
আমি যখন থ্রি বা ফোরে পড়ি তখন ইত্তেফাক পত্রিকায় খেলার খবর পড়তাম। আর সেইসময় খেলা মানেই ছিল ফুটবল। সেই ইত্তেফাক পত্রিকার খেলার পাতাটিতে মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, ওয়ারী, বিজেএমসি ইত্যাদি দলের খবর থাকতো। ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন সময়েও আমি পয়েন্ট বুঝতাম না। জিতলে কতো পয়েন্ট বা ড্র হলে কীভাবে পয়েন্ট বন্টন হয় তখনো না বোঝা আমি ভাবতাম ২ গোলে জিতলে দুই পয়েন্ট পায় দল আবার ৫ গোলে জিতলে তার প্রাপ্ত পয়েন্ট হয় ৫।
একদিন এভাবেই এই গোল অনুযায়ী দেয়া আমার পয়েন্ট এবং পত্রিকার পাতায় দলগুলোর পয়েন্ট টেবিলের অমিল দেখে বুঝলাম এখানে আরো কিছু ঘাপলা আছে। সেইসময় আমি আর এই রহস্য উদঘাটন করতে পারিনি। যাইহোক এই খেলার খবর পড়ে পড়ে ফুটবলের প্রতি আগ্রহ জন্মায়।
মনে আছে সেই তখন থেকে আমি সাদা কালো জার্সির দল মোহামেডানের সমর্থক। নিয়মিত দলের খেলার খবর রাখি। আরেকটু বড় হবার পর বন্ধুরা মিলে খেলা দেখতে যাওয়া শুরু করলাম। ১৯৮৭/৮৮ থেকে নিয়মিত স্টেডিয়ামে যেতাম আমি। বসতাম মোহামেডানের সমর্থকদের জন্য নির্ধারিত গ্যালারীতে। আমাদের বসার নির্দিষ্ট জায়গা ছিল, সেখানেই বসে খেলা দেখতাম।
যেদিন মোহামেডানের সাথে আবাহনীর খেলা থাকতো সেদিন ঢাকা ভিন্ন এক নগরে বদলে যেতো যেন। দুপুরের পর থেকে সকলেই স্টেডিয়াম মুখী। রাস্তাঘাট লোক চলাচল কম। মতিঝিল ও গুলিস্তানের তারা প্রস্তুতি নিতো বিরাট একটা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া বা হাল্কা ইট পাটকেলের জন্য। খেলা শেষ হলে তখন হাল্কা পাতলা গ্যাঞ্জাম হতো। যাইহোক এইসব ছাপিয়েও তখন ফুটবল অন্ত প্রাণ এক জাতির দেখা মিলতো যেন যাদের ধ্যান ও জ্ঞান ছিল ফুটবল। যাদের সকল ভালোবাসা মোহামেডান আবাহনীর জন্য। এভাবেই ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা নিয়ে উন্মাতাল এক কৈশোরকাল কাটিয়েছি আমরা।
কালের পরিক্রমায় ফুটবল ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে নির্বাসিত হলো মিরপুর স্টেডিয়ামে। আমরা সেখানেও কয়েক বছর খেলা দেখেছি। সর্বশেষ ম্যাচটি মনে হয় আমি আর আমার বন্ধু মুন্নাই দেখেছিলাম। সেটা ছিল মিরপুরে। তারপরেই কেমন জানি ছন্দ পতন হলো। ধীরে ধীরে ফুটবলের সাথে দূরত্ব বাড়তে লাগলো। একসময় সেটা নাই ই হয়ে গেলো।
আমি স্কুলের হয়ে সর্বশেষ ফুটবল ম্যাচ খেলেছি কলাবাগান মাঠে। ম্যাচটি আমরা জিতেছিলাম। স্কোর লাইন ছিল ১-০। পেনাল্টিতে এই গোলটি পেয়েছিলাম। ডি বক্সের ভেতর আমাকেই ফাউল করার ফলে সেই পেনাল্টি পেয়েছিলাম আমরা। গোল কে করেছিল তা মনে নেই, হয়তো আরিফুল না অন্য কেউ। সেদিন আমাদের গোল রক্ষক ছিল মুন্না। আমার পজিশন ছিল লেফট ব্যাক। আমি যে কদিন ফুটবল খেলেছি লেফট ব্যাক পজিশনেই খেলেছি।
ঢাকার বাইরে সর্বশেষ ম্যাচটি আমি খেলেছিলাম কেরানীগঞ্জ এর আটি বাজারের মাঠে। সেই ম্যাচে অসাধারণ কিছু সেইভ করেছিল মুন্না। সেই খেলায় জিতেছিলাম নাকি হেরেছিলাম তা আর মনে নেই। আমরা মোহাম্মপুর থেকে ট্রলার নিয়ে গিয়েছিলাম আটি বাজারে। সম্ভবত ১৯৮৯ এর ঘটনা এটি।
মোহাম্মদপুরের উদয়াচল ক্লাবে এক বছর পাইওনিয়ার লিগেও খেলার কথা ছিল। প্রথম ম্যাচেই ডান হাতের আংগুল ভেংগে সেই সিজনের ইতি হয়েছিল। আর খেলা হয়নি। উলটো গুলিস্তান না নবাবপুরে মান্ডার তেলের এক কবিরাজের কাছে গিয়ে সেই হাত/আংগুল মালিশ করিয়ে আসতে হতো আর কি যে ব্যাথা। কলাবাগানের আসিফ ছিল দুর্দান্ত স্টপার ব্যাক। ও আর আমি ছিলাম উদয়াচলে। আংগুল ভেংগে যাবার এই ম্যাচটি খেলেছিলাম মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডের মাঠে। আহা কী দিন ছিল আমাদের।
তখন আমরা ভাড়ায় গিয়েও খেলতাম। এটাকে বলতো ক্ষেপ। তো এমনই এক ক্ষেপের ম্যাচ খেলতে নেমেছিলাম ধানমন্ডি ৮ নাম্বার মাঠে। হাফ টাইমের পর আমি নিজেই মাঠ ছাড়লাম। আমার বদলে অন্য খেলোয়াড় নামলো। আমাকে দেয়া হলো ৫০ টাকা। সেই টাকা নিয়ে চলে এলাম আর সেটাই ছিল আমার লাস্ট ডে অফ ফুটবল। তারপর বুট জার্সি সহ ফুটবলকে বিদায় জানালাম। আর নামিনি ফুটবল খেলতে। তারপর যা প্রেম তা শুধু টিভিতে খেলা দেখা পর্যন্ত। মাঠে আর যাওয়া হয়নি। নিজেও নামিনি।
আজ এতো কথা কেন মনে হলো?
হুট করেই কৈশোরের সেই প্রিয় দল মোহামেডান এর শিরোপা জয়ের খবর দেখছি। আর এই শিরোপা জয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করতেই নিজের শৈশব কৈশোরের কিছু সময়ে ফিরে যাওয়া।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


