আমি সমুদ্র প্রচন্ড ভালোবাসি। সমুদ্র আমাকে প্রচুর টানে। বছরে কয়েকবার সমুদ্রে না যেতে পারলে আমার মন খুব আনচান করে। তবে সমুদ্র সৈকত দেখেছি হাতে গোনা কয়েকটা।
২০০৮ সালের কথা। তখন সবে ঢাকায় এসেছি। ভার্সিটিতে পড়া শুরু করার পাশাপাশি টুকটাক কিছু ইনকাম শুরু করেছি। টার্গেট বাসা থেকে যত কম টাকা নেওয়া যায়। প্রতি মাসে একটা টার্গেট করেছিলাম, সেই পরিমান টাকা হলে আমার টিউশন ফিস আর বাসা থেকে নিতে হবে না। দেখা গেলো প্রথম তিন মাসেই আগামী ৬মাসের টিউশন ফিস ও আমার থাকা খাওয়ার খরচ যোগাড় করে ফেলতে সামর্থ হয়ে গেলাম। সাথে কিছু বাড়তি টাকাও পকেটে।
এর মধ্যে হঠাৎ সামনে আসলো টানা ৪দিনের ছুটি। ব্যাস, আর যায় কই। ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হলাম বাসস্ট্যান্ডে। কোন উদ্দেশ্য নাই কোথায় যাবো। বাড়িতেও আসতে পারি, আবার অন্য কোথাও যেতে পারি। কাউন্টারে গিয়ে মুখ অন্ধকার, কোন টিকিট নাই। ৪দিনের ছুটির খবর আমার আগে পুরা দেশের মানুষ পেয়ে গেছে, তাই টিকিট কেটে রেখেছে।
কল্যানপুরে যে কয়টা বাসের কাউন্টার ছিলো, সবগুলিতে ঢু মেরে কিছুটা হতাশ। ভাবলাম বাসায় ফিরে যাই। এর মধ্যে দেখি এক ভদ্রলোক টিকিট কাউন্টারে এসে কিছু একটা অনুরোধ করছে; তার দুইটা টিকিট ফেরৎ দিতে চায়। টাকার দরকার।
আমি এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম টিকিটের দাম কত। তিনি দুইটা টিকিট যত টাকায় কিনেছিলেন, তার থেকেও শ-খানেক কমিয়ে বললেন, কিন্তু তার টাকা চাই। আমি পুরা টাকা দিয়েই দুটা টিকিট কিনে ফেললাম। কক্সবাজারের টিকিট। কিন্তু দুইটা দিয়ে কি করবো?
হিমেলকে ফোন দিলাম, বললাম ব্যাগ গুছিয়ে সায়দাবাদ বাস স্ট্যান্ডের ইউনিক এর কাউন্টারে আসতে। হিমেল ঘুমাচ্ছিলো। সে কোন রকমে ব্যাগ নিয়ে চলে এলো। বাসে উঠে জিজ্ঞাসা করলো, কই যামু আমরা? আমি উত্তর করলাম, এটাতো প্রথমে যখন বলেছিলাম আসতে তখনই জিজ্ঞাসা করার ছিলো। যাই হোক, কথা বলতে বলতে রাত পার। আমি শুধু অপেক্ষায় কখন সমুদ্র দেখবো।
কক্সবাজারের সী-বিচ গুলির খুব কাছাকাছি পৌঁছাতেই দূর থেকে সমুদ্র দেখা গেলো। সমুদ্রের বিশালতা দেখে আমি একপ্রকার হা করেই থাকলাম। বাস থামতেই হোটেলের খোঁজে না বেরিয়ে দৌড়ে গেলাম বিচে। সমুদ্র তখন অনেকটাই শান্ত। কিন্তু কি সেই শান্তের গর্জন। একর পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চায়।
সমুদ্রের সামনে দাড়িয়ে হঠাৎই যেন আবিস্কার করলাম নিজের ক্ষুদ্রতা। চোখ থেকে ধীরে ধীরে, এক সময় অঝোরে পানি গড়াতে থাকলো। এই কান্না কেন এসেছিলো সেটা আজও আমার কাছে রহস্য।
সমুদ্রের বিশালতা কেন যেন ক্যামেরা বন্ধী করা যায় না। এর বিশালতা শুধু এর সামনে দাড়িয়েই অনুভব করা যায়। মোবাইল, ক্যামেরা কিংবা কম্পিউটারের ছোট্ট স্ক্রীণে সমুদ্র যতই দেখা হোক, সমুদ্রের বিশালতা শুধুমাত্র সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালেই অনুভব করা যায়।
এরপরও বহুবার গিয়েছি সমুদ্রে। বহুবার গা ভিজিয়েছি নোনা জলে। প্রতিবারই নিজেকে ক্ষুদ্র-অতি তুচ্ছ মনে হয়েছে। মনের অহংকার এক এক করে ঝরে পড়েছে।
একবার প্রচন্ড হতাশায় ভুগছিলাম, সদ্য ব্রেকআপ, ব্যবসার অবস্থা যাচ্ছে না তাই, ভার্সিটির রিসার্চের কাজ আগাচ্ছে না.... বৃষ্টির মৌসুম চলছে তখন। সমুদ্র প্রচন্ড উত্তাল। তার মধ্যে হেটে চলে গেলাম, বহুদূর। কখনও পানি বুক সমান, কখনও মাথার উপরে। বহু কষ্টে কয়েক পা এগিয়ে যাই, প্রচন্ড স্রোত আবার আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে আসে পাড়ে। ঘন্টা খানেক লেগেছিলো এটা বুঝতে যে এমন ঢেউ ভেঙ্গে টিকে থাকাই একজন মানুষের কাজ, ঢেউয়ের সাথে ভেসে যাওয়ায় কোন সার্থকতা নেই।
সেদিন সমুদ্র, সৈকত আর আকাশ আমার সাথে কথা বলেছিলো।
Photo by Iraj Ishtiak on Unsplash
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ২:০৪