আমি ছোট বেলা থেকে মাছ কম খাই। খাওয়ার মধ্যে ঘেরের রুই-কাতল, চিংড়ি আর ইলিশ। গ্রামে আমাদের ঘের আছে, ওখানে রুই-কাতল চাষ হয়। সেখান থেকে মাছ আসে, ঐ মাছ খাওয়ার লোভেই হয়ত রুই-কাতল খাওয়া শুরু। ইলিশ তো ঘ্রাণে পাগল হয়ে।
আমাদের বাজারে একটা মাছ উঠতো, খুলনার ভাষায় একে বলে "কইলে মাছ", এটার ভর্তা আমার দুর্দান্ত লাগতো। কড়া ঝাল দিয়ে করা হতো আমাদের বাড়িতে। আমি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে এই মাছ খেতাম। অপর দিকে আমি পাঙ্গাস মাছ কোন দিনও এক টুকরাও মুখে নেই নি। মাগুর মাছের বেলাতেও তেমনই। আর শুটকি, ওটা তো কেউ রান্না করলে মনে মনে গালি দিতাম গন্ধের জন্য, খাওয়া তো দূরের কথা!
খুলনার ছেলে হয়েও মাছ খাইনা, এই কথা শুনে অনেকেই অবাক হতো। আরও অবাক হতো যখন শুনতো আমার বাড়ি নদীর কাছেই আবার গ্রামে ঘের আছে শুনে।
যাই হোক। সৌদী আরবে আসবার পর আমি টুকটাক মাছ খেতে বাধ্য হতাম। কিছু কিছু মাছ ভালো লাগাও শুরু হয়েছিলো, কিন্তু মাংস দেখলে যে টান আসে, সেটা আসতো না কখনোই। এদিকে ফ্রোজেন রুই-কাতলা আর ইলিশের দামও অনেক, খাওয়া হয় না বলা যায়। ধীরে ধীরে মাছ খাওয়া অভ্যাস করতে লাগলাম।
সৌদীদের মাছ খাওয়া দেখে আমি অবাক হতাম বরাবরই। যে দেশে একটাও নদী নেই, সেই দেশের মানুষ মাছ খায়! সমুদ্র আছে, তাও তো সেই এমাথা আর ওমাথায়। এদের মাছ খাওয়া দেখাতে একবার এক ভাই শহরের মধ্যে মাছের দোকানে নিয়ে গিয়েছিলো। ওখানে বিভিন্ন রকম মাছ ভাজি ও রান্না করে খায়। এত ভিড় আর কোন রেষ্টুরেন্টে দেখি নাই আগে!
একবার একজনের সাথে ইয়েমেনের গা ঘেঁসা ছোট্ট এক মফস্বল সারুরায় গিয়েছিলাম। রিয়াদ থেকে আবহা বিমানে, আর আবহা থেকে সারুরা গাড়িতে। সে এক এক্সপেরিয়েন্স! ওখানে গিয়ে দেখি আমাদের আগমন উপলক্ষে সাত প্রকার মাছ সৌদী স্টাইলে রান্না ও ভাজি করা হয়েছে। আমার তো ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা। এক পদও গোস নাই? খাবো কি? একজন কাছের একটা রেষ্টুরেন্ট থেকে একটা পোড়ানো মুরগি (ফাহাম) এনে দেওয়ায় রক্ষা। যদিও যার সাথে গিয়েছিলাম, তার অনুরোধে সাত ধরণের মাছের প্রতিটাই একটু করে খেয়েছিলাম।
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পার্টটাইম কাজ করেছিলাম। সেখানে এক বাংলাদেশী ভাই দেখি ইন্ডিয়ান একজন টিচারের কর্মকান্ডে মহা ক্ষিপ্ত! তাকে সান্তনা দিতে দিতে সৌদী ডিন বললেন, "ছাড়ান দাও, ও মাছ খায় না, বুদ্ধি কম!" কথাটা বলতেই ঐ বাংলাদেশী ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন!
সৌদী ডিন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমিও কি মাছ না খাওয়ার দলে? আমার মাঝে আমার বাঙ্গালিত্ব জেগে উঠলো, লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, না না, খাই তো!
ঐ ডিন আমাকে ঐ দিন রাত্রেই নিয়ে গেলেন সেই মাছের বাজারে। সাথে আরও কয়েকজন বাংলাদেশী শিক্ষক। গাদি খানেক মাছ খেয়ে তারপর উঠলাম। বাংলাদেশী শিক্ষকদের আমার দিকে তাকানো এবং মুচুর-মুচুর হাসি দেখে ঐ ডিন একাধিকবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে আসলেই আমি মাছ খাই কি না!
সৌদীতে আমার প্রায় ৬ বছর হয়ে গেছে। এই ৬ বছরে আমি যত মাছ খেয়েছি আগের ৩০ বছরে মনে হয় না আমি এর ১০ ভাগের এক ভাগ মাছ খেয়েছি। এখন নিয়ম করে সপ্তাহে একবার মাছ কিনি। বউ-ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে খাই। মাঝে মধ্যে মাছের দোকানে গিয়ে স্কুইড ভাজি কিনে খাই।
এখনও যদি অন্য কারও কাছে শুনি সে মাছ খায় না, ডিনের ঐ কথাটা কানে বাজে, "ছাড়ান দাও, ও মাছ খায় না, বুদ্ধি কম!"
Photo by James Wheeler on Unsplash
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:২৯