রাশানের ঘুম আসছে না ।জোর করে চোখ বুজে রয়েছে ।কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছে না।তার চোখ আরো বেশি জ্বালা করছে ।
না,সে কাঁদছে না ।কান্না শুকিয়ে গেছে অনেক আগে। সারারাত জেগে থাকার
ফলে চোখ জ্বলছে ।
রাশান নিরুপায় ,তার অভিধানে ঘুম শব্দটা হারিয়ে গেছে
।নিয়ম করে রাত জাগায় ধাতস্থ হয়ে গেছে সে ।নির্বিঘ্নেই কাটিয়ে দেয় রাতগুলো ।তবে আজ তার চোখ বড্ড বেশি জ্বালা করছে ।
হঠাত্ চোখ মেলবার প্রয়োজন বোধ করল রাশান ।বাইরে আবছা আলো ।দেয়ালঘড়ির
দিকে তাকাল সে ।ধুঁকে ধুঁকে চলতে থাকা কাঁটাগুলো দেখে সময়টা ঠিক
ঠাহর করতে পারল না । ধ্যাত্,বিছানায় আর শুয়েই থাকবে না ! উঠে পড়ল রাশান
।দেয়ালঘড়ির একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল ।এবার সময়টা দেখতে পেল ।ছটা ২৪
।সেকেন্ডের কাঁটাটা অবিরাম ঘুরছে ।যেন জীবনঘূর্ণির সাথে তাল মেলাচ্ছে ।
ফ্ল্যাটে মেইন দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই রাশানের রুম। রুমে একটা অপ্রশস্ত
বারান্দাও রয়েছে ।ওখানে একটা ফোল্ডিং টেবিল আর দুটো টুল পাতা ।টেবিলে
কিছু সাদা কাগজ নজরে পড়ল ওর ।বাইরে খুবই মন খারাপ করে দেওয়া চিত্র ।একটা নিমগাছ ।সমস্ত পাতা ঝরে পড়এছে ।ভোরের আলোয় গাছটাকে ভৌতিক দেখাচ্ছে ।দুএকটা কচি পাতা জানান দিচ্ছে গাছটা টিকে গেছে।
রাশান বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল ।ভেতরটা এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন ।ও জ্বেলে দিল
ফ্লোরোসেন্ট বাতি ।
বাথরুমে একটা বড়সড় আয়না ।রাশান শুনেছে বাথরুমের বড়
আয়না নাকি আভিজাত্যের প্রতীক ।আসলে কিন্তু ওরা মধ্যবিত্ত ।ফ্ল্যাটের অতিরিক্ত
ভাড়াটা ওদের জন্যে বাড়তি খরচ ।আয়ের চেয়ে বলতে গেলে ব্যয় বেশি করেন
রাশানের বাবা ।ছেলের বিলাসব্যসন আর ভবিষ্যতের প্রতি তাঁর কড়া নজরদারি
।বাবার আত্মসম্মানবোধ প্রকট ।সারাটা জীবন ছেলের পিছেই ব্যয় করেছেন ।সঞ্চয় বলতে গেলে কিছুই নেই ।কিন্তু তাঁর এক কথা,একদিন আমার ছেলেই
আমার গড়ে তোলা বড় সম্পদ হয়ে উঠবে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে রাশান চোখে পানির ঝাপটা দিল ।তার কাছে মনে হল কেউ
যেন তার চোখে গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে ।আয়নায় দেখল দুটো রক্তবর্ণের চোখ তার
দিকে সোজা তাকিয়ে আছে ।সে জানে তার ঘুম প্রয়োজন ।কিন্তু ঘুম
যে তার চোখের পাতা থেকে মুছে গেছে !
