somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাফফারা জাসদ দেয়নি, বঙ্গবন্ধু ও দেশ দিয়েছে

৩১ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১০:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১. কাফফারা জাসদ দেয়নি। কাফফারা দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর তার পরিবার। পরিবারের নিরপরাধ নারী ও শিশু। বাঙালি জাতির ঐক্যের মিলিত মোহনায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি ঘাতকের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার মধ্য দিয়ে রক্তের বন্যায় ভাসতে ভাসতে কাফফারা দিয়েছে একটি সদ্য স্বাধীন জাতি। কাফফারা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উঠে আসা একটি তরুণ সাহসী প্রজন্ম। জাসদ স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আলোর দুয়ার খুলতে পারেনি। উগ্র রোমান্টিক হঠকারী পথে হাঁটতে হাঁটতে তারা শুধু জনবিচ্ছিন্নই হয়নি, রীতিমতো দেউলিয়া রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। জনমত গঠনে ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি বিভ্রান্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের বিরোধ বারবার ভাঙনের তীরে নিয়ে দলটিকে রিক্ত-নিঃস্বই করেনি মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে। দেউলিয়া জাসদের নেতারা দুই আনি ক্ষমতার অংশীদারিত্বের পুরস্কার অর্জন করেছেন। কাফফারা দিয়েছে স্বাধীনতার চেতনায় উঠে আসা একটি সাহসী প্রজন্ম। সদ্যভূমিষ্ঠ বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা একটি তরুণ প্রজন্ম সেই বিভ্রান্ত হঠকারী নেতৃত্বের হাত ধরে স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে তাদের মেধা ও সৃজনশীলতাকে নিঃশেষ করেছে।

এককালের প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশের মেডিকেল কলেজসহ সব শিক্ষাঙ্গনে তারুণ্যকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো অন্ধকার পথে টেনে নিয়েছিলেন জাসদ নেতৃত্ব। সেই জাসদের উচ্চাভিলাষী নেতৃত্বের দু-চার জন নানা সময়ে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেও দেশ গড়ার সংগ্রামে যে তারুণ্য শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারত তারা ব্যর্থতার চোরাবালিতেই ডুবেছে। সংসদের বিগত অধিবেশনে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখতে গেলে স্বাধীনতা-উত্তর জাসদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্কের সূচনা ঘটেছিল। সেখানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বুকভরা দহন নিয়ে সেই জাসদের কর্মকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরে এক হাত নেন। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু সংসদে থাকলেও কথা বলেননি। জাসদের কার্যকরী সভাপতি মাইনুদ্দিন খান বাদল দাঁড়িয়ে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বাদল বলেছেন, পিতার সঙ্গে বেয়াদবি বা সমালোচনা করে যদি কোনো ভুল করে থাকি তবে সেই ভুলের কাফফারা দিচ্ছি এখন! হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ! মুজিবকন্যার অাঁচল ধরে নৌকায় চড়ে জীবনে প্রথম আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করে সংসদে এসেছেন ছয়জন নেতা। আলাদাভাবে নির্বাচন করলে এদের অনেকে প্রার্থীই হতেন না। মন্ত্রীও হয়েছেন। অথচ বলছেন, কাফফারা দিচ্ছেন! কাফফারা দিয়েছে দেশ, জাতি, জনগণ ও তার নেতা। মাইনুদ্দিন খান বাদলরা পুরস্কৃত হয়েছেন।

এ বিষয় নিয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম, এককালের জাসদ ছাত্রলীগের জন্মকালীন সাধারণ সম্পাদক, ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না এবং কাজী সিরাজ এ নিয়ে কলাম লিখেছেন। জাসদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো ফ্যাক্টর দূরে থাক সাংগঠনিক অস্তিত্ব খুঁজতে দুরবিন লাগাতে হয়। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাসদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে গভীর গবেষণার অন্তর্নিহিত অর্থ লুকিয়ে রয়েছে।

২. জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মেজর (অব.) এম এ জলিল। যৌবনে বিদ্রোহ করলেও শেষ জীবনে দক্ষিণপন্থি ইসলামী রাজনীতির পাকিস্তানি ভাবধারায় হাঁটতে হাঁটতে মৃত্যুবরণ করেন। জাসদ নেতৃত্বের বিভ্রান্তির এখানেই শুরু নয়। ষাটের ছাত্রলীগের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রচার, স্বাধিকার-স্বাধীনতার আন্দোলনের পথে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভাব, সত্তরের গণরায় ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সেই সময়কার ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে সিরাজুল আলম খানের অবদান ইতিহাসের ক্যানভাসে বর্ণময়, উজ্জ্বল এবং গৌরবের। '৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মণি, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, এম এ রউফসহ ৬০ জন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আওয়ামী লীগে যোগদান করার মুহূর্তে একজনের নাম শূন্য থেকে যায়। তার নাম সিরাজুল আলম খান। মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান এই নেতা জাসদ প্রতিষ্ঠার নেপথ্য কারিগর হলেও তিনি সংগঠনের কোনো পদ-পদবি নেননি। স্বাধীনতা-উত্তরকালের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে রহস্যময় পুরুষ হয়েই রয়েছেন। ইতিহাসের অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন তার কাছে রয়েছে। বর্তমান ও অনাগত প্রজন্মের জানার জন্যই জীবনের পড়ন্ত বেলায় তার সেসব প্রশ্নের উত্তর খোলাসা করা দরকার। জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদকে কার্ল মার্কসের ধারায় 'শুয়োরের খোঁয়াড়' বলেছিলেন। পার্লামেন্টকে রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট বলেছিলেন। সেই তিনি সেনাশাসক এরশাদের '৮৮-এর নির্বাচন যখন সব রাজনৈতিক দল বর্জন করেছে তাতে অংশগ্রহণ করে গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা হয়ে প্রমাণ করেছেন, সেদিনের জাসদ নেতৃত্বের মাথায় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের মুকুট থাকলেও ক্ষমতার লোভ ও মোহ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেননি। ব্যক্তিগত জীবনে তাদের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ভূমিকা নিজেদের প্রতি কী নির্দয় অবিচারের রূপ উন্মোচন করেছে তা জাতি দেখেছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার আগের শাসনামলে আ স ম আবদুর রব মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা জাসদের আরেক প্রতিষ্ঠাতা শাজাহান সিরাজ হাসপাতালে সংজ্ঞাহীন রয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে ইতিহাসের শাজাহান সিরাজের প্রতি কতটা অবিচার করেছেন তা ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে। একই সঙ্গে প্রশ্ন থেকেই যায় জাসদ নেতৃত্বের হঠকারী পথে যেসব কর্মী জীবন দিয়েছিলেন তাদের রক্তের দাগ মুছতে না মুছতেই নিজেদের পরিবর্তিত অবস্থানের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ও জবাবদিহিতা কী কর্মী, কী মানুষের কাছে না দিয়েই যেভাবে পরবর্তীতে ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়েছেন বা ভাঙা-গড়ার পথ নিয়েছেন সেখানে সেই আত্দোৎসর্গকারী কর্মীদের কথা কি ভেবেছিলেন?

৩. প্রতিষ্ঠাকালীন জাসদের সহ-সভাপতির শূন্যপদটি রাখা হয়েছিল কর্নেল (অব.) তাহের বীর উত্তমের জন্য। মুজিব সরকার উৎখাতের রাজনীতির পথহাঁটা আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়া জাসদের গণবাহিনীর প্রধান কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীতে সৈনিক সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন। গণবাহিনীর হত্যা, সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াওর উগ্র রোমাঞ্চকর রাজনীতি '৭১-এর পরাজিত শক্তির পাল্লাই ভারী করেনি, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ে গ্লানির তিলক পরা বিশ্বমোড়লদের হাতকেও শক্তিশালী করে দেয়। চিলির আলেন্দের মতো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপট ও পরিবেশ তৈরি করে দেয়। ৭ নভেম্বর জাসদ ও গণবাহিনীর তথাকথিত বিপ্লবের চিত্রপট প্রমাণ করে দেয় ১৫ আগস্ট জাতির জীবনে কালরাত না এলেও তাদের একটি শক্তিশালী আঘাত নিঃসন্দেহে আসত বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের জন্য। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দিলেও সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পর ৭ নভেম্বর উল্লসিত জাসদের মুখের হাসি মিলিয়ে যায় সূর্যাস্তের আগেই। জিয়াউর রহমান তাদের বিপ্লবী সরকারের ফাঁদে পা না দেওয়ার কারণেই জাসদের কাছে হয়ে যান বিশ্বাসঘাতক। কিন্তু ক্ষমতা দখলের যে পথ জাসদ ও গণবাহিনী নিয়েছিল খোদ সেনাবাহিনীতে হঠকারী বিপ্লবের বীজ বপন করে সেটি একটি সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আলোকে জাতির সঙ্গে কতটা বিশ্বাসঘাতকতা সেই প্রশ্নের সদুত্তর কখনো দেয়নি। জাসদ নেতৃত্ব বরাবরই অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন। তাই ইতিহাসের কাঠগড়ায় অতীতে, বর্তমানে এমনকি ভবিষ্যতেও জাসদ নেতৃত্বকে দাঁড়াতে হচ্ছে; দাঁড়াতে হবেই।

