বইঃ অর্ধবৃত্ত
লেখার ধরণঃ উপন্যাস
লেখকঃ সাদাত হোসাইন
প্রকাশনীঃ অন্যধারা
প্রচ্ছদঃ চারু পিন্টু
প্রকাশঃ একুশে বইমেলা ২০২০
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৩৮৪
মলাট মূল্যঃ ৫৯০/-
এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে সবাইকেই আশেপাশের মানুষের সাথে সর্ম্পক গড়ে তুলতে হয়। সেই সর্ম্পকের অন্তরঙ্গতা এবং আবেগ একেকজনের সাথে একেক রকম হয়। সময়ের সাথে সাথে এই সর্ম্পকগুলির আনুসঙ্গিতাও বদলে যেতে থাকে। হুট করে কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বদলে যায় সর্ম্পকের দৃষ্টিভঙ্গি। কাছে মানুষ হয়ে যায় দূরের কেউ। এক সময়ে দূরে তাড়িয়ে দেয়া মানুষকেও নিজেই প্রয়োজনে হুট করে বুকে জোরেই টেনে নিতে হয়।
অর্ধবৃত্ত উপন্যাস মূলত বিভিন্ন সম্পর্কের গভীরতা, সংকট ও সমীকরণ মিলিয়ে দেয়ার গল্পের সমাহার। এই লেখার পুরোটা জুড়েই আছে একাধিক সর্ম্পকের টানাপোড়েন নিয়ে ঝড় ঝঞ্ছা এবং বিচ্ছেদ বিভেদ আর হাহাকারের বিভিন্ন রঙয়ের আস্তরন। উপন্যাসিক আদ্যোপান্ত চেষ্টা করেছে জীবনের বিভিন্ন নিস্তরঙ্গ সর্ম্পকের খুটিনাটি বিষয়গুলি ফুটিয়ে তুলতে।
কাহিনীঃ
পুরো উপন্যাস ঘিরে রয়েছে একটা মাত্র যৌথ পরিবারের সংসার নিয়ে। এই সংসারে আছে নানাবিধ মানুষ, প্রত্যেকেরই রয়েছে মতামত, মতের ভিন্নতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি। সম্পর্কগুলি বিশ্লেষণ করার চেষ্টাও করা হয়েছে সেভাবেই। স্বার্থের প্রয়োজনে স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে পরপুরুষে জড়িয়ে পরে। আবার এই স্বার্থের প্রয়োজনেই চরম সংসার বিদ্বেষী মানুষ হুট করে বৌ নিয়ে এসে হাজির হয়। এখানে সবাই নিজেকে ধোয়া তুলসীপাতা মনে করে। কিন্তু আদতে সবাই নিজের স্বার্থের জন্যই সবকিছু করে বেড়ায়। উপন্যাসটা আমি লিখলে এই কবিতাটা অবশ্যই লেখার সাথে দিয়ে দিতাম।
কবিতা - স্বার্থের প্রয়োজনে (মহিউদ্দিন মোহাম্মাদ যুনাইদ)
স্বার্থের প্রয়োজনে-
সাদা হয় কালো, কালো হয় সাদা।
প্রয়োজন ফুরালে রংধনুর সাত রংও
মাঝে মাঝে ফ্যাকাসে মনে হয়।
যে ভালোবাসা শুধুই অন্যায় আবদার করে যায়,
টিকে থাকে সেটা শুধুই সুতার আগায়।
ফুঁ দিলেই উড়ে যায় যদি আবেগ,
সেটা অস্তিত্ব আসলে কোন কালেই ছিল না!