এভাবে আর কতদিন চলবে ?সে ঘুমাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল ।যেভাবেই হোক একটা
উপায় বের করতেই হবে তাকে ।অনেক ভেবে চিন্তে রাশান ঠিক করল তার মুক্তির পথ ।
বারান্দায় গিয়ে বসল রাশান ।ভোরের স্নিগ্ধতা কেটে গেছে।রৌদ্র প্রখর হতে
চলেছে ।টেবিলে রাখা কিছু সাদা কাগজ একটা নীল পেপারওয়েটে চাপা পড়ে আছে
।নীল রংটা খুব প্রিয় রাশানের ।পাশেই নীল কালির কলমটা পড়ে ছিল।সেটা তুলে
নিয়ে সে লিখতে শুরু করল -
প্রিয় নাহার
আমি জানিনা কেন তোমাকে লিখছি ।এও জানিনা আদৌ তোমার কাছে চিঠিটা পৌঁছাবে
কিনা ।তবু লিখছি ।
তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালবাসা ।আমি তোমাকে একটু বেশিই হয়ত ভালবেসে
ফেলেছিলাম ।এখনো বাসি ।অনেক অনেক বেশি ভালবাসি ।
কিন্তু তোমায় জানানো হবে না আর কোনদিন ।আমি চলে যাচ্ছি ।তুমি কেন আমায় আগেই
বলনি যে তুমি আমার হবে না ,তুমি অন্য কারো ?তাহলে কি তোমার বুকে মাথা
গুঁজবার স্বপ্ন দেখতাম ?তোমার চোখের জলের কষ্টগুলো মুছে দিতে চাইতাম ? কখনো না ।ভেবেছিলাম তোমায় ভুলে যাবো ।কিন্তু তোমায় ভোলা অসম্ভব ।
জানো ?আমার অনেক চোখ জ্বলছে ।কিন্তু আমি ঘুমাতে পারছি না ।এজন্যে তুমিই দায়ী ।চিন্তা করো না ।আমি একটু পরেই ঘুমাতে যাচ্ছি ।তুমি দায়মুক্ত হবে।
চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে রাখল রাশান ।অকস্মাত্ রোদ পড়ে গেছে ।দমকা বাতাস
ছুটছে ।বৃষ্টি হবে বোধহয় ।ভিজতে ইচ্ছে করছে তার ।
কিন্তু পা চলছেই না ।মেইন গেইট পর্যন্ত যেতেই ওকে বেগ পেতে হল ।
ছুটির দিন বলে তখনো বাসায় কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি।সবাই পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে !ভীষণ হিংসে হতে লাগল রাশানের ।
মেইন গেইটটা হ্যাচকা টানে খুলে ফেলল রাশান ।ছাদে যাবে ।দরজা খোলার সময় একটু ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হল ।তবে মনে হয় না তাতে ঘুম ভাঙবে ।
টালমাতাল অবস্থায় সিঁড়ি ভেঙে সাততলা ছাদে পৌঁছাতে ভারী কষ্ট হল ওর ।ছাদের দরজাটা হাট করে খোলা ।দারোয়ান চাচা খুলে রেখেছে বোধহয় ।
ছাদে পা রাখা মাত্রই জলের একটা কোমল পরশ তাকে ছুঁয়ে গেল তাকে ।বৃষ্টি এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে!ছাদের এক কোণায় সালাম আঙ্কেলদের টবে কিছু ফুল ফুটে আছে ।অদ্ভূত সুন্দর ফুলগুলো সে চিনে ।কিন্তু নাম মনে
করতে পারলো না ।
উদাস ভঙ্গিতে আকাশের দিকে চাইল রাশান ।বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ভারী এলোমেলো ।
ঠিক তার জীবনের মত ।রাশানের দুচোখ জ্বলছে ।মুক্তির পথটা দ্রুত বেছে নিতে
হবে ,বিড়বিড় করে বলল সে ।
হাঁটতে হাঁটতে পকেট হাতড়ে লাইটারটা বের করল রাশান । একটা সিগারেট ধরাল ।গুঁড়ি
বৃষ্টির মাঝে সিগারেটের সাদা ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে ,রাশান অনমনে চেয়ে আছে
সেদিকে ।
সিগারেটে কয়েক টান দিয়েই তার ইচ্ছে মরে গেছে ।সিগারেটটা ফেলে দিয়ে সে আচ্ছামত মাড়িয়ে দিল ।
ছাদটা ঢালাই দেওয়া হয়েছে কদিন আগে।এখনো রেলিং তৈরি হয়নি ।কিনারায় গিয়ে
নিচের দিকে পা ঝুলিয়ে বসল রাশান ।আশ্চর্য! কাজটা আগেও করার চেষ্টা করেছে,তবে ভয় পেয়ে সরে এসেছে ।অথচ আজ তার একটুও ভয় করছেনা!
মুক্তির জন্য তৈরী রাশান ।সে সুইসাইড করবে ।সাত তলা থেকে লাফ দিবে ।
আরে এত তাড়াহুড়ো কিসের !আরো কিছু সময় সুন্দর পৃথিবীর বুকে কাটুক।আরো কিছু সুন্দর স্মৃতি নিয়েই নাহয় মায়ের কাছে যাবে সে।
আচ্ছা,সে মারা গেলে তার মায়ের কাছে যেতে পারবে তো ?মায়ের কোলে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে তো ?
বছর তিনেক আগের ঘটনা।রোড একসিডেন্টে মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের কিছু কথা তার মনে পড়ে গেল ।
"বাবা রাশান ,
কেঁদোনা ।আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাদের ছেড়ে চলে যাবো ।তুমি জানো তোমার আব্বু কী পরিমাণে কষ্ট করে। তাকে সামলানোর দায়িত্ব আজ থেকে তোমার ।তুমি
কোনদিন তাকে কোন আঘাত দিবে না ।কথা দাও বাবা !"
'কথা দিলাম মা !'
........
আকাশটা নীল ।একটুও মেঘ নেই কোথাও ।বৃষ্টি থেমে গেছে ।
নাহারকে লেখা আধভেজা চিঠিটা জ্বলতে দেখা গেল ।ছাইগুলো পড়ে রইল বারান্দায় ....
রাশান সুইসাইড করবেনা ,আর চোখ জ্বলছেনা ওর....