এমন কি কেউ আছেন- যিনি জীবনের কোনো পর্যায়ে, বিশেষত শৈশবে কল্পনা করেননি বা ভাবেননি- ইস! যদি একদিনের জন্য হলেও রাজা হতে পারতাম, বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম!
বাস্তবে হবে না জেনেও অনেকে কল্পনায় ঠিকও করে ফেলেন, সেই দিনটাতে কি কি করবেন। আবার এটাও সত্যি, অনেকের জীবনে এই স্বপ্ন বা কল্পনা বাস্তব হয়েই ধরা দিয়েছে। ধরুন সেই লোকটার কথা- যাকে সম্রাট হুমায়ূন একদিনের জন্য দিল্লির সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। তার মানে, এসব কল্পনা সত্যি হলেও হতে পারে।
এখন ভাবুন এই সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি– বলিউডের ‘মিনিস্টার’ বা টালিউডের ‘ফাটাকেস্ট’ ছায়াছবির কথা। সম্ভাবনাটা সত্যি হতেই পারে, তবে যে পদ্ধতিতে এসব ছায়াছবিতে তা চিত্রায়ন করা হয়েছে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে তার কতোটুকু যুক্তিযুক্ত?
একজন মানুষের মনন পরিশীলিত করার জন্য কিংবা বিনোদনের জন্য শিল্প, সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। একজন মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য এসবের চর্চার সত্যিকার অর্থে কোনো বিকল্প নেই। আর এদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব পদ্ধতি কোনো একটা বিষয়কে তুলে ধরার ক্ষেত্রে।
তবে, অনেক ক্ষেত্রে যেখানে মনোবিদ্যা বা মনোরোগ চিকিৎসার ব্যাপার আসে, দেখা যায় অনেক ভুল উপস্থাপনা কিংবা ভুল ধারণার রূপায়ন। এসবের পেছনে ভিত্তি হিসেবে থাকে- আপাত সত্য বা অর্ধ প্রমাণিত কোনো একটি বিষয়, অথবা আগে প্রচলিত ছিল কিন্তু এখন নেই এমন কোনো বিষয়, এমনকি সম্পূর্ণ মনগড়া বা সমাজে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা।
বিশিষ্ট সমালোচকের দৃষ্টিতে নয়, কিছুটা মজা করার ইচ্ছে নিয়েই আসুন দেখে নিই– মানসিক রোগ ও তার চিকিৎসা নিয়ে কি কি ভুল সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে সাধারণত হয়ে থাকে-
১. মানসিক রোগের চিকিৎসক নাকি গোয়েন্দা
প্রায়ই বিভিন্ন উপন্যাসে, চলচ্চিত্রে দেখা যায়, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে রোগী কোনো জটিল সমস্যা নিয়ে এসেছেন, আর চিকিৎসক সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বা অন্য কিছু করতে করতে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছেন। এরপর তিনি নিজেই নেমে পড়েন মাঠে, রোগীকে আড়ালে অনুসরণ করেন, বা রোগীর বিভিন্ন কথা বিশ্লেষণ করেন, বিভিন্ন আত্মীয় বা বন্ধুর কাছ থেকে তথ্য জোগাড় করেন– এক কথায় রীতিমতো গোয়েন্দাকে হার মানিয়ে সমস্যার সমাধান করে ফেলেন। সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেন, এমনকি কোনো লুকিয়ে থাকা অপরাধীকে আইনের হাতে তুলে দেন। থ্রিলারধর্মী উপন্যাস বা চলচ্চিত্র হিসেবে ব্যাপারটা খুবই উপভোগ্য, কিন্তু আসলে সে রকম কিছু কি হয়?
২. দেখামাত্র মন পড়ে ফেলা
কেউ একজন হয়তো হেঁয়ালি করে কথা বলছে, কিংবা অনেক কথা গোপন করে রাখতে চাইছে-আর মিসির আলী বা তার মতো কোনো মনোবিদ বা কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ভারি চশমার আড়ালে তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। লোকটির কথা শেষ হতেই তিনি দাঁড়ি–কমাসহ লোকটির মনের যাবতীয় কথা একের পর এক বলে গেলেন। আর লোকটি ধরা পড়ে কাঁচুমাচু, আর আশপাশের মানুষজন অবাক বিস্ময়ে হতবাক।
পাঠক কিংবা দর্শক হিসেবে আপনিও যদি উৎফুল্ল বোধ করেন, তবে লেখক বা পরিচালককে অবশ্যই গুণীজন বলতে হবে- কারণ, বাস্তবে এমন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
৩. রোগী:ডাক্তার = ১:১
ভাবুন কৌশিক গাঙ্গুলীর তৈরি ‘শব্দ’ ছায়াছবির কথা। সবদিক দিয়েই নিঃসন্দেহে অসাধারণ একটি ছবি। কিন্তু, সেখানের মনোরোগ বিশেষজ্ঞটি কি করেন সারাদিন- তা কি খেয়াল করেছেন? তিনি শুধু একটি রোগীকে নিয়েই চিন্তা করেন, আলোচনা করেন, বই ঘাঁটেন আর সোফায় বসে ঘুমান। ভাবতেই কি অন্যরকম লাগছে না?
৪. মানসিক রোগের চিকিৎসা = ভালোবাসার অভিনয় করতে গিয়ে ভালবেসে ফেলা
গল্পের বা নাটকের বা সিনেমার নায়ক বা নায়িকা ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে আজ বদ্ধ উন্মাদ, তার মা-বাবা- দাদি শোকে কাতর, কি করবেন ভেবে দিশেহারা। বিখ্যাত ডাক্তার অমল বোস আসলেন রোগী বা রোগিনীকে দেখতে, দেখা শেষে গম্ভীর মুখে জানালেন সমাধান- এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে, যে মন-প্রাণ উজাড় করে তাকে ভালোবাসবে, ভুলিয়ে দেবে অতীত স্মৃতি। এটাই একমাত্র চিকিৎসা– আর কোনো উপায় নেই। এরপরের ঘটনা সবার জানা।
অনেক সময় চিকিৎসক তরুণ বয়সের হলে দায়িত্বটা নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নেন। সমস্যা হচ্ছে, একজন চিকিৎসক সারা জীবনে শুধু একবারই এমন সেবা দিতে পারবেন, বারবার করতে গেলে কি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
৫. মানসিক রোগের চিকিৎসা-ইলেকট্রিক চেয়ারে হাত পা বেঁধে শক দেওয়া
সালমান খান অভিনীত একটি সিনেমাতে দেখা গেল-তার পাগলামির জন্য, বোকামির জন্য বা কোনো নির্দেশ মানতে না চাওয়ার জন্য একটাই সমাধান, উচ্চমাত্রার বৈদ্যুতিক শক। তাকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় একটা কক্ষে, মাথায়-পায়ে-হাতে লোহার বেড়ি পড়িয়ে দেওয়া হয়- তারপর কাচের ওপার থেকে একটা মেশিনে নব ঘুরিয়ে শক দেওয়া হয়, প্রায় ৫/৬ মিনিট ধরে।
ধর্ষকাম মনোভাবের এক চিকিৎসক ইচ্ছে করেই বেশিমাত্রার বৈদ্যুতিক শক দিতে থাকেন এবং মাত্রাটাও বাড়াতে থাকেন ইচ্ছেমতো। অবশেষে, সুন্দরি তরুণী মনোরোগ চিকিৎসক শিল্পাশেঠী এসে তাকে উদ্ধার করেন, ভালোবাসার মাধ্যমে।
কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার তাই না? তবে, ভয়ের কোনো কারণ নেই। সত্যিকার অর্থে, যে পুরাতন চিকিৎসা পদ্ধতি Electroconvulsive Therapy-র ওপর ভিত্তি করে এসব দেখানো হয়- তা এখন ব্যবহার হয় না বললেই চলে। যদিওবা কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োগ করাও হয়, তার আগে অনেক সতর্কতা, পরীক্ষা নিরীক্ষার পর, রোগীকে অজ্ঞান করে মাত্র ১/২ সেকেন্ডের জন্য দেওয়া হয়। বুঝতেই পারছেন, কষ্ট যা হয় তা আসলে নায়ক নয়, দর্শক-ই ভোগ করেন।
৬. মানসিক রোগের মোক্ষম দাওয়াই- মাথায় বাড়িঃ
এ ব্যাপারে বিশেষ আর কিছু কি বলার আছে? উপমহাদেশের ছবি দেখেছেন, বিশেষত, বাংলা ছায়াছবি, কিন্তু এ জিনিশ দেখেননি- তা হতেই পারে না। মূলত ভুলে যাওয়ার কারণ হিসেবে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেলেও, মাঝে মধ্যে পাগল হয়ে যাবার ঘটনা হিসেবে দেখা যায়। ব্যাপারটা এত সাধারণ হয়ে গেছে যে, এখন পাঁচ– ছয় বছরের শিশুও বলে দিতে পারে, সুস্থ হয়ে ওঠার একটাই উপায়। আর তা হলো আবার মাথায় বাড়ি দেওয়া। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা সত্যি নয়।
৭. মানসিক রোগের চিকিৎসা- সম্মোহন পদ্ধতি
‘আজ রবিবার’ নাটকটির কথা আশা করি অনেকেরই মনে আছে। সেখানে জাহিদ হাসানকে সুস্থ করে তোলা হয় সম্মোহন পদ্ধতির মাধ্যমে। শুধু এখানেই নয়- অনেক উপন্যাসে, নাটকে, গল্পেই দেখানো হয়- মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সম্মোহন করার জিনিশপত্র নিয়েই ঘোরাঘুরি করেন- আর লোক দেখলেই একটা দোলক দোলাতে দোলাতে বলতে থাকেন- আপনি এখন ঘুমিয়ে পড়বেন, আপনার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে।
কিন্তু, আপনার চেনাজানা কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কি এই আচরণ করেন? করবেনই বা কেন? এসব সম্মোহন পদ্ধতি এখন আর কেউই ব্যবহার করেন না। আসলে, এর সাথে একটু রহস্যময়তা, গা শিউরে ওঠার সম্পর্ক আছে দেখেই- শিল্প সাহিত্যে এর বহুল ব্যবহার।
৮. টাকা খোর চিকিৎসকঃ
খলনায়ক কোনো ভাবেই পাচ্ছেনা নায়িকার মন, কিংবা ছোটভাই হাত করতে চায় সব সম্পত্তি- উপায় কি? উপায় আছে- হাত করতে হবে টাকাখোর অমানুষ এক মনোরোগ চিকিৎসককে। আর তারপর তার ক্লিনিকে ভর্তি করে দাও নায়ককে, অথবা বড়ভাইকে। ব্যস, কেল্লা ফতে!
ওখানে, চিকিৎসকের নেতৃত্বে বন্দি লোকটাকে পর্যায়ক্রমে মারধর, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হবে। আর সবশেষে একটা বিশাল বড় ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ নিয়ে আসা হবে-যাতে ভর্তি করা আছে অব্যর্থ ‘পাগল’ বানানোর ওষুধ। ভাগ্য ভালো থাকলে, দেয়াল ভেঙে কেউ উদ্ধার করে নিয়ে যায় বন্দিকে, আর খারাপ হলে –‘পাগল’।
বিষয়টাতে, কিছু সত্যতা যে নেই তা নয়। তবে, যত সহজে এ ঘটনা ঘটতে দেখানো হয়, তত সহজ নয় বাস্তবে। এখানে মনে রাখা দরকার, আমাদের দেশে অনেক ধরণের ভুয়া মানসিক রোগের চিকিৎসক নামধারী ব্যক্তি, বেআইনি ভাবে মানসিক রোগের ভুয়া চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। যাদের কারো কারো আবার নিজস্ব ‘পাগলা গারদ’ আছে। সেসব ক্ষেত্রে এসব হওয়া সহজ হলেও হতে পারে।
কিন্তু, কোনো সরকারি হাসপাতালে কিংবা আদালতে কাউকে মানসিক রোগী বা অপ্রকৃতস্থ (পাগল বলে কোন শব্দ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের অভিধানে এখন আর নেই) হিসেবে ঘোষণা করতে হলে, কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়, কারো একক সিদ্ধান্তে তা হয় না।
আবার, কারো অনুরোধে বা অবৈধ ঘুষের মাধ্যমে একজন রোগীকে নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত সময় হাসপাতালে রাখা যায় না। আর একটি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমেই একজনকে সম্পূর্ণ ‘পাগল’ বানানো আগের দিনে রূপকথায় সম্ভব হলেও আধুনিক কোনো ওষুধের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়।
৯. মনোরোগ চিকিৎসক- আধা-পাগল
মনোরোগ চিকিৎসক কিন্তু কোনো পাগলামি করেন না, কিংবা আবোল-তাবোল বকেন না, কিংবা উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা করেন না– এমন কোনো চরিত্র সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া রীতিমত দুষ্কর।
সাধারণ মানুষের মনে কবি বললেই যেমন ঝোলা কাঁধে একটা উদাসী পথিকের ছবি ভেসে উঠে, তেমনি মনোরোগ চিকিৎসক হিসেবে আধা-পাগল একজন মানুষকেই সার্থক ভাবে গণ-মানুষের মনে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন শিল্পী- সাহিত্যিকরা।
আসলে, প্রত্যেক মানুষেরই কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে- যেসব তাকে অন্যদের কাছে পছন্দের বা অপছন্দের করে তোলে। কিন্তু, একজন মনোরোগ চিকিৎসক যেহেতু সাধারণের ভাষায় ‘পাগলের’ চিকিৎসা করেন, তাই তার এইসব আচরণকেও পাগলামি হিসেবে ভাবতেই সবাই ভালবাসে। আর সাহিত্যিকরাও এই ব্যপারটাকে নিয়ে মজা করেন।
এসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা করার কিংবা উচিৎ-অনুচিত ঠিক করে দেওয়ার কোনো উদ্দেশ্যই এই লেখার কারণ নয়। এই লেখার বক্তব্য একটাই- একদিনের রাজা বানাতে চাইলে সম্রাট হুমায়ুনের কাছ থেকে ধার না করে, বর্তমান পদ্ধতির মধ্যেই গ্রহণযোগ্য কোনো ধারণা তৈরি করাটাই শক্তিমান সাহিত্যিকের কাজ।
গতানুগতিকতা থেকে বের হয়ে নতুন কিছু তৈরি হলেই বেশী উপভোগ্য হয় ব্যাপারটা। যেমন-সত্যজিৎ রায়ের ‘বাক্স বদল’ ছায়াছবিটি সেই সময়ের তুলনায় আধুনিক হলেও বর্তমান সময়ের বিবেচনায় বাস্তবসম্মত নয়। পক্ষান্তরে, উল্লেখ করা যায়– ‘ভুল ভুলাইয়া’, ‘Shutter Island’, ‘Inception’ এমনই সব ছবির কথা, যেখানে অবাস্তব ও বাস্তব কি সুন্দরভাবে মিশে যায়, যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে।
‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’-এর মতো বাস্তবতা ও বৈজ্ঞানিক ধারণাকে ধারণ করেই তৈরি হোক অসাধারণ কাহিনী, উপন্যাস, ছায়াছবি, নাটক- এটাই শেষ প্রত্যাশা। ভুলে গেলে চলবে না, সচেতনতা তৈরিতে এসবের চেয়ে শক্তিশালী দ্বিতীয় কোনো মাধ্যম নেই।
-------------------------------------------------------------------------------
ভাবলাম - আমার আগের লেখাগুলি ধারাবাহিক ভাবে এখানে দিতে থাকব, পাশাপাশি নতুন লেখাও থাকবে। মুলতঃ এক জায়গায় সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই এটি করছি।
এই লেখাটি আমার এবং পূর্বে banglanews24.com এর মনোকথায় প্রকাশিত হয়েছে-- নিচে তার লিঙ্কঃ
এইখানে ক্লিক করুন।
--------------------------------------------------------------------------------
সবাই ভালো থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:২৮