স্বার্থের প্রয়োজনে ভাঙ্গি আমরা অনায়েসে আড়ি,
স্বার্থ ফুরালেই স্বপ্নের ডানায় সুদূরে দেই পাড়ি।
আফজাল আহমেদ-মছিদা বেগমের এই যৌথ সংসারে আছে রাফি-মুনিয়া-জাফরের সম্পর্ক, সুমি-দিপুর সম্পর্ক, আশফাক-আফসানার সম্পর্ক, মুকিত-নাদিয়া-সফিকের সম্পর্ক। বাকি আরো কিছু অনুজ্জ্বল সর্ম্পক মূল কাহিনীর আশেপাশেই ঘুরাঘুরি করেছে।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুনিয়া আসলে একজন স্বার্থপর লোভী মহিলা যে নিজের ক্যারিয়ারের জন্য নিজের স্বামীকে দূরে সরিয়ে দিয়ে প্রভাবশালী রফিক সাহেবের কাছে ধর্ণা দেয়, দীর্ঘদিন ধরে রফিক সাহেবকে শারীরিকভাবে সন্তুষ্ট করলেও একসময় বিরক্ত হয়ে নিজের প্রায় অর্ধেক বয়সের একটা ছেলে রাফি যে কিনা নিজের মেয়ের বান্ধবীর বড় ভাই, তার সাথে অবৈধ সর্ম্পক গড়ে তোলে নিজের স্বামী জাফর’কে দিনের পর দিন ঠকিয়ে। পুরো লেখার মধ্যেই মুনিয়ার একের পর এক এইসব অবৈধ রগরগে সর্ম্পকের সপক্ষে বিভিন্ন সাফাই দেখতে পাওয়া যায়। খামখেয়ালি বা বাউন্ডুলে রাফিকে আসলে মুনিয়া নিজের সুবিধামতন ব্যবহার করেছে, অসম একটা শারীরিক সর্ম্পকের সমীকরণে আটকে তাকে আটকে রেখেছে। আর তাই রাফির কাছে মুনিয়া এক নারীদেহ ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। নিজের স্বার্থের জন্য একসময় মুনিয়া রফিক সাহেব’কে রাতের অন্ধকারে মেরে ফেলে। এই দৃশ্য দেখার কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে অল্পবয়স্ক রাফি। শেষ পর্যন্ত রাফি খুনের দায় নিজের মাথায় নিয়ে ফাঁসির আসামী হয়।
চরিত্র চিত্রায়নঃ
এই উপন্যাস কিছুটা ধীর গতির পাঠকদের জন্য যারা সংবেদনশীল এবং লাইন বাই লাইন মনোযোগ দিয়ে পড়ে যায় তাদের জন্য। সময় স্বল্পতা নিয়ে বা তাড়াহুড়া করে পড়লে এই উপন্যাসের আসল স্বাদ যে কেউ মিস করবে নিশ্চিত। আমার পুরো বই শেষ করতে প্রায় বারদিনের মতো সময় লেগেছে।
অনেকগুলি চরিত্র নিয়ে উপন্যাসটা ঘুরপাক খেয়েছে। মূল চরিত্র মুনিয়ার সংসার জীবন, পরকীয়া জীবনের নোংরামীর সাথে আশেপাশের সবার জীবনের টুকরো টুকরো খণ্ডচিত্র লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন।
মানবীয় অনুভূতির ব্যাপারগুলি বোঝাতে যেয়ে অনেক কিছু অসাধারণভাবে লিখছেন যা সাধারণ পাঠকদের জন্য কিছুটা বিরক্তকর হয়ে উঠতে পারে। বেশ কয়েকজন ইতিমধ্যেই দীর্ঘময়তার জন্য লেখা স্কেপ করে পড়েছে বলে আমার কাছে অভিযোগ করেছে। কিন্তু এই লেখাগুলিই মনোযোগ দিয়ে পড়লে যেকোন পাঠকের হৃদয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়বে।
অল্পবয়সী চরিত্র হিসেবে ঋদ্ধিকে দুর্দান্ত ভাবে উনি ফুটিয়ে তুলেছেন। বাহাবা দিচ্ছি উনাকে এই চরিত্রের জন্য।
