somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রেললাইন - একটি চুমুর গল্প (অখণ্ড)

২১ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নাইন্টিন নাইন্টি-টু'র কথা। হবিগঞ্জের মতো একেবারেই মফস্বল একটা শহরে একজোড়া তরুণ তরুণীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গল্প করাটা ভয়ানক কিছু! ছোট্ট শহরে যে কেউ দেখে ফেলার ভয়, দেখে ফেললে কি যে ভাববে, বাসায় বিচারও চলে যেতে পারে। সেই ভয়কে তোয়াক্কা না করেই কলেজের ফার্স্ট গেটের সামনে শেষবারের মতো দাঁড়িয়ে ছিল বাচ্চু ও শেলী। তখন বাচ্চুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল, আটকানোর কোন চেষ্টাই ছিল না। শেলী কথা শেষ না করেই গটগট করে হেঁটে একটা রিকশা নিয়ে চলে গেল। পা ছড়িয়ে মাটিতে বসতে বসতে বাচ্চু দেখলো রিকশা অনেক দূরে গিয়ে বাঁয়ে বাঁক খেয়ে চলে যাচ্ছে।



হবিগঞ্জ ততদিনে জেলাসদরের সকল সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে নি, যদিও ১৯৮৪ সালের পয়লা মার্চ (সতেরো ফাল্গুন) সাবেক সেনা প্রধান এরশাদ শাসনামলে সিলেট জেলার অন্তর্গত মহকুমা শহর থেকে জেলা শহরে উন্নীত হয়েছিল। এর আগে ১৮৭৮ সাল থেকেই হবিগঞ্জ সিলেট জেলার অংশ ছিল। সিলেট জেলা তখন যুগ্ম ভারতের আসাম প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। বৃটিশ শাসকগণ প্রশাসনিক সুবিধার জন্য জেলাসমূহকে সাব-ডিভিশনে ও সাব-ডিভিশনসমূহকে থানায় বিভক্ত করে। এরই ধাবাবাহিকতায় সিলেট জেলাকে মহকুমায় এবং মহকুমাসমূহকে থানায় বিভক্ত করা হয়। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে সিলেট জেলাতে সিলেট সদর, করিমগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ মহকুমা সৃষ্টির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয। তবে সরকারী অর্থাভাবে যথাসময়ে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সুনামগঞ্জ মহকুমা গঠন করার পর ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে হবিগঞ্জ মহকুমা গঠন করা হয়। এককালে হবিগঞ্জের নাম 'হাবিবগঞ্জ' ছিল, পরে কালের বিবর্তনে নাম বদলে যায়।



শহরে একমাত্র ছেলেমেয়েদের কমবাইন্ড কলেজ হচ্ছে 'বৃন্দাবন সরকারী কলেজ', তখন কলেজের ছেলেমেয়েরা নিজেদের পরস্পরের কাছ থেকে যতটা দূরে রাখা সম্ভব রাখতে চেষ্টা করতো। তবুও যে এখানে প্রেমভালবাসা হত না যে তা না, হত; অনেকটা লুকিয়ে, প্রেম হয়ে গেলেও লুকাছাপার একটা ব্যাপার থাকত। কলেজের সেকেন্ড গেট দিয়ে ঢুকলেই বিশাল মাঠ সামনেই পড়ে; মাঠের বাঁপাশে শহীদ মিনার, শহীদ মিনারের পাশে একটা গাছ, বিশাল মাঠে একাকীত্বের প্রতীক যেন। মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তে কলেজ মসজিদ, মসজিদের সামন দিয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়ার রাস্তা। রাস্তার গোড়ায় মসজিদের সামনেই বিশাল একটা বটগাছ। গাছের শেকড়ে ছেলেমেয়েরা বসত। মসজিদের পিছনেই ছিল একটা পুকুর, বাঁধানো ঘাট, ঘাটে বসে মেয়েরা দলবেঁধে আড্ডা দিত।

কলেজের সেকেন্ড গেটের ওপাশেই একটা খাল, খালের ওপারে জেলা কারাগার। লাল রঙের লোহার মোটা গরাদের গেট, সবসময় পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকত। জেল এলাকায় সবসময় লোক গমগম করত, জেল কোয়ার্টার খালের পাশ ঘেঁষেই। অদূরে জেলের মসজিদের পাশেই বাঁধানো ঘাটওয়ালা বিশাল এক পুকুর। পুকুরের ঘাটে বসলে রাস্তার ওপাশে উঁচু দেয়ালে ঘেরা স্টেডিয়াম দেখা যায়। জেলের মধ্য দিয়ে একটা হাঁটা রাস্তা আছে, ঐ রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে একেবারে শেষ মাথায় গার্লস স্কুল 'বাসন্তী কুমার গোপালচন্দ্র সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়', গার্লস স্কুলের সামনে গিয়ে রাস্তা হাতের ডানে মোচড় খেয়েছে, সেদিকে এগুলেই সংস্কৃতিচর্চা প্রতিষ্ঠান 'সুরবিতান', সুরবিতান থেকে একটু এগুলেই তিন রাস্তার মোড়, সেখান থেকে সোজা প্রেসক্লাব, ডানে গেলে বাঁপাশে স্টেডিয়াম, স্টেডিয়ামের পরেই একটা পুরানো জেলা পরিষদের দালান, একসময়ে সাবডিভিশনাল অফিস ছিল এবং তার চারপাশে বড় বড় কড়ই গাছ। এসবের ডান পাশে জেল মসজিদের ঐ পুকুর এবং সামনে এসে ঐ রাস্তা কলেজের থার্ড গেটের সামনে ব্যাক রোডের সাথে মিলেছে।

হবিগঞ্জকে 'পাজামা শহর'ও বলা হয়ে থাকে, তার একটা কারন আছে। পাজামার শুরুর দিকে যে কোমর থাকে, সেই কোমর হচ্ছে শহরের শায়েস্তানগর এলাকা এবং সেখান থেকে দুদিকে দুপায়ের মতো একটা মেইন রোড ও আরেকটা ব্যাক রোড চলে গেছে একেবারে শহরের শেষমাথায় বাজার পর্যন্ত যেখানে কিনা খোয়াই নদীর মুখ। এই নদীর তীরে বাজারকে ঘিরেই শুরু হয়েছিল একসময় এ শহরের যাত্রা। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের খালখনন কর্মসূচির আওতায় শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত খোয়াই নদীকে কেটে শহরের অনেক বাইরে দিয়ে দিক পরিবর্তন করা হয়। এর ফলে পুরোনো নদীটা শহরের মধ্যে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, লেকের মতো অনেকটা দেখতে। এই মৃত নদীর পাড়েই পুলিশ থানা, তত্‍কালীন হাসপাতাল আর সদ্য জেলা প্রসাশকের কার্যালয়, ফৌজদারী আদালত। আর নতুন নদীমুখে গড়ে উঠে বাজার, চৌধুরী বাজার।

শহরের ঠিক পাশ দিয়ে রেললাইন ছিল, দুটো রেলস্টেশন এখনও আছে, একটা কোর্টস্টেশন নামে পরিচিত ও আরেকটা বাজার স্টেশন। সকাল বিকাল দুবেলা 'বাল্লা' নামক একটা লোকাল ট্রেন চলত শায়েস্তাগঞ্জ অবধি।





নব্বইসালের একেবারে শেষের দিকে এসে বাচ্চু তার চাচার বাসায় উঠলো রাজনগরে, বাড়ি থেকে এসে কলেজে ক্লাস করা কঠিন হয়ে পড়ে এ যুক্তি বাবাকে বুঝিয়ে চাচার বাসায় এসেছে পড়ালেখা করতে। বাচ্চুর চাচা ইসহাক সাহেব অনেক আগেই গত হয়েছিলেন। তখনকার সময়েই সেই বাসা দোতলা ছিল ঐ এলাকায়। বাসার পাশে জেলা পরিষদের কর্মকর্তার বাসভবন, এককালে তার চাচা যখন চাকরি করতেন তখন ঐ কোয়ার্টারে থাকতেন। আরেকপাশে জেলা কারাগারের পতিত নিচু জমি, যেখানে বারোমাসই পানি জমে থাকত। ইসহাক সাহেবের পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে। বিয়ের বাকী ছিল ছোট মেয়ে আর ছোট ছেলেটা। বড় ছেলে সংসার দেখাশুনা করে, বিরাট বড় সংসার, মোটামুটি বলতে গেলে যৌথ পরিবারই। বাসার নাম তাদের বংশ উপাধি অনুসারে 'তরফদার ভিলা', বাসার পিছনে জেলা পরিষদের পুকুর আর পুকুরের কিনারা ঘেঁষে সুইপার কলোনী। আশেপাশে আর তেমন কিছুই ছিল না, সরকারি স্কুলের চকদার স্যারের বাসা 'চকদার ভিলা' এবং আশেপাশে কয়েকটা বাসা ছিল। রাস্তার ওপাশে রেজা স'মিল ছিল, কিছু অস্থায়ী ও সেমি পাক্কা মুদি দোকান ছিল। অনেক অনেক আগে এখানে একটা লাইব্রেরি ছিল 'পুঁথিঘর'।

বাচ্চুর কাজ বাসায় বলতে তেমন কিছুই ছিল না, বাসায় কাজের লোকের অভাব নেই। তার প্রধান কাজ হচ্ছে প্রতিদিন সকালে উঠে কলেজে যাওয়া এবং বিকেলে বাসায় ফেরা, সন্ধ্যার পর ছোট্ট রুমটিতে ভীড়ের মধ্যেই পড়তে বসা। আর সপ্তাহ শেষে বাড়িতে যাওয়া। তার দিন কাটছিল এভাবেই, কলেজে তেমন একটা বন্ধু পরিচিত কেউ নেই, একেবারেই সাধারণ অন্য আর দশটা গ্রাম থেকে শহরে আসা ছেলেদের মতো।





কলেজে বাচ্চুর প্রথম ক্লাসের দিনে একেবারে পিছনের দিকে একটা বেঞ্চে বসেছিল তার এলাকার কিঞ্চিত পরিচিত একটা ছেলের সাথে। ক্লাস শুরু হওয়ার পরে দেরিতে একটা মেয়ে এসে ক্লাসে ঢুকলো। ভেজা খোলা চুল ছড়িয়ে রেখেছে পিঠে, খুব সম্ভবত সকালে ঘুম থেকে উঠেই গোসল করেছে, মাথার চুল তখনও শুকোয় নি তাই বোধ হয় খুলেই এসেছে। কপালে ছোট্ট একটা টিপ, আর পুরো মুখজুড়ে স্নিগ্ধতা; বেশ মায়াকাড়া চেহারা। বাচ্চুর চোখ যেন আটকে থাকলো ওখানেই ক্যামেরার ফ্রীজশটের মতো, তার মনে হতে লাগলো অনন্তকাল ধরে এ চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যাওয়ার একটা প্রচলন আছে, প্রথম দেখায়ই মেয়েটির জন্যে বুকের ভিতরে কেমন জানি একটা অনুভূতি অনুভব করে বাচ্চু। কেউ কেউ বলে প্রথম দেখার প্রেমে কষ্ট থাকে বেশি, বাচ্চু অবশ্য সে কথা জানতো না।




বাড়ি থেকে শহরে আসা তেমন কষ্ট সাধ্যির ব্যাপার ছিল না তবুও সে শহরে আসলো। আসলে তার উদ্দেশ্য ছিল অন্য, খোঁজ বের করা সেই মেয়েটির পাশাপাশি থাকা। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে মেয়েটিকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিল। ক্লাসে মেয়েটি থেকে একটি নির্দিষ্ট কৌণিক দূরত্ব রেখে এমন ভাবে বসত যেন সে দেখতে পায় ঠিকই কিন্তু মেয়েটি যেন তাকে দেখতে না পায়। প্রতিদিন ক্লাসে বসে মেয়েটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। দূর থেকে লক্ষ্য করত মেয়েটির প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, বান্ধবীদের সাথে কথা বলা, হাসি। বেখেয়ালে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় কয়েকদিন স্যারের চোখে ধরাও পড়লো। একদিন এক মোক্ষম সময়ে মেয়েটির নাম জেনে গেলো, এক বান্ধবীর দূর থেকে ডাকের মাধ্যমে, 'শেলী'।
ঐদিন রাতে বাড়িতে গিয়ে উত্তেজনায় তার ঘুম আসলো না, বারবার শেলীর প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি তার চোখে ভাসতে লাগলো। রাতে পড়ার সময়ে সে খাতার শেষ পাতায় 'বাচ্চু', 'শেলী' নাম দুটো লিখে তার মধ্যে একটা যোগ চিহ্ন দিয়ে দিলো। পরে কেটে ফেলে কালি দিয়ে গাঢ় করে পাছে কেউ দেখে ফেললে যদি জিজ্ঞেস করে তখন তো উত্তর দিতে পারবে না।




তার কয়েকদিন কলেজ ছুটি শেষে জেল গেটে দাঁড়িয়ে দুটো ছেলের সাথে টুকটাক আলাপ করছিল, একটু পর লক্ষ্য করলো শেলী সেকেন্ড গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। শেলী হেঁটে অনেকদূর চলে যাওয়ার পর সে ছেলেদুটোর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে তার পিছনে হাঁটা শুরু করলো। পিছন পিছন হেঁটে হেঁটে তার বাসা পর্যন্ত গেলো, তখনই মাথায় খেলা করলো একটা বিষয়, 'আরে এ তো চাচার বাসার কাছেই, রাজনগরেই।'
তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই সে ছুটি শেষে জেলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকত শেলীর চলে যাওয়া দেখার জন্যে, মাঝে মধ্যে পিছন পিছন বাসা অবধি যেত। ঐদিন থেকেই তার মাথায় ঘুরতে লাগলো কি করে বাবাকে বুঝিয়ে শহরে চাচার বাসায় আসা যায়।




এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো, শেলীর সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজতে খুঁজতেও পেলো না। এরমধ্যে সে চাচার বাসায় এসে স্থায়ী হয়ে গেছে। হঠাত্‍ একদিন সেই সুযোগটা করে দিলো তাদের ক্লাসেরই আরেক মেয়ে রুবি। ক্লাস থেকে বের হবে এমন সময় আচমকা চোখ পড়লো বারান্দার এক কোণায় রুবি আর শেলী দাঁড়িয়ে। রুবি তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো, বুকটা ধ্বক করে উঠলো অজানা আশঙ্কায়, ইতস্ততভাবে এগিয়ে গেলো তাদের দিকে। কাছে যেতেই রুবি বললো, 'ইংলিশ স্যারের বাসা চিনো?'

