ওর হাসির শব্দটা আমার বাছে বড়ই অদ্ভুত লাগে। ওর
হাসির সাথে গ্রাম্য টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার
খানিকটা মিল আছে। গ্রাম শব্দটা ব্যবহারের কারণ
হচ্ছে টিনের বাড়ি ওয়ালা চালা গ্রামেই বেশি দেখা
যায়। টিনের চালে ঝড়ে পড়া বৃষ্টির কিন্তু আলাদা
একটা ছন্দ আছে। যদি ছোট ছোট ফোটায় বৃষ্টি পড়ে
তাহলে এক ধরনের শব্দ আর যদি বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়ে
তাহলে আর এক ধরনের শব্দ হয়। আমার মাঝে মাঝে
টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে পড়তে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নামা
শুরু করলে এক ধরনের শব্দ হয়, ঠিক এই শব্দ টাই আমার
মধ্যে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। জয়তির হাসির শব্দটা
ঠিক একই রকম। টিপটিপ করে নামতে নামতে হঠাৎ ঝুপ
করে নামার মত। ও প্রথমে মুখে হাত দিয়ে ঠোট চেপে
হাসে, নিজেকে সামলাতে পারেনা ও!ঠিকই একসময়
খিলখিল করে হেসে ওঠে।আমার ভেতরটা কেন যেন
দুমড়ে-মুচড়ে যায় সে সময়!আমার খুব ইচ্ছে করে তখন ওর
দিকে তাকিয়ে থাকতে।খুব ইচ্ছে করে খিলখিল হাসির
সাথে সাথে কেঁপে ওঠা চোখের পাতা দেখতে!হাসির
দমকে কিভাবে ওর চোখে জল এসে যায়,খুব দেখতে ইচ্ছে
করে আমার! জয়তি এখন যে বিষয়টা নিয়ে হাসছে,তা
হলো রং।আমি ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম,রং
জিনিসটা কেমন?আর এটা শুনেই ও হাসতে হাসতে শেষ!
-"এটা কোন প্রশ্ন হলো!রং আবার কেমন!রং তো রঙের
মতো!সাদা,কালো,নীল,ধূসর......" -"আচ্ছা,সাদা রং টা
কেমন"? -"কি অদ্ভুত প্রশ্ন!সাদা রং আবার কেমন!সাদা
রং তো সাদা রঙের......." জয়তি কথা শেষ করতে
পারেনা,থেমে যায়।আমি জানি,ও এখন আর কথা বলতে
পারবেনা।আমি এ ও জানি,এই মেয়েটা এখন আমার
সামনে থেকে ছুটে পালাবে।আড়ালে গিয়ে অনেকক্ষন
কাঁদবে।ফিরে এসে বলবে,"নিয়াজ ভাই,তুমি আমার উপর
রাগ করোনি তো?" আমিও যে কি না!কেন যে এসব
জানতে ইচ্ছা করে আমার!কি হবে জেনে,রং কি?
বিভিন্ন ধরনের রং ই বা দেখতে কেমন?যে জিনিস
কখনো দেখা হয়নি,তার প্রতি এতো আগ্রহ না থাকাটাই
ভালো।আগ্রহ যতো কম হবে,কষ্ট ও ততো কম হবে।
ছোটবেলা থেকেই আমার চোখ নষ্ট।এভাবে না বলে,বলা
উচিত্,আমি অন্ধ।আগে খুব খারাপ লাগতো এই কথাটা
বলতে বা ভাবতে।কিন্তু,এখন আর খারাপ লাগেনা।আমি
মেনে নিয়েছি আমার ভাগ্যকে। ছোটবেলা থেকেই
আমি এক অর্থে ঘরের ভেতর বন্দী।আমার বয়সী ছেলেরা
যখন বাড়ির সামনের উঠোনটাতে ছুটোছুটি করতো,আমি
তখন ঘরের ভেতর চুপ করে বসে থাকতাম।ইচ্ছা করলেই
হয়তো ওদের সাথে খেলতে পারতাম।আমি দেখতে
পাইনা কিন্তু আমার তো দুটি পা এবং দুটি হাত আছে!
ইচ্ছা করলেই ওদের সাথে হয়তো ছুটোছুটি করতে
পারতাম,এক একটি পদক্ষেপের সাথে হয়তো হোচট খেয়ে
পড়ে যাওয়ার ভয় থাকতো,কিন্তু তার মাঝেও বোধহয়
একটা আনন্দ ছিলো।এই আনন্দটা কখনো আমি উপভোগ
করতে পারিনি।কারন আমি কখনোই ঘর ছেড়ে বাইরে
যেয়ে ওদের সাথে ছুটোছুটি করার চেষ্টা করিনি।আমার
খুব অস্বস্তি লাগতো এইটা ভেবে,যাদের সাথে খেলবো
তাদেরকে আমি কখনোই দেখতে পাবোনা অথচ তাঁরা
আমাকে সবসময় দেখবে! আমি জয়তিদের বাড়িতে আছি
প্রায় ৪ বছর হতে চললো।ওরা আমার আপন কেউ
না,লতায়পাতায় আত্মীয়।মা তো সেই কবেই হারিয়ে
গেছে অজানার দেশে!বাবা ও যখন আমাকে কিছু না
বলেই অজানার দেশে চলে গেলো,তখন আমার কি
অবস্থা হয়েছিলো তা ঠিক বোঝাতে পারবোনা।বাবা
আমার সার্বক্ষনিক সঙ্গী ছিলো,সেই বাবাও যখন
আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেলো,তখন আমি বুঝতে
পারলাম,এই পৃথিবীর মাঝে আমি একটা ধূলিকনা ছাড়া
আর কিছুই না!আমার যখন দিশেহারা অবস্থা,তখনই
জয়তির বাবা আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন।আপন
আত্মীয়-স্বজনই যখন আমার দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি
জানালো,তখন এই মানুষটা কেন আমার দায়িত্ব নিলেন
তা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা।বাবা আমাকে একবার
বলেছিলো,মানুষ তাঁর সারাজীবনে একটি ভালো
মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারে।বাবা যদিও অনেক
বেশী উল্টাপাল্টা বকতো,কিন্তু আমার মনে হয় বাবার
এই কথাটা ঠিক।আমি আমার জীবনে একজন ভালো
মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছি,আর তিনি হলেন
জয়তির বাবা।এই লোকটার সাথে আমার কথা-বার্তা খুব
কমই হয়।মাঝে মাঝে তিনি আমার রুমে আসেন।তিনি যে
কথাটা সবচেয়ে বেশী বলেন তা হলো, -"বাবা,তুমি যে
চোখে দেখতে পাওনা,এর জন্য কিন্তু মনের ভেতর কোন
দুঃখ জমায়ে রাখবানা।পৃথিবীটা অনেক খারাপ একটা
জায়গা,মানুষগুলো ও অনেক খারাপ।মাঝে মাঝে আমার
মনে হয়,আমি কেন অন্ধ হলাম না!" আমি হাসি।খুব সহজ
সরল এই মানুষটা।প্রতিবার যাওয়ার আগে আমাকে বলে
যান, -"বাবা,আমার যদি খুব বেশী টাকা থাকতো,আমি
তোমাকে অনেক বড় ডাক্তার দেখাতাম।আমার খুব
খারাপ লাগেরে বাবা......." আমি বুঝতে পারি,মানুষটা
চোখ মুছতে মুছতে চলে যায় তখন।আচ্ছা,একটা মানুষ
কিভাবে এতো ভালো হয়! জয়তি আমার ৫ বছরের ছোট।
অনেক আবেগী মেয়েটা।মাঝে মাঝেই আমাকে
গল্প,উপন্যাস বা কবিতা পড়ে শোনায়।আর সেগুলো যদি
কষ্টের হয়,তাহলে চোখের জলে সব ভাসিয়ে দেয়!আমি
অবাক হয়ে বলি,"এই গাধী মেয়ে,তুই কাঁদছিস কেন?"ও
তখন ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,"আচ্ছা,নিয়াজ ভাই,তুমি
কি বলতে পারো,লেখকেরা কেন এতো কষ্টের গল্প
লেখে?এরা কি আনন্দের কোন গল্প লিখতে পারেনা?"
এতো আবেগী মেয়েকে কিছু বোঝানো কঠিন!এই
মেয়েটা অসম্ভব রকমের ভালো।সবসময় আমার পেছনে
ছাঁয়ার মতো থাকে!আমার কখন কি লাগবে তা ঠিকই ও
বুঝতে পারে! জয়তি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে!ও
এমন ভাবে কোন কিছুর বর্ননা দেয় যে আমি চোখে না
দেখা সত্ত্বেও মনে হয়,আমি সবকিছু দেখতে পারছি!
মেয়েটা একটু পাগলী টাইপের।জোছনা রাতে চাঁদের
আলোতে না ভিজলে নাকি তাঁর ঘুম হয়না!ওকে অবশ্য
দোষ দিইনা,ওর বয়সী মেয়েরা এরকম আবেগী হয়েই
থাকে।তবে সমস্যা হলো,ওর সাথে আমাকেও চাঁদের
আলোতে ভিজতে হয় আর ওর বকবকানি শুনতে হয়!আমার
থেকে ভালো শ্রোতা আর কেই বা আছে!আমি যে খুব
একটা অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকি তাও কিন্তু না!ওর মন
ভাল থাকলে মাঝে মাঝেই গান গেয়ে শোনায়।ও এই
গানটা প্রায় শোনায় আমাকে, "চাঁদের হাসি বাধ
ভেঙ্গেছে উপচে পড়ে আলো ও রজনীগন্ধা তোমার
গন্ধসুধা ঢালো......." আমার খারাপ লাগেনা ওর পাশে
বসে থাকতে।কিন্তু,কিছুদিন ধরেই মেয়েটার যেনো কি
হয়েছে।এইতো কয়েকদিন আগেই এক রাতে এসে আমাকে
বললো,"নিয়াজ ভাই,আজ জোছনা রাত।চলো,একসাথে
ভিজবো।" আমি বললাম,"যে চাঁদের আলোয় তুই ভিজতে
চাস,সেই আলোতো আমি দেখতে পাইনা,আমি কিভাবে
ভিজবো বল!" জয়তি কিছুক্ষন চুপ করে থাকে।তারপর খুব
আস্তে করে বলে,"তুমি আমার চোখ দিয়ে জোছনা
দেখবে।আমার হাত ধরে ভিজবে চাঁদের
আলোয়,পারবেনা?" আমি চমকে উঠি!এ ধরনের কথা
শোনার জন্য আমি কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না!মেয়েটা
কোন ভুল করতে যাচ্ছে না তো!আমার ধারনা ধীরে
ধীরে সত্য প্রমানিত হয়।আমি বুঝতে পারি,মেয়েটা
অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে।আমার সাথে নিজেকে
জড়িয়ে ফেলেছে!আর কখনোই ওর পাশে বসে চাঁদের
আলোয় ভেজা হয়নি আমার!এখনো ও আমাকে
ডাকে,একসাথে জোছনায় ভিজবে বলে,কিন্তু আমি
যাইনা।অনেক অজুহাত দিয়ে বসে থাকি চুপ করে।আমি
বুঝতে পারছিলাম না আমার ঠিক কি করা উচিত্!অনেক
চিন্তা ভাবনা করে,অবশেষে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি
আমি....... -"নিয়াজ ভাই,তুমি আমার উপর রাগ করোনি
তো?" জয়তি ফিরে এসেছে।আমি ওকে বলি, -"নাহ্!তোর
উপর কি কখনো রাগ করেছি পাগলী?আমার রুমের সব
কিছু,এমন কি আমার ব্রাশে পেস্ট পর্যন্ত লাগিয়ে আমার
হাতের কাছ রাখিস তুই!কিভাবে রাগ করবো আমি?"
-"আমার যে কি হয় মাঝে মাঝে,বুঝতে পারিনা!মনে
হয়,তুমি সব কিছু দেখছো!তাই তো বারবার ভুল করি" আমি
কিছু বলিনা,মেয়েটার কথা শুনি শুধু। -"আজ কিন্তু
পূর্নিমা।আজ একসাথে বসে চাঁদের আলো খাবো!না
করতে পারবানা কিন্তু!আমি একটু পরে এসে ডেকে নিয়ে
যাবো" -"আজ পারবোনা।মাথা ব্যথা করছে খুব।" -"আমি
জানতাম,তুমি একটা না একটা অজুহাত দেখাবে,আমাকে
এড়িয়ে যাওয়ার জন্য।আমার পাশে বসে থাকতে কি
তোমার খুব বেশী কষ্ট হবে?" -"সত্যিই আজ খুব মাথা ব্যথা
করছে।আরেক দিন না হয়......." জয়তি অনেক অভিমান
নিয়ে চলে যায়।আমি জানি,এই মেয়েটা কেঁদে কেঁদে
আজ বালিশ ভেজাবে।আমি ওকে কিভাবে
বোঝাবো,আমারো খুব ইচ্ছা করে ওর পাশে বসে ওর
হাতটা ধরতে!পরম নির্ভরতার একটা আশ্রয় খুঁজে পেতে
ইচ্ছা করে ওর মাঝে!কিন্তু,আমি কখনোই আমার
ইচ্ছাগুলো পুরন করতে পারবোনা।বাস্তবতা আমাকে সে
সুযোগ দেবে না।এই আবেগী মেয়েটাকে আমি কখনোই
এই কথাগুলো বোঝাতে পারবোনা,কখনোই না.......
পৃথিবীটা ঘুমিয়ে পড়েছে।মানুষগুলো ও।আমাকে বের
হতে হবে এখনই।জামা কাপড় আগেই কিছু গুছিয়ে
রেখেছিলাম।বাবার রেখে যাওয়া অল্প কিছু টাকার
কিছু অংশ দিয়ে অনেক কষ্টে একটা ট্রেনের টিকিট
জোগাড় করেছি।কোন না কোন ভাবে স্টেশন পর্যন্তও
চলে যেতে পারবো।খুব খারাপ লাগছে এভাবে চলে
যেতে,কিন্তু.....বাস্তবতা অনেক কঠিন,আমাকে যেতেই
হবে....... ট্রেনের জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস
ঢুকছে।আজ পূর্নিমা।চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে
পৃথিবীটা।এক অসীম শূন্যতা এসে আমাকে জাপটে ধরে।
এই রাতে,কোন এক মানবীর পাশে বসে,তাঁর দৃষ্টি দিয়ে
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার কথা ছিলো আমার!
আচ্ছা,আমি কি কাঁদছি!জয়তি যে বলেছিলো,আমি
আবেগহীন একটা মানুষ!তাহলে,কেন জলের ধারা বাঁধ
ভেঙ্গেছে আজ? শেষ রাতের ট্রেনটা ছুটে চলে তার
গন্তব্যের দিকে।আর ট্রেনের ভেতর বসে থাকা ''নাজিয়াত''
নামের ছেলটি ছুটে চলে গন্তব্যহীন গন্তব্যের
দিকে...............