সারাটাক্ষন সে ফড়িংয়ের মতোই ছুটোছুটিতে ব্যস্ত...ধরতে গেলে হাত থেকে ছুটে পালায়...মাঝে মাঝে ওকে আমি ফড়িং বলেই ডাকি, সেও খুব মজা পায়। দশই নভেম্বর আমার ফড়িং সোনার জন্মদিন।
এই ছবিটা আজকের
দিন কিভাবে চলে যায়!!! মনে হচ্ছে, এইতো সেদিন সে এলো পৃথিবীতে... দেখতে দেখতে আজ তার পাঁচ বছর হলো। সন্তানের আগমনের দিন সব মায়ের কাছেই এক বিশেষ দিন...স্মৃতির পাতায় আপন মহিমায় দিনটি ভাস্মর হয়ে রয়েছে...২৬ রোজার দিবাগত রাত মানে শবেকদরের রাত...নামাজ পরা শুরুই করেছিলাম কিছুটা দেরীতে...রাত বারোটার দিকে ধীরে ধীরে পরছি...মাটিতে সিজদাহ দিতে পারি না...চেয়ারের উপরে সিজদা দিয়ে কিছুক্ষন বিরতি দিয়ে দিয়ে নামাজ পড়লাম...ঘন্টা দুই পরে আর ভালোলাগছিলো না, ঘুমোতে গেলাম তিনটার দিকে...শুয়েও কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না..একবার এইদিকে ঘুরি আরেকবার ঐদিকে ঘুরি...তার কিছুক্ষন পরেই বুঝতে পারলাম, তার পৃথিবীতে আসার সময় হয়ে গেছে। যদিও আসার কথা আরও ছয়দিন পরে ছিলো। রাত চারটার সময় হসপিটালে যেয়ে ভর্তি হলাম। ও পেটে আসার পর থেকেই অনেকের কাছ থেকে অনেক ধরনের কথা শুনেছিলাম,ভীষন কস্ট...অনেক সময় মা, বাচ্চা দুজনেই মারা যায়..এমনই নানা ধরনের কথা। এসব কথা মনে পড়ছিলো আর ভীষন ভয়ও করছিলো..তারউপরে পাশে পরম মমতাময়ী মা নেই, এই দূরদেশে সেইসময়টায় আসতে পরেননি। এই কারনে ভয়টা আরও বেশি লাগছিলো...তবে এখানের হসপিটালে হাজবেন্ডকে থাকতে দেয় পাশে ডেলিভারী হবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। পরের দিন দুপুর দুইটায় সব যন্ত্রনা, কষ্টের অবসান শেষে নরমাল ভাবেই তার জন্ম। করুনাময়ের অশেষ রহমত কোনো অপারেশান ছাড়াই সুস্থ্য ভাবে তার জন্ম হয়েছে।
হওয়ার সাথে সাথেই নাড়ী কেটে ওকে আমার বুকে শুয়ে দিলো নার্স।
উঠে চোখ খুলে দেখার শক্তিটুকুও নেই, চোখ বন্ধ করেই অনুভব করতে পারছি, নরম তুলতুলে পাখির ছানার মতো ছোট ছোট হাত পা নাড়ছে...সেই সময়ের অনুভূতিটা এখনও চোখ বন্ধ করলই দেখতে পাই...আমার জীবনের শ্রেষ্ট অনুভূতি।
বয়স যখন একদিন
দুই বছর থেকেই ওকে ডেকেয়ারে রাখতে হয়। প্রথম দিকে কিছুতেই থাকতে চাইতো না...রেখে আসার সময় জামা ধরে কান্নাকাটি করতো, আর ছাড়তে চাইতো না। জামার কোনাটা ঐ ছোট্ট হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে সিড়ি দিয়ে নীচে নেমেও ওর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যেতো..যতক্ষন শুনতে পেতাম ততক্ষন নীচেই দাড়িয়ে থাকতাম...একসময় যখন আর শব্দ পেতাম না তখন চোখ মুছে নিজের কাজে যেতাম।
পার্কে কাঠের ট্রেনে
বাসায় সে সবসময়ই বাংলাতেই কথা বলে...ডেকেয়ারে ও ছাড়া বাকী সবাই জাপানিজ, বাধ্য হয়েই ওকে জাপানিজ বলতে হয়। কিন্তু গেট থেকে বের হবার সাথে সাথেই তার বাংলা কথার ফুলঝুড়ি ফোটে...ফিরতে ফিরতে কোনোদিন সন্ধ্যা হয়ে গেলে, আকাশে যখন টুপকরে চাঁদটা উঠে পরে...তার প্রশ্ন, চাঁদটা কেনো শুধু আমার সাথে সাথেই হাটে!!!!! কেনো তোমার সাথে যায় না!!! আমি থামলেই কেনো থেমে যায়!!!! আর আমাদের বাসার কাছে এসেই কেনো চুপ করে বসে থাকে!!!!