জড়তা কাটিয়ে উঠতে না পারা বাচ্চু মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' সূচক উত্তর দিলো যদিও সে বাসা চিনতো না।

রুবি শেলীকে দেখিয়ে বলল, 'ইলা আমার বান্ধবী, স্যারের বাসাত যাইতো, বাসাডা চিনাই দিবায় নি?'

আমতা আমতা করে ঘাড় কাত করলো সে, ঠিক হলো ছুটির পর স্যারের বাসায় তার সাথে শেলী যাবে।

তার মনের মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো, কল্পনা করতে লাগলো কি কি বলবে। ভাবতে লাগলো, রিকশা করে দুজন একসাথে যাবে! আবার চিন্তা করলো, শেলী কি তার সাথে রিকশায় উঠবে? তাছাড়া লোকে দেখলে কি ভাববে!

একূল ওকূল ভাবতে ভাবতে ছুটির ঘন্টা বেজে গেলো, ক্লাসে তার পাশে যে ছেলেটি বসে তাকে জিজ্ঞেস করে স্যারের বাসা চিনে নিলো। ক্লাস শেষে শেলী দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো, বাচ্চু কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না, চোখ দিয়ে ইশারা করেই হাঁটা শুরু করলো। তার পিছন পিছন শেলী হাঁটতে লাগলো।


কলেজ গেটে তখন ছুটি শেষে প্রায় সব ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে, এত লোকের ভিড়ে বাচ্চু কেমন জানি লজ্জা ও ভয় পাচ্ছিল, যদি সবাই বুঝে ফেলে সে যে শেলীকে পছন্দ করে! সে মনে মনে ভাবছিল রিকশা নিবে কিন্তু দুজনে একসাথে রিকশায় উঠার সাহস পেল না কিংবা লোকে একইসাথে দেখলে কি ভাববে তা ভেবে রিকশা ঠিক করলো না। পুরোটা পথ সে উসখুস করতে লাগলো ভিতরে ভিতরে, শেলীকে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারছিলো না। মেয়েরা সাধারণত আস্তে হাঁটে, বাচ্চুর হাঁটার গতির সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে শেলীর কষ্ট হচ্ছিল, পিছন থেকে আস্তে করে ডাক দিলো, 'ওই অত জোরে আঁটো কেল্লাইগ্গা?'

বাচ্চু হাঁটার গতি কমিয়ে দেয়। স্যারের বাসা ছিল কালীবাড়ি ক্রস রোডের ঐদিকে, অগ্রণী ব্যাংকের কাছাকাছিই। স্যারের বাসার সামনে এসে বাসা দেখিয়ে বলল, 'উই যে, উইটা স্যারের বাসা।'

স্যারের বাসার গেটের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে শেলী তাকে ধন্যবাদ স্বরূপ একটা হাসি দিলো, বিনিময়ে সেও একটা হাসি ফিরিয়ে দিলো। শেলী স্যারের বাসার ভিতরে ঢুকে যাওয়ার অনেকক্ষণ পর পর্যন্ত সে ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তায়। প্রথমবারের মতো কথা বলা এবং পাশাপাশি হেঁটে আসার রোমাঞ্চ বেশ কিছুদিন স্থায়ী ছিল তার মনে। এরপর থেকে ক্লাসে দেখা হলে টুকটাক চোখের ইশারায় কিংবা মুখে কুশলাদি বিনিময় হতো। কিছুদিন পরেই অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা প্রথমবর্ষের ছিল। পড়াশুনায় মোটামুটি মনোযোগ দিলো যদিও পড়তে বসলে পড়ার চেয়ে মন বেশি শেলীকে টানে।



পরীক্ষার দিনকয়েক আগে একদিন ছুটি শেষে অনেক সময় পর্যন্ত বাচ্চু জেল গেটে দাঁড়িয়েও শেলীর দেখা না পেয়ে, খুঁজতে লাগলো তাকে ক্যাম্পাসেই। এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে এসে দেখে চার নম্বর কক্ষে শেলী একা বসে বইখাতা নিয়ে পড়ছে। জানালার পাশে সে দাঁড়িয়ে রইলো খানিকক্ষণ। ছায়া দেখে চোখ তুলে বাচ্চুকে দেখে ভিতরে ডাকলো শেলী। ভিতরে গিয়ে বাচ্চু বলল, 'বাসাত যাইতায় না আজকে?'

খাতা থেকে মাথা তুলে শেলী উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, 'ফড়া শ্যাষ অইছে না, দুইদিন ফরে ফরীক্ষা, কিচ্ছু ফারি না, বাসাত বইয়া ফড়া যায় না, ঝামেলা থাকে।'



শহরে যে বাসায় শেলী থাকে সেটা তার খালার বাসা। দু রুমের ছোট্ট টিনশেডের বাসা, বাসার আয়তনের চেয়ে লোকসংখ্যা বেশি। খালা, খালু ও তিন ছোট ছোট ভাইবোন এবং বড় খালার ছেলে থাকে তার। শেলীর মা থাকেন নবীগঞ্জে মামাবাড়িতে, জেলা শহরের নিকটবর্তী এক থানাসদরে। শেলীর বাবা নদীতে নৌকাডুবিতে মারা গেছেন অনেক আগেই, সে তখনও ভালো করে বুঝতে শিখে নি 'বাবা' কি জিনিস আর 'মৃত্যু' কী। তারপর থেকেই তার মা সে আর তার বড় বোনকে নিয়ে মামাবাড়িতে থাকেন। স্কুলজীবন নবীগঞ্জে শেষ করে শহরে এসে বৃন্দাবন কলেজে ভর্তি হয়েছে। খালার বাসায় থেকে পড়াশুনা করার ঝামেলাও আছে, বাসার কাজে সাহায্য করতে হয়। ছোট ভাইবোনের দুষ্টুমি কান্নাকাটির কারনে ঠিকমতো পড়তেও পারে না, তাই পরীক্ষা সামনে দেখে বাধ্য হয়ে ছুটির পর ক্লাসে বসে একা একা পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।


ঝামেলার বিবরণী শুনে বাচ্চু খাতার দিকে ঝুঁকে এসে দেখতে চাইলো সে কি পড়ছে, যা শেলী পড়ছিল তা কয়েকদিন আগেই সে পড়েছে এবং ভালো করেই পারে। সে সামনের বেঞ্চে উল্টো হয়ে শেলীর মুখোমুখি বসে পড়া দেখিয়ে দিতে লাগলো।




মাসতিনেকের মধ্যে তারা অনেক ভালো বন্ধু হয়ে গেলো। প্রতিদিন ক্লাসের শুরু এবং শেষে দুজনের কথা হত। প্রতিদিন বাসায় ফিরে বেশ রোমাঞ্চিত থাকত বাচ্চু, রাতে পড়তে বসলে পরে মাথায় ঘুরতো, পরদিন আবার দেখা হবে! পরদিন আবার তার সামনে বসে গুটগুট করে কথা বলবে শেলী, এসব ভাবতে ভাবতে সে রোমাঞ্চিত হত খুব। মনে মনে অনেক কল্পনা সাজাত, পরদিন এসে শেলীকে কি কি বলবে তা ভাবত কিন্তু শেলীর সামনে আসলে কোনকিছুই বলতে পারত না। মজার কল্পনাগুলো করতে করতে বেশ ভালো সময় কাটাতো সে। পড়ালেখার ব্যাপারে একজন যা পারে না তা অপরজন দেখিয়ে দিত, খাতা নোট বই এসব তাদের মধ্যে বেশ আদানপ্রদান হত। বাচ্চু একবার একটা খাতার মধ্যে করে তার লেখা একটি কাব্যিক চিঠি ঢুকিয়ে দিলো। পরদিন সে বেশ উত্তেজিত ও উদ্বিগ্ন ছিল শেলী এসে ক্লাসে কি প্রতিক্রিয়া দেখায় তা ভেবেই।

সেদিন ক্লাস শেষে শেলী ডাক দিলো বাচ্চুকে। সে আসলে দাঁড়িয়েই ছিল তার জন্যে। শেলী এসে তাকে বলল, 'চলো আজকে ঘুইরা আই।'

বাচ্চু চোখ উল্টিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কই যাইতায়?'

শেলীর প্রতিউত্তর, 'রেললাইনের ইখানো।'


দুজনে হেঁটে হেঁটে কলেজের ফার্স্ট গেট থেকে বেরিয়ে কলেজের পিছনেই অদূরে রেললাইনের উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো, বাঁপাশে শহরের তখনকার একমাত্র কিন্ডারগার্ডেন স্কুল 'দি রোজেস', বিশাল খোলা মাঠ আর ডানে আনসার ক্যাম্প পেরিয়ে একেবারে রাস্তার শেষে রেললাইন। রেললাইনের ওপাশটা পুরোপুরিই খালি। দূরে বহুদূরে গ্রাম দেখা যায়, মধ্যে সব পতিত জমি। ফসলের সময় ধান চাষ করা হয়, বর্ষায় থাকে ভরা টুপটুপে পানি, এর মধ্যেই সামান্য একটু উঁচু জায়গা আছে। খোলা জায়গা বিধায় বাতাসের তীব্রতা বেশি, বাতাসে শেলীর চুল উড়ছিল। বারবার হাত দিয়ে মুখের উপর আছড়ে পড়া অবাধ্য চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে। বাচ্চু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তাকে, কপালে লাল ছোট্ট টিপ, হাল ফ্যাশানের লাল সালোয়ার কামিজে তাকে যেন লাল টুকটুকে বউ মনে হচ্ছে। মেঘলা আকাশের ফাঁকে উঁকি দিয়ে আসা তীর্যক রোদ্রে ঝলমল করছিল তার পুরোটা চেহারা। টুকটাক গল্প করতে করতে তারা রেললাইনের দুপাশে দুজনে স্লিপারের ধাপে ধাপে পা রেখে হাঁটছে। হঠাত্‍ শেলী তাকে জিজ্ঞেস করলো, 'আইচ্ছা কালকে বইর ভিত্রে ইটা কিতা দিছলায়?'

থতমত খেয়ে বাচ্চু বলল, 'কই! কিচ্ছু না তো! মনে অয় আমার লেখা কুনো কাগজ গ্যাছে গা ভিত্রে।'

অন্যদিকে তাকিয়ে শেলী বলল, 'ও আইচ্ছা, তুমি তো লেখো ভালাঐ, আইচ্ছা কবিতার মাইজ্ঝ্যে 'এসো আমরা ভালবাসায় করি মাতামাতি' ই লাইনটার মানে কিতা?'