মানব চরিত্র নিয়ে কাজ করতে যেয়ে বেশিরভাগ সময় চরিত্রগুলির অন্ধকার দিকগুলিই তুলে আনা হয়েছে। দিপু আর সুমির পরিণতিটাও খুব ভয়াবহভাবে দাগ কেটে যায় মনে। তবে দুর্বল চরিত্র শফিক’কে হুট করেই এতটাই শক্তিশালী বানিয়ে নাদিয়ার জীবনের ভয়ংকর কালো অধ্যায়ের পর নিয়ে আসাটা আমার কাছে দৃষ্টি কটূ লেগেছে।
নাদিয়া নাবিলা মা হাফসা’কে অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার অধিকারী দেখানো হয়েছে যে অগ্রীম অনেককিছুই টের পেয়ে যায়, যেটা কিছুটা অস্বাভাবিক লেগেছে। অসুস্থ হয়ে বাসায় বিছানায় দিনের পর দিন কেউ শুয়ে থাকলেই অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায় না। নাদিয়ার বাবাকেও দুর্বল চরিত্র বানাতে যেয়ে খুব বেশি দুর্বল বানিয়ে দেয়া হয়েছে। আশফাক সাহেব নিজের এত বড় একটা মেয়েকে নিজের কাছে এনে হুট করে নাদিয়ার একদম অপরিচিত একজনের কাছে রেখে চলে যাবে ব্যাপারটা লেখাকে কিছুটা হাল্কা করে ফেলেছে।
মছিদা বেগম এবং আফজাল সাহবের চরিত্র চিত্রায়ন সুন্দর লেগেছে। তবে মুকিতের নাদিয়ার জন্য ঢলাঢলি অতিরিক্ত লেগেছে। মেয়ে দেখতে এসে এতবেশি প্রেমে পড়ে যাওয়া আবার গভীর প্রেম থেকে নাদিয়ার বিপদে পালিয়ে যাওয়া পাঠকের ভালো নাও লাগতে পারে।
সুমি এবং তার বাবা আজিজ মাস্টার এর চিত্রায়ন বেশ ভালো লেগেছে।
তবে মুকিতের সাথে জাহানারা শেষের দিকে তর্কাতর্কি এবং মুকিতের মুখে থুথু দেয়াটা কিছুটা অস্বাভাবিক।
এই উপন্যাসের প্রথম থেকে ৩৩০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত যেই লয়ে এবং গতিতে লেখা হয়েছে, তারপর থেকে কেন যেন খুব তাড়াহুড়া করা হয়েছে। সমীকরণ মেলানোর জন্যই, না পৃষ্ঠার সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য সেটা লেখকই বলতে পারবেন। তবে শেষ দিকের এত তাড়াহুড়া লেখাটাকে কিছুটা হালকা করে দিয়েছে। বিশেষ করে যেই মুনিয়া’কে লেখক এত আর্দশবাদী নারী হিসেবে দেখিয়ে এসেছে, হুট করে তার চারিত্রিক নোংরামীগুলি নিয়ে এসে কাহিনী মিলিয়ে দেয়া কেমন যেন লাগে। একজন স্বার্থপর নারী যে নিজের প্রয়োজনে স্বামীকে ঠকিয়ে বিভিন্ন জনের সাথে দেহ বিলি করে বেড়ায় তাকে প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই আর্দশবাদী নারী হিসেবে দেখানো আমার কাছে মোটেও পছন্দ হয় নি। পাশার দান পালটে যেতে পারে, তাই বলে পুরোপুরি উলটে যেতে পারে না।
কবিতার ব্যবহারঃ
অল্প কিছু অসাধারণ কবিতা উনি ব্যবহার করেছেন এই লেখায় যেটা আমাকে খুবই আকর্ষন করেছে। বিশেষ করে এই কবিতাটাঃ
“আমি একদিন নিখোঁজ হবো, উধাও হবো রাত প্রহরে,
সড়কবাতির আবছা আলোয়, খুঁজবে না কেউ এই শহরে।
ভাববে না কেউ, কাঁপবে না কেউ, কাঁদবে না কেউ একলা একা,
এই শহরের দেয়ালগুলোয়, প্রেমহীনতার গল্প লেখা।”
