somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইউক্রেন যেভাবে আমেরিকার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলো..

০১ লা মে, ২০২৫ রাত ৯:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গতকাল ইউক্রেনের জন্য খুব খারাপ একটা দিন ছিল।

ইউক্রেন আমেরিকার সাথে এমন একটা চুক্তি করেছে যে, এটাকে দেশ বিক্রি করে দেয়া বললে মোটেও ভুল হবে না। একটু বিস্তারিত বলার চেষ্টা করি।

গতকাল স্বাক্ষর করা চুক্তি অনুযায়ী, এখন থেকে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ থেকে পাওয়া মুনাফার ৫০ ভাগের মালিক হবে আমেরিকা। এর কারণ হলো, এতদিন ধরে আমেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধে যে বিনিয়োগ করেছে, এটা হবে তার ক্ষতিপূরণ। ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আমেরিকা ইউক্রেনে ১৮৩ বিলিয়ন ডলার ’বিনিয়োগ’ করেছে। এইবার সেই বিনিয়োগ সুদে-আসলে তুলবে।

রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধ ছিল আমেরিকার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন। এই শতকের গোটা সময়জুড়ে আমেরিকা এই যুদ্ধের স্বপ্ন দেখে গেছে। এখন সেই যুদ্ধের খরচ আসবে খোদ ইউক্রেন থেকে?

সত্যটা হলো, সেই লক্ষ্যেই বছরের পর বছর ধরে আমেরিকা ওখানকার তরুণদের পেছনে “বিনিয়োগ” করে গেছে। তরুনদেরকে এটা বুঝানো হয়েছে যে, ইউক্রেনের রাজনৈতিক দলগুলো খারাপ। এরা দুর্নীতিগ্রস্ত, এদেরকে দেশ থেকে তাড়াও। সেসব প্রকল্পের সার কথা ছিল, রাশিয়া তোমাদেরকে লুটপাট করছে, রাশিয়া তোমার ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। তরুণদেরকে বুঝানো হয়েছে যে, তোমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলো।

ফলে ১০ বছরের মাথায় দেশটা দুইটা বড় আন্দোলন দেখে। ২০০৪ সালের "Orange Revolution" এবং ২০১৪ সালের "Euromaidan" আন্দোলন। মূলত এই দুই আন্দোলনই ইউক্রেনের ইতিহাসকে বদলে দেয়। বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন এনেছিল।

বিশেষ করে ২০১৪ সালের আন্দোলন। বলা হয়, এটা গোটাটাই ছিল ইউরোপের বানানো পশ্চিমা ধাঁচের এমন এক আন্দোলন, যেখানে ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রভাব মুক্ত করার জন্য ইউরোপের কিছু দেশ এবং আমেরিকা দুই হাতে বিনিয়োগ করে গেছে।

আন্দোলন চলাকালে পশ্চিমা নেতারা (যেমন, জোন ম্যাককেইন, ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড) কিয়েভে গিয়েছিলেন, সমাবেশে বক্তৃতা দিয়েছিলেন!

তার আগে, তরুণদেরকে ক্ষ্যাপানোর জন্য আমেরিকা ইউক্রেনে গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার ইত্যাদির পূনর্বহালের নামে এনজিও ও সিভিল সোসাইটির মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত টাকাাপয়সা ঢেলেছে। তিনটা প্রতিষ্ঠান এই টাকা পয়সা ঢালার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল, USAID, National Endowment for Democracy (NED) এবং Open Society Foundations।

এসব ফান্ডিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল, অন্তত কাগজে কলমে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা। কিন্তু গবেষকরা দেখিয়েছেন, এসব প্রকল্প "soft power" বা "influence operation" হিসেবে কাজ করেছে, যার মাধ্যমে মূলত তরুণদের মধ্যে পশ্চিমা ধ্যানধারণা ছড়ানো হয়েছে। ফলে যখনই বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে, সেসব বিক্ষোভে হাজার হাজার তরুণ যোগ দিয়েছে। ফলে ২০১৪ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানোকোভিচকে রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে হয়!

এরপরের দুই তিন বছরের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পর ২০১৯ সালে জেলোনস্কিকে ক্ষমতায় বসানো হয়। যার রাজনীতিতে কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না; বরং উনি ছিলেন টেলিভিশনের এক কৌতুক অভিনেতা।

এই কৌতুক অভিনেতার হাত ধরেই গতকাল যে চুক্তিটা হলো, এর বিনিময়ে ইউক্রেনের মহামূল্যবান খনিজ সম্পদ এখন আমেরিকার।

ইউক্রেনের যে সব স্বপ্নবান তরুণ সেসব আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, তারা এখন প্রাণ বাঁচাতে ইউরোপের নানা দেশে পরিবারসহ উদ্বাস্তু!

ইউক্রেনের মহামূল্যবান খনিজ সম্পদের দিকে আমেরিকার চোখ কেনো?

ইউক্রেনের মাটির নিচে রয়েছে বহু মূল্যবান critical minerals—যা আধুনিক প্রযুক্তি, সবুজ জ্বালানি এবং প্রতিরক্ষা শিল্পে অপরিহার্য। এর মধ্যে আছে, লিথিয়াম (Lithium) যা ব্যাটারি উৎপাদনে অপরিহার্য। নিওডিমিয়াম (Neodymium), প্রাসিওডিমিয়াম (Praseodymium) এগুলা উইন্ড টারবাইন, ইলেকট্রিক মোটর ও ডিফেন্স টেকনোলজিতে ব্যবহৃত শক্তিশালী চুম্বক তৈরিতে দরকার। টাইটানিয়াম (Titanium) এভিয়েশন, ডিফেন্স, স্পেসক্রাফ্ট এবং চিকিৎসা যন্ত্রাংশে ব্যবহৃত হয়।

চীন বর্তমানে বিশ্বব্যাপী rare earth supply এর প্রধান সরবরাহকারী—সেই monopsony ভাঙতে ইউক্রেনকে কৌশলগতভাবে মূল্যবান মনে করা হয়।

ইউক্রেনে প্রায় ১২,০০০টি খনিজস্থল চিহ্নিত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ২০টি খনিজ আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত।

ইউক্রেন আগাগোড়া এক কৃষি প্রধান দেশ। দুনিয়ার শস্যভাণ্ডারের অন্যতম যোগানদাতা হল ইউক্রেন। ইউরোপের সবচেয়ে বেশি আবাদযোগ্য জমিও কিন্তু এই ইউক্রেনেই।

পৃথিবীর মহা গুরুত্বপূর্ণ মোট কালো মাটির ২৫ভাগ পাওয়া যায় এই অদ্ভুত সুন্দর দেশটায়; যা গোটা ইউরোপের হিসেবে তৃতীয়।

সূর্যমুখী ও সেই থেকে উৎপাদিত তেল-উভয়ই রপ্তানিতে দুনিয়ার শীর্ষ দেশটার নাম হলো ইউক্রেন।

ভুট্টা দুনিয়াব্যাপি মহা গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য। উৎপাদনের দিক থেকে তৃতীয় আর রপ্তানির দিক থেকে চতুর্থ দেশটার নাম ইউক্রেন।

এই দেশটা আলু উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ।

জব উৎপাদনে সারা দুনিয়াব্যাপি পঞ্চম।

মধু উৎপাদনেও দুনিয়ায় পঞ্চম স্থানে থাকা দেশের নাম ইউক্রেন। ২০২১ সালে এই দেশ একা ৩১.২ মিলিয়ন মেট্রিক টন গম উৎপাদন করেছে। একইভাবে রপ্তানিতেও এই দেশ উপরের দিকে। বিশ্বে অষ্টম।

মুরগীর ডিম উৎপাদনে সারা দুনিয়ায় নবম।

পনির রপ্তানিতে সারা দুনিয়ায় ১৬ তম স্থান ইউক্রেনের।

দুনিয়ার ৬০ কোটি মানুষের খাবারের সংস্থান একা ইউক্রেনে করতে পারে। তার মানে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ছাড়া বাকি সব দেশকে খাওয়াতে পারে ইউক্রেন। অথবা দারিদ্র্য পীড়িত অর্ধেক আফ্রিকাকে একা খাওয়ারে পারে ইউক্রেন।

শিল্পায়নেও ইউক্রেন কৃষির মতোই প্রাগ্রসর এক দেশ৷

স্টিল উৎপাদনে দুনিয়ায় দশম স্থান ইউক্রেনের। বছরে উৎপাদন করে সাড়ে ৩২ মিলিয়ন টন।

নিরাপত্তা সরঞ্জাম উৎপাদনে সারা দুনিয়ায় ইউক্রেনের স্থান নবম। খনিজ রপ্তানিতে দুনিয়ায় অষ্টম।

লোহাজাতীয় দ্রব্যাদি রপ্তানিতে সারা দুনিয়ায় চতুর্থ স্থান ইউক্রেনের। পলি রপ্তানিতে চতুর্থ।

রকেট লঞ্চার উৎপাদনে এই দেশটা সারা দুনিয়ায় চতুর্থ।

পরমাণু শক্তি উৎপাদন বিষয়ক স্থাপনা ও সরঞ্জাম বানানোর ক্ষেত্রে এই দেশের নাম চার নম্বরে আসে।

গতকাল থেকে ইউক্রেনের সব খনিজ সম্পদের অর্ধেকের মালিক আমেরিকা। এই যুদ্ধ থেকে আর কি পেলো ইউক্রেণ? পেলো, ৪৬০০০ মৃত সেনা, ১ লাখ ৮০ হাজার চিরতরে পঙ্গু, ১৩ হাজার সাধারণ মানুষের মৃত্যু, ঘরহারা লাখ লাখ পরিবার, ইউরোপ আমেরিকায় উদ্বাস্তু ইউক্রেনীয়ানদের ঢল, আর রাশিয়ার কাছে হারালো বেশ কিছু জায়গা!

বাংলাদেশের সাথে কোথাও মিল খুঁজে পাওয়া যায়?

লিখেছেন: Raju Norul
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০২৫ রাত ৯:৪৮
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×