পাশ বালিশ দিয়ে ঘোড়া খেলা
আমি যদি কখনো বাসায় হঠাৎ কোনো শব্দ জাপানিজে বলি...সাথে সাথে বলবে, তুমি যেভাবে সবসময় কথা বলো...ওভাবেই বলো মানে আমার মুখে বাংলা কথাটাই বেশি পছন্দ করে। বছর খানেক আগে যখন রাতে কিছুতেই ঘুমোতে চাইতো না, তখন ওকে কোলের মধ্যে নিয়ে বাংলা ছড়া সুর করে করে শোনাতাম...তখন চুপ করে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতো...এভাবে বেশ কয়েকটা বাংলা ছড়া বলতে পারে..."ঐ দেখা যায় তালগাছ", "আগডুম বাগডুম", "আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা"
গাড়ী চালানোতেই রাজ্যের আনন্দ
এখন সে প্রিস্কুল টাইপের একটা সেন্টারে যায়...এখানে ছয়বছর বয়স থেকে স্কুল। প্রিস্কুলে পড়াশুনা তেমন বই ধরে ধরে না..খেলতে খেলতে পড়া...রং চেনা...বেশিরভাগ সময়ই সে কাগজ দিয়ে ওরিগামি বানাতে পছন্দ করে...শুধু ও না, সব বাচ্চা গুলোই দেখি ওরিগামি বানাতে পারদর্শি...কি বানাতে পারে না, এই ছোট ছোট পিচ্চিরা বিড়াল থেকে শুরু করে বক, প্লেন আরও কত কিযে বানায়...প্রতিদিন নানান রকমের ওরিগামি নিয়ে আসবে বাসায়, সেই সাথে আমাকেও সেগুলো শিখাবে
তখন কেবলই দাত উঠা শুরু করেছে
ওর স্কুলে যেতে দশ থেকে পনেরো মিনিটের হাটা রাস্তা...আমাদের দুজনের যতকথা এই রাস্তাতেই...একদিন ওকে প্রশ্ন করলাম, তুমি আমার কি হও? সাথে সাথে ওর উত্তর আমি তোমার বন্ধু। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি, এত ছোটবেলাতেই এত সত্যি কথাটা সে কিভাবে শিখে ফেললো!!!!! এখন আমার দিন রাত প্রতিটা মুহূর্ত কাটে এই ছোট্ট বন্ধুটাকে ঘিরে..পুরোটা সময় জুড়ে থাকে সে।
হামাগুড়ির বয়সটাতে
পথে যেতে যেতে একদিন বললাম, দেখো রাস্তায় অনেক গাড়ী-ঘোড়া থাকে, সাবধানে হাটবে...মাথা ঝাকিয়ে বললো হুম, কিন্তু রাস্তায়তো কোনো ঘোড়া নেই মামনি!!! বললাম ওটা কথার সাথে মিলিয়ে বলেছি..সে বুঝতে চায় না... তার কথা রাস্তায় যেহেতু ঘোড়া নেই, তাই ওকথা বলা যাবেনা...কি আর করা, তার কথাতেই সায় দিতে হয়। এমন নানান ধরনের কথায় সে প্রায়ই আমার ভুল ধরে
আমার ছেলের নাম জাওয়াদ
আরেকদিন ফিরতি পথে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে...বৃষ্টির পরিমান এত বেশি যে এক হাত দূরের মানুষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। সাথে বেশ জোড়ে বজ্রপাতও, সত্যি বলতে কি আমার বেশ খানিকটা ভয়ই লাগছিলো... হেটে হেটে ফিরছিলাম...ছোট্ট বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি ভয় পাচ্ছ? সে বললো না একটুও নাকি ভয় পাচ্ছে না...আমি বললাম, আমারতো খুব ভয় করছে...ও বলে কোনো ভয় নেই, আমি আছি না তোমার সাথে ...সেদিন সেই বৃষ্টির মধ্যে ছোট্ট হাতটা ধরে পথ চলতে থাকলাম...
এমন করেই কেটে যাচ্ছে আমাদের দিন...
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০০৯ সকাল ৯:১৫