'কুনো মানে নাই, কবিতার ছন্দ মিলাইতে লেখছি আর কি!' কি সুন্দর মিথ্যে বলে চেপে গেলো বাচ্চু তখন। সে বুঝতে পারলো না আসলেই কি শেলী বুঝতে পেরেছে কিনা এটা তার উদ্দেশ্য প্রণোদিত কাজ।

অনেকক্ষন চুপ থেকে শেলী বলল, 'আমারে টুকটাক ইরখম লেইক্খা দিবায় নি? আমার ভালাঐ লাগছে।' বলেই হাসতে লাগলো।

হাসির পাল্টা জবাব দিয়ে বাচ্চু বলল, 'আইচ্ছা দেখি।'




ঐদিনের পর থেকে ক্লাস শেষে তাদের ঘুরোঘুরির জায়গা হয়ে দাঁড়ালো রেললাইন। কখনো বিকেল, কখনো দুপুর, রেললাইন ধরে পাশাপাশি হাঁটত তারা। বাচ্চু একদিন বলে, 'আও লাইনের উফ্রে দিয়া আঁটি।'

শেলী বলল, 'নাহ পইড়া যাইমু গিয়া।'

বাচ্চু মনে মনে চাচ্ছিল লাইনের উপর দিয়ে হাঁটতে গেলে তো ভারসাম্য ধরে রাখতে হাত ধরতে হবে আর এটাই সুযোগ হাত ধরার। অবলীলায় এড়িয়ে গেল তা শেলী হয়ত বুঝতে পেরেই। ততদিনেও হাত ধরা হয় নি দুজনার, বাচ্চুর হাত ধরতে খুব ইচ্ছে হয়। একবার একটা খাতা দিতে গিয়ে আঙুলের সাথে আঙুল হালকা স্পর্শ লেগেছিল যদিও তা ঠিকমতো টের পায় নি সে। বেচারা তখন মুখ গোমড়া করে এগিয়ে যেতে থাকলো।

মাঝে মাঝে ট্রেন যেত, লাইন ছেড়ে পাশে দাঁড়াত, ট্রেনের যাত্রীরা হা করে তাকিয়ে থাকত তাদের দিকে। আশেপাশের লোকজনের কেউ কেউ গবাধি পশু চড়াতে আসতো এই রেল লাইনে, তারাও হা করে তাকিয়ে থাকতো। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে একা একা পাশাপাশি থাকাটা তখন ছিল অত্যাশ্চর্য একটা বিষয়। কখনো তারা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে রেললাইনে পাশাপাশি বসত যেন দূর থেকে কেউ দেখলে কিছু মনে না করে। তবে প্রায় সময়ই শেলী বসত না, তার নাকি বসতে ভালো লাগে না। বসতে ভালো লাগে না, না পাশাপাশি বসলে কেউ দেখে ফেলবে তার ভয় তা ঠিক বুঝে উঠতে পারত না বাচ্চু। তার খুব ইচ্ছে শেলীকে নিয়ে ভরা পানির ঐ জায়গায় যে উঁচু ঢিবিটা আছে তাতে বসার কিন্তু বসার কথা বলতে পারেনি। কিছু কথা থাকে প্রিয়জনের সামনে আসার পর বলা হয় না অথচ আগে কতবারই না ভাবা হয় সেই কথাটা নিয়ে! প্রিয়জন কখনও জানতেও পারেনা মনের কথা।





দিন গড়িয়ে যাচ্ছিল এভাবেই তাদের। বন্ধুতার আড়ালে এক বুক ভালবাসা নিয়ে বাচ্চু পথ চলে কিন্তু কখনো বুঝতে পারে না শেলীর মনে কি আছে। হয়ত তার মনে নিখাদ বন্ধুতা! ব্যাপারটা বেশ পীড়া দেয় বাচ্চুকে। সে তার ভিতরের কথা প্রকাশ করতে চায়, আবার করতে ভয় পায় যদি যে বন্ধুত্ব তাও নষ্ট হয়! যেমন চলছে চলুক না, মন্দ তো নয়, ভালোই তো! প্রথমবর্ষ পেরিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উঠে তারা, পড়ালেখার চাপ বাড়ে, গল্প আড্ডার পূর্ব বিষয় দৈনন্দিন জীবন থেকে প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ক্লাস, স্যার আর পড়াশুনার বিষয়। দিন চলে যায়, ঘড়ির কাঁটা যেন দ্রুত ঘুরতে থাকে দুজন একসাথে থাকলে, টেরই পায় না কেউ। এক ফাল্গুনে প্রথম কথার পর চৈত্র বৈশাখ পেরিয়ে বর্ষা শেষে আশ্বিন মাস আসে। মাঝে মধ্যে শেলী বাড়িতে যেত, গেলেও দুয়েকদিনের জন্যে, যাওয়ার আগে প্রত্যেকবার বাচ্চুকে জানিয়ে যেত আর বলে যেত যেন সে ক্লাস নোটগুলো রাখে তার জন্যে। বাচ্চু যত্ন করে পড়া তৈরী করে রাখত তার জন্যে।

প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষায় পুরো ক্লাসে প্রথম হলো শেলী আর দ্বিতীয় বাচ্চু, কয়েকমার্কের ব্যবধান মাত্র। দুজনেই নিজ নিজ ফলাফলে এবং যৌথ প্রচেষ্টায় পড়ালেখার সুফল পেয়ে সীমাহীন আনন্দিত। সময় গড়িয়ে আস্তে আস্তে নির্বাচনী পরীক্ষা এগিয়ে আসলো। ক্লাসে তাদের ঘনিষ্ঠতা ও ভালো ফলাফল সহজে কেউ মেনে নিতে পারলো না, মুখে কিছু না বললেও তারা অন্যচোখে দেখত ব্যাপারটাকে। ক্লাস বাকী সবার সাথেই মোটামুটি একটা সম্পর্ক ছিল সহপাঠী হিসেবে, ক্লাসের বাইরে তেমন কারো সাথেই বিনা দরকারে কথা হত না শেলীর। বাচ্চুও তেমন কারো সাথে মিশত না, শেলী যতটা সময় থাকে ঠিক ততটা সময় তার সাথেই, এছাড়া আর কারো সাথে থাকত না। ক্লাসে যে দুতিনটা ছেলের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল তাদের সাথেই মিশত বাচ্চু। তারা দুজনও তেমন একটা গা করত না পাছে লোকে কি বলছে তাতে।




বহুদিন তাদের আর রেললাইনে যাওয়া হয় নি পড়ালেখা আর পরীক্ষার ব্যস্ততায়। একদিন আবার শেলীকে বাচ্চুকে প্রস্তাব দিল রেললাইনে যাওয়ার। হেঁটে হেঁটে রেললাইনে আসার পথে শেলী বলল, 'কই হেইদিন যে কইছলাম আরেকটা লেখা দিতায়, কই? আনছো নি?'

বাচ্চু বইয়ের ফাঁক থেকে লেখা বের করতে করতে বলল, 'লেইক্খা রাখছিলাম বহুত আগেঐ, চাইছো না ইতার লাইগ্গা দিছিও না। আর কত লেখা নিতায়? তুমি তো আমারে একটা লেইক্খা দিলায় না!'

শেলী বলল, 'আমি তো তোমার লাখান লেখতে ফারি না, আইচ্ছা যাও একদিন লেইখা দিমু নে।'

শেলী কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো রেললাইনের উপর বসে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বাচ্চু। পড়া শেষ করে মুখ বাঁকিয়ে বলল, 'অসভ্য কুনানের! ইতা কিতা লেখছো!'

বাচ্চু অবাক হয়ে বলল, 'আরে কিতা কও!'

''রক্তিম অধর রাঙিয়ে দেয়া আরেকজোড় অধর প্রাপ্য' ইতা কুন ধরনের কথা!'

বাচ্চু মাথা নিচু করে অপমানিত স্বরে বলল, 'ভালা না লাগলে ছিঁইড়া ফালাই দেও।'

শেলী কাগজটা ছিঁড়ে না ফেলে বরং তার বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রাখলো।






বেশ কিছুদিন পরের কথা। নির্বাচনী পরীক্ষার তারিখ দিয়ে দিয়েছে। দুজনের সামনে অনেক চাপ পড়ালেখার। একদিন কলেজে গিয়ে বাচ্চু দেখে শেলী আসে নি। ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল, কিছু হলো না তো শেলীর! তার বুকটা মোচড় মেরে উঠলো। সে ভাবলো হয়ত বাসায় কোন সমস্যা কিংবা অসুস্থ, এমনিতে তো অকারণে ক্লাসে আসা বাদ দেয় না। সারাদিন মন খারাপ থাকলো তার, কোন কিছুতেই যেন মন বসলো না। পরদিনও কলেজে আসলো না শেলী, সে রীতিমতো খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। কোথাও কোন খোঁজ না পেয়ে শেলীর বান্ধবী রুবিকে জিজ্ঞেস করে। রুবিও সঠিক বলতে পারে না তার খবর। সে বাচ্চুর চোখেমুখে হতাশা আর হন্তদন্ত ভাব দেখে বুঝতে পারে যে শেলীর জন্যে কতটা আবেগ তার ভিতরে। রুবি আশ্বাস দেয় যে বাসায় গিয়ে খবর নিয়ে আসবে পরদিন।

পরদিন ক্লাসে এসেই রুবিকে খোঁজে বের করে বাচ্চু, রুবির কাছ থেকে জানতে পারে যে শেলী বাড়িতে গেছে হঠাত্‍ এক জরুরী তলবে। এ খবরে অন্তত সে নিশ্চিত হলো যে শেলীর খারাপ কিছু হয় নি তবুও তার ভিতরে কি যেন একটা বিষয় খোঁচাতে থাকলো।


দেখতে দেখতে নির্বাচনী পরীক্ষা এসে গেলো। পরীক্ষায় শেলী অংশগ্রহন করলো না, বাচ্চু পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে ব্যাপারটায়। বাড়িতে কী এমন কাজ যে কারনে পরীক্ষা বাদ দিতে হবে! শেলীর চিন্তায় মগ্ন বিভোর থেকে বাচ্চুর পড়ালেখা থেকে মন উঠে গেলো। বাসার চাপের কারনে কোন রকমে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করলো, যদিও সে বুঝতে পারছিল যে তার পরীক্ষা এতটুকুও ভালো হচ্ছে না, শুধু নামমাত্র অংশগ্রহন করা আর কি! পরীক্ষার সময়ে এবং তারপরে পুরোপুরি ভবঘুরে হয়ে গেলো বাচ্চু। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, উস্কখুস্ক চুলে ঘুরে বেড়াত রেললাইনে, কলেজে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকত শেলীর খালার বাসার অদূরে।


নির্বাচনী পরীক্ষার বেশ কিছুদিন পর ফলাফল দিবে, মধ্যের সময়টাতে কিছুই করার নেই বাচ্চু। ইতিমধ্যে প্রায় দুমাস হয়ে গেছে শেলীর কোন খোঁজ খবর নাই, রুবিও কোন খবর জানে না। রুবি নিজ থেকে আরও একদিন শেলীর খালার বাসায় গিয়ে এসেছে, শেলীর খালা কিঞ্চিত বাজে ব্যবহার করেছে তার সাথে। অনেকদিন পর শেলীর সাথে শেষবারের মতো একদিন দেখা হয় বাচ্চুর।







একুশ-বাইশ বছর পরের কথা। দুহাজার তেরো সাল। আমি আকিব থাকি তখন সলিমুল্লাহ রোডে। চাকরি-বাকরি নাই, সারাদিন বাসায় থাকি, অনলাইনে ঘুরাঘুরি করে সময় কাটে আর অফলাইনে জাতিসংঘের একটা ক্ষুদ্র সংগঠনের সাথে কাজ করি শিশুদের নিয়ে। আগস্ট মাসের দিকে আমার কপাল খুলে গেলো, মালয়শিয়ার কুয়ালালামপুরে ইউএনের একটা কনফারেন্স হবে এবং বাংলাদেশ থেকে তাতে আমি একা যাচ্ছি এ্যাম্বাসেডর হিসেবে। এই খুশিতে দিন কয়েক খুব লাফানো শেষ করে ইমেইলে পাওয়া কনফারেন্সের ইনভাইটেশন, ফাইভ স্টার হোটেলের বুকিং টিকেট ও মালয়েশিয়ান এয়ারওয়েজের টিকেট নিয়ে এম্বেসীতে দৌড়াদৌড়ি করে ভিসা গ্রান্ট করে নিলাম পাঁচ দিনের জন্যে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এক মাঝরাতে ঢাকা থেকে মালয়শিয়ান এয়ারওয়েজের এক ফ্লাইটে রওনা হলাম। প্লেনে উঠেই চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, যে ব্যক্তি ছয়নম্বর বাসে ঝুলে ঝুলে ঘুমোতে পারে তার জন্যে বিজনেস ক্লাস সিট ঘুমানোর জন্যে অনেক উন্নত স্থান। কুয়ালালামপুর পৌঁছে এয়ারহোস্টেস মালয়শিয়ান মেয়ের রিনরিনে আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গার পর দেখি সকাল হয়ে গেছে। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে (Lapangan Terbang Antarabangsa Kuala Lumpur) নেমে বেশ ভালো লাগলো, ঢাকার এয়ারপোর্টের চেয়ে কয়েকগুন বেশি উন্নত। জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ, প্রথম বিমান ভ্রমন; এসব মিলিয়ে বেশ উত্তেজিত রোমাঞ্চিত, তবে কিঞ্চিত ক্লান্ত ঘুম পরিপূর্ণ হয় নি বলে। ক্লান্তি আমার নিমেষেই উধাও হয়ে গেলো যখন গ্র্যান্ড মিলেনিয়াম কুয়ালালামপুর হোটেলের সামনে ট্যুরিস্ট কার এসে থামলো। একজন হোটেল বয় এসে দরজা খুলে দিয়ে মাথা কুর্নিশ করে ভিতরে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিলো। আমি ভাড়া মিটিয়ে বিশাল ট্রাভেলিং ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে নেমে ভিতরে না ঢুকে চারপাশ দেখতে লাগলাম। মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট আওয়াজ বের হলো আমার, 'বাপ্রে!'
হোটেলের সামনেই বিশাল শপিং সেন্টার, নানান দামী দামী ব্র্যান্ডের শোরুম, তখনও খুলেনি। বিভিন্ন ধরনের বিলবোর্ড, ইলেক্ট্রিক বোর্ড চোখে পড়ল। হোটেলের বাঁপাশেই একটা ব্যাংক (public bank), ডানে সিটিজেনের (citizen) বিশাল দুই শিঙয়ের মাথা উঁচু করা দালান। শপিং সেন্টারের পাশেই বাঁদিকে আরেকটি হোটেল (PICCOLO HOTEL) মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। আশেপাশের পরিবেশ দেখে স্তম্ভিত ভাব কাটিয়ে ব্যাগ বয়ের হাতে দিয়ে তার পিছন পিছন ভিতরে ঢুকলাম।