৪. ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জনগণকে খাবার দিতে, মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হিমশিম খাচ্ছেন; রাস্তা নেই, ব্রিজ নেই, বিধ্বস্ত যোগাযোগব্যবস্থা, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী বিশ্বমোড়লদের নেতিবাচক অবস্থান মিলিয়ে এক করুণ পরিস্থিতি সেই সময় যখন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসা শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা তখন আওয়ামী লীগ যেমন সবাইকে নিয়ে সরকার গঠনের পথে হাঁটেনি, তেমনি '৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সিরাজ শিকদারের পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি হরতালের ডাক দিয়ে বসে। তাই নয়, রাতের অন্ধকারে বিপন্ন বাংলার পাটের গুদামে আগুন, প্রকাশ্য দিবালোকে শ্রেণিশত্রু খতমের নামে জনপ্রতিনিধিদের হত্যা, থানা লুটসহ নানা নাশকতায় লিপ্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের রূপরেখায় সদ্যস্বাধীন দেশের '৭২ সালের ২১ জুলাই মুজিববাদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগানে বিভক্ত ছাত্রলীগের সম্মেলন ডাকার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তিকে বিভক্ত করে দেওয়া হয়। এই বিভক্তির দায় শুধু একা জাসদের নয়, এটি যেমন সত্য তেমনি যারা জাতির পিতাকে বিভক্ত অংশের সম্মেলনে টেনে নিয়েছিলেন তারাও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে '৭৩ সালের ১ জানুয়ারি মস্কোপন্থিরা কার ইন্ধনে হরতাল ডেকে রক্ত ঝরিয়েছিলেন? বঙ্গবন্ধু যখন একক নেতা, তার সামনে কথা বলার ঔদ্ধত্য যখন কারও নেই তখন তার হাতে গড়া সন্তানদের দিয়ে '৭২ সালের ৩১ অক্টোবর চরম মুজিববিদ্বেষী জাসদের জন্ম কাদের ষড়যন্ত্রের ফসল? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর ৪২ বছরেও জাতির সামনে খোলাসা হয়নি। দেশের শিক্ষাঙ্গনে যখন ক্লাস নেওয়ার শ্রেণিকক্ষ নেই, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞে শেষ হয়ে গেছে অবকাঠামো তখন ছাত্রলীগের ভাঙনের মুখে ডাকসু নির্বাচন কেনই বা দেওয়া হয়েছিল? অন্যদিকে গোটা দেশে যেখানে আওয়ামী লীগ নামের রাজনৈতিক শক্তির একচ্ছত্র প্রভাব সেখানে '৭৩ সালের নির্বাচনে কিছু কিছু আসনকে বিতর্কিত করা হলো কার স্বার্থে? এমনকি ৫০টি আসনেও যদি জাসদসহ অন্যান্য দল বিজয়ী হয়ে যেত তাহলে কী এমন সর্বনাশ হয়ে যেত? সেদিন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটি হিসেবে উগ্রপন্থি জাসদ, সর্বহারা পার্টি, অতিবিপ্লবী চীনারা যেমন ব্যবহৃত হয়েছেন তেমনি শাসক দলের একাংশ ক্ষমতার দম্ভ আর উন্নাসিকতা এবং স্বজনপ্রীতিতে ডুবে ছিলেন। তা সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের মতো রক্তাক্ত কর্মসূচি জাসদ কেন নিয়েছিল? বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আসেনি। সেদিন কেন এসেছিল? সেদিনের জাসদে মুক্তিযুদ্ধের টগবগে তারুণ্যের হাত ধরে সূচনা ঘটলেও পরবর্তীতে দেশের শিক্ষাঙ্গন ও মফস্বল শহরজুড়ে দেখা গেছে জাসদের কাফেলায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরাও যোগ দিয়েছেন। নিষিদ্ধ ছাত্রসংঘের (ছাত্রশিবির) সদস্যরাও ঠাঁই পেয়েছেন। এমনকি পাকিস্তানি দালালদের সন্তানরা সক্রিয় ভূমিকায় জাসদ রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। সর্বোপরি গণবাহিনী গঠনের মাধ্যমে যে অরাজকতা ও ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে জাসদ জনবিচ্ছিন্নই হয়নি, আমজনতার রোষের মুখে পতিত হয়েছিল। এমনকি বাড়ির তরুণ লম্বা চুল রাখলে, মুরুবি্বদের সঙ্গে তর্ক করলে বলা হতো এ তো দেখি জাসদ হয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে।

