কবিতা লেখা একটা গুণ। একটা বিশেষ গুণ। ইচ্ছে করলেই সবাই কবিতা লিখতে পারে না। কবিতা লেখার জন্য বুকের ভিতরে ‘কবি কবি’ একটা মন থাকতে হয়। বাংলা সাহিত্যে বহু বছর ধরে কবিতা লেখার যে পদ্ধতি প্রচলিত ছিল ইদানিং আধুনিকায়নের মাধ্যমে সেই কবিতা লেখার পদ্ধতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে।
.
ছন্দ মিলিয়ে লেখা কিংবা নির্দিষ্ট মাত্রায় লেখার নিয়ম এখন বেশিরভাগ কবি’রাই ব্যবহার করেন না। ছন্দ কিংবা অছন্দে, মাত্রা কিংবা মাত্রাহীন, যেটাই হোক না কেন, আমার কাছে মনে হয় একটা কবিতা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন পাঠক সেই কবিতাটা পড়ার সময় কিংবা আবৃত্তি করার সময় কবিতার মাঝে অজান্তেই হারিয়ে যায়। যে কবিতা পড়ে একজন পাঠক তার অর্থ বুঝতে পারে না কিংবা সেই কবিতার সাথে নিজেকে একাত্মতা ঘোষণা করতে পারে না, সেই কবিতাটা আসলে পাঠকের হৃদয় কতটুকু গভীরে স্পর্শ করেছে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। এখানেই নতুন কবি, পুরাতন কবি এবং প্রকৃত কবির মধ্যে পার্থক্যটা সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে। বহু বছর ধরে কবিতা লিখলেই কিংবা শত শত কবিতা লিখলে যে একজন প্রকৃত কবি হয়ে উঠবে, ব্যাপারটা সেটা নয় এটা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক দানকৃত একটা বিষয়। সবার মাঝে এই গুণটা থাকার কথা না, থাকেও না। অথচ এটাই সবাই বুঝতে চায় না।
.
আজকাল হাটে মাঠে ঘাটে প্রচুর কবিতা দেখতে পাওয়া যায় যেগুলো পড়ার সময় অযাচিতভাবে উদ্ভট কিংবা কঠিন শব্দ ব্যবহার করা হয় পাঠকদের বিভ্রান্ত করার জন্য এবং নিজেকে উঁচু পর্যায়ের বাংলা সাহিত্যবিদ প্রমাণ করার জন্য। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে এইসব কবিরা নিজেরাই বিভ্রান্ত থাকেন, নতুন করে এরা পাঠকদের কী বিভ্রান্ত করবেন? যারা সহজ-সরল শব্দেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন না, এরা এইসব কঠিন কঠিন শব্দে এই কাজ কিভাবে করবেন আর পাঠকরাই বা কিভাবে বুঝবে এই প্রশ্নটা রয়ে যায় এসব কবিতা পড়ার সময়।
.
আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কবিতা আবৃত্তি করা। প্রতিটা কবির কবিতা সুন্দর করে আবৃত্তি কিভাবে করতে হয় জানা উচিত, অবশ্যই জানা উচিত। ছাইপাশ একটা লিখে, লাইনের কোন ঠিক ঠিকানা ছাড়া, কিছু একটা লিখে দিলেন যেটা আবৃত্তি করা সম্ভব না। সেটা আর যাই হোক না কেন, কিছুতেই কোন কবিতা হতে পারে না। কবিতা কোন গল্প না বা কোন প্রবন্ধ না যে গড়গড় করে পড়ে গেলেই হবে। এভাবে পড়লে শুধু পড়াই হবে কিন্তু কবিতার মূল থিম কখনো অনুভূত হবে না। ছন্দ কিংবা মাত্রা আপনি যদিও না মানেন কিন্তু আপনার লেখা কবিতা নামক জিনিসটা অন্ততপক্ষে আবৃত্তি করার উপযুক্ত হতে হবে। উল্টাপাল্টা লাইন সম্পৃক্ত করে যারা কবিতা লেখেন, আমার জন্য ধারণা তারা আবৃত্তির “অ আ” পর্যন্ত জানেন না।
.
কবিতা লেখার জন্য অদৃশ্য গুরুত্বপূর্ণ টপিক হচ্ছে বিরাম চিহ্নের সুষ্ঠু ব্যবহার। কোথায় দাড়ি, কমা, সেমিকোলন বা হাইফেন ব্যবহার করতে হবে, সেটা লেখার থিম এর উপরে এবং শব্দচয়নের উপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করে। আন্দাজে প্রতিটা লাইনের শেষে কমা কিংবা দাড়ি দিয়ে গেলেই হবে না। এই ধরণের হাস্যকর বিরাম চিহ্নের ব্যবহারে আসলে শুধুভাবে লেখার কোনকিছু প্রকাশ পায় না, শুধু প্রকাশ পায় কবির বিরাম চিহ্ন সম্বন্ধে নূন্যতম কতটুকু জ্ঞান সেটাই। খুব দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকাল এই সমস্যাটাই বেশিরভাগ কবিতার মধ্যে পাওয়া যায়। কবিতা লেখার জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যাকরণ আছে, নিয়ম তান্ত্রিক পদ্ধতি আছে, মনের ভিতর আবেগ গদগদ হয়ে উঠলেই কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়লে, কিংবা ক্রমাগত মোবাইলে কীবোর্ডের বাটনগুলি টিপলে কবিতা প্রসব হবে না। এইজন্যই ব্যঙ্গ করে বলা হয় দেশে কাকের চেয়েও কবির সংখ্যা বেশি!
