মি: আশরাফের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে কিছুটা লজ্জা পেয়ে মুখটা নামিয়ে নিয়ে একটু হাসলো রীণা। মি: আশরাফের কাছে সেই হাসিটা মোহনীয় মনে হলো। তিনি মুগ্ধ নয়নে কিছুক্ষণ ওর দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলেন। সেই মুগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে পড়ে রীণার মুখে এক রাশ রক্ত জমে উঠলো। ও আবার মুখটা নামিয়ে নিলো। কী যে হলো কে জানে। বুকের ভেতর যেন রিনিঝিনি মাদল বাজতে লাগলো ওর। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ছবিটার দিকে মনোযোগ দিলো। মি: আশরাফও আবার বাস্তবে ফিরে এসে বললেন,
---ও বারবার রাতের ছবি আঁকছে কেন? নিশ্চয়ই ও রাতেরবেলা এমন কিছু দেখেছে যা আজও ওর অবচেতন মনে জীবন্ত হয়ে আছে। আর তাই বারবার ওর ছবিতে ঐ একই ঘটনা উঠে আসছে। রীণা আরও ভাল করে ছবিটা দেখো নিশ্চয়ই কোন ক্লু বেরিয়ে আসবে।
রীণা উত্তেজিতভাবে ছবিটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।
---স্যার একটা জায়গায় যেন কালো রঙটা একটু বেশি এবং সেই কালো রঙটার উপরে আবার পেন্সিল দিয়ে কিছু আঁকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কী সেটা বোঝা যাচ্ছে না। বড্ড হিজিবিজি।
---আরেকটু ভাল করে দেখার চেষ্টা করো। ঐ বাড়ির প্রতিটা জিনিস মনে করো আর মিলিয়ে দেখো।
রীণা তাকাতে তাকাতে চোখটা একটু ছোট করলো। তারপর কিছু একটা ধরতে পেরে ওর চোখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মি: আশরাফ টেবিলের ওপাশ থেকে ওর দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললেন,
---কিছু বুঝলে?
---স্যার আমার মনে হয় ও ওদের বাড়ির পুকুরের পাশের চাতালটা আঁকার চেষ্টা করেছে। চাতালের ভেতরে একটা নারী মূর্তি। মূর্তিটা কাঁদছে। ভাল করে তাকালে বোঝা যায়।
মি: আশরাফ ভাল করে তাকিয়ে বললেন,
---হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছ তুমি। কিন্তু এই ছবির মানেটা কী?
---বুঝতে পারছি না স্যার।
---তোমার বোনের কবর তো ঐ বাসায় না?
---না স্যার। ওদের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা কবরস্থান আছে, ঐখানে।
---তুমি কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত?
---পুরোপুরি নিশ্চিত স্যার। আমি তো নিজের চোখেই দেখেছি। সবাই ঐ কবরস্থানে আপুর লাশ নিয়ে গেল। ওখানেই ওকে কবর দেয়া হল।
বারো
---কিন্তু এই কেইসটা তো তিন বছর আগেই ক্লোজড হয়ে গিয়েছিল। এটা একটা সুইসাইড কেইস ছিল।
---ক্লোজড হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু উনার বোন কেইসটা আবার রিওপেন করেছেন। উনি এই মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত চান।
---সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমেই কেইসটা ক্লোজড হয়েছিল। ওদের চোখের সামনেই সব হয়। এখন এতদিন পর আবার তদন্তের প্রয়োজন কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
--মি: আবীর আপনার এত রিঅ্যাক্ট করার তো কিছু নেই। যদি এটা সুইসাইড হয়েই থাকে তাহলে আপনি এত নার্ভাস হচ্ছেন কেন? আর যদি হত্যাও হয় তবুও তো আপনার আমাদেরকে সহায়তা করা উচিৎ। আপনি নিশ্চয়ই আপনার স্ত্রীর হত্যার বিচার হোক তাই চাইবেন? নাকি চান না মি: আবীর?
---কী বলছেন এসব? যদি এটা হত্যা হয়ে থাকে অবশ্যই আমি আমার স্ত্রী হত্যার বিচার চাই। কিন্তু ঘটনাটা আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে। এটাকে হত্যা ভাবার কোন অবকাশই নেই।
---অনেক সময় চোখের সামনে যা ঘটে তা সত্যি নাও হতে পারে। আমাদেরকে আমাদের নিয়ম মাফিক তদন্ত করতে দিন। যদি এটা সুইসাইড হয়েই থাকে তদন্ত শেষে আবার ক্লোজড হয়ে যাবে। সুতরাং নার্ভাস না হয়ে আমাদের কাজে সহায়তা করুন।
পুলিশ অফিসার বজলুর রশীদ হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন। বজলুর রশীদের বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। একজন সৎ,দায়িত্ববান ,কর্তব্যপরায়ন ,নির্ভীক পুলিশ অফিসার হিসেবে ইতিমধ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন এই অফিসার। অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো, সত্যকে খুঁজে বের করা এবং অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি পাইয়ে দেয়া যেন তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের দিনে এমন একজন ন্যায়পরায়ণ পুলিশ অফিসার সত্যি বিরল।
অফিসে নিজের কেবিনে বসে বজলুর রশীদের সাথে কথা হচ্ছিল আবীরের। দীনার কেইসটা রিওপেন হয়েছে শুনে ভীষণ উত্তেজিত আর নার্ভাস হয়ে পড়েছিল ও। পুলিশ অফিসারের কথায় তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
---কী বলছেন? আমার নার্ভাস হওয়ার কী আছে। ঠিক আছে আপনারা আপনাদের কাজ করুন।
---তাহলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো ঘটনাটা বিস্তারিত বলুন।
---পুরো ঘটনার বিস্তারিত তো আপনাদের ফাইলেই আছে।
---আছে। তবু আপনাকে আবার একটু কষ্ট করে বলতে হবে। পুরো কেইসটা শুরু থেকে আবার খতিয়ে দেখতে হবে। আপনার প্রথম স্ত্রীর সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
---আমার প্রথম স্ত্রীর সাথে আমার সম্পর্ক খুবই ভাল ছিল। আমাদের মধ্যে কখনোই কোন ঝগড়াঝাঁটি হতো না। আমরা দুজন দুজনকে খুব ভালবাসতাম। রীণা এসব ভাল করেই জানে।
---রীণা? রীণা কে?
---রীণা আমার প্রথম স্ত্রীর বোন, যে কেইসটা রিওপেন করেছে।
---ও আচ্ছা তাই বলুন। আজকাল ভুলোমনা হয়ে গেছি। বয়স বাড়ছে বুঝলেন? আচ্ছা তারপর বলুন।
---বললাম তো।
---ও হ্যাঁ। শুনলাম আপনার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর এক মাসের মধ্যেই আপনি আবার বিয়ে করেন। এত ভালবাসা কি এক মাসেই উবে গেলো মি: আবীর?
---আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমার একটি ছোট মেয়ে আছে। মেয়েটির বয়স তখন মাত্র তিন বৎসর। সদ্য মা হারা হয়ে মেয়েটি তখন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো। ওর জন্যই আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করি।
---আর বিয়ে করার জন্য মেয়েও রেডি ছিল। তাও নিজের বাড়িতেই। ভেরি স্ট্রেঞ্জ!
---কী---কী বলতে চাইছেন আপনি?
আবীরের গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল। কোনরকমে তোতলাতে তোতলাতে প্রশ্নটা করলো ও।
---কিছু মনে করবেন না প্লীজ। পুলিশের স্বভাবই হল একটু বাঁকা বাঁকা প্রশ্ন করা। বুঝলেন? আপনাদের উপর তলায় ভাড়াটে কবে এসেছিল? মিসেস দীনা অসুস্থ হওয়ার পর না আগে?
---অসুস্থ হওয়ার আগে। দীনা আর তানির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও ছিল। ওরা দুজন দুজনকে খুবই পছন্দ করতো।
---আচ্ছা ঘটনাটি এবার বলুন।
আবীর একটু সময় নিল। কথাগুলো গুছিয়ে নিল মনে মনে। তিন বছর আগের ঘটনা। তখনকার বয়ান আর এখনকার বয়ানে এতটুকু হেরফের হতে পারবে না।
---নতুন বাড়ি করে আমরা এখানে শিফট হই। আগে আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। দীনা খুব খুশি ছিল নতুন বাড়ি নিয়ে। ওর নিজের একটা বাড়ি হয়েছে এই খুশিতে ও যেন একেবারে উপচে পড়ছিল। সারা বাড়ি গাছ লাগিয়ে ভরে ফেলল। সেই সাথে ছোট্ট একটা ফুলের বাগানও করলো। কত রকমের ফুলের গাছ যে লাগালো ঐ বাগানে। ফুলে ফুলে আর সবুজ গাছ গাছালিতে সারা বাড়ি যেন হেসে থাকতো।
দীনা খুবই হাসিখুশি একটা মেয়ে ছিল। সব সময় হাসি আনন্দে মেতে থাকতে পছন্দ করত ও। মনের আনন্দে ঘর সাজাতো। কত জিনিস যে কিনত ঘর সাজানোর জন্য। রান্না করতেও ভীষণ ভালবাসতো ও। প্রায়ই ইউ টিউব দেখে দেখে নতুন নতুন রেসিপি শিখতো আর রান্না করতো। রান্নার হাতও দারুণ ছিল ওর।
কিন্তু হঠাৎই এই হাসিখুশি মেয়েটা ধীরে ধীরে চুপচাপ হয়ে যেতে থাকলো। আমি প্রথমে ব্যাপারটা উপেক্ষা করি। ভাবতাম বয়স হচ্ছে। দায়িত্ব বাড়ছে। তাই হয়তো ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে পড়ছে। কিন্তু না। এটা ছিল ওর অসুস্থতা। ও ধীরে ধীরে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছিল। কোন কথা বলতো না। একা একা বসে থাকতো। কথা বললে উত্তর দিতো না। কিন্তু সংসারের সব কাজ ঠিক মত করতো। মেয়ের খেয়াল রাখতো। আমার খেয়াল রাখতো।
আমি ওকে সাইকোলজিস্টেের কাছে নিয়ে গেলাম। কিন্তু কোন কাজ হলো না। তারপর সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালাম। সাইকিয়াট্রিস্ট ঔষধ দিলো। কিন্তু ওর কোন পরিবর্তন তাতে হলো না। একদিন ও অনেকগুলো ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেলল। আমার মাথায় তো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম। বারবার মনে হতে লাগলো ও চলে গেলে আমার কী হবে। ও পাগলই হোক আর যাই হোক তাতে ওর জন্য আমার ভালবাসা এতটুকু কমেনি। বরং মনেপ্রাণে চাইতাম ও আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। তাড়াতাড়ি ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সেবা শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তুললাম।
আরেকদিন বিকেলে আমি বাগানে কাজ করছিলাম। মেয়েটা আমার সাথেই ছিল। হঠাৎ কাজের মেয়ের চিৎকার শুনে ভেতরে গিয়ে দেখি ওর মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। আর পাশে পড়ে আছে কীটনাশকের শিশি।
--- আপনার স্ত্রী বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করছিলেন উনাকে তো কোন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা উচিৎ ছিল আপনার।
---হ্যাঁ। কিন্তু মেয়ের কথা চিন্তা করে সেই উদ্যোগ নিতে পারিনি। নিজেরও খারাপ লাগতো ওকে কাছ ছাড়া করতে।। শুনেছি মানসিক হাসপাতালে রোগিকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়। ধীরে ধীরে সব বোধ শক্তি লোপ পেয়ে যায়। তাই ওখানে দেয়ার সাহস পাইনি। কিন্তু তৃতীয়বার আত্মহত্যার চেষ্টা করার পর ভাবছিলাম হাসপাতালে দিয়ে দিবো। কিন্তু তার আগেই ঘটনাটা ঘটে যায়।
---আচ্ছা। তারপর বলুন।
---আমি, দীনা আর তিতলি আমরা তিনজন একই বিছানায় ঘুমাতাম। মেয়েটা ছোট ছিল তাই আমাদের সাথেই থাকতো। দীনা অসুস্থ হলেও সব কাজ আবার ঠিকমত করতো। কাজের মধ্যে কেউ ওকে দেখলে বুঝতেই পারতো না ও যে অসুস্থ। মাঝেমাঝে আমারই খটকা লাগতো দীনা আসলেই অসুস্থ তো নাকি সবই আমার ভুল।
খুব ইচ্ছে করতো আবার আমার সাথে কথা বলুক, হাসুক, হাসি আনন্দে ছুটে বেড়াক সারা ঘরময় আগের মত। সেদিন ও বিছানা করছিল আর ওর দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলাম। দীনা কী সুন্দর পরিপাটি করে তিনজনের বিছানা করলো। তারপর মেয়েকে কোলে করে নিয়ে বালিশে শুয়ালো। মেয়ে প্রতিদিনের মত আবদার করতে লাগলো গল্প বলার জন্য। দীনা যথারীতি মেয়ের কথার কোনো জবাব না দিয়ে মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো উদাস দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে।
এক সময় মা মেয়ে দুজনই ঘুমিয়ে পড়লো। দীনা ঘুমিয়ে পড়লে পরে আমি ঘুমাতাম। নয়তো মনের মধ্যে একটা ভয় থেকে যেত কখন কী করে বসে। সেদিন ও ঘুমিয়ে পড়ার পর আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। বাইরে সেদিন খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। বাজও পড়ছিল খুব। বিকট একটা বাজের শব্দে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। তাকিয়ে দেখি দীনা বিছানায় নেই। আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:২৭