৫. আমাদের রাজনীতির গৌরব হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে ভাষা ও গণতন্ত্রের অধিকার অর্জিত হয়েছে, রাজনীতিবিদদের কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আমাদের রাজনীতির দীনতা হচ্ছে পৃথিবীর অনেক রাজনীতিবিদ ও শাসক কিংবদন্তির নায়কে পরিণত হলেও ইতিহাস বলে তারা ফেরেশতা নন, এত সাফল্যের মধ্যে তাদেরও ভুলত্রুটি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও দলগুলো ভুল স্বীকার করে দেশের জনগণের কাছে দূরে থাক নিজ দলের কর্মীদের কাছেও ক্ষমা চাইতে জানেন না। আওয়ামী লীগ নামের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটির পরতে পরতে বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা হয়ে যায়, কিন্তু আজীবন গণতন্ত্রের সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে মস্কোর প্রেসক্রিপশনে আর ন্যাপ কমিউনিস্টের খপ্পরে পড়ে একদলীয় বাকশাল গঠন ছিল ভুল, তা স্বীকার করা হয়নি। উগ্র হঠকারী জাসদ ভ্রান্ত রাজনীতির পথে পথে ভুলের চড়া মাশুল দিতে গিয়ে যেমন হাজার হাজার কর্মীর জীবন শেষ করে দিয়েছে তেমনি একটি সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রা হোঁচট খাইয়ে দিয়েছে, সর্বহারাসহ প্রতিক্রিয়াশীলদের লাভবান করে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করে অমার্জনীয় অপরাধ করেছে তা স্বীকার করে জাতির কাছে নেতারা ভুল চাইতে নারাজ। এদের সঙ্গে মস্কোপন্থিদের জীবিত বঙ্গবন্ধুর সামনে কখনো আনুগত্য আর হত্যাকাণ্ডের পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের খাল কাটা বিপ্লবের কোদাল হাতের কর্মী হওয়ার ভুলের জন্যও ক্ষমা চাইতে হয় না।

