পরদিন সকাল ৭টায় ঘুম ভাঙলো আমার। অনেক স্নিগ্ধ একটা সকাল। সকালের মেরিনা ভিউ অনেক বেশি সুন্দর, আরো অনেক রিফ্রেশিং। বেলকনির চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে অনেক আয়েশ করে সকালের কফি খেলাম। এরপর টুকটাক ব্রেকফাস্ট রেডি করলাম। কিচেন থাকার এই এক সুবিধা। বাইরের খাবার মুখে না রুচলে অন্তত কিছু একটা করে খাওয়া যায়। ব্রেকফাস্ট করে রেডি হয়ে বের হয়ে পড়লাম আগের দিনের অসম্পূর্ণ ঐতিহাসিক ভ্রমণ সম্পূর্ণ করতে।
খুব বেশি চমকপ্রদ কোন স্থাপত্য নয়। তবে অনেক পুরোনো কিছু স্থাপনা। হয়তো ঐ যুগে এরকম সমুদ্র মধ্যবর্তী কোন দ্বীপে এই অনেক বেশি ছিল। তবে বেশি ভাগই পাহাড়ের উপর। একটা লাল দূর্গ আছে। আর ৯৯টা সিঁড়ি পার হয়ে একটা স্থাপনা আছে ব্ল্যাকবিয়ার্ড ক্যাসল। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম, সেদিন বন্ধ ছিল ব্ল্যাকবিয়ার্ড ক্যাসল। মিঃ ব্ল্যাকবিয়ার্ড ছিলেন একজন নামকরা স্প্যানিশ জলদস্যু। বিখ্যাত না কুখ্যাত সেটা বুঝতে পারলাম না। তিনি এটা তৈরী করেন নি। তার স্মরণে ডেনিশ উপনিবেশ যুগে নির্মিত হয় এটা। ডেনিশ উপনিবেশ পূর্ববর্তী যুগে এই দ্বীপগুলো ছিল স্প্যানিশ জলদস্যুদের রমরমা আখড়া। কল্পকাহিনীর জলদস্যু না, একবারে সত্যিকারের দুধর্ষ জলদস্যু! অবশ্য অনেক কল্পকাহিনীও প্রচলিত আছে এদের নিয়ে। ব্লু বিয়ার্ডের কাহিনী তার মাঝে অন্যতম। সে কাহিনী আপাতত এখানে আর পাড়লাম না।
ইতিহাস খুঁজতে খুঁজতে দুপুর হয়ে গেলো। সেইন্ট থমাসের সব বড় বড় অফিসিয়াল ও প্রশাসনিক লোকজনের বাস এখানেই। বেশির ভাগ ঐতিহাসিক ভবনগুলোকে সংরক্ষণ করে তাদের বাসস্থান বানানো হয়েছে। যেহেতু স্থাপনাগুলো সব পাহাড়ের গাঁয়ে, তাই সেখান থেকে অপূর্ব সব মেরিনাভিউ পাওয়া যায়।
অনেকক্ষণ সময় নিয়ে শহর আর পাহাড়ে হেঁটে হেঁটে, বাচ্চার স্ট্রলার ঠেলে ঠেলে সব ঘুরে ফিরে দেখলাম। এরপর খাঁড়ির পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া একটা পায়ে হাঁটা পাকা রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। খাঁড়ির পাশ ঘেঁষেই খোলা মতন একটা জায়গায় এসে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। এরপর রিসোর্টে ফিরে বিশ্রাম করে আবার বের হলাম।
পাহাড়ের উপর বারবার উঠতে নামতে গিয়ে খেয়াল করলাম এই দ্বীপে কৃষ্ণচূড়ার আধিক্য। যেদিকেই যাও, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে যেখানে সেখানে এই কৃষ্ণচূড়া। আমি তো ঘোষণাই করে দিলাম, সেন্ট থমাসের জাতীয় ফুল কৃষ্ণচূড়া! দ্বিতীয় হল বাগানবিলাস। এরপর নাম না জানা আরো অসংখ্য ফুল। অযত্নে অবহেলায় বেড়ে ওঠা। প্রথম গেলাম একটা ছোট্ট পাহাড়ি বোটানিক্যাল গার্ডেনে। খুব বেশি মুগ্ধকর কিছু নয়। তবে পাহাড়ি বন জঙ্গলে একা কিছুটা সময় কাটানোর জন্য উপযুক্ত স্থান। গার্ডেনে একটা ইকো সিস্টেম মেনটেইন করা হয়েছে। তাই ওখানে প্রচুর গিরগিটি ও ব্যাঙ আছে। এদের কারণে এখানে কোন মশা নেই। আসলেই তাই। আটলান্টায় আমাদের বাগানেও কয়েকটা ব্যাঙ আর গিরগিটি পোষার চিন্তা এলো তৎক্ষণাৎ। মশার যন্ত্রণায় আমাদের বাগানে নামা কষ্ট হয়ে যায় মাঝেমাঝে।