উপন্যাসের শুরুতেই আলাদা করে লেখা কবিতাটাও ভালো লেগেছে।
সমস্যা এবং যা যা ভালো লাগেনিঃ
লেখার সময় উনি একজন খুব পরিচিত একজন লেখক, হুমায়ুন আহমদের লেখার স্ট্যাইল ফলো করেছেন। চরিত্র চিত্রায়নের বেলাও একই কান্ড ঘটেছে। রাফি ‘হিমু’র চরিত্রের সাথে এবং নাদিয়া ‘মাতাল হাওয়া’র নাদিয়ার সাথে এতই মিল, এমন কী পরিণতির দিক থেকে দুটি চরিত্রের ভীষন মিল যা রীতিমত চোখে পড়ার মতো। বেশ খারাপ লেগেছে এই বিষয়। উনার মতো একজন নামকরা মৌলিক লেখকের কাছ এটা অবশ্যই আশা করা যায় না।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এই উপন্যাসের মা মুনিয়া মেয়ে ঋদ্ধির একজন ছেলেকে কাছে পাওয়া নিয়ে মা–মেয়ের টানাপোড়েন দেখা যায় সেটাও হুবুহু সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘কাছের মানুষ’ উপন্যাসের কেন যেন মিলে যায়।
আগ্রহী পাঠকদের হুমায়ুন আহমদের ‘মাতাল হাওয়া’ এবং সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘কাছের মানুষ’ পড়ার আমন্ত্রণ রেখে গেলাম। দুইটা বইয়ের কাহিনী একটা বইতে এনে মিলিয়ে দেয়ার এই তেলেশমাতি কাণ্ড কিভাবে ঘটলো বুঝলাম না।
কবিতার ব্যাপারেও নাকি উনি আগের বই ‘নির্বাসন’ এ ব্যবহার করা কবিতা এখানেও আবার চালিয়ে দিয়েছে। অনেকটাই এক টিকিটে দুইটা মুভি দেখানোর মতো। যদিও লেখার ভিতরে কবিতাগুলি পড়তে আমার ভালোই লেগেছে। অবশ্য আমি ‘অর্ধবৃত্ত’ পড়ালেও ‘নির্বাসন’ পড়িনি।
উনার কবিতা লেখার হাতও তো ভালো। নতুন বইয়ের জন্য কী নতুন কবিতা লিখে দেয়া যেত না?
পরিশেষঃ
একটা উপন্যাস’কে তুলনামূলকভাবে রেটিং জন্য নিন্মোক্ত পদ্ধতি আমি ব্যবহার করি-
* থীম / প্লট - ১
* কথোপকথন - ১
* চরিত্র বিন্যাস - ১
* ট্যুইষ্ট / পাঠকের আকর্ষন – ১
* লেখার মুন্সিয়ানা – ১
আমার দৃষ্টিতে এই বইয়ের জন্য মার্কিং হবেঃ
* থীম / প্লট - ০.৭৫
* কথোপকথন - ১
* চরিত্র বিন্যাস - ১
* ট্যুইষ্ট / পাঠকের আকর্ষন – ০.৫০
* লেখার মুন্সিয়ানা – ১
[* অন্য লেখার সাথে মিল থাকার জন্য এবং কিছু জায়গা অযথাই টেনে বড় করার জন্য]
এটাই আমার পড়া সাদাত হোসাইনের লেখা প্রথম উপন্যাস। বেশ ধৈর্য্য ধরে পড়লেও পড়তে খুব একটা খারাপ লাগেনি।
যেকোন ধীর স্থির পাঠকের এই বই পড়তে ভালই লাগবে।
তবে পৃষ্ঠা সংখ্যা আরো কমিয়ে আনা যেত ইচ্ছে করলেই এবং তাতে বইয়ের দামও কমে যেত।
উৎসর্গঃ শ্রদ্ধেয় ব্লগার সাহাদাত উদরাজী ভাইকে। সাদাত হোসাইনের উপর উনার একটা পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতেই এই বইটা যোগাড় করে পড়া এবং পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখা হয়েছে।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, জুন ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:৫৭