.
প্রতিটা কবিতা একটা সুনির্দিষ্ট থিমের উপর লিখতে হয়। কবিতার সামনে আগানোর সাথে সাথে সেই থিম এর উপরে কবির অনুভূতিগুলো লাইনের ধাপে ধাপে প্রকাশ পেতে থাকবে। কোন কবিতার মাঝখানে যেয়ে হুট করে যদি আপনি থিম পাল্টান, তাহলে সেটা তো বিপদজনক। এর অর্থ হচ্ছে পাঠকরা কবিতা পড়তে যেয়ে বিভ্রান্ত হবে, কারণ কবি নিজেই বিভ্রান্তকর অবস্থার মধ্যে এই কবিতাটা লিখেছে। থিম একটা টপিকের উপর হতে হবে, কবিতার থিম নিয়ে কবিতার মাঠের মধ্যে ফুটবল খেলার কোন দরকার। ফুটবলে যেমন কিক দিতে পারলেই যে কেউ খেলোয়ার হয় না, ঠিক তেমনি উল্টাপাল্টা শব্দ, উল্টাপাল্টা লাইন, উল্টাপাল্টা থিম নিয়ে যা ইচ্ছা তাই একটা লেখা দিলেও সেটা কবিতা হয়ে উঠে না এবং সে নিজেও কবি হবে না। এই জ্ঞান যতদিন না আসবে শুদ্ধভাবে কবিতা লেখাও শিখবেন না আপনি।
.
সচরাচর আরেকটা সমস্যা দেখা যায়। প্রতিটা কবির একটা নিজস্ব ঢং থাকে, স্টাইল থাকে। বাকিজীবন সেই স্টাইলেই তাকে লিখে যেতে হয় একের পর এক। অথচ অনেক সময় দেখা যায় কিছু কিছু অতি উৎসাহী কবিরা নিজের নিজস্ব স্টাইল বাদ দিয়ে আরেকজনের স্টাইলে লেখা শুরু করেন, অন্যের তৈরি করা ঢঙে লেখার চেষ্টা করে। ময়ূরের পালক যেমন কাকের যায় শোভা পায় না, অন্য কারো লেখার ঢং তেমনি নিজের লেখায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না। এই জগাখিচুড়ির শেষ পরিণতি হচ্ছে কবিরা শেষ পর্যন্ত কবিতা লেখার একান্ত নিজস্ব ঢং'টাই হারিয়ে ফেলেন। কবিতা লেখার সময় কখনো অন্য কাউকে অনুকরণ করে, অনুসরণ করে, কিংবা তার ঢঙে লিখতে যাওয়া উচিত না। এটা ভুল মারাত্মক ভুল। এর ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে থাকে।
.
কারো যদি কবিতা লেখার ইচ্ছে হয়, তার সর্বপ্রথম যেটা চেষ্টা করা উচিত সেটা হচ্ছে, সাহিত্যের ভালো ভালো কবিদের প্রচুর কবিতা পড়া। প্রচুর কবিতা পড়তে পড়তে একসময় সেইসব লেখার স্টাইলগুলো, অবিরত যে ভুলগুলো কবিরা এড়িয়ে চলেন সেগুলো এবং কিভাবে মনের ভাব সুস্পষ্টভাবে শব্দচয়নের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা যায় শিখতে পারবেন। এটা অত্যন্ত জরুরী শিখতে পারা।
.
মনের ভাব কোন একটা টপিকের উপরে দশ লাইনেও লেখা যায় আবার সেটা এরচেয়ে অনেক সুন্দর করে এক লাইনেও পরিপূর্ণ ভাবে প্রকাশ করা যায়। সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যাপক মনের ভাব প্রকাশ করাই হচ্ছে কবিতা মূল উদ্দেশ্য। যতদিন পর্যন্ত কবিরা এই গুন'টা অর্জন করতে না পারবে, ততদিন তাদের কবিতা পড়তে থাকলে পাঠকদের মনে হবে অহেতুক টানাহেঁচড়া করে ইলাস্টিকের মতন এইসব কবিতাগুলি বড় করা হয়েছে। পাঠকদের বিরক্ত সৃষ্টি করে কোন কবি জনপ্রিয় হতে পারেনি এবং সেই কবিতা পাঠকের হৃদয় কখনো স্থান দখল করতে পারবে না।
.
যে কোন একটা কাজের সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। গ্রামার থাকে। সুষ্ঠুভাবে কোন কাজ করতে হলে এইসব নিয়ম জেনে নেয়াও নিজের দায়িত্বের মাঝে পরে। আমি শুধু এটাই সবাইকে অনুরোধ করেছি।
.
সুন্দর গঠনমূলক, ব্যাকরণগত এবং শুদ্ধ বানানে সাহিত্যচর্চায় কবিতা হয়ে উঠুক ভাব প্রকাশের অনন্য মাধ্যম।
.
কবিরা স্বল্প ভাষায় ব্যাপক অর্থ প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়ে গভীর একটা স্থান দখল করে নিক এই কামনাই রইলো সকল কবিদের প্রতি।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইলো
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, জানুয়ারী ২০২২
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০২২ সকাল ৯:৫০