চারিদিকে হালকা হালকা গরম পড়েছে। শীত-বসন্তের শেষ হতে চলেছে, বৈশাখ আসন্ন। তবে আছে ফুরফুরা বাতাস, আকাশে প্রায় পূর্নিমার চাঁদ। দুদিন আগে বা পরে পূর্নিমা। খোকন মিয়া ফিরছিলেন বাজার থেকে, গুন গুন করে গান গাইছেন তিনি। বাজারে তার একটা মাছের দোকান আছে।
গ্রামের এই দিকটায় তখনও বিদ্যুতের ছোঁয়া লাগেনি। চারিদিকে বাঁশঝাড়, গাছ, আর গ্রামের সরু পথ। বাম দিকে মোড় নিতেই খোকন মিয়া একটু ধাক্কা খেলেন। বাঁশ ঝাড়ের পাশে কেউ লম্বা আলখাল্লা পরে দাড়িয়ে আছে। খুব সম্ভবত দাড়িয়ে প্রস্রাব করছে। একটু ভয় পেলেও সাহাস করে এগিয়ে যেতে লাগলেন, গানের গলাটা একটু জোর বাড়িয়ে নিলেন।
লম্বা আলখাল্লা পরা লোক অথবা অন্য কিছুকে পার হয়ে যাবার আগ মূহুর্তেই সে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করলো, "কিরে? কিরাম আছিস?" সম্পূর্ণ খুলানার টানে কথা শুনে খোকন মিয়া একটু আস্বস্ত হলো, ভূত অন্তত না।
আলখাল্লা পরা লোকটা বললো, "তোর কাছে আগুন আছে নাকি?" খোকন মিয়া ভূতের ভয়ে সব সময় পকেটে একটা ম্যাচ, এক টুকরা কয়লা ও একটা পেরেক রাখেন। বাজার থেকে মাছ সাথে নিয়ে ফেরেন না সাধারণত; বিশেষ করে যদি রাত ১২টার বেশী হয়ে যায়। আজকে তার সাথে মাছ নেই। আছে ম্যাচ, কয়লা আর পেরেক।
খোকন মিয়া একটু আস্বস্ত হলেন, ভূতে তো আর আগুন চাইবে না। তিনি এগিয়ে যেতে যেতে পায়ের দিকে লক্ষ্য করলেন, পা উল্টা না, তার মানে মানুষ। আস্তে করে কাঁপা গলায় উত্তর করলেন, "ম্যাচ আছে।"
"এট্টু ধরায় দে তো, আমার হাত ভিজে"। খোকন মিয়া এই কথা শুনে ম্যাচ বের করে আগুন ধরিয়ে ঐ লোকের মুখের কাছে ধরতেই তার চক্ষুচড়ক গাছ। একি? এতো এক রাক্ষসের মুখরে বাবা! আর সাথে সাথে চারদিক থেকে একাধিক গলায় হা হা হা হা, হি হি হি হি করে শব্দ আসতে লাগলো।
খোকন মিয়া চিৎকার করতে করতে লম্বা লম্বা পায়ে দৌড় দিলো। কিছুদুর দৌড়ে খোকন মিয়া মাঠের মধ্যে নেমে গেলো, মাঠের ঐ পাশে স্কুলে সারা রাত প্রহরী থাকে, তার নাম ডাকতে ডাকতে দৌড়।
---------
পরদিন আমরা জানলাম পাশের গ্রামে নাকি কে ভূত দেখেছে। সেই লোককে দেখতে আমরা তার বাড়িতে হাজির। তার বাড়ি গিয়ে দেখি বিশাল এক জমায়েত। বাড়িতে বেশ লোকজন আসেছে তার ভূতের গল্প শুনতে। সে বড় বড় চোখ করে গল্প বলছে। লোকজন নানান মন্তব্য করছে। কেউ বলছে ভূত, কেউ বলছে জ্বীন!
আমি আর রিগ্যান তার কাছাকাছি একটা জায়গায় বসতে পারলাম। তিনি আমাদের সামনে তৃতীয়বারের মত, সব মিলিয়ে কতবার তার কোন ইয়াত্তা নাই, গল্পটি বললেন। ভূত তাকে কিভাবে কি করেছে, কি বলেছে, কিভাবে তার হাত ধরেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রতিবারই গল্পে তিনি বলেন ভূত যখন উনাকে তাড়া করেছিলো, তখন নাকি ভুত সাধারণ মানুষের সাইজ থেকে বেড়ে ২৫-৩০ হাত লম্বা পা নিয়ে ধাওয়া করেছিলো!
গল্প শুনে বের হয়ে আসছিলাম, রিগ্যানকে ঠেকানো গেলো না। সে মহা বিরক্ত, কারণ সে জানে যে আমার বড় ভাই কোন ভাবেই খোকন মিয়ার হাত ধরে নি, সে এটাও জানে যে ২৫-৩০ হাত লম্বা পাও ছিলো না ভূতের। সে গিয়ে মুখের উপর প্রশ্ন করে বসলো, ভূতের যদি ২৫-৩০ হাত লম্বা পা হয়, তাহলে সে তো দৌড়ে আপনার আগে চলে যাওয়ার কথা, আপনি কিভাবে ভূতের আগে আগে দৌড়ালেন? প্রশ্ন শুনেই খোকন মিয়া হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন! আমাদের সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো।
--------
আমাদের ৭জনের একটা গ্যাং ছিলো। আমরা খুলনার বুকে রাতে-বিরাতে বহুত ঘুরেছি। বহুত মজা করেছি। এই গ্রুপের লিডে ছিলো আমার ভাই আর রিগ্যানের ভাই। সাথে আমরা কচিকাঁচা ৫জন। আমাদের মধ্যে একজনকে তার ঢাকা প্রবাসী মামা ঈদে একটা ভয়ঙ্কর মুখোস গিফট করেছিলো। ঐটা নিয়ে আমরা প্লান প্রোগ্রাম করেই ঐদিন রাত্রে ভয় দিতে নেমেছিলাম। খোকন মিয়া তার একটা শিকার মাত্র।
আর একদিন বের হয়েছিলাম, তেমন সুবিধাজনক কোন মক্কেল পাওয়া গেলো না। এক সাথে ফিরছি, একটা বাড়ির জানালায় একজনকে ঝুলে ঝুলে পড়তে শুনলাম। তখন এসএসসি পরীক্ষা চলছে। সে ভুলভাল পড়তেছে দেখে রিগ্যানের ভাই তাকে দাবড়া দিলেন, বললেন ঠিক করে পড়। উনার মনেই ছিলো না যে উনি মুখোসটা পরে আছেন। ঐ ছেলে এক মহা নাচন কুদন করে চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে খাটের নিচে আশ্রয় নিলো।
এই ঘটনার পর আমরা ভয় দেওয়া থেকে বিরত থাকি। কিন্তু কালে ভাদ্রে আমাদের কাউকে কাউকে দেখা যেতো ঐ মুখোশ পরে রাত্রের আধারে তিন রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে থাকতে!
Photo by Valery Tenevoy on Unsplash