আগের পর্ব ...
নমরূদের সঙ্গে বিতর্ক ও অগ্নিপরীক্ষা :
ইবরাহীম (আ.) এটাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করলেন। নমরূদ ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করায় সে উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে উঠেছিল এবং নিজেকে একমাত্র উপাস্য ভেবেছিল। তাই সে ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করল, বল তোমার উপাস্য কে? নমরূদ ভেবেছিল, ইবরাহীম তাকেই উপাস্য বলে স্বীকার করবে। কিন্তু নির্ভীক কণ্ঠে ইবরাহীম জবাব দিলেন, ‘আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি মানুষকে বাঁচান ও মারেন’। মোটাবুদ্ধির নমরূদ বলল, ‘আমিও বাঁচাই ও মারি’। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে খালাস দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে পারি। আবার খালাসের আসামীকে মৃত্যুদন্ড দিতে পারি। এভাবে সে নিজেকেই মানুষের বাঁচা-মরার মালিক হিসাবে সাব্যস্ত করল। ইবরাহীম তখন দ্বিতীয় যুক্তি পেশ করে বললেন, ‘আমার আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন, আপনি তাকে পশ্চিম দিক হ’তে উদিত করুন’। ‘অতঃপর কাফের (নমরূদ) এতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো’ {বাক্বারাহ ২/২৫৮}।
কওমের নেতারাই যেখানে পরাজয়কে মেনে নেয়নি, সেখানে দেশের একচ্ছত্র সম্রাট কেন পরাজয়কে মেনে নিবেন। যথারীতি তিনিও অহংকারে ফেটে পড়লেন এবং ইবরাহীমকে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ জারি করলেন। সাথে সাথে জনগণকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বললেন, ‘তোমরা একে পুড়িয়ে মার এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’ {আম্বিয়া ২১/৬৮}। উল্লেখ্য যে, কুরআন কোথাও নমরূদের নাম উল্লেখ করেনি এবং সে যে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ উপাস্য’ দাবী করেছিল, এমন কথাও স্পষ্টভাবে বলেনি। তবে ‘আমিও বাঁচাতে পারি ও মারতে পারি’ {বাক্বারাহ ২/২৫৮} তার এই কথার মধ্যে তার সর্বোচ্চ অহংকারী হবার এবং ইবরাহীমের ‘রব’-এর বিপরীতে নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করায় সে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ রব’ হিসাবে ধারণা করেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। প্রধানত: ইস্রাঈলী বর্ণনাসমূহের উপরে ভিত্তি করেই ‘নমরূদ’-এর নাম ও তার রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। কুরআন কেবল অতটুকুই বলেছে, যতটুকু মানব জাতির হেদায়াতের জন্য প্রয়োজন।
যুক্তিতর্কে হেরে গিয়ে নমরূদ ইবরাহীম (আ.)-কে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুকুম দিল। অতঃপর তার জন্য বিরাটাকারের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, ‘তারা ইবরাহীমের বিরুদ্ধে মহা ফন্দি আঁটতে চাইল। অতঃপর আমরা তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম’ {আম্বিয়া ২১/৭০}। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তাদেরকে পরাভূত করে দিলাম’ {ছাফফাত ৩৭/৯৮}।
অতঃপর ‘একটা ভিত নির্মাণ করা হ’ল এবং সেখানে বিরাট অগ্নিকুন্ড তৈরী করা হ’ল। তারপর সেখানে তাকে নিক্ষেপ করা হ’ল’ {ছাফফাত ৩৭/৯৭}। ছহীহ বুখারীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের সময় ইবরাহীম (আ.) বলে ওঠেন, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’।*৯*
একই প্রার্থনা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছা.) করেছিলেন, ওহোদ যুদ্ধে আহত মুজাহিদগণ যখন শুনতে পান যে, আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে না গিয়ে পুনরায় ফিরে আসছে মদীনায় মুসলিম শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, তখন ‘হামরাউল আসাদে’ উপনীত তার পশ্চাদ্ধাবনকারী ৭০ জন আহত ছাহাবীর ক্ষুদ্র দল রাসূলের সাথে সমস্বরে বলে উঠেছিল ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’ ঘটনাটি কুরআনেও বর্ণিত হয়েছে’।*১০* এভাবে পিতা ইবরাহীম ও পুত্র মুহাম্মাদের বিপদ মুহূর্তের বক্তব্যে শব্দে শব্দে মিল হয়ে যায়। তবে সার্বিক প্রচেষ্টার সাথেই কেবল উক্ত দো‘আ পাঠ করতে হবে। নইলে কেবল দো‘আ পড়ে নিষ্ক্রিয় বসে থাকলে চলবে না। যেমন ইবরাহীম (আ.) সর্বোচ্চ পর্যায়ে দাওয়াত দিয়ে চূড়ান্ত বিপদের সময় এ দো‘আ করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছা.) বিরোধী পক্ষের সেনাপতি আবু সুফিয়ানের পশ্চাদ্ধাবনের পরেই উক্ত দো‘আ পড়েছিলেন।
বস্তুতঃ এই কঠিন মুহূর্তের পরীক্ষায় জয়লাভ করার পুরস্কার স্বরূপ সাথে সাথে আল্লাহর নির্দেশ এল ‘হে আগুন! ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইবরাহীমের উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও’ {আম্বিয়া ২১/৬৯}। অতঃপর ইবরাহীম মুক্তি পেলেন।
অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইবরাহীম (আ.) ফিরে আসেন এবং এভাবে আল্লাহ কাফিরদের সমস্ত কৌশল বরবাদ করে দেন। এরপর শুরু হ’ল জীবনের আরেক অধ্যায়।
হিজরতের পালা :
ইসলামী আন্দোলনে দাওয়াত ও হিজরত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তৎকালীন পৃথিবীর সমৃদ্ধতম নগরী ছিল বাবেল, যা বর্তমানে ‘বাগদাদ’ নামে পরিচিত।*১১* তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে এবং মূর্তিপূজারী ও তারকাপূজারী নেতাদের সাথে তর্কযুদ্ধে জয়ী হয়ে অবশেষে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে ইবরাহীমের দাওয়াত ও তার প্রভাব সকলের নিকটে পৌঁছে গিয়েছিল। যদিও সমাজপতি ও শাসকদের অত্যাচারের ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেয়নি। কিন্তু তাওহীদের দাওয়াত তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল এবং তা সাধারণ জনগণের হৃদয়ে আসন গেড়ে নিয়েছিল।
অতএব এবার অন্যত্র দাওয়াতের পালা। ইবরাহীম (আ.) সত্তরোর্ধ্ব বয়সে অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হন। এই দীর্ঘ দিন দাওয়াত দেওয়ার পরেও নিজের স্ত্রী সারাহ ও ভাতিজা লূত ব্যতীত কেউ প্রকাশ্যে ঈমান আনেনি। ফলে পিতা ও সম্প্রদায় কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি আল্লাহর হুকুমে হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন। যাওয়ার পূর্বে তিনি নিজ সম্প্রদায়কে ডেকে যে বিদায়ী ভাষণ দেন, তার মধ্যে সকল যুগের তাওহীদবাদী গণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় লুকিয়ে রয়েছে।
ইবরাহীমের হিজরত-পূর্ব বিদায়ী ভাষণ:
আল্লাহর ভাষায়, ‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, আমরা সম্পর্ক ছিন্ন করছি তোমাদের সাথে এবং তাদের সাথে যাদেরকে তোমরা পূজা কর আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে। আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করছি এবং আমাদের ও তোমাদের মাঝে স্থায়ী শত্রুতা ও বিদ্বেষ বিঘোষিত হ’ল যতদিন না তোমরা কেবলমাত্র এক আল্লাহর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করবে। ... প্রভু হে! আমরা কেবল তোমার উপরেই ভরসা করছি এবং তোমার দিকেই মুখ ফিরাচ্ছি ও তোমার নিকটেই আমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল’ {মুমতাহানাহ ৬০/৪}। এরপর তিনি কওমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমি চললাম আমার প্রভুর পানে, সত্বর তিনি আমাকে পথ দেখাবেন’ {ছাফফাত ৩৭/৯৯}। অতঃপর তিনি চললেন দিশাহীন যাত্রাপথে।
আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা তাকে ও লূতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই দেশে, যেখানে বিশ্বের জন্য কল্যাণ রেখেছি’ {আম্বিয়া ২১/৭১}। এখানে তাঁর সাথী বিবি সারা-র কথা বলা হয়নি নারীর গোপনীয়তা রক্ষার শিষ্টাচারের প্রতি খেয়াল করে। আধুনিক নারীবাদীদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী সারা ও ভাতিজা লূতকে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে গেলেন পার্শ্ববর্তী দেশ শাম বা সিরিয়ার অন্তর্গত বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অদূরে কেন‘আন নামক স্থানে, যা এখন তাঁর নামানুসারে ‘খালীল’ নামে পরিচিত হয়েছে। ঐ সময় সেখানে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অস্তিত্ব ছিল না। এখানেই ইবরাহীম (আ.) বাকী জীবন অতিবাহিত করেন ও এখানেই কবরস্থ হন। এখানে হিজরতের সময় তাঁর বয়স ৮০ থেকে ৮৫-এর মধ্যে ছিল এবং বিবি সারা-র ৭০ থেকে ৭৫-এর মধ্যে। সঙ্গী ভাতিজা লূতকে আল্লাহ নবুঅত দান করেন ও তাকে পার্শ্ববর্তী সমৃদ্ধ নগরী সাদূমসহ পাঁচটি নগরীর লোকদের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয় ও তিনি সেখানেই বসবাস করেন। ফলে ইবরাহীমের জীবনে নিঃসঙ্গতার এক কষ্টকর অধ্যায় শুরু হয়।
উল্লেখ্য যে, মানবজাতির প্রথম ফসল ডুমুর (তীন) বর্তমান ফিলিস্তীনেই উৎপন্ন হয়েছিল আজ থেকে এগারো হাযার বছর আগে। সম্প্রতি সেখানে প্রাপ্ত শুকনো ডুমুর পরীক্ষা করে এ তথ্য জানা গেছে।*১২*
ইনশাআল্লাহ চলবে ...
রচনাঃ
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
*৯* বুখারী, হা/৪৫৬৩ তাফসীর অধ্যায়, সূরা আলে-ইমরান ।
*১০* আলে ইমরান ৩/১৭৩; আর-রাহীক্ব পৃঃ ২৮৬।
*১১* কুরতুবী, আন‘আম ৭৫-এর টীকা।
*১২* ঢাকা, দৈনিক ইনকিলাব তাং ৭/৬/০৬ পৃঃ ১৩।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



