somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাফাখুম...... বাংলাদেশের নায়েগ্রা!

০৯ ই আগস্ট, ২০১০ বিকাল ৪:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





নাফাখুম

বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি স্থানটি সাঙ্গু নদীর উজানে একটি মারমা বসতী। মারমা ভাষায় 'খুম' মানে হচ্ছে জলপ্রপাত। রেমাক্রি থেকে তিন ঘন্টার হাঁটা পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় আশ্চর্য সুন্দর সেই জলপ্রপাতে, যার নাম 'নাফাখুম'। রেমাক্রি খালের পানি প্রবাহ এই নাফাখুমে এসে বাঁক খেয়ে হঠাৎ করেই নেমে গেছে প্রায় ২৫-৩০ ফুট....প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছে চমৎকার এক জলপ্রপাত! সূর্যের আলোয় যেখানে নিত্য খেলা করে বর্ণিল রংধনু! ভরা বর্ষায় রেমাক্রি খালের জলপ্রবাহ নিতান্ত কম নয়... প্রায় যেন উজানের সাঙ্গু নদীর মতই। পানি প্রবাহের ভলিউমের দিক থেকে সম্ভবতঃ নাফাখুম-ই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত। আমার দেশে এত সুন্দর একটা জলপ্রপাত....অথচ আমরা খুব কম জন-ই এই জলপ্রপাতটা সম্মন্ধে জানি!


নাফাখুম (আপস্ট্রীম থেকে তোলা)

নাফাখুমের পড়ন্ত জলের ধারার নীচে গিয়ে বসার সুযোগ রয়েছে। আমার-আপনার জন্য বিষয়টা বেশ রিস্কি হলেও পাহাড়ীরা জলপ্রপাতের পিছনে বসে অনায়াসে মাছ শিকার করে। এক ধরনের উড়ুক্কু মাছ (স্থানীয় ভাষায় মাছটির নাম নাতিং মাছ) উজান ঠেলে এসে নাফাখুমে বাধাপ্রাপ্ত হয়, লাফ দিয়ে এই প্রপাত-টা আর ক্রস করতে পারেনা....গিয়ে পড়ে জলপ্রপাতের ভিতরে ছোট্ট একটা গুহায়। অনায়াসে সেখান থেকে মাছ সংগ্রহ করে স্থানীয় পাহাড়ীরা।


রেমাক্রি বাজার (নদী থেকে তোলা)

রেমাক্রি বাজার থেকে দুইভাবে নাফাখুম-এ যাওয়া যায়। এক ঘন্টা উঁচু-নীচু পাহাড়ী পথ মাড়িয়ে(পাহাড় ডিঙিয়ে) তারপর রেমাক্রি খালের পাড় ধরে বাকিটা হেঁটে চলা। এই পথে গেলে নাফাখুমে পৌঁছাতে আপনার সময় লাগবে চার ঘন্টা। রেমাক্রি খাল ক্রস করতে হবে তিন বার, যার মধ্যে শেষবার আপনাকে সাঁতার পানি পেরুতে হবে। আপনি পাহাড় না ডিঙিয়ে গোটা পথই রেমাক্রি খালের পাশ দিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে নৌকা করে রেমাক্রি খালের মুখে (যেখানে রেমাক্রি খাল সাঙ্গুতে পড়েছে, রেমাক্রিখুম) যেতে হবে আপনাকে...তারপর খালের পাড় দিয়ে হাঁটা পথে নাফাখুম বরাবর। এই পথে আপনাকে চার বার খালটি ক্রস করতে হবে...তবে সময় লাগবে তিন ঘন্টা। আমি আপনাকে দ্বিতীয় পথেই যেতে পরামর্শ দেব...এতে আপনার সময় ও এনার্জী দু'টোই ব্যয় হবে কম। আর শীতের দিনে গেলে খাল ক্রস করার ঝামেলাই নেই.... গোটাটাই আপনি ঝিরিপথ দিয়ে হেঁটে যেতে পারবেন। তবে শীতকালে নাফাখুম-এর এই পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ হবেনা.... পানি প্রবাহ অনেক কমে যাবে তখন।

রেমাক্রিখুম-টাও খুব সুন্দর! রেমাক্রি বাজারের কাছেই এই 'রেমাক্রি খুম'। রেমাক্রি খাল যেখানে এসে সাঙ্গু নদীতে পড়েছে.... সেটাই রেমাক্রি খুম।


রেমাক্রিখুম

পাঁচ-ছয় ফুট উপর থেকে কয়েকটি ধাপে পানি পড়ছে এই জলপ্রপাতে। এ'টি অনেক চওড়া। এই জলপ্রপাতটিও আপনাকে মুগ্ধ করবে নিঃসন্দেহে। তিন্দু থেকে রেমাক্রি যাবার পথেই চোখে পড়বে এই রেমাক্রিখুম।


রেমাক্রিখুম

সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ব্লগার বান্দরবানের থানচি উপজেলার তিন্দু, বড়পাথর, রেমাক্রি ঘুরে এসেছেন... চমৎকার সব ছবিসহ অনেকে পোস্ট-ও দিয়েছেন। বিস্তারিত না গিয়ে আমি শুধু কিছু তথ্য শেয়ার করছি এখানে....



নীলগিরি

১. বান্দরবান শহর থেকে থানচি উপজেলা (বান্দরবান জেলার সর্বদক্ষিণের উপজেলা) সদরের দূরত্ব ৮২ কিঃমিঃ। রিজার্ভ চাঁদের গাড়ীতে বান্দরবান থেকে থানচি যেতে সময় লাগবে ৩ ঘন্টা, ভাড়া নেবে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। পথে চিম্বুক আর নীলগিরিতে নেমে কিছু ছবি তোলার ইচ্ছে থাকলে সময় কিছুটা বেশী লেগে যেতে পারে।


তিন্দু (সাঙ্গুর পাড়ে)


তীব্র স্রোত ঠেলে উজানে যাবার চেষ্টা

২. বর্ষায় ইঞ্জিনবোটে থানচি থেকে তিন্দু যেতে সময় লাগবে আড়াই ঘন্টা। তিন্দু থেকে রেমাক্রি যেতে লাগবে আরও আড়াই ঘন্টা। এই পাঁচ ঘন্টার নৌ-পথে আপনি উজান ঠেলে উপরের দিকে উঠতে থাকবেন আর ভার্টিকেল ডিষ্টেন্স কভার করবেন প্রায় ৫০ মিটার । শীতের সময় ইঞ্জিন বোট চলার মত নদীতে যথেষ্ট গভীরতা থাকেনা...তখন ঠ্যালা নৌকাই একমাত্র বাহন। বর্ষা মৌসুমে তিন দিনের জন্য ইঞ্জিনবোটের ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। আর শীত মৌসুমে ঠ্যালা-নৌকার ভাড়া পড়বে প্রতি দিনের জন্য ১০০০ টাকা।


সাঙ্গু নদীর উজানে হঠাৎ এরকম স্টেপ-ডাউন পাবেন প্রচুর

৩. থানচি থেকে যত উজানে যাবেন (দক্ষিণে).... নদীর স্লোপ তত বাড়তে থাকবে। গোটা নদীপথেই একটা জেন্টেল স্লোপ-তো আছেই...তার উপরে মাঝে মাঝেই আছে ১ ফুট থেকে ১ মিটার পর্যন্ত খাড়া স্টেপ-আপ। আমি রেমাক্রি ছাড়িয়েও ছোট মওদক পর্যন্ত গেছি। কিন্তু তিন্দু থেকে রেমাক্রি পর্যন্ত নদীপথ-টুকুই বেশী খরস্রোতা ও একটু ঝুঁকিপূর্ণ।


যখন আমরা বড়পাথর অতিক্রম করছি

৪. ঢালু পাহাড়ী নদী খরস্রোতা হওয়াই স্বভাবিক... বর্ষায় সাঙ্গুও সেইরকম খরস্রোতা। তবে ভয় পাবার কিছু নেই। নৌকার মাঝিরা যথেষ্ট স্কীল বলেই মনে হলো। দু' একটা দূর্ঘটনার গল্প হয়তো শুনবেন.... কিন্তু আমি ভয়ের কিছু দেখিনি, বরং ফেরার সময় রাফটিং-এর একটা মজা উপভোগ করেছি। থাকা-খাওয়ার কিছুটা অসুবিধা মেনে নিলে এমনকি এ্যডভেঞ্চার প্রিয় মেয়েরাও অনায়াসে রেমাক্রি পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারবেন।


চমৎকার সুস্বাদু চাঁপা কলা

৫. থানচি থেকে নৌকায় উঠার সময় মাত্র ১০০ টাকায় এইরকম এক কাঁদি চাঁপা কলা নৌকায় তুলে নিলে.... পথে বেশ কাজে লাগবে।

৬. হাতি পোকার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এন্টি মসক্যুইটো ক্রীম নিতে ভুলবেন না।


রেমাক্রি রেস্ট হাউজের বারান্দায়... ধুম ঘুম!

৭. রেমাক্রি পর্যন্ত যদি যান... তবে এইভাবে ঘুমিয়ে সময় না কাটিয়ে একটু কষ্ট করে 'নাফাখুম' দেখে আসতে ভুলবেন না। হাতে সময় থাকলে ব্যাটকেভ বা বাঁদূর গুহা-টাও দেখে আসতে পারেন, যদিও আমরা ব্যাটকেভ দেখে আসার সময় করতে পারিনি।

৮. আর্মি বা বিডিআর-এর রেফারেন্স থাকলে তিন্দু ও রেমাক্রিতে বিডিআর-এর আতিথেয়তা পেতে কষ্ট হবেনা.... আর বিডিআর-এর আতিথেয়তা পেলে থাকা-খাওয়ার সম্ভাব্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা-টা সহজেই মিলে যাবে। সাথে উপরি পাবেন নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা...যদিও নিরাপত্তা জনিত কোন অসুবিধা আমার চোখে পড়েনি।

৯. বিডিআর ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা না করতে পারলেও কোন অসুবিধা নেই। নিশ্চিন্ত মনে বছরের যে কোন সময় ৪ থেকে ৬ জনের গ্রুপ নিয়ে চলে যান তিন্দু, রেমাক্রি। মারমাদের বাঁশ-কাঠের বাড়ীতে অনায়াসে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে আপনাদের। মারমাদের প্রায় প্রতিটি বাড়ীতেই খুব অল্প টাকায় এমন থাকা-খাওয়ার সুবিধে রয়েছে। তিনবেলা খাওয়ার খরচ পরবে জনপ্রতি ২০০ টাকা, আর থাকা ফ্রি। তবে যে বাড়ীতে ফ্রি থাকবেন... খেতে হবে তাঁর দাওয়ায় বসেই।

১০. থানচি পর্যন্ত আপনার টেলিটক মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাবেন। তিন্দু গিয়ে আপনার মোবাইলে নেটওয়ার্ক না থাকলেও আপনি একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবেন না। মারমাদের দোকান থেকে বাঁশের উপর এ্যন্টেনা লাগানো সেট থেকে চাইলে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন। কিন্তু রেমাক্রি পৌঁছালে আপনি একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।

তাহলে একবার সুযোগ করে ঘুরে আসুন তিন্দু, বড়পাথর, রেমাক্রি, নাফাখুম.... উপভোগ করে আসুন ভিন্ন এক থ্রিলিং প্রকৃতি। স্যাটিসফেকশন গ্যারান্টেড!





সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১১ রাত ১:৪০
১২৩টি মন্তব্য ১০৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×