৬. স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাসদ ও চীনপন্থিরা মুজিব সরকার উৎখাতের নামে হঠকারিতার চরম পথ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে 'গণকণ্ঠ' ও 'হক কথা' মিলিয়ে যে মিথ্যাচার হয়েছে তা একাত্তরের পরাজিত শক্তিও করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশের শিক্ষাঙ্গনের তারুণ্যনির্ভর এই রাজনৈতিক শক্তি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির পথ যতটা আগলে ধরেছে ততটা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। জাতির পিতাকে বঙ্গবন্ধু বলতেও তারা চরম কার্পণ্য দেখিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ ছাত্র সংসদগুলোয় ছাত্রলীগের বিজয়ে নির্বাচিতরা অভিষেক অনুষ্ঠানে জাতির মহান নেতার নাম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তা পণ্ড করে দিয়েছে। ডাকসুতে 'বঙ্গবন্ধুর' ছবি উঠলে জাসদের গায়েই আগুন লাগে। সেই তারা আওয়ামী লীগের ক্ষমতার অংশীদার হয়ে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও আওয়ামী লীগ সরকারের গুণকীর্তনে ঘাম ঝরালেও আজও ব্যাখ্যা দেননি কেন তারা সেদিন ওই উগ্র পথ নিয়েছিলেন। কেন তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও জাতির জনকের প্রাপ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করেছেন? তবে কি তাদের সেদিনের রাজনীতি ভুল বলে স্বীকার করছেন? স্বীকার করে থাকলে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে আপত্তি কোথায়? ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না একজন সৃজনশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে আমার পছন্দের মানুষ। তিনি সম্প্রতি লিখেছেন- 'জাসদ রাজনীতি '৭৪-এর ১৭ মার্চের পর থেকে '৭৫-এর ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ছিল অ্যাডভেঞ্চারে ভরা। গণবাহিনী, ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন হাইজ্যাকের চেষ্টা, ৭ নভেম্বর এবং তার পরবর্তী অভ্যুত্থানের চেষ্টা সবই ছিল উগ্র ও হঠকারিতায় ভরপুর। ফলে তছনছ হয়ে যায় জাসদ।' মাহমুদুর রহমান মান্না এই জাসদের হয়ে সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোয় তার বাগ্মিতায় কট্টর মুজিব সরকার ও আওয়ামী লীগকে সমালোচনার তীরে ক্ষতবিক্ষত করে তারুণ্যকে দলে টেনেছেন। সেই মাহমুদুর রহমান মান্না জিয়া-এরশাদের সঙ্গে গেলে মন্ত্রী হতেন নিঃসন্দেহে। বিএনপিতে গেলে অনেক বড় নেতাও থাকতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর তিনি কখনো বলেননি তার অতীত রাজনীতি ছিল ভুলে ভরা। জাসদ করে তারা ভুল করেছেন, তাই আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছেন। না হয় আওয়ামী লীগে কেন এসেছিলেন? আজ আবার আওয়ামী লীগ করতে না পারার বেদনা থেকেই কি সরকারের সমালোচনায় মুখর? মান্না '৭৩-এর ডাকসুর ব্যালট বাঙ্ ছিনতাইয়ের জন্য আওয়ামী লীগের অনুশোচনা হচ্ছে কি না জানতে চেয়েছেন। কিন্তু '৭৩-এর ডাকসু নির্বাচন তো আওয়ামী লীগ করেনি! ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল ছিল। ব্যালট বাঙ্ ছিনতাইয়ের দায় ছাত্র ইউনিয়ন নেবে না কেন?

৭. জাসদের যে কজন নেতার নাম লেখায় এসেছে তাদের কারও প্রতি আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা আক্রোশ নেই। বরং অনেকের সঙ্গে রয়েছে সখ্য। তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান মাথায় তুলে রাখার মতো। কিন্তু বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য অতীতের পোস্টমর্টেম হওয়া জরুরি। তাদের ভুলের মাশুল কতটা চড়া তা তারাই ভালো জানেন। মাইনুদ্দিন খান বাদল আওয়ামী লীগের বদান্যতায় দুবার সংসদে এসে গুণকীর্তন করেন। সেটি তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু যখন বলেন, পিতার সমালোচনা বা পিতার সঙ্গে বেয়াদবি করার কাফফারা দিচ্ছেন তখন প্রশ্ন ওঠে কাফফারা কোথায় দিচ্ছেন? ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করছেন আর পিতার সঙ্গে এ কেমন বেয়াদবি যে জাতিকে নেতৃত্বশূন্য হতে হয়েছে আপনাদের উগ্রতায়, হঠকারিতায়? এমনকি '৭৫-উত্তরকালে জিয়াউর রহমানের কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় যেতে না পারার গ্লানি বুকে নিয়েও আপনারা কীসের জন্য চরম মুজিববিদ্বেষী ও আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক ছিলেন? তবে কি সেটি ভুল ছিল? নাকি আজ ক্ষমতার অন্ধ মোহে শাসকগোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য এমন করছেন?

পীর হাবিবুর রহমান
( বাংলাদেশ প্রতিদিন )
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×