দক্ষিণ কোরিয়ার নান্দনিক চলচ্চিত্রের নির্মাতা কিম কি দুক তার “The Bow” ছবির গল্পটা শুরু করেন ঠিক লোকালয় থেকে অনেক দূরে সমুদ্রের মাঝে । এক ষাট বছরের বৃদ্ধের বেঁচে থাকা ছোট একটা পুরোনো জাহাজে, আর একেই উপজীব্য করে কাহিনী শুরু । প্রতিদিন নিয়ম করে সেই বৃদ্ধ ক্যালেন্ডারে এক একটা দিনের তারিখে ক্রস চিহ্ন দেয় । দশ বছর ধরে সেই অপেক্ষা আর মাত্র কয়েকটা দিন পরেই সেই দিন । তার সেই ছোট জাহাজে একটা বৌদ্ধ মূর্তির ছবি ,আর তাকে লক্ষ্য করে তার ধনুকের তীর ছুটে যায় । নিঃসঙ্গতার বেড়াজালে আবদ্ধ এ বৃদ্ধের জীবনের আনন্দ , অনুভূতি কিংবা কষ্ট সব প্রকাশ পেতে থাকে প্রতিটা সময়ে ছবির ফ্রেমে ।
গল্পের লেখক “The Bow” ছবির নির্মাতা কিম কি দুক নিজেই । সেলুলয়েডে গল্প বন্দি করার এক চমৎকার দক্ষতা আছে এ কোরিয়ান নির্মাতার । ছবির গল্পকে যেন খুব বেশি আপন করে তুলতে পারে দর্শক তা খুব ভালোভাবে জানেন এ পরিচালক । শিল্পের বুনন , গল্পের মাধুর্যতা যেন একেকটা মুহূর্তকে জীবনবোধের একটা হু হু হাহাকার সৃষ্টি করে দেয় ছবির প্রতিটা অংশজুড়ে । জীবনটা শিল্পীর রংতুলির আঁচড়ের মতন ঠিক লাল-নীল-বেগুনী । ছবির একেকটা ফ্রেমে দক্ষ এ নির্মাতা সময়কে যেভাবে বন্দী করেছে , যেভাবে আলো ছুটে এসেছে জাহাজে কিংবা দূরের গন্তব্যের যে সীমারেখা টেনেছেন কিংবা সুরের যে মূর্ছনা এবং তাতে হারিয়ে যাওয়া এবং কষ্টগুলো ভুলে থাকার যে একটা অন্যরকম প্রয়াস তা ঘড়ির কাটার সময় বাড়ার সঙ্গে আরও খুব বেশি করে দর্শকে আঁকড়ে ধরবে ।
প্রায় সময় বৃদ্ধের কাছে আসে বিভিন্ন মানুষ ,তার জাহাজে বসে বরশি দিয়ে মাছ ধরতে । সেই বৃদ্ধ তাদের আপ্যায়ন করে , কিছু আয়ও করে এভাবে। দক্ষ এ তীরন্দাজের প্রতিটা তীরই লক্ষ্যব্রষ্ট হয় সবসময় , প্রতিবারই সেই বৌদ্ধ মূর্তির ছবিকে ছেদ করে । কি এক মায়া যা আচ্ছন্ন করে রাখে বৃদ্ধকে । মানুষ তার কাছের মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে ।সেই অনুভূতিটা বেশিরভাগ মানুষই মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারেনা । বৃদ্ধের এই নিঃসঙ্গ জীবনে আসা প্রেম , এই ভালোবাসার জন্যে তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড মুহূর্তেই যে কাউকে অবাক করবে । এক অল্প বয়সী তরুণীকে ভালোবাসা এবং সেই ভালোবাসার আগে ও পরের অদ্ভুত সময়কাল ছবিতে প্রকাশ পায় । জীবনবোধ , জীবনাচরণ মানুষকে অনেকটা অন্যরকম করে দেয় তা কিম কি দ্যুকের চলচ্চিত্রের ভাষায় বারবার ঘুরেফিরে আসে । সমুদ্রের একাকীত্ব , ভালোবাসার মানুষকে আগলে রাখা ও তার প্রতি ভালোবাসা ,নিজের ভেতরের মানুষটাকে যেন প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করেছে সেই বৃদ্ধ । চারপাশের অথই জলরাশির জলধ্বনি কিংবা ভোরের স্নিগ্ধ আলো কিংবা রাতের তারার খেলা গভীর সমুদ্রে একজন বৃদ্ধের জীবনে কতটা জীবনবোধকে যে আন্দোলিত করে তার এক মূর্তমান প্রকাশ পরিচালক ফুটিয়ে তুলেছেন যথেষ্ঠ মুনশিয়ানায় ।
ক্যালেন্ডারের একটা তারিখের জন্যে যে অপেক্ষা , যে আবেগ অভিনেতার প্রতিটা ভাবে প্রকাশ পায় তা কখনো কখনো যেমন রুঢ় মনে হবে একজন দর্শকের কাছে ,ঠিক তার পরের মুহূর্তেই মনে হবে এটাই ঠিক এটাই বাস্তব । মানুষের জীবনের এই প্রকাশটাই আসলে সত্য ।সবার আত্নপ্রকাশ বা নিজেকে প্রকাশ করাতো একরকম নয় । বৃদ্ধতো আসলেই একজন মানুষ , তারওতো আবেগের একটা জায়গা থাকা দরকার । উত্তাল সমুদ্রের মাঝে জাহাজে বসবাস করা বৃদ্ধের অপেক্ষা আর উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকা আসলেই যৌক্তিক তখন মনে হবে । সমুদ্রের বিশাল ঢেউ এর মাঝেও জীবনটাকে নিজের মতন করে গড়ে তোলা যায় , জীবনের অর্থ খোঁজা যায় তা এ চলচ্চিত্রের নির্মাতার নির্মাণশৈলী দেখে আরেকবার মনে হবে । মনে হবে একবার হারিয়ে যাইনা গভীর সমুদ্রে জাহাজের সাথে , একবার জীবনকে বেছে নেই অন্য মানুষদের কাছ থেকে আলাদা করে । দিন শেষে রাতে একটু জোছনার আলো কিংবা সাগরের গর্জনতো মন্দ নয়।
নব্বই মিনিটের বুকের ভেতর হুহু করে ওঠা জীবনের খুব বেশি ভেতরে ছুটে যাওয়া জীবনমুখী এ কোরিয়ান ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৫ এ । অভিনয় করেছে -Yeo-reum Han, Si-jeok Seo, Gook-hwan Jeon প্রমুখ । শৈল্পিক চলচ্চিত্রের নান্দনিক পরিচালক কিম কি দুক এর চলচচ্চিত্রটি ভালোবাসা ও নাটকীয়তার অবয়ব । যাকে মানুষ ভালোবাসে তাকে বারবার মানুষ বাঁচাতে চায় , বারবার তার সানিধ্যের জন্যে ছুটে যায় , তার কাছে থাকতে চায় । ভালোবাসার মানুষের প্রতি যে অব্যক্ত ভালোবাসা থাকে মানুষের প্রতি যা ভালোবাসার মানুষটি হয়ত কখনই বুঝতে পারেনা , তবুও অনেক কিছু যেন বলা হয়ে যায় ইশারায় কিংবা চোখের ভাষায় ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১১