ভিতরে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ! আমাদের বসুন্ধরা সিটির নিচতলা থেকে যেমন মধ্যভাগটা গোলাকার হয়ে উপরে উঠে গেছে তেমনি। উঁচু থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে লম্বা একটা সাদা ঝাড়বাতি। রিসিপশনে মালয়শিয়ান মেয়েটি মুচকি হাসি দিয়ে আমার আগে থেকে রিজার্ভ করা রুমের চাবি ও আনুসাঙ্গিক সবকিছু দিলো, লিফটে করে বয়ের সাথে উপরে উঠে গেলাম।


আমার নিজেকে অতি ক্ষুদ্র মনে হলো হোটেলের ঝাঁকঝমকের কাছে, মনের ক্ষুদ্রতা ঝেড়ে ফেলে চৌদ্দতলায় ১৪০৪ নম্বর রুমে গেলাম। আমার মাঝে অদ্ভুত একটা গুণ আছে, চট করে যেকোন পরিবেশের সাথে নিজেকে তদানুযায়ী মিলিয়ে নেওয়ার। চট করে মিশে গেলাম আভিজাত্যে।


আমার রুমটা একেবারে ঝকঝকে তকতকে বেশ বড় ডিলাক্স স্যুট। রুমের মাঝামাঝিতে দেয়াল ঘেঁষে শ্বেতশুভ্র চাদর বিছানো ফোমের বিশাল এক বিছানা, অনায়েসে দুজন ঘুমানো যাবে এমন। একপাশের দেয়াল থাইগ্লাসের, যাতে জানালা হিসেবে ছোট্ট কাঁচেরই খোপ আছে যা খোলা যায়। জানালা দিয়ে বাহিরের সবকিছু অনায়েসে দেখা যায়। বিছানার অপরপাশে একটা নিচু প্রশস্ত কাঠের আলমারি, তার উপরে একটা ৫২" এলইডি টিভি! তার একপাশে একটা রীডিং টেবিল ও চেয়ার। বিছানার পাশে দেয়ালে একটা আয়না আছে বড়, আয়নার নিচে একটা টেবিল, ড্রেসিং টেবিলের অনুরূপ কিছুটা। সামনে বসার জন্যে একটা চেয়ার। রুমে ঢুকেই হাতের বাঁপাশে এটাচ বাথ, তাতে অত্যাধুনিক সব ফিটিংস; গিজার, হিটার-কুলার সবই আছে। বয়কে টিপ দিয়ে বিদায় করে বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হলাম। আয়েশী জীবনযাপনে অন্যরকম একটা ভাব আসে মনে, প্রফুল্ল চিত্তে উপভোগ করতে লাগলাম সবকিছু। গোসলের সময় গুণগুণ করে গানের কলি ভাঁজতে শুরু করলাম ভাঙ্গা কন্ঠে। জীবন হঠাত্‍ করেই অনেক সুন্দর মনে হলো।


গোসল করে বেরিয়ে আধভেজা অবস্থায় তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগলাম। নিজেকে কেমন জানি অচেনা মনে হচ্ছিলো ভেজা চুলে, নিজেকে আয়নায় দেখে নিজের প্রেমেই পড়ে গেলাম। জানালার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বাহিরে চোখ রাখলাম, চারপাশে উঁচু উঁচু দালান, মানুষজনকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে। পাশেই এইচএসবিসি ব্যাংকের একটা সুউচ্চ দালান দেখে ঢাকার এইচএসবিসি'র কথা মনে পড়ে গেলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কাপড় পাল্টে বিছানায় কাত হলাম ঘুমোনোর জন্যে, গোসল করার পর সতেজ শরীরে ভালো ঘুম হবে। বিকেলে আবার কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে।


দুপুরে খাবারের সময় বয় এসে বলে গেলো খেতে চাইলে নিচে ব্যুফেতে খেতে পারব। খাঁটি বাংলাদেশীর মতো লুঙ্গি পরেই ব্যুফেতে গেলাম খেতে, সবাই কেমন আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলো, আমি তেমন পাত্তা দিলাম না। দেশের প্রতিনিধিত্ব যেহেতু করছি তো উচিত দেশীয় সংস্কৃতি প্রদর্শন করা, মনের মধ্যে অন্যরকম একটা ভাব চলে আসলো। ব্যুফের পদ্ধতি খুব ভালো লাগলো, খাবারগুলোও বেশ। অ্যাপিটাইজার ও স্টার্টার শেষ করার পর নিজের পছন্দমত মেইন কোর্স নিয়ে এসে একটা টেবিলে বসে পড়লাম, টেবিলে আরও তিনটা চেয়ার বাকী ছিল। পুরো ডাইনিং জুড়েই কিছু লোক ছিল, ওয়েটাররা যার যা দরকার তা এগিয়ে দিচ্ছিলো। আগেই খাবার আনার সময় দেখে নিয়েছি যে অনেক রকম চোখরোচক ডেজার্ট আইটেম, মজারও বটে। খেয়ে দেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে রুমে এসে তৈরী হয়ে নিলাম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্যে। রুমে এসে এক ট্যুর পরিদর্শক জানিয়ে গেলো, আমাদের কনফারেন্স এই হোটেলের কনফারেন্স হলেই হবে এবং বাদবাকী আর ৩২টা দেশের সবাই এই হোটেলেই উঠেছে। অনুষ্ঠান সাড়ে চারটায় শুরু হবে, অনুষ্ঠানের আদবকেতা, কর্মসূচি বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আমি তৈরি হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন সাড়ে চারটা বাজবে।




কনফারেন্স হলটা মোটামুটি বড়ই, এখানে এরকম কনফারেন্স হর কয়েকটা আছে। আমাদের এখানটা সাজানো হয়েছে নিজেদের সুবিধার্থে, 'ইউ' আকৃতি করে সাদা চাদরে ঢাকা টেবিলে পাশপাশি জোড়া লাগিয়ে রাখা হয়েছে। যে পাশটা খালি আছে ঐখানে একটা লম্বা টেবিল রাখা, কনফারেন্সের প্রধানরা ঐখানে বসবে। তার পিছনে ব্যানার, একপাশে প্রজেক্টরের ব্যবস্থা। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর একে একে সবাই নিজেদের পরিচয় দিলো, আমিও দিলাম। একের পর এক বক্তৃতা চলতে লাগলো; শিশুদের অধিকার, অপুষ্টি বিষয়ক জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিলো। বেশিরভাগই আমার মাথার উপর দিয়ে গেলো তবুও মনোযোগী শ্রোতা হয়ে বসে রইলাম। বক্তৃতা শেষে সবার মধ্যে পারস্পরিক মেলবন্ধনের জন্যে নিজেদের মধ্যে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হলো, আমি মরক্কোর একটা ছেলের সাথে কিছুক্ষন কথা বললাম, তারপর একটা ফিলিপিনোর সাথে। মরক্কোর ছেলেটার ইংরেজী বুঝতে কষ্ট হলো, সে 'ট'কে 'ত' বলে আর 'ড'কে 'দ' বলে, আমার সব প্যাঁচ লেগে গেলো। ফিলিপিনো ছেলেটা 'ইয়েস', 'নো', 'থ্যাংকিউ' আর মাথা নাড়ানো ছাড়া কিছুই জানে না, তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী শুনে মনে হলো এর চেয়ে আমাদের বাংলা মিডিয়ামের ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছাত্র ভালো ইংরেজী বলতে পারবে।



এরপর শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বসে বসে ঝিমুচ্ছিলাম বিরক্ত লাগছিল বসে বসে, একটা সিগারেট খাওয়ার জন্যে মনটা আনচান করছিল। অনুষ্ঠানে যার যার নিজের ভাষায় গান গাইছে, নাচ দেখাচ্ছে। পুরোই রসকষহীন ব্যাপার, কোন কিছুর অর্থোদ্ধারই করতে পারলাম না। ইন্ডিয়ান এক মেয়ে এসে গান গাইলো, শুধুমাত্র তার গানটাই বুঝতে পারলাম। আমি বসে বসে ঝিমুচ্ছি এমন সময় পাশে এক মেয়েলি আওয়াজ, 'হেই! আ ইয়্যু ফ্রম বাংলাদেশ?'
চোখ তুলে বিরক্তি সহকারে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, 'দেখতে পারছিস না বুক পকেটের কাছে ব্যাজে লিখা আছে, বাংলাদেশ! আর তাছাড়া আগে পরিচয় দেয়ার সময় শুনিস নাই'

বিরক্তি নিমেষেই উধাও হয়ে গেল সুন্দরী মেয়ে দেখে, আমি মুখ হাসি হাসি করে উত্তর দিলাম, 'ইয়াপ।'


একথা ওকথার পর সে জানালো তার বাবামা দুজনই বাংলাদেশী কিন্তু সে কখনও বাংলাদেশে যায় নি। তার জন্ম ইংল্যান্ডে। মেয়েটির চেহারা দেখলে অবশ্য মনে হয় এ উপমহাদেশেরই, আমি ভেবেছিলাম পাকিস্থানী হবে হয়তো, এরকম লম্বাচওড়া মেয়েরা সাধারণত পাকিস্থানী বংশোদ্ভূত হয়। বাংলাদেশী রক্তের ছোঁয়া পেয়ে আমিও একটু আগ্রহী হলাম, তার সাথে অনেক কথাই হয়ে গেলো; প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক। মেয়েটার নামটা আমার বেশ লাগলো, 'তানিশা'।

তার সাথে কথায় কথায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যে কখন শেষ হয়ে গেলো টেরই পেলাম না। কনফারেন্স হল থেকে সবার শেষে বের হলাম দুজন। একসাথে ডিনার করে রুমে ফিরলাম, তার রুমও আমার ফ্লোরে কিন্তু একেবারে শেষ প্রান্তে। রুমে এসে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো, সারাদিনের বিরক্তিকর কাজকর্মের পরে তানিশার সাথে পরিচয় হওয়াটা মন সতেজ করার টনিক হিসেবে কাজ করেছে। ফুরফুরে মন নিয়ে ঘুমোতে গেলাম পরদিনের কাজ ভেবে ভেবে ও তানিশার সাথে আবার দেখা হওয়ার উত্তেজনা নিয়ে।




পরদিন সকাল থেকে কর্মশালা শুরু হলো, ব্যস্ততার মধ্যে কাটলো সারাদিন। তানিশা আশেপাশে থাকলেও তার সাথে কোন কথাই হলো না, বারকয়েক চোখে চোখ পড়লো মাত্র। কর্মশালা শেষে সন্ধ্যায় রুমে ফিরে গোসল করে একটু বিশ্রাম নিলাম। রাতে আর কোন অনুষ্ঠান নেই, যে যার মতো রাতে ঘুরতে যেতে পারে বলা হয়েছে। আমি কাপড় চোপড় পরে নিচে নামলাম আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে। নিচে নেমে দেখি তানিশা বসে আছে একটা চেয়ারে একা, আমার সাথে চোখাচোখি হতেই হাত তুলে ইশারা দিয়ে ডাকলো। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, 'হোয়ার আ ইয়্যু গোয়িং?'

আমি তাকে আশেপাশে ঘুরে বেড়ানোর কথা বললাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, 'উড ইয়্যু লাইক টু জয়েন উইথ মী?'

