আদ্রতা থাকায়   গাছপালাও  একটু বেশি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে গাড়ি উঠা আরম্ভ করল। তারপর একটা  খাড়ির কাছে এসে থামল। সারী সারী টুরিস্ট বহনকারী কোচ, ট্যাক্সি, কোস্টার সে এক এলাহি কাণ্ড। সবার উদ্দেশ্য এটলাস মাউন্টেন থেকে নেমে আসা 'সেটি ফাতমা ওয়াটার ফলস'  দেখা । যে  কিনা সাতবার ওয়াটার্স ফলস  সৃষ্টি করেছে  নেমে যেতে যেতে  নিচে ভ্যালির দিকে।চলেছে সে নিজের মনে কুলু কুলু শব্দের গান গেয়ে ।

কে এই সেটি ফাতমাঃ

সেটি ফাতমা একজন স্বনামধন্য স্কলারের মেয়ে। ফাতমা নিজেও সবার চেয়ে বুদ্ধিমতী এবং ধার্মিক স্বাধীন চেতা  মহিলা ছিলেন ।  স্বাধীনচেতা  হওয়ার জন্য মানুষ তাকে সমালোচনা করতে পারে । এই ভয়ে তিনি এখানে এসে বিয়ে করে এই নির্জন স্থান বেছে নেন বসবাস করার জন্য । তার নাম অনুসারেই এই ওয়াটার ফলস টির নাম হয় 'সেটি ফাতমা ওয়াটার্স ফলস'

শুধু যে ওয়াটার ফলস  দেখা তাই নয় তার সাথে এখান কার ভুপ্রকৃতি আর জিওলজিক্যাল গঠন, এটলাস মাউন্টেকে আবিষ্কার করা ট্রেকিং আর হাইকিং  এর মাধ্যমে, 'বারবার ভিলেজ'(বারবার মরক্কোর একটা ট্রাইবের নাম)  ভিজিট করে  তাদের জীবন যাত্রা আর কালচার জানা, তাদের বাড়িঘর বানানোর পদ্ধতি  কত কিছু এর সাথে জড়িত।

আমরা গাড়ি থেকে নামলাম।  ট্রেকিং এ সাহায্য করা এবং পথ দেখানোর জন্য একজন গাইড ভাড়া করলাম। শুরু হল পাহাড় ট্রেকিং আর হাইকিং ।

সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। পথে পথে সুভেনিয়ার আর রেস্টুরেন্ট এর দোকান অনেক।  হটাৎ সব কমে যেতে আরম্ভ হল । শুরু হতে লাগলো বিরাট বিরাট বুলডার ডিঙ্গানো । যা সেই শক্তিশালী গাইড ছাড়া সম্ভব হতনা।দেখছি বয়স্ক ইউরোপিয়ান অনেক টুরিস্ট না যেয়েই ঘুরে আসছে। কি কারন জিজ্ঞাসা করে যানতে পারলাম এই সব পাথর ডিঙ্গানো আর এই দুর্গম পথ ক্রস করা তাদের পক্ষে সম্বভ নয়। কিন্তু সেই গাইড আমাদেরকে সাহস দিয়ে ,  সাহায্য করে আর কোথা দিয়ে গেলে রাস্তা সহজ হবে বাৎলে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেলো।  আজ মনে পড়ছে সেই দয়ালু মরক্কোর গাইড টাকে বার   বার। আমি মরক্কোর মানুষকে  এই জন্যই  খুব পছন্দ করি। তারা খুব ভালো মনের মানুষ।

তার পর একটু একটু করে নিচে নামা। মোট সময় লেগেছে ২ঘন্টা ৩০ মিনিট ।  এক এক করে  সাতটি ওয়াটার ফলসের ধারা  দেখতে পেলাম। সামনেই প্রধান ওয়াটার ফলস   এসে গেলো । অনেক উঁচু থেকে পড়ছে ফলস টি । পানির ধারা থাকার জন্য কিছু কিছু গাছ গাছালি আছে। ওয়াটার ফলস  অনেক দেশে অনেক দেখেছি। দেখে বেড়ানোর প্রধান কারন ডিফারেন্ট ভূপ্রকৃতি , গঠন প্রণালী আর জীববৈচিত্র্য ।

যাই  হোক এখন ওয়াটার ফলস  দেখা শেষ করে উপরে উঠার পালা। বিরাট বিপদ দেখছি কি ভাবে উপরে উঠতে হবে প্রায় ১০ ফুট উঁচু ভার্তিক্যাল  কোন রকম খাঁজ বা স্টেপ ছাড়া পাথরের গা। আবার সেই দয়ালু গাইড উপরে উঠে দুই হাতে টেনে তুললো আমরাকে । যেখানে কোনো স্ট্যান্ড ছিলনা যেখানে সে একহাত দিয়ে সাপর্ট পাবে। একটু যদি হাত ছাড়া হয় পড়ে  যাবো একেবারে ১০ ফুট গভীরে । এযে কত বড় বিপদ থেকে উদ্ধার তা আল্লাহ্‌-  ই জানে। যাই  হোক উপরে উঠে খুব সরু হাঁটার রাস্তা। নিচে তাকাতে ভয়ে গা শির শির করছে।

