somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হযরত হূদ (আলাইহিস সালাম)- ২য় পর্ব

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ১০:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্ব ...
কওমে ‘আদ-এর প্রতি হূদ (আ.)-এর দাওয়াতের সারমর্ম :
কওমে নূহের প্রতি হযরত নূহ (আ.)-এর দাওয়াতের সারমর্ম এবং কওমে ‘আদ-এর প্রতি হযরত হূদ (আ.)-এর দাওয়াতের সারমর্ম প্রায় একই। হযরত হূদ (আ.)-এর দাওয়াতের সারকথাগুলি সূরা হূদ-এর ৫০, ৫১ ও ৫২ আয়াতে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন, যা এক কথায় বলা যায়- তাওহীদ, তাবলীগ ও ইস্তেগফার। প্রথমে তিনি নিজ কওমকে তাদের কল্পিত উপাস্যদের ছেড়ে একক উপাস্য আল্লাহর দিকে ফিরে আসার ও একনিষ্ঠভাবে তাঁর প্রতি ইবাদতের আহবান জানান, যাকে বলা হয় ‘তাওহীদে ইবাদত’। অতঃপর তিনি জনজীবনকে শিরকের আবিলতা ও নানাবিধ কুসংস্কারের পংকিলতা হ’তে মুক্ত করার জন্য নিঃস্বার্থভাবে দাওয়াত দিতে থাকেন এবং তাদের নিকট আল্লাহর বিধানসমূহ পৌঁছে দিতে থাকেন। তাঁর এই দাওয়াত ও তাবলীগ ছিল নিরন্তর ও অবিরত ধারায় এবং যাবতীয় বস্তুগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে। অতঃপর তিনি জনগণকে নিজেদের কুফরী, শেরেকী ও অন্যান্য কবীরা গোনাহ সমূহ হ’তে তওবা করার ও আল্লাহর নিকটে একান্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনার আহবান জানান।

উপরোক্ত তিনটি বিষয়ে সকল নবীই দাওয়াত দিয়েছেন। মূলতঃ উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি। মানুষ যখনই নিজেদের কল্পিত দেব-দেবী ও মূর্তি-প্রতিমাসহ বিভিন্ন উপাস্যের নিকটে মাথা নত করবে ও তাদেরকেই মুক্তির অসীলা কিংবা সরাসরি মুক্তিদাতা ভাববে, তখনই তার শ্রেষ্ঠত্ব ভূলুণ্ঠিত হবে। নিকৃষ্ট সৃষ্টি সাপ ও তুলসী গাছ পর্যন্ত তার পূজা পাবে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব ও তার সেবা বাদ দিয়ে সে নির্জীব মূর্তির সেবায় লিপ্ত হবে। একজন ক্ষুধার্ত ভাইকে বা একটি অসহায় প্রাণীকে খাদ্য না দিয়ে সে নিজেদের হাতে গড়া অক্ষম-অনড় মূর্তিকে দুধ-কলার নৈবেদ্য পেশ করবে ও পুষ্পাঞ্জলী নিবেদন করবে। এমনকি কল্পিত দেবতাকে খুশী করার জন্য সে নরবলি বা সতীদাহ করতেও কুণ্ঠিত হবে না। পক্ষান্তরে যখনই একজন মানুষ সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবলমাত্র আল্লাহ্‌কে তার সৃষ্টিকর্তা, রূযীদাতা, বিপদহন্তা, বিধানদাতা, জীবন ও মরণদাতা হিসাবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে, তখনই সে অন্য সকল সৃষ্টির প্রতি মিথ্যা আনুগত্য হ’তে মুক্তি পাবে। আল্লাহর গোলামীর অধীনে নিজেকে স্বাধীন ও সৃষ্টির সেরা হিসাবে ভাবতে শুরু করবে। তার সেবার জন্য সৃষ্ট জলে-স্থলে ও অন্তরীক্ষের সবকিছুর উপরে স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সে উদ্বুদ্ধ হবে। তার জ্ঞান ও উপলব্ধি যত বৃদ্ধি পাবে, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভক্তি ততই বৃদ্ধি পাবে। মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টজীবের প্রতি তার দায়িত্ববোধ তত উচ্চকিত হবে।

দ্বিতীয়তঃ বস্তুগত কোন স্বার্থ ছাড়াই মানুষ যখন কাউকে সৎ পথের দাওয়াত দেয়, তখন তা অন্যের মনে প্রভাব বিস্তার করে। ঐ দাওয়াত যদি তার হৃদয় উৎসারিত হয় এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত সত্যের পথের দাওয়াত হয়, তাহ’লে তা অন্যের হৃদয়ে রেখাপাত করে। সংশোধন মূলক দাওয়াত প্রথমে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও তা অবশেষে কল্যাণময় ফলাফল নিয়ে আসে। নবীগণের দাওয়াতে স্ব স্ব যুগের ধর্মনেতা ও সমাজ নেতাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হ’লেও দুনিয়া চিরদিন নবীগণকেই সম্মান করেছে, ঐসব দুষ্টমতি ধর্মনেতা ও সমাজ নেতাদের নয়।

তৃতীয়তঃ মানুষ যখন অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তখন তার দুনিয়াবী জীবনে যেমন কল্যাণ প্রভাব বিস্তার করে, তেমনি তার পরকালীন জীবন সুখময় হয় এবং সে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়। হূদ (আ.) স্বীয় জাতিকে বিশেষভাবে বলেছিলেন, ‘হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তাঁর দিকে ফিরে যাও। তাহ’লে তিনি আসমান থেকে তোমাদের জন্য বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন’ {হূদ ১১/৫২}। এখানে ‘শক্তি’ বলতে দৈহিক বল, জনবল ও ধনবল সবই বুঝানো হয়েছে। তওবা ও ইস্তেগফারের ফলে এসবই লাভ করা সম্ভব, এটাই অত্র আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

হূদ (আ.)-এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি :
হযরত হূদ (আ.) স্বীয় কওমে ‘আদকে শিরক পরিত্যাগ করে সার্বিক জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। তিনি তাদেরকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করার এবং যুলুম ও অত্যাচার পরিহার করে ন্যায় ও সুবিচারের পথে চলার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু নিজেদের ধনৈশ্বর্যের মোহে এবং দুনিয়াবী শক্তির অহংকারে মদমত্ত হয়ে তারা নবীর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলল, তোমার ঘোষিত আযাব কিংবা তোমার কোন মু‘জেযা না দেখে কেবল তোমার মুখের কথায় আমরা আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা উপাস্য দেব-দেবীদের বর্জন করতে পারি না। বরং আমরা সন্দেহ করছি যে, আমাদের দেবতাদের নিন্দাবাদ করার কারণে তাদের অভিশাপে তোমাকে ভূতে ধরেছে ও মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে তুমি উন্মাদের মত কথাবার্তা বলছ। তাদের এসব কথার উত্তরে হযরত হূদ (আ.) পয়গম্বর সূলভ নির্ভীক কণ্ঠে জবাব দেন যে, তোমরা যদি আমার কথা না মানো, তবে তোমরা সাক্ষী থাক যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তোমাদের ঐসব অলীক উপাস্যদের আমি মানি না। তোমরা ও তোমাদের দেবতারা সবাই মিলে আমার অনিষ্ট সাধনের চেষ্টা কর। তাতে আমার কিছুই হবে না আল্লাহর হুকুম ছাড়া। তিনিই আমার পালনকর্তা। তাঁর উপরেই আমি ভরসা রাখি। যারা সরল পথে চলে, আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন।

অহংকারী ও শক্তি মদমত্ত জাতির বিরুদ্ধে একাকী এমন নির্ভীক ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও তারা তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস করেনি। বস্তুতঃ এটা ছিল তাঁর একটি মু‘জেযা বিশেষ। এর দ্বারা তিনি দেখিয়ে দিলেন যে, তাদের কল্পিত দেব-দেবীদের কোন ক্ষমতা নেই। অতঃপর তিনি বললেন, আমাকে যে সত্য পৌঁছানোর দায়িত্ব আল্লাহ পাক দিয়েছেন, সে সত্য আমি তোমাদের নিকটে পৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে যদি তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করতেই থাক এবং হঠকারিতার উপরে যিদ করতে থাক, তাহ’লে জেনে রেখ এর অনিবার্য পরিণতি হিসাবে তোমাদের উপরে আল্লাহর সেই কঠিন শাস্তি নেমে আসবে, যার আবেদন তোমরা আমার নিকটে বারবার করেছ। অতএব তোমরা সাবধান হও। এখনো তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে এসো।

কিন্তু হতভাগার দল হযরত হূদ (আ.)-এর কোন কথায় কর্ণপাত করল না। তারা বরং অহংকারে স্ফীত হয়ে বলে উঠলো, ‘আমাদের চেয়ে বড় শক্তিধর (এ পৃথিবীতে) আর কে আছে’? {হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৫}। ফলে তাদের উপরে এলাহী গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো।

আগামী পর্বে সমাপ্ত ইনশাআল্লাহ্ ...

রচনাঃ
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×