সে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। রাস্তায় তখন লোকজন গমগম করছে, সবাই পায়ে হেঁটে, ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়ি, বাচ্চা-কাচ্চা সবাই। কারো দিকে কারো নজর নেই, যার যার কাজে সবাই ব্যস্ত। বেশিরভাগ মেয়েরা শর্টস আর টিশার্ট পরা, ছেলেরা সাধারণ পোষাক। মুসলমান মেয়েরা হিজাব বোরকা লাগিয়ে ঠিকই পাশাপাশি চলাফেরা করছে। হোটেলের এপাশটায় কোন গাড়ি চলে না, বুকিত বেনিতাং ওয়াকের পর থেকে গাড়ি চলাফেরা করে। বেনিতাং ওয়াকের ওখানে চাররাস্তার মোড়, সেখানে মাথার উপর দিয়ে দ্রুতগতির রঙ্গিন ট্রেন যাওয়া আসা করে। ট্রেনগুলো দেখতে সুন্দর, বিভিন্ন কোম্পানির স্টিকার পুরো গায়ে সাঁটানো বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে। চাররাস্তার মোড়ে বাটা জুতার শোরুম দেখতে পেয়ে হাসি আসলো, আমাকে হাসতে দেখে তানিশা কেন হাসছি তা জিজ্ঞেস করলো, আমি তাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। আমি যতটা সময় চোখ বুলিয়ে আশপাশ দেখছিলাম ঠিক ততটা সময় সে হ্যান্ডিক্যাম দিয়ে দৃশ্যধারন করে রাখছিলো। কিছুক্ষন পর রাস্তার ওপারে ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে ঢুকলাম দুজনে।

তানিশা আধাবাঙালি হওয়ায় সে ভাতমাছ খুব একটা পছন্দ করে না, তার পছন্দ পিত্‍জা, বার্গার এসব। সে পেটপুরে খেলো, আমি কিছুই খেলাম না, খাওয়ার ইচ্ছা কেন জানি না হচ্ছিলো না তখন। তার সাথে আস্তে আস্তে কথা হচ্ছিলো, আমার সবকিছু জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিচ্ছিলো। আমি সহজসরল সব উত্তরই দিলাম। আমার জীবনযাপন, ব্যবহার এবং সবকিছুই তাকে অনেক আকৃষ্ট করলো, সে বারবার একই কথা বলছিল, 'ইওর লাইফ ইজ রিয়েলি অ্যামেইজিং!'
আমি মুচকি হাসলাম প্রতিবারই।

ঘুরাঘুরি শেষে রাতে ফিরে আসলাম হোটেলে, শরীরটা তেমন একটা ভালো লাগছিল না তাই রুম সার্ভিসকে দিয়ে খাবার আনিয়ে খেয়ে নিলাম রুমে বসেই। রাজার হালে থাকছি যখন তো একটু আরাম করাই যাক না! নরম ফোমের বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সেদিনের সমাপ্তি ঘটেছিল সাথে সাথেই।





পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বাসে রওনা দিলো পুরো টীম পেনাং এর উদ্দেশ্যে। কুয়ালালামপুর থেকে ২৯২ কিমি দূরে, বাসে উঠে ঘুমোতে না পারায় খানিকটা বিচলিত ছিলাম তবে রাস্তার পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে গেলাম। পাঁচ ঘন্টা ঠায় বাসে বসা ছিলাম, মাঝে দুইবার যাত্রাবিরতি ছিল। পেনাং শহরে প্রবেশ করার পর অদ্ভূত সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম, দূরে একপাশে পাহাড়ের সারি আর অন্যপাশে সমুদ্র। সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে রাস্তা, রাস্তা যথেষ্ট উঁচুতে, পাকা করা বাঁধ দেয়া মুম্বাইয়ের সমুদ্র তীরবর্তী কিছু এলাকার মতো। বাঁধের কিনারায় বড় বড় পাথর রাখা যেন বাঁধ ভেঙ্গে না যায় স্রোতের তোড়ে। সাজানো গোছানো একটা শহর, বেশিরভাগ বাড়িঘর রঙিন টালি দিয়ে ছাদ করা যশোরের প্রত্যন্ত এলাকার ঘরগুলোর মতো। দুতিনতলা বাড়ির ছাদও টালিতে চৌচালা হিসেবে তৈরি করা, দেখতে অদ্ভূত সুন্দর।


প্রথমে আমাদের নিয়ে গেলো এখানকার প্রখ্যাত একটা বৌদ্ধমন্দির দেখাতে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অনেক উঁচুতে মন্দির। মন্দিরের কারুকাজ অনেক সুন্দর, চোখে ঘোর লাগিয়ে দেয়। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু মুগ্ধই হচ্ছিলাম। মন্দিরের অগ্রভাগ সূঁচালো হতে হতে অনেক উঁচুতে চলে গেছে, সোনালী কমলা রঙের মিশেলে তৈরী সূচালো অগ্রভাগটা। মন্দিরে একটা মানুষের বড় মূর্তি দেখলাম, খুব সম্ভবত গৌতম বুদ্ধের তবে আমি তাঁর চেহারার সাথে মূর্তির কোন সাদৃশ্য খুঁজে পেলাম না। মন্দিরের উপর থেকে নিচে বাড়িঘরকে খুব সুন্দর দেখায়, প্রায় সব বাড়ি একই রঙের টালিতে তৈরি বলে একরঙা মনে হয় পুরো এলাকাটাকে। মন্দির ঘুরে দেখার পর আমরা আবার বাসে উঠি।


পেনাং দ্বীপের জাহাজঘাটায় এসে আমরা বাস থেকে নামলাম, কয়েকটা বিশাল উঁচু দালানও রয়েছে, খুব সম্ভবত বে-ওয়াচ রিসোর্ট ঐগুলো। জাহাজঘাটায় নেমে সবাই ছবি উঠাতে লাগলো, আমি একেবারে সমুদ্রের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে দূরে বহুদূরে তাকিয়ে ছিলাম। নীল রঙের পানি, কক্সবাজারের পানি নীল নয় ততটা, সেন্টমার্টিনের পানি অনেকটা নীল, আমার কাছে পেনাংয়ের পানি আরও বেশি নীল মনে হলো। আমার পাশে এসে ভারতীয় মেয়েটা দাঁড়ালো, ইংরেজীতেই বলল, 'হোয়াই আর ইয়্যু সো ইন্ট্রুভার্ট? স্ট্যান্ডিং হেয়ার লোনলি!'

আমি হাসলাম, হেসে তাকে চমকে দিতে হিন্দীতে বললাম, 'অ্যায়সা কুচ খাস নেহি হ্যায়, ম্যায় সমুন্দর কি খুবসুরতি দেখ রাহা হো।'
আমি এমনিতে অচেনা লোকদের চমকে দিতে পছন্দ করি, মাঝে মাঝে কাউকে চমকাতে উদ্ভট জিনিসও অনায়েসে করি।

মেয়েটা আসলেই চমকে গেলো, সে হিন্দীতে বলল, 'তুম! হিন্দী ভি জানো?'

আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, 'হাঁ, হিন্দী সিনেমা দেখ দেখকার শিখ লিয়া।'

মেয়েটি বেশ খুশি হলো, সে বেশ সুন্দরীও ছিলো। খোলাচুলগুলোতে সমুদ্রের অবাধ্য বাতাস খেলা করছিল, তার চুল ঠিক করার দিকে কোন ভ্রুক্ষেপই ছিল না। আমি মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম খানিকক্ষন। আমার দৃষ্টি এড়িয়েই কথা বলা শুরু করল টুকটাক, সে আমার কয়েকটা ছবি তুলে নিলো সমুদ্রকে পিছনে রেখে তার আইপ্যাডে। তার সাথে কথা বলতে বলতেই আমাদের জাহাজে উঠার ডাক পড়ে গেলো।


ছোট্ট একটা দুতলা সমুদ্রতরী, এটাকে জাহাজ বললে ভুল হবে। নিচতলায় খাবার আর বসার ব্যবস্থা আছে, দোতলায়ও বসা এবং শোয়ার ব্যবস্থা আছে, ওয়েল ফার্নিসড যাকে বলে আর কি, ডেক আছে সামনে ও পিছনের দিকে। আর তার উপরে ছাদ, ছাদটিতেও উঠা যায়, ছোট্ট লোহার সিঁড়ি আছে। আমি সিঁড়ি চড়ে ছাদে উঠে গেলাম একা। জাহাজ ছেড়ে দিলো, আমি ছাদে পা ছড়িয়ে বসে আছি, ইঞ্জিন ভটভট শব্দ করে আমাদেরকে আস্তে আস্তে ঘাট থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শহর আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে, পাহাড়গুলো ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি আনমনা হয়ে পড়লাম, ছাদের উপরে বসে থাকায় বাতাসে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো আমায়। সমুদ্র আমাকে কেন জানি না খুব আনমনে বানিয়ে দেয় প্রতিবারই, যতবার গিয়েছি তার কাছে সে আমাকে উদাস বানিয়ে দিয়েছে।


বাতু ফিরিঙ্গিতে (Batu Feringghi) পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল পেরিয়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, বাতু ফিরিঙ্গি হচ্ছে পেনাং তথা মালয়শিয়ার সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্র সৈকত। সূর্য সমুদ্র তীর থেকে বামকোণ দিয়ে ডুবে যেতে লাগল ক্রমশ। কক্সবাজারে সূর্য ডোবে ঠিক বরাবর দর্শকের দৃষ্টি থেকে, টুপ করে পানির নিচে তলিয়ে যায় একরাশ লালিমা আকাশে ছড়িয়ে। আর এখানে পাহাড়ের এক কোণ থেকে তীক্ষ্ন তীর্যক আলোসহ লালিমা ছড়িয়ে পাহাড়ের আড়ালে সূর্য লুকিয়ে যায়। সূর্য লুকিয়ে যাওয়ার অনেকক্ষন পর পর্যন্ত আলোকিত থাকে চারপাশ। ছোট্ট সেই জাহাজ থেকে নেমে আমরা সবাই দ্রুত সৈকতে নামলাম। সৈকতে বেশ লোকজনের ভীড় আছে, বাচ্চাকাচ্চা থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক সবাই সংক্ষিপ্ত পোষাক পরিহিত অবস্থায় পানিতে দাপাদাপি করছে। আমি পানির কাছাকাছি এসে জিন্স গুটিয়ে হাঁটু পর্যন্ত তুলে নিলাম, নীল জল এসে আমার পায়ের পাতা ডুবিয়ে দিচ্ছে বারবার। যে যার মতো সমুদ্র তীরে ঘুরছে, ছবি তুলছে। আমি সাথে ক্যামেরা নেই নি, তাছাড়া আমার জীর্ণশীর্ণ মোবাইল বের করতেও লজ্জা লাগছিল, সবার হাতেই অ্যান্ড্রয়েড, ট্যাব কিংবা আইফোন! আমি একবারও ছবি না তুলে চোখের মধ্যে গেঁথে নিতে থাকলাম সৌন্দর্য্য, হঠাত্‍ শুনি কে যেনো ডাকছে। তাকিয়ে দেখি তানিশা হালকা দৌড়ে আসছে আমার দিকে, 'হোয়ার ওয়ার ইউ? লুকিং ফর এ্যা লং টাইম!'

আমি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, 'হোয়াই?'

আমাকে খুঁজছে দেখে মনে মনে খুশি হলাম, যাক দুদিনেই টান পড়ে গেছে মনের।সে উচ্ছসিত গলায় বলল, 'লেটস পিক অ্যা ফটো, আই টোল্ড মা মম অ্যাবাউট ইয়্যু।'

আমি মনে মনে বললাম, 'খাইছে রে! কস্কি মমিন!'

সে বলতেই আছে, 'আই টোল্ড লাস্ট নাইট দ্যাট উই মেট, শী ওয়াজ ইন্টারেস্টেড হেয়ারিং ইউ আ এ্যা বাঙ্গালী।'মনে মনে বললাম, 'ও আচ্ছা' তবুও মুখটা হাসি হাসি করে রাখলাম।

সে একটু দম নিয়ে বলল, 'আই ওয়ানা শো হার ইওর ফটো।'

আমি কিছু না বলেই তাকে সম্মতি দিলাম।

সে আমার কাছাকাছি এসে সমুদ্রকে পিছনে রেখে দাঁড়িয়ে কয়েকটা সেলফি তুলল। আমি হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়েই রইলাম। পাশাপাশি দাঁড়ানোয় শরীর ঘেঁষে দাঁড়াতে হলো তার। আমার নাকে তীব্র একটা মেয়েলি ঘ্রাণ লাগলো, রীতিমতো মাদকতাপূর্ণ!



হোটেলে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো। সন্ধ্যার পর আবার সেই ছোট্ট জাহাজে করে পেনাংয়ে ফিরেছিলাম আমরা। ফেরার পথে আমি আর ছাদে উঠি নি, ডেকে দাঁড়িয়ে হাওয়া খেতে খেতে ফিরেছি। পাশে ছিল সেই ভারতীয় মেয়েটি, 'মোনালী'; তার সাথে পুরোটা পথ কথা বলতে বলতে কাটিয়ে দিলাম। বাসে উঠে চট করে ঘুমিয়ে পড়লাম, ক্লান্ত ছিলাম খুব।


পরদিন ছিল কর্মশালার শেষদিন। সেমিনারের এক ফাঁকে আমি বিশাল ফোমের সোফায় গা এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি এমন সময় দেখি তানিশা আমার পাশে এসে বসছে, সারাদিনের ক্লান্তি তার চোখে মুখে। আমার সাথে কথা না বলে পাশে বসে নিবিড় চিত্তে মোবাইলে কি জানি করছে। আমি দেখেও না দেখার ভান করে বসে রইলাম। কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম সে তার মায়ের সাথে স্কাইপে কথা বলছে, পুরো হোটেল জুড়ে ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক আছে, সে তারই সদ্ব্যবহার করছে। আমি ওয়াইফাই চালাতে পারছি না কারন আমার অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল নেই। কিছু করারও নেই, এখানকার সিম কিনি নি তাই কোন নেটওয়ার্কই চালাতে পারছি না, মনে মনে আফসোস করতে লাগলাম, ধুর ফেসবুকে কে কি করছে তা দেখতে পারছি না বলে। হঠাৎ সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'মম ওয়ান্টস টু টক উইথ ইউ।'

আমি একটু অবাক হলাম এবং সাথে সাথে কিছুটা বিরক্তও হলাম, 'কি ফাজলামি! বলা নাই কওয়া নাই তার মায়ের সাথে আমারে কথা বলায় দিবে!
'আমি বিরক্তি সহকারেই মোবাইল হাতে নিলাম। তার মা আমার সাথে একেবারে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা শুরু করলেন। কুশলাদি পর্ব শেষ করে তিনি আমার বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও টুকটাক ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। আমি অখুশি থাকার পরও ভদ্রতা বজায় রেখেই উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম।


আমার দেশের বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করে যখন তিনি জানলেন যে আমি হবিগঞ্জের ছেলে, তিনি আমাকে চমকে দিয়ে জানালেন তিনিও হবিগঞ্জের মেয়ে। আমি তো পুরোপুরিই অবাক! তারপর কথায় কথায় হবিগঞ্জ নিয়ে অনেক কথাই হলো। তিনি অনেক বছর দেশে আসেন নি, জিজ্ঞেস করলাম দেশে কেন আসেন না। তিনি বললেন যে দেশে তার কেউ নাই, তার বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছেন। তবে তিনি বললেন যে খুব শীঘ্রই একবার দেশে আসার ইচ্ছে আছে তার। আমি বললাম, দেশে আসলে যেন আমাকে যেকোন দরকারে ডাকেন।


কুয়ালালামপুর পর্ব যেন খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গেল বুঝে উঠার আগেই। দেশে ফিরে আসার সময় একরাশ ভালোলাগা, অনেক অভিজ্ঞতা এবং কিছু সুন্দর মূহুর্তের স্মৃতি নিয়ে ফিরলাম সাথে করে। তানিশা আমার সাথে যোগাযোগের জন্যে সব ঠায়ঠিকানা নিয়ে নিলো, আমিও তার ইমেইল, ফেসবুক, স্কাইপ আইডি রেখে দিলাম। সবসময় যোগাযোগ যেন রাখি তার অনুরোধ করে গেলো সে, 'প্লীজ কীপ ইন টাচ।'


তানিশার ফ্লাইট পরদিন আমার আগে থাকায় সে চলে গেলো সকালেই, আমার ভিতরে খারাপ লাগা অনুভব করলাম। সে হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় দেখাও হয় নি, আমি তখনও ঘুমে ছিলাম। সন্ধ্যার ফ্লাইটে করে আমি দেশে ফিরে আসলাম।


দেশে ফিরে তানিশার সাথে যোগাযোগ হতে থাকলো নিয়মিত স্কাইপে, মাঝে মাঝে তার মাও আমার সাথে কথা বলতেন, 'অ্যান্টি' বলে ডাকতাম তাকে। তিনি আমার কাছে আমার পারিবারিক অবস্থা এবং হবিগঞ্জ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন, কতটুক বদলে গেছে গত আঠারো বিশ বছরে দেশ তা জিজ্ঞেস করতেন। তার সাথে কথা বলে বুঝলাম যে তিনি দেশ সম্পর্কে কোন খবরই রাখেন না, হয়তো কোন অভিমান আছে দেশ নিয়ে কিংবা অনেকে আছে বিদেশে গেলে দেশের কথা ভুলে যায়। তানিশার সাথে আমার সম্পর্কটা অদ্ভূত দোলাচালে আটকে থাকলো, আমাদের সম্পর্কটা না-প্রেম না-বন্ধুত্বের মধ্যে ঘোরপাক খেতে লাগলো। তাকে যখন জিজ্ঞেস করতাম, 'হোয়াট এ্যাম আই?'

সে অনেকক্ষণ ভেবে বলতো, 'আই ডোন্ট নো, জাস্ট ফীল দ্যাট ইউ আর সামওয়ান হু ক্যান মেক মী স্মাইল।'

আমি হাসতাম, জোরে জোরে। আমার হাসিতে বিরক্ত হয়ে সে বলতো, 'ইডিয়ট!'
'ইডিয়ট' শব্দটা তখন বেশ মধুর লাগতো।


মেয়েরা তাকেই পছন্দ করে যে তাকে হাসাতে পারে, মেয়েরা নিজেদের মনের ভিতরে কিছু দুঃখ গোপনে পুষে রাখে। বিভিন্ন ধরনের দুঃখ, কোনটা যৌক্তিক কিংবা কোনটা অযৌক্তিক; তবে তাদের কাছে সবই যৌক্তিক। তারা নিজেদের এটা নেই, সেটা নেই অনুভব করে দুঃখ বোধ করে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা তারা নিজেকে দুঃখী ভাবতে ভালবাসে, আর যখন তারা তাদের আশেপাশে এমন কোন ছেলেকে পায় যে কিনা তাদের হাসাতে পারে তবে সে ছেলের প্রতি অদ্ভূত একটা মায়ায় আটকে যায়, সেটা হয়ত মোহ। সেই মোহকে কেউ কেউ ভালবাসা বলে মনে করে ভুল করে। আমার প্রতি সৃষ্টি মোহটা তানিশার কেটে গেলে কিছুদিন পরই তবে তার পিছনে কিছু অনুঘটক ছিল। হঠাত্‍ করেই ইউরোপ ট্যুরের একটা প্রোগ্রাম এসে যায় তার। ছয়টি দেশে পনের দিনের ভ্রমণ, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জনসচেতনতামূলক কাজ। ইউরোপের ইতালি, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, জার্মানী প্রভৃতি দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে পনের দিন ঘুরে ইংল্যান্ড ফেরার পর সে কেমন যেন আমার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ট্যুরের পনের দিন সে ঘুরোঘুরিতে ব্যস্ত থাকায় তার সাথে যোগাযোগ হয় নি, ব্যাপারটা আমাকে খুব পীড়া দেয়। পনেরটা দিন আমার যে কিভাবে কেটেছিল আমি নিজেই জানি না। আমি তার অভাব অনুভব করতাম প্রতিটা সকালে, প্রতিদিন সে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আমাকে ফোন করে জাগিয়ে দিত আমার সকালে; প্রতিটা মন খারাপের একাকী সময়ে তার পাশে না থাকাটা খুব কষ্ট দিতো। ইংল্যান্ড ফেরার পর তার ভিতর আমি তেমন কোন অনুভূতি দেখলাম না আমার প্রতি, সে কেমন জানি আমাকে এড়িয়ে যায়। তারপর দুয়েকবার কথা হয়েছিল চ্যাটে, ফোনে; আমি অভিমানে কড়া কয়েকটা কথা বলায় সে আমাকে অপমান করে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আমার কানে একটা জিনিস বারবার বাজতে লাগলো, 'স্যরি! হু দ্য হেল ইউ আর, ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, ইয়ু আর নোবডি টু ব্লেইম মী ফর অ্যানিথিং এন্ড আয়্যাম নট ইওর স্লেইভ টু বিহেভ অ্যাজ ইয়্যু উইশ...।'

আমি এবার মুচকি হেসে সামনের দিকে তাকালাম। হুট করে চলে আসা আবেগে সে আমাকে চট করে তার মনের খুব কাছের কেউ ভাবতে শুরু করল, সকল অধিকার আমাকে দিয়ে দিলো! আবার যখন ইচ্ছে হলো ছুঁড়ে ফেলে দিলো! বড্ড অদ্ভূত! আজকালকার ভালবাসা এমন হয়েই দাঁড়িয়েছে, আমি মনে হয় বেশ সেকেলে তাই এখনও প্রেম ও প্রেমিকার ঘ্রান শুঁকে বেড়াই। আমি আর পিছনের দিকে না তাকিয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হলাম। এরই মধ্যে চাকরি হয়ে গেলো আমার একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ছোটখাটো পদে। প্রতিদিন সময়মত অফিস, কাজের চাপ আর ব্যস্ততায় কারো অভাব অনুভব করার ফুসরত পেতাম না। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম, পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে ফেললাম।


এভাবেই প্রায় মাস ছয়েকের মতো গেলো, হঠাত্‍ একদিন ইমেইল পেলাম তানিশার মায়ের কাছ থেকে। ইমেইল ওপেন করার আগে বুকে ধ্বক করে উঠল, কোন খারাপ সংবাদ নয়ত! তানিশা যোগাযোগ বন্ধ করার পর দুবার তার মায়ের সাথে ইমেইল চালাচালি হয়েছিল। তিনিই পাঠিয়েছিলেন আমি শুধু উত্তর দিয়েছিলাম, তাও মনে হয় মাস চারেক আগে। আমি তো ভেবেছি তারা আমাকে ভুলেই গেছে। অ্যান্টির ইমেইল পেয়ে বুঝতে পারলাম না এখনও তারা আমাকে ভুলে নি। তারা দুজনে নাকি সামনের মাসে আসবে দেশে, আমার সাথে দেখা করতে চান তিনি। আমি তাকে বলি যেন দেশে এসে আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, তানিশার কাছে তো আমার নাম্বার আছেই।

গত জুন মাসের শুরুর দিকে তানিশা ও তার মা বাংলাদেশে আসলো। আমাকে ফোন দিয়ে তানিশা জেনে নিলো কবে আমি তাদের সময় দিতে পারব। তার সাথে আগের সম্পর্ক আর তৈরি হলো না; সম্পর্কগুলো কেমন জানি! মেয়েদের হাতের কাঁচের চুড়ির মতো, একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগানো যায় না, জোড়া লাগিয়ে পরলেও মাঝে মাঝে হাত কেটে যায় সামান্য ঘর্ষণে। তানিশার সাথে আমার আবার যোগাযোগটা কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ালো, সেই আগের সে যে নেই তাই। তবুও অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের বললাম আগামী শুক্র ও শনিবারের কথা, এ দুদিন ছাড়া ছুটি বের করা সম্ভব না, এমনিতেই অফিসে কাজের চাপ বেশি। তাছাড়া ভাবলাম রোজার আগে একবার বাসায় গিয়ে আসি। দিনক্ষণ অনুযায়ী আমি চলে গেলাম হবিগঞ্জে, পরদিন বিকালে তাদের সাথে দেখা কালীবাড়ির মোড়ে আশরাফ জাহান কমপ্লেক্সের সামনে। আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় সামনে এসে একটা মাইক্রো এসে থামলো, দরজা খুলে একে একে নেমে আসলো তানিশা ও তার মা। তানিশাকে তো আগেই দেখেছি, এক বছরে তার মধ্যে বিশেষ তেমন কোন পরিবর্তন নেই, শুধু চুলের কাট পাল্টিয়েছে। তানিশার মাকে যতটা না বয়স্ক মনে করেছিলাম ততটা সামনাসামনি নন, বিদেশের আবহাওয়া আর আভিজাত্যে চেহারায় বয়স্কের চাপ পড়তে পারে নি। দুজনকে পাশাপাশি দেখলে যে কেউ মনে করবে বড়বোনের সাথে তানিশা এসেছে, চেহারায়ও যথেষ্ট সামঞ্জস্য আছে। দেখা হওয়ার আদবকেতা শেষে অ্যান্টির অনুরোধে গাড়িতে উঠতে হলো তাদেরকে শহর ঘুরিয়ে দেখানোর জন্যে।






একানব্বইর একেবারে শেষের দিকে একদিন হুট করে বাড়ি থেকে চাচাতো ভাই কাউসার এসে হাজির শেলীর খালার বাসায়। তাকে কি জন্যে জানি জরুরী ভিত্তিতে বাড়িতে যেতে হবে। শেলীর মাথায় আচমকা তখন বাজ পড়ে, সে মনে করেছিল তার মায়ের হয়ত কিছু হয়েছে! সে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো, যতই তাকে বলা হয় যে তার মায়ের কিছুই হয় নি তবু সে কান্না থামায় না। পুরোটা পথ ফোপাতে ফোপাতে বাড়িতে যায়, বাড়িতে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। বাড়িতে আসার কিছুসময় পর সন্ধ্যায়ই বুঝতে পারে কেন ডেকে আনা হয়েছে জরুরী ভিত্তিতে।

সন্ধ্যায় তার বড় বোন মলি মামীর একটা নতুন সোনালী পেড়ে নীল শাড়ি এনে দেয় পরার জন্যে, 'নে ইইটা পিন্দ, তরে কইন্ন্যা দেখতে আইব অখন।'

বিস্মিত চোখে হতবাক শেলীর কাছে তখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় কেন তাকে জরুরী তলবে বাড়িতে আনা হয়েছে। ইংল্যান্ড প্রবাসী ছেলে, দেখতে শুনতে ভালোই, ছেলের পরিবারও বেশ অবস্থাসম্পন্ন, সকলেই বিদেশ পাড়ি দিয়েছে, বিয়ে করে মেয়েকেও কিছুদিন পরে নিয়ে যাবে। এমন ভালো পাত্রকে ভুলক্রমেও হাতছাড়া করতে চান না শেলীর বড় মামা বোরহান। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে শেলীর ছোট মামীর শ্বশুড় বাড়ি থেকে। বড় বোনকে রেখে ছোট বোনের বিয়ে এ নিয়ে মাথা ব্যাথা কারোর মধ্যেই ছিল না কারন কাউসারের বাবা মলিকে বহু আগে থেকেই ছেলে বউ হিসেবে ঘর তুলবেন বলে ঠিক হয়ে আছে। ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঝাড়া হাত পা হতে চান শেলীর মা, এরপর তার নিশ্চিন্ত জীবন। মেয়ে ইংল্যান্ড গেলে যে টাকা পাঠাবে তাতেই চলে যাবে তার বাকী জীবন, অভাবের আর মুখ দেখতে হবে না।


ছেলে পক্ষের মেয়ে পছন্দ হয়ে গেলো, মামা বোরহান আর দেরি করতে চাইলেন না; চট করে গ্রামের কাজীকে ডাকিয়ে এনে বিয়ে পড়িয়ে নিলেন ছেলে পক্ষকে এক প্রকার জোর জবরদস্তি করে। বিয়ে পড়িয়ে দিলে তিনি ভাবলেন, 'আলহামদুলিল্লাহ! যাক আপদ বিদায় হইছে, খরচাপাতি লাগত না আর বিয়ার।'

বিয়ে পড়ানোর সময় থেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো শেলী। কবুল বলতে গিয়ে অনেক দেরি করে ফেলায় ছোট মামার কাছ থেকে ঝাড়িও শুনলো। ছেলের পক্ষ ঠিক করলো আসছে শুক্রবার বাদ জুমআ তারা মেয়েকে তুলে নিয়ে যেতে আসবে। সে রাতে তারা চলে গেলো, তবে তার আগে ঘরে পালা মোরগ দুটো আর ঘাটের তাজা মাছ দিয়ে তাদের ভোজ করানো হল। নতুন জামাই বেচারা বেলাল বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে না পারায় খানিকটা ব্যাথিত ছিল তা কেউ বুঝতে পারলো না খুশি খুশি মুখ করে রাখায়। আসন্ন শুক্রবার রাতের কথা ভেবে ভেবেই সে স্বর্গসুখ পাচ্ছিলো।

সে রাতে সবাই চলে যাওয়ার পর শেলী একেবারে উত্তরের ঘরে খিল লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলো। এ কাঁদার কারন হিসেবে তাদের বাড়ির বাকীরা 'অন্য পরিবারের চলে যাওয়ার দুঃখ' ধরে নিলেও মূলতঃ সেটা কারন ছিল না। শেলীর কাছে মনে হচ্ছিলো তার স্বপ্নগুলো চুরমার হয়ে গেছে, তার অনেক স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করবে। স্বপ্নভঙ্গের যাতনার চেয়েও ঐ রাতে শেলীর মনে অন্য একটি দুঃখ খেলা করছিল, 'কিছু একটা যেন নেই' অথবা 'হারিয়ে গেছে' এমন রকমের একটা দুঃখ। শেলী জানা-অজানা হরেক কারনে সারারাত কেঁদেটেদে নাকমুখ ফুলিয়ে চোখ লাল করলো।


তিন দিন পর, শুক্রবার, বাদ জুমআ, ছেলের পক্ষের কয়েকজন আত্নীয়স্বজন ও ছেলে এসে শেলীকে সাথে করে নিয়ে গেলো। কাগুজে ফুলে সাজানো ছোট্ট ইঞ্জিনের নৌকায় করে নতুন বউকে সাথে নিয়ে গেলো হাসিখুশি বেলাল। সারাটা সময় সে মুখে একটা সাদা রুমাল ঢেকে রেখেছিলো।


বিয়ের পরদিন সকাল থেকেই শেলীর মনে ঘুরঘুর করতে লাগলো বাচ্চুর কথা। বাচ্চুকে সে বলে আসতে পারেনি এ অপরাধবোধে ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে গেলো। তাকে না পেয়ে বাচ্চু কি কি করতে পারে তা ভাবতে লাগলো। হঠাত্‍ করেই সে বাচ্চুর প্রতি তীব্র মায়া অনুভব করতে লাগলো। দীর্ঘদিন একসাথে পথচলা, হাসিঠাট্টা; প্রত্যেকটা মূহুর্তের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতি, সবকিছুই এক এক করে মনে পড়তে লাগলো তার। বাচ্চুর সাথে হয়ত তার আর দেখা হবে না, আগের মতো সময় কাটানো হবে না ভেবে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। হঠাত্‍ তার মনে আসলো, 'আচ্ছা বাচ্চু আমাকে ভালবাসে? আমাকে কি মনে মনে চাইত?'

তার মনে পড়তে লাগলো বাচ্চুর প্রতিটা কাব্যিক চিঠির প্রত্যেক লাইনের কথা। কিছুক্ষন পর তার হঠাত্‍ আফসোস লাগতে শুরু হলো, 'আহারে! ছেলেটা আমাকে ভালবাসে অথচ আমি কখনো তাকে বুঝতে চেষ্টা করিনি।'
আফসোস থেকে শেলীর মনে এক ধরনের অপরাধবোধ চলে আসলো। সারাটা দিন বাচ্চুর কথাই ভাবলো, ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যার পর আবিষ্কার করলো সে নিজেও বাচ্চুকে ভালবাসে! এ বিষয়টা আবিষ্কার করার পর সে আবার দরজার খিল লাগিয়ে কাঁদতে লাগলো। নিজের ভেতরে ভেতরে ভাঙ্গচুর শুরু হলো তার শতবার, কোনভাবেই মনকে আর প্রবোধ দিতে পারলো না। বাচ্চুর জন্যে মন খারাপ হয়ে থাকলো তার এর পরের কয়েকটা দিন। দিনে দিনে সে লক্ষ্য করলো নিজের ভিতর আশ্চর্য্য পরিবর্তন, বাচ্চুর জন্যে ভালবাসা ক্ষণে ক্ষণে চক্রবৃদ্ধির সূত্রানুসারে হু হু করে বাড়ছে!


রবিবারে অর্থ্যাত্‍ যেদিন শ্বশুড়বাড়ি চলে আসে তার দুদিন পর সকালে শেলী তার স্বামী বেলালকে ডেকে বলল, 'আমারে তালাক দেলাইন? আমি আর ঘর করতাম না।'

এসময় বিছানায় বসা অবস্থায় অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছিলো। দাঁড়িয়ে থাকা বেলাল বিছানায় বসে তার মুখ হাত দিয়ে তার দিকে ঘুরিয়ে খানিকক্ষন তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বলেছিলো, 'তোমারে কিতা তালাক দিলাইবার লাইগ্গা বিয়া করছি নি?'

গলগ্রহের এই বিবাহিত জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ না পেয়ে হতাশ হয়ে গেলো শেলী। বড় অদ্ভূত মানব মন, দূরে গেলে টের পায় কী জিনিস পিছনে ফেলে এসেছে অথচ কাছে থাকাকালীন সময়ে তাদের রাজ্যের অনাগ্রহতা। দাঁত থাকতে আসলেই দাঁতের মর্যাদা টের পাওয়া যায় না।


স্বামীর সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল শেলী, কিন্তু পারে নি। বারবার প্রতিটা পদক্ষেপে তুলনা চলে আসত তার মনে বাচ্চু ও বেলালের মধ্যে, তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখত বাচ্চু এগিয়ে। জীবনসঙ্গী হিসেবে যে রকম কেউ একজনকে সে মনে মনে কল্পনা করত ঠিক ঐরকমই বাচ্চু। দিন দিন সময় গড়িয়ে গেল অনেক, মনের মধ্যে দ্বিধা নিয়ে চলতে বাস করতে লাগলো সে। বিয়ের দেড় মাস পর তার স্বামী বেলাল তাকে রেখে ইংল্যান্ড চলে যায়। তারপর সে শ্বশুড়বাড়ি থেকে আবার মামাবাড়িতে এসে থিতু হয়। মামাবাড়িতে আসার পর দেখলো কেউ তার পড়ালেখা নিয়ে কিছু ভাবছে না, সে সবার মতের বিরুদ্ধে একরকম জোর করে শহরে খালার বাসায় এলো পড়ালেখার উদ্দেশ্যে। বাড়িতে কলেজে পরীক্ষার কথা বলে আসলেও তার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাচ্চুর সাথে দেখা করা। বাচ্চুর সাথে দেখা হয়েছিল, কলেজ গেটের সামনে, সেটাই শেষবারের মতো দেখা। তারপরদিনই সে বাড়িতে ফিরে যায় একবুক কান্না জমা করে।



বিশ বাইশ বছরে হবিগঞ্জ শহর একেবারেই বদলে গেছে, সর্বত্র আধুনিকতার ছোঁয়া। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বাড়িঘর শপিংমল সবই বদলে গেছে। অনেক বছর পর যদি কেউ শহরে এসে থাকে তবে চিনতে খুব কষ্ট হবে। তানিশার মায়েরও একই অনুভূতি হলো, আগের হবিগঞ্জ একেবারে বদলে গেছে। যেদিকে তাকালেন তিনি সেদিকেই দেখেন নতুনের ছোঁয়া। গাড়িতে করে শহরের এমাথা থেকে ও মাথা ঘুরে দেখছেন আর সামনের সিটে বসা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, 'এটা কি? কবে হলো?'

আমি একে একে উত্তর দিচ্ছিলাম আর দেখিয়ে দিচ্ছি সব। একসময় যে কালীবাড়ির মোড়ে অগ্রণী ব্যাংক ছিল তা এখন আর নেই, এপেক্সের বড় শোরুম হয়ে গেছে সেথায়। পুরাতন আর.ডি হলটা এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে জায়গামতোই। একসময়ের রূপালী ম্যানশনটাও আগের মতোই আছে, শুধু আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে একটু। রূপালী ম্যানশনের অপরপাশে মাথা উঁচু করে আছে নতুন আরেক শপিং কমপ্লেক্স, খাঁজা গার্ডেন সিটি। গাড়ি সোজা শায়েস্তানগর পর্যন্ত গিয়ে আবার ব্যাক রোড দিয়ে ঘুরালো। পুরাতন বাসস্ট্যান্ডটা এখন আর নেই, বাসস্ট্যান্ড সরিয়ে নতুন বাইপাসের পাশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এখন সিএনজি স্ট্যান্ড। আগের নজির সুপার মার্কেট বদলে গেছে। ঐসময়ে শহরের একমাত্র কমিউনিটি সেন্টার ছিল আল-আহমদিয়া, তা আর নেই, ক্লিনিক খুলেছে ওখানে নতুন। বেবিস্ট্যান্ডটাও আগের মতো নেই, আদালত প্রাঙ্গনটাও বেশ বদলে গেছে। পুরাতন পৌরসভা ভবন সরিয়ে নিয়ে নতুন পৌরসভা ভবন হয়েছে বিশাল ভাবে। স্টেডিয়াম এলাকা কিছুটা আগের মতোই আছে। কলেজের সামনে এসে গাড়ি থামাতে বললেন তানিশার মা। আমরা গাড়ি থেকে নেমে কলেজের ফার্স্ট গেটের দিকে এগুচ্ছিলাম, আমি আড়চোখে তাকে দেখতে লাগলাম। কেমন আনমনা হয়ে গেছেন তিনি, বদলে যাওয়া এলাকাগুলোতে নিজের কৈশোর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কলেজ গেট খোলা ছিল, ভিতরে ঢুকলাম আমরা। তিনি তানিশাকে ডেকে দেখাতে লাগলেন তার কলেজ, আমি কিছুটা পিছনে পড়ে গেলাম। তানিশা হ্যান্ডিক্যামটা চালু করেছে, কলেজটাও আগের মতো নেই। বেশ কয়েকটা নতুন ভবন তৈরী করা হয়েছে। পুরাতন বটগাছটার চারপাশে বেদী তৈরি করা হয়েছে। মসজিদের পিছনের পুকুরটাও আর নেই, অনেক আগেই ভরাট করা হয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাসের সুর দেখলাম আমি তার চোখে মুখে। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছিল, আমি একটু তাড়া দিতে লাগলাম তাদের। তিনি যেন কলেজ থেকে ফিরে আসতে চাচ্ছিলেন না, তবুও আমার কথায় ফিরে এসে গাড়িতে উঠলেন। গাড়িতে উঠেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'ট্রেইন চলে নি অখনো কলেজের পিছে দিয়া?'

আমি অবাক হয়ে বললাম, 'ট্রেইন চলত কইত্থাইক্কা? ট্রেইনের লাইনঐত্ত নাই! রাস্তা অই গেছে অখন উইখানো।'

তিনি আস্তে করে বললেন, 'ওহ।'

একসময়ের রেললাইন এখন আর নাই, পুরাতন স্টেশন দুইটাও প্রায় বিলীন, নেই বললেই চলে। শহরের পাশ দিয়ে বাইপাস রাস্তা হয়ে গেছে রেললাইন উঠিয়ে দিয়ে। তার চোখে আরও পরিবর্তন ধরা পড়লো, আগের জেলা কারাগারটা আর নেই। আমি জানালাম, শহর সম্প্রসারনের পর কারাগার সরিয়ে শহরের প্রবেশদ্বার ধুলিয়াখালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর কারাগারের এই জায়গাগুলো কলেজ কতৃপক্ষ অধিগ্রহন করে এখানে ক্যান্টিন, মহিলা হোস্টেল ও নতুন ভবন করেছে।



গাড়ি রিকশার চাপে আস্তে আস্তে রাজনগর এলাকায় প্রবেশ করতেই 'তরফদার ভিলা'র সামনের বইপত্র লাইব্রেরি থেকে আমার চাচাতো ভাই তারেক আমাকে ডাকলো, ড্রাইভারকে বলে গাড়ি দাঁড় করালাম। বেরিয়ে এসে তার সাথে টুকটাক কথা বলে আবার গাড়িতে উঠলাম। সে অনেকদিন পর আমাকে দেখেছে তাই ডেকেছে, গাড়িতে দেখে একটু অবাক আর সাথে কে জিজ্ঞেস করলো, আমি পরিষ্কার করে কিছুই জানালাম না, রহস্যময় হাসি দিয়ে গাড়িতে উঠে গেলাম। গাড়িতে উঠতেই তানিশার মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'এ তোমার কিতা অয়? বন্ধু?'

আমি জানালাম, 'নাহ, আমার চাচতো ভাই, পিছে যে বাসাডা দেখতাছইন উইটা আমার চাচার বাসা এবং দোকানটাইনও তারার।'

তিনি খানিকটা দম নিয়ে বললেন, 'আইচ্ছা বাচ্চু তোমার কিতা অয়?'

আমি হুট করে চিনতে পারলাম না, ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম, তার চেহারায় অস্ফুট উত্তেজনা, নাকের নিচেও যেন একটুখানি ঘাম। আমি আমার স্মৃতির খাতা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলাম, হুট করে মাথায় আসলো, 'ও, বাচ্চু চাচা? আমার চাচা আছলা তাইন।'

তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, 'কই আছে অখন? কিতা করে?'

আমি বললাম, 'তাইন তো মইরা গেছইন গিয়া বহুত আগে, আট দশ বছর অইব।'

এ কথা বলে আমি তার দিকে তাকালাম, তার চোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসছিল। তানিশাও তাকিয়ে ছিল তার মায়ের অদ্ভূত আবেগের দিকে, তানিশা তাকে জিজ্ঞেস করলো, 'হু ওয়াজ হি মম?'

তিনি আস্তে করে কান্না সামলে বললেন, 'নো বডি!'

আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কোন অসুবিধা?'

তিনি নিজেকে সামলে বললেন, 'না, না, ঠিক আছে, ছেলেমেয়ে নাই? বিয়াসাদী করছিলো?'

আমি যা জানতাম তার সম্পর্কে তা তাকে বললাম, 'নাহ, আমি যতটুক বড় অইয়া জানছি, তাইনের মাথাত সমইস্যা আছিল, কেউর কাছে যাইতা না, আগে বুঝি ভালা আছলা, হঠাত্‍ কইরা তাইন কিরম জানি অই গেছলা গা। আর জানি না কিচ্ছু। তাইন মারা যাওয়ার সময় আমি ইস্কুলো পড়তাম, মারা গেছলা কই জানি তারপরে লাশ আইনা টাউনো দাফন করা অইছে। তাইন হবিগঞ্জ শহর ছাইড়া আর কুনানো যাইতা না, এমনকি তাইনের আব্বা মারা যাওয়ার সময়ও দেখাত গেছইন না। তাইনের আম্মা অবশ্য অখনো বাইচ্চা আছইন।'

কথাগুলো বলে তার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি ঝরঝর করে কাঁদছেন। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, 'কি হইলো রে!'
তানিশা তাকে সান্তনা জানাচ্ছিলো, সেও কিছুটা অবাক ছিল। তার মাকে হয়ত এভাবে কখনো কাঁদতে দেখে নি, সে নিজেও বুঝতে পারছিল না কেন তার মা অচেনা একজনের মৃত্যুর খবর শুনে কাঁদছেন।

তিনি কান্নাভেজা চোখে আমাকে অনুরোধ করলেন, 'আইচ্ছা তুমি কিতা আমারে অখন লইয়া যাইবায় নি তার কবরের কাছে?'

আমি যা বুঝার বুঝে গেলাম, দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেললাম চট করে। ড্রাইভারকে বলে দিলাম শায়েস্তানগরের দিকে আবার যেতে, শায়েস্তানগর কবরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়েছিল অনেক আগে।



বাইশ বছর পর শেলী আবার মুখোমুখি হলো বাচ্চুর, সেই বাচ্চু আর নেই, বদলে গেছে পুরোপুরি। বাচ্চুর কবরের নিকটে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। তার চোখে ভাসছে নানান স্মৃতি, মনে হয় তার এইতো সেদিন বাচ্চুর সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে পুরো সময়। বাচ্চুর ছলছলে চোখের কথা হঠাত্‍ মনে পড়ল, শেষবার যেদিন বাচ্চুর সাথে দেখা হয় সেসময় তারা দুজনেই কেঁদেছিলো।

বহুদিন পর কলেজে এসে যোগাযোগ করে রুবির সাথে, রুবিকে দিয়ে খবর পাঠায় বাচ্চুর কাছে। তার কাছে তখন বিশাল অপরাধবোধের বোঝা, সে নিজেকে বাচ্চুর সামনাসামনি উপস্থিত করাতে পারছিল না। রুবির খবরে হন্য হয়ে বাচ্চু আসে কলেজের ফার্স্ট গেটের বাইরে।

দৌড়ে গেটের কাছাকাছি আসামাত্রই বাচ্চু দেখতে পায় শেলী দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপারে কোর্টের পুকুরপাড়টা ঘেঁষে। আস্তে করে রাস্তা পার হয়ে শেলীর সামনে গেলো। শেলীর দিকে তাকালো, শেলী চোখ তুলে তাকাতে পারছিলো না, সামনে পুকুরের দিকে তাকিয়ে ছিল। বাচ্চু চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, তার ভিতরে অভিমান। দীর্ঘদিন ধরে না দেখতে পারার ব্যাকুলতায় কিছুটা ভাটা এসেছে, একেবারে শান্ত সে ভাটার সমুদ্রের মতো। কিন্তু শেলীর মনের ভিতর ঝড় বইছে, উত্থাল পাতাল ঝড়, উত্তাল সমুদ্রের মতো তার মনে হাজারো প্রশ্ন আছড়ে পড়ছে বারবার।

শেলী আস্তে করে বাচ্চুকে বলল, 'আইছো? একটা কথা কইতে ডাকছিলাম।'

বাচ্চুও ঠান্ডাস্বরে বলল, 'কিতা?'

শেলী বলল, 'দুই মাস ক্যানে আইছি না জানো নি? তোমারে না জানাইয়া ক্যানে গেছলাম গা জানো?'

বাচ্চু মাথা নাড়ল। শেলী বাচ্চুর দিকে তাকিয়ে তার প্রতিক্রিয়া কী জানতে বলল, 'আমার বিয়া অই গেছে হুট কইরা!'

বাচ্চু বিশ্বাস অবিশ্বাসের মধ্যবর্তী অবস্থায় পড়ে গেলো। সে শেলীর সবকথাই বিশ্বাস করেছে চোখ বন্ধ করে, এই কথাটাও হয়ত বিশ্বাস করত কিন্তু পারছে না। সে মনে প্রাণে চাইছে এ কথাটা যেন মিথ্যা হয়, সে বিশ্বাস করতে পারছে না তার শেলী অন্যকারো ঘরণী হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। যাকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসা হয় তাকে কখনও অবিশ্বাস করা যায় না। তার ডানচোখের কোণা গড়িয়ে টুপ করে জল পড়তে লাগলো। শেলী অবাক বিস্ময়ে তা দেখে মাথা অন্যত্র ঘুরিয়ে নিলো।

মেয়েরা বড্ড কঠিন হৃদয়ের হতে পারে, যাকে ভালবাসে তার চোখে ভালবাসা খুঁজে দেখতে সে তাকে কষ্টও দিতে পারে, এমনকি বিয়ের খবরটা দিতেও খানিকটা দ্বিধাবোধ করে না। কোন ছেলে যদি হত তবে সে পালিয়ে বেড়াত নয়ত অপরাধবোধে কাতর কন্ঠে বলত।

শেলী পাল্টা প্রশ্ন করলো, 'আইচ্ছা তুমি কিতা আমারে ভালবাসতায়?'

এক চোখে জল নিয়ে ফিক করে হেসে বলল, 'ভালবাসতাম না বাসি, অখনো।'

শেলীর ঠোঁট কেঁপে উঠল, সে বুঝতে পারল তার কান্না চলে আসবে যেকোন মূহুর্তে, সে কান্না দেখাতে চায় না বাচ্চুকে।

'বাচ্চু, আমি যাইগা, বাসাত যাওন লাগব।' এ কথা বলে ব্যাগ থেকে খুলে একটা ভাঁজ করা কাগজ বাচ্চুর হাতে গুঁজে দিয়ে রিকশায় গটগট করে উঠে গেলো।

বাচ্চু কাগজটা হাতে নিয়ে ছোট্ট রাস্তা পেরিয়ে কলেজের দেয়ালে হেলান দিতে দিতে কাগজটা খুলে দেখলো।

''আমাকে যে ভালবাসো তা আগে বলো নি কেনো? আমি আগে বুঝতে পারি নাই, বিয়ের পর বুঝতে পেরেছি যে তোমাকেও আমি ভালবাসি। আমি চাই না আর কিছু তবে তুমি যদি আরও আগে বলতে হয়ত অন্যরকম হতে পারত তোমার আমার গল্পটা।''

এটুক পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল বাচ্চু। দেয়ালে হেলান দিয়ে মাটিতে বসতে বসতে দেখলো শেলীকে নিয়ে রিকশা বাঁদিকে বাঁক খেয়ে চলে যাচ্ছে। দৃষ্টিসীমার বাইরে যাওয়ার পর সে আবার কাগজ ভিজে চোখে দেখতে লাগলো।

''তোমার 'একটি চুম্বনের অভিপ্রায়' লেখাটা পড়ে আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম সবকিছু। আমার একটা ইচ্ছা কোন একদিন তোমাকে গভীর আবেগে একটা চুমু খাবো, তোমার অভিপ্রায় পূরণের লক্ষ্যে।''



শেলী ঝরঝর করে কাঁদছে কবরের সামনে হাঁটু গেঁড়ে। এতটা বত্‍সর পর বাচ্চুকে আবার পেলো কিন্তু এ পাওয়া তো পাওয়া নয়। বাচ্চুকে আজ তার বুকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু......। হঠাত্‍ করে সে ভাবতে লাগলো, তারা দুজনে ছিল পাশাপাশি অবস্থানরত দুটি রেললাইন। একই সাথে এতটা পথ এসে হঠাত্‍ একজন বাঁক ঘুরিয়ে অন্যত্র চলে গেছে আরেকজন সীমা টেনেছে স্টেশনে। তাদের গন্তব্য তাই কখনো এক হয় নি, এক হলে তারা মিশে যেতো একে অপরের সাথে যেমন করে একটা রেললাইন আরেকটার সাথে মিশে একইসাথে গন্তব্যের দিকে এগুতো!

কান্নাভেজা চোখে শেলী ঘাড় ঘুরিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা তার মেয়েকে দেখলো। তানিশা আকিবের বাহুতে ধরে কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঝাপসা দৃষ্টিতে মনে হলো, সে আর বাচ্চু ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। শেলী আস্তে করে মাথা নিচু করে বাচ্চুর কবরের এপিটাফে চোখ বন্ধ করে একটা গাঢ় চুমু খেলো। বাচ্চু হয়ত আজ থেকে গভীর প্রশান্তি নিয়ে ঘুমোতে পারবে। আর এদিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারা দুজনে শেলীর দিকে।



লেখকের কিছু কথাঃ
গল্প লেখার পিছনের কিছু ভাবনাঃ
গল্পটা আমার নিজের শহর হবিগঞ্জ নিয়ে লেখা, নিজের শহরকে সবার সামনে পরিচিত করার উদ্দেশ্যে লেখা। সিলেটের বাইরে আসার পর থেকে যেই জিজ্ঞেস করতো, 'দেশের বাড়ি কই?'
উত্তরে যদি বলতাম, 'হবিগঞ্জ' তাইলে অনেকে চিনতে পারতো না। তখন পাল্টা প্রশ্ন অনেকে করতো, 'কোথায় এটা?'
চিনিয়ে দিতে হতো এভাবে, সিলেট বিভাগের একটা জেলা। অনেকে এমনও বলেছে, গ্রাম নাকি?
একটা সময় পর বিরক্ত হয়ে বলতাম, 'আমার বাড়ি সিলেটে।'
নিজের শহরকে হাইলাইটেড করলাম এই গল্পের মাধ্যমে।

উৎসর্গঃ সকল হবিগঞ্জবাসীর জন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৫০
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×