অনেক দূর হাঁটার পর নিচে নামলাম। আমাদের গাইড কে অনেক টাকা বখশিশ দিলাম খুশি হয়ে।  পাশে  একটা  বারবার ভিলেজ । নিচে নেমে তাদের বিখ্যাত 'তাজিনে' রান্না করা মাংস আর আলু খেয়ে রওনা দিলাম বাড়ির পথে।

কাছেই ছিল 'অরিকা ভ্যালি' (ourika vally)।সেখানে নেমে এর সৌন্দর্জ দেখলাম ঘুরে ঘুরে।'অরিকা' নদীটি সেই সেটি ফাতিমা ফলসের প্রবাহ ধারা ।২,২০০ মিটার উঁচু মাউন্ট এটলাস থেকে এর সৃষ্টি। যখন 'অরিকা' সমতলে আসে তখন চারদিকে নানা রকম ফসল ফলায় কৃষক ।অরিকার পানি সেচ দিয়ে  অলিভ,কমলা , অলমণ্ড এবং  চেরি বাগানের সৃষ্টি হয়।   আবহাওয়া এখানে মাইলড ।সামারে এখানে সামান্য বৃষ্টি হয়।

অউজউদ  ওয়াটার ফলস (Ouzoud ওয়াটার ফলস) 

পরের দিন আমাদের গন্তব্য স্থল ছিল অউজউদ ওয়াটার ফলস

আজিলাল প্রদেশের,  টানাগমেইলট ( tanaghmeilt )ভিলেজের,  মধ্য এটলাস মাউনটেন থেকে একটা নদী বের হয় , যার নাম আল -আবিদ । এটা যখন একটা ১১০ মিটার  গভীরের গোর্জে গিয়ে পড়ে তা দেখার মতো  একটা ঝর্নার সৃষ্টি করে। এখানে অনেক গুলো শস্য গ্রাইন্ড করার মিল আছে আর এই জন্যই এর এই নামটা হয় । কারন 'অউজউদ' শব্দ টির অর্থ গ্রাইন্ড মিল। আমরা বোটে করে ওয়াটারস ফলস এর কাছে চলে গিয়েছিলাম। উপরে অনেক অলিভ বাগান আছে একটা গাইড আমরাকে নিয়ে সব কিছু দেখাতে নিয়ে গেলো অলিভ বাগান থেকে অলিভ কি ভাবে কালেক্ট করে।  ,অলিভ থেকে তেল বানানো, যারা বানায় তাদের বাড়ি  আর ভিলেজ সব দেখলাম। নদী টির উৎপত্তি স্থল সে দেখাল। রিসেন্ট আবিষ্কার সেখানে একটা কেভের মধ্যে আরকেওলজিসস্ট দের গবেষণা । সেখানে উদ্ধার হয়েছে লাখ লাখ বছর আগের হান্টার গ্যাদারার দের থাকার আস্তানা। সব কিছু দেখে আমরা ফিরে আসলাম হোটেলে।

তার পরের দিন আমরা কোয়াড বাইকিং করলাম।  এটা একটা মজার  অভিজ্ঞতা। একদিন ঘুরে আসলাম আগাফায় মরুভূমি দেখার জন্য। । আর একদিন লোকাল ভেজিটেবল মার্কেট ঘুরে টাটকা   বেগুন  আলু আর মাংস কিনে বেশ মজা করে রাঁধলাম।লোকাল মার্কেট ভিজিট করতে আমার সবসময় খুব ভালো লাগে।  লোকাল বাসে করে একদিন বেরিয়ে  আসলাম মারাকাস থেকে। লোকাল বাসে লোকাল মানুষদের সাথে মেসার সুযোগ হয় । এটা বেশ এক অভিজ্ঞতা। শেষ হল আমাদের ১২ দিনের মরক্কোর টাকারখুস্ট ঘোরা ঘুরি।

'তাকারখুসস্ট' একটা ভালোবাসার নাম। কেন এই ভালোবাসা? সুন্দর ওয়েদার ,মানুষের ব্যাবহার, অন্যরকম ভূপ্রকৃতি সব কিছু মিলিয়ে মনে হয় বার বার এখানে আসবো ।

পরের দিন লন্ডনে ফিরে এলাম।

লেখকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস, লন্ডন
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২৫ ভোর ৫:০৮
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×