somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: উল্টাটান

২১ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ৯:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাইরে ভোর হচ্ছে। তার তন্দ্রামতো এসেছিলো, তন্দ্রার ভিতর বারবার সে একই স্বপ্ন দেখছিলো। স্বপ্ন না দুঃস্বপ্নই হবে। এই চরে ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। আর জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, নৌকো, কলাগাছ, বকফুল, গরুছাগল, হাঁসমুরগি আর লাউয়ের মাচাং। আর তার বাচ্চাটার জামার একটা অংশ একটা নিমগাছের ডালে আটকে আছে। আর বাচ্চাটা কাঁদছে। কিন্তু তার কান্নার শব্দ ঢাকা পড়েছে ঝড়ের শব্দে। জায়নামাজের মতো লাল একটা শাড়ি উড়ে যাচ্ছে দেখলো নিমগাছের পাশ ঘেঁষে। তার মনে হলো এটা জরিনার পরনে ছিলো। স্বপ্ন আর বিস্তারিত হলো না, ফজরের আযানের শব্দে তার তন্দ্রা ছুটে গেলো।

ইদানীং প্রায় রাতে সে এইসব হিজিবিজি স্বপ্ন দেখে। রাতে ঘুম হয় না। তন্দ্রামতো হয়। সে বিছানায় পড়ে আছে প্রায় দুইবছর হতে চললো। এবং প্রতিদিনই বাইরে ভোর হয়।


নদীতে নতুন চর জেগেছিলো সেবছর। মানিকের পাল্লায় পড়ে সেও চর দখলে গিয়েছিলো। এই চরের মারা পড়েছে দুইজন। সবচে বড় লাঠিয়াল হাসমত। আর তার সাগরেদ মানিক।

লাঠির আঘাতে তার ডান পা থেতলে গিয়েছিলো। ওরা হাসমত আর মানিকের লাশের সাথে তাকেও উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। হাসমতের লাশের কী হলো সে জানে না। মানিকের লাশ যখন টুকরো টুকরো করে কেটে ভুষি আর খড়ের সাথে গরুকে খাইয়ে দিলো তখনও সে নির্বিকার, কেবল একটু বমি বমি ভাব হয়েছিলো। যখন সাড়ে তিনদিন পর ওরা তার কাছে এসে বললো, অ মিয়া! এমুন ভাঙা পাডি দিয়া তুমার কাম কী? এইডা হইলো বুঝা... বলেই ভুজালির কোপে হাঁটুর উপর থেকে তার থেতলানো ফোলা ডান পাটা কেটে ফেললো তখনও তেমন ব্যথা পেলো না। ওই পায়ে কোনো চেতনা ছিলো না। মনে হলো শরীর ভারমুক্ত হলো। তার অবাক লাগলো। কিন্তু যখন তার পাটা তার সামনেই টুকরো টুকরো করে কেটে ভুষি আর খড়ের সাথে গরুকে খাইয়ে দিলো তার বমি হলো, এবং সে বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেলো। তার জ্ঞান ফিরলো তার ঘরের বিছানায়। তার মুখের ওপর জরিনার নিলির্প্ত মুখ। জরিনা তাকে কিছু বলে নি। পরে শুনেছিলো তার অজ্ঞানদেহ চরে পড়েছিলো। লালু তাকে প্রথম আবিস্কার করে। এবং চরে জানাজানি হয়। সেবছর এইচরের লোকজন নতুনচর দখল করতে পারে নি।


জরিনার হাসির শব্দ শুনে সে। ভাবে, মাগী কি রফিক্যার লগে হাসে, হের লগে কী চলতাছে? ভাবে, মাগীডা খায় কী, দিন দিন এমুন সোন্দর হয় কেমতে? তার সবকিছু অসহ্য লাগে সে মাথার উপর বালিশ চেপে ধরে বিছানায় গড়াগড়ি খায়।

দিন পাল্টে গেছে। এখন সেই প্রেম আর নেই। অভাব আর পঙ্গুত্ব সব কেড়ে নিয়েছে তার জীবন থেকে। এই দুইতিনবছরে জরিনা তার বিছানায় দুইয়েকবারও আসে নি। সে এখন শাশুড়ির ঘরে থাকে। শাশুড়ির মরার পর থেকেই জরিনা ওইঘরে থাকে ছেলেটাকে নিয়ে। এখন একা থাকে। ছেলেটার যখন চারবছর বয়স তখন তাকে রফিকের হাফেজখানায় রেখে আসে। ওখানে আরো ছেলেরা থাকে খোঁপখোঁপ ঘরে। জরিনা দুইদিন পরপর গিয়ে দেখে আসে।

তার শরীর দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। আরেকটা পাও নীল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এখন শুধু খিটিমিটি লাগে। সে কারণে অকারণে জরিনাকে ডাক দিয়ে অশ্রাব্যভাষায় গালিগালাজ করে। জরিনা চুপ করে শোনে।


দরজায় ঠক ঠক শব্দ হয়। দরজা ভেজানো তারপরও শব্দ। সে কথা বলে না। অসহায় চোখে দরজার দিকে তাকায়। সে বাতাসকে মনে মনে বাপান্ত করে। তারপর তার মনে পড়ে লালুর কথা। ভাবে, লালু নাতো! এ কুকুরটা তার কাছে মাঝে মাঝে আসে, মানুষের মতো তার সাথে কথা বলে, প্রথমে সে অবাক হয়ে ভাবতো, কুত্তা কেমতে কথা কয়? তারপর মনে হলো, সবডি আল্লার খেল...। যখন থেকে সে ঘরে একা একা থাকেÑ একদিন লালু এলো। কুকুরটাকে দেখে তার ভালো লাগে এটা বলতে গেলে তার প্রাণ রক্ষা করেছিলো। সে ভাবে, আল্লার অছিলা। দরজা ঠেলে লালু ঢুকে ঘরে, মিয়াভাইয়ের শইলডা কেমুন?
ভালা নারে! তুই খাইছোস কিছু?
আমারে নিয়া ভাবতে অইবো না। আমার খাওনের অভাব নাই।
আইজগা কী খবর লইয়া আইলি?
মিয়াভাই চরে লাখে লাখে পিঁপড়া ঢুকতাছে। এইডা ভালা লক্ষণ না।
হ। আমি কদিন ধইরা খারাপ খোয়াব দেখতাছি।
তুমার শইলতো শুকাইয়া যাইতাছে শুটকি মাছের লাহান।
হ।

তার কান্না পায়। সে গোঁ গোঁ করে কাঁদে আর বিছানায় গড়াগড়ি করে। লালু দরজা ঠেলে বের হয়ে যায়।


ভরদুপুর। জরিনা ভাবে, রফিকভাইজান না থাইকলে যে কী অইতো? সে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। সে ভাবে, সারাজীবন মানুষডা আর বিয়াও করলো না। আমার লগে বিয়া হইলে তো... সে আর ভাবতে পারে না, একটু লজ্জাও পায়।

সারাদিন কিভাবে কেটে যায় জরিনা বুঝতেও পারে না। সারাদিন কাজ করতে হয় এ বাড়িতে। অনেক বড় বাড়ি। নদী পার হয়ে প্রতিদিন এই বাড়িতে আসে সে। স্বামী পঙ্গু হওয়ার পর থেকেই সে বাড়ি বাড়ি কাজ করে। এবাড়িতে কাজ করছে তাও আটনয়মাস হয়ে গেছে। করিমের বয়স সাড়ে চারবছর। আপাতত করিমকে হাফেজখানায় দিয়ে দিয়েছে। অইখানে সে থাকে। কোনো টাকা পয়সা দেয়া লাগে না, হাফেজখানাটা রফিক চালায়। সে জরিনার দূর স¤পর্কের ভাই। বছরদেড়েক হলো সে এই চরে এসেছে। জরিনার স্বপ্ন ছেলেকে ভালো স্কুলে পড়াবে, শহরে পাঠাবে। সে ভাবে, করিমের বাপের পাডা ভালা থাইকলে তার আর চিন্তা থাইকতো না। এইসব কথা মনে হতেই তার চোখ ফেটে পানি আসে। সে আঁচল চোখে চেপে ধরে।

এই বাড়িতে জরিনা সারাদিন গরুর জন্যে খড়বিচালি কুটে, ভুষি মাখায়। গোয়াল ঘরে এগারোটা গরু। দুইটা গরু গাভীন। সে কাজ করতে করতে হঠাৎ তার গোয়াল ঘরের একটা কড়ি কাঠের দিকে চোখ যায়। একটা পেরেকে ঘুনষির সাথে ঝুলতে থাকা একটা মাদুলির দেখতে পায়। খুব পরিচিত লাগে। সে হাতে নেয়। সে চিনতে পারে চর দখলের ঘটনার আগেও এটা স্বