এক
বেলি ফুলের গাছটা ফুলে ফুলে সাদা হয়ে গেছে। স্নিগ্ধতায় ভরপুর টাটকা একেকটা ফুল। বৃষ্টির ছাটে গোসল করে যেন আরো মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে। গতকাল সারারাত কালবৈশাখী ঝড় হয়ে গেলো। তবে কি কালবৈশাখী,সব দীনতা, সব রিক্ততা ধুয়ে মুছে নিয়ে গেলো সাথে করে? সারা ব্যালকনি বেলির সুবাসে মাতোয়ারা। ফুলগুলো দেখে চমকে উঠলো রিনি। অনেকদিন হলো গাছটা লাগিয়েছে ও। প্রতিদিন যত্ন করে পানি দিতো। মাঝে মাঝে সারও দিতো। গাছটা ধীরে ধীরে কী সুন্দর বেড়ে উঠছিলো। তারপর হঠাৎই কী যে হলো। গাছটার কথা বেমালুম ভুলে গেলো ও। গাছে পানি দেয়া তো দূরের কথা। ব্যালকনিতে আসাটাও বন্ধ হলো।
শুধু কি ব্যালকনি? কত কী যে জীবনের বন্ধ হয়ে গেলো। ফেবুতে যাওয়া হয় না। ব্লগে যাওয়া হয় না। ডায়রি লিখা হয় না। সব প্রিয় কাজগুলো ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে শুরু করলো। বাচ্চাগুলোর সাথে সারাদিন ক্যাটক্যাট করতো। ওর মত শান্ত একটা মহিলার মেজাজ কী যে তিরিক্ষি রূপ ধারণ করলো। ঘরের সবাই ওর সাথে কথা বলতে ভয় পেতো।
এমন অবস্থা শুধু যে ওর, তা না। সবারই। বাচ্চাগুলোও ঝগড়া করতে করতে ক্লান্ত। পৃথিবীতে সবাই সবার সাথে ঝগড়া করতে করতে ক্লান্ত। বাবার সাথে ছেলের কথা বন্ধ। মায়ের সাথে মেয়ের কথা বন্ধ। স্বামী স্ত্রী একে অপরের দিকে পেছন ফিরে শোয়। মাঝখানে থাকে কোলবালিশ। বন্ধুর সাথে বন্ধুর যোগাযোগ বন্ধ। কারণ বাকবিতণ্ডা।
ঘরে ঘরে এখন নিস্তব্ধতা। শহরে শহরে নিস্তব্ধতা। দেশে দেশে নিস্তব্ধতা। পৃথিবীটাই এখন নিস্তব্ধতা। কথাবিহীন নিস্তব্ধতা। যান্ত্রিক নিস্তব্ধতাও ছিল কিছুদিন আগে। তবে এখন শুধু কথাহীন নিস্তব্ধতা। পৃথিবীর সব মানুষ কথা বলতে ভুলে গেছে। হাসতে ভুলে গেছে। শুধু আছে কাজ। হাসিবিহীন, কথাবিহীন কাজ। যে যার কাজ করে। জরুরী কথা সব হয় ম্যাসেজে, এস এস এস এ।
বহুদিন কোন ফুল, কোন পাখি, কোন গান মনে সাড়া জাগায়নি। আজ কী যে হলো। এই বেলি ফুল মনে কী যেন এক বার্তা পৌঁছে দিলো। বার্তাটা খুশির নাকি বিষাদের ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না রিনি। ঠোঁটের দুই কোণে একটা কিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলো। রিনি নিজের ঠোঁটে হাত দিয়ে কিছু একটা বুঝার চেষ্টা করলো। ঠোঁটটা কি একটু প্রসারিত হয়েছে? রিনি কিছু একটার প্রয়োজন অনুভব করলো। কী সেটা? মনের ভেতরটা হাতড়াতে লাগলো ও পাগলের মত। কী সেই জিনিস। কী? কী? কী?
হঠাৎ চোখদুটো জ্বলে উঠলো। মনে পড়েছে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে, জিনিসটা কী? ছুটে গেলো ও জিনিসটার কাছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়না। যার প্রয়োজন, কতকাল যে অনুভব করেনি কে জানে। কখনও যদি আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখাও যেত, সেই প্রতিচ্ছবিটা সচেতনভাবে তাকিয়ে দেখার সাধ কতদিন জাগেনি! আজ সেই প্রয়োজন বোধ করছে ও। আজ সেই সাধ জেগেছে বুকে, অনেক দিন পর।
আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজের মুখমণ্ডল চোখে পড়লো। নিজের মুখটা দুই হাতে স্পর্শ করলো রিনি। কতদিন পর নিজের চেহারাটা এভাবে দেখছে। ঠোঁটের দুই কোনে ওটা কী দেখা যাচ্ছে? দুই ঠোঁটের এই প্রাসারণকে কী যেন বলে? আহা! মনে পড়ছে না কিছুতেই। কী ওঠা? বড় চেনা সেই নাম। বড় আপন! আবার মনের আনাচেকানাচে পাগলের মত হাতড়াতে থাকে ও।
দুই
একটার পর একটা ফ্লাইট বিদেশীদের নিয়ে হাজির হচ্ছে বাংলাদেশে। চীন, ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষেরা এসে ভরে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা নতুন ভাইরাসের উদ্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের সব মানুষ সেই ভাইরাসের সংক্রমণে সংক্রমিত। শোনা যায়, সেই ভাইরাস নাকি প্রথম সংক্রমিত করে রিনি নামের এক নারীকে। সেই ভাইরাস নাকি ভীষণ ছোঁয়াচে। তার কাছ থেকেই ভাইরাসটি সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে সবাই ঈদ উৎসবের মত কোলাকুলি করছে। দেশে বিদেশে এই ভাইরাসের খবর ছড়িয়ে যেতেই, সবাই পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। বিদেশীরাও বাংলাদেশীদের সাথে কোলাকুলিতে মেতে উঠছে। কারণ এই ভাইরাসটা এখন সবার খুব প্রয়োজন। করোনা নামক এক ভয়ঙ্কর বিচ্ছিন্নতাবাদি ভাইরাসের ছোবলে পৃথিবীটা একটি বিষণ্ন গ্রহে রূপ নিয়েছিল। যেখানে খুশি নামক অনুভূতিটির চিহ্ন বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
এবার হাসি নামক একটি ভাইরাস খুশি বহন করে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলাদেশে। তাই তো সব বিষণ্ন মানুষের দল ছুটছে হাসিখুশির দেশ বাংলাদেশে। আর নয় কোন বিচ্ছিন্নতা। সবখানে এখন শুধুই সংযুক্ততা। সবখানে এখন শুধুই খুশির বার্তা।
©নিভৃতা
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০২০ রাত ১২:১৯