এরপর গেলাম মাউন্টেন টপে। মাউন্টেন টপ এখানকার টপরেটেড ট্যুরিস্ট স্পট। সেন্ট থমাসের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় এই মাউন্টেন টপ। আর এখান থেকে দেখা দৃশ্য নাকি ক্যারিবীয়ান অঞ্চলের অন্যতম সুন্দর দৃশ্য! আসলেই তাই। প্রথম যখন দেখলাম, মনে হলো এই দৃশ্য কি সত্যি নাকি সিনেমাতে দেখছি! প্রায় ১৫০০ ফুট উপর থেকে দেখা যায় ইউ আকৃতির অপূর্ব নীল এক সমুদ্র সৈকত। দূরে হালকা নীল আকাশ আর ধূসর মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে নীলচে সবুজাভ কিছু দ্বীপ। সবমিলিয়ে কি এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য! আমি শব্দের কারিগর নই। তাই ভাষায় সেই সৌন্দর্যের কিছুই প্রকাশ করতে পারছিনা। উত্তর দিকের সব পাহাড়ের চূড়া থেকে এই সৈকতের খুব অসাধারণ কিছু ভিউ পাওয়া যায়। শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা হয়। দূরের দ্বীপগুলো ছিল ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস ও অন্যান্য ইউএস ভার্জিন আইল্যান্ডস।
বানানা ডাইকুরি নামের একটা বার কাম স্যুভেনির শপ এই স্পটের হোস্ট। বানানা ডাইকুরি হলো কলা মিশ্রিত এক প্রকার রাম যা এখানকার খুব জনপ্রিয় আইটেম। স্যুভেনির শপটা বেশ বড়। টুকটাক কেনাকাটা করে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসলাম। এরপরের গন্তব্য ছিল উপর থেকে দেখা সেই অপূর্ব নীল সৈকত মেগান্স বে!
মেগান্স বে, ক্যারিবীয়ান অঞ্চলের টপ রেটেড ও জনপ্রিয় সৈকতগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেইন্ট থমাসের উত্তর উপকূলে দুইটা পাহাড়ের মাঝে এক মাইল দীর্ঘ ছোট্ট একটা সৈকত। ক্রুইজ শিপ যেদিন আসে, সেদিন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় এই সৈকত। ভাগ্যিস আমরা যেদিন গিয়েছিলাম, সেদিন কোন ক্রুইজ শিপ আসেনি। তাই খুব আয়েশ করে উপভোগ করতে পেরেছি এর নির্মল শান্ত সৌন্দর্য। কোন উত্তাল ঢেউ নেই। কোন ভীড় নেই। শান্ত ঢেউ আর অগভীর পরিষ্কার নীল জল। পা ভিজিয়ে হেঁটেছি বেশ কিছুক্ষণ। বালুকাবেলায় বসে নিরিবিলি কাটিয়েছি আরো কিছুটা সময়।
এর মধ্যেই আমার ছোট্ট মেয়েটা একটু অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রচন্ড গরমে। এতো ভালোলাগার মধ্যে সমস্যা ছিল শুধু এটাই। তা হলো এই গরম। নাতিশীতোষ্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চলের মানুষ আমি। তাই নিরক্ষীয় সবুজ ভালো লাগলেও উষ্ণ বায়ু ও তাপমাত্রা সহ্য হবেনা, এটাই স্বাভাবিক। সেদিনের পাততাড়ি গুটিয়ে তাই আমরা রিসোর্টে ফিরে গেলাম। এমনিতেই আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। পরের দিন পার্শ্ববর্তী দ্বীপ সেইন্ট জনে যাবো আমরা ডে ট্রিপে। সকাল সকাল এই দ্বীপের অপর প্রান্তে গিয়ে ধরতে হবে ফেরি।
চলবে...
আগের পর্বের লিঙ্ক - ক্যারিবিয় স্বর্গ ভার্জিন আইল্যান্ডসঃ প্রথম পর্ব
পরের পর্বের লিঙ্ক - ক্যারিবিয় স্বর্গ ভার্জিন আইল্যান্ডসঃ তৃতীয় পর্ব
এই ভ্রমণকাহিনী সম্পর্কিত আরও ছবি দেখতে হলে ক্লিক করুন -
কৃষ্ণচূড়ার দ্বীপ... Saint Thomas, USVI
আমার ভ্রমণ সংক্রান্ত ইউটিউব ভ্লগ ও ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন নিচের লিঙ্কে -
Bangladeshi American Travel and Lifestyle
আমাকে ফেসবুকে ফলো করতে ক্লিক করুন - Sofia Nishi
আমাকে ইন্সটাগ্রামে ফলো করতে ক্লিক করুন - Sofia Nishi
আগ্রহী হলে দেখতে পারেন আমার কয়েকটি ভ্রমণ ভ্লগ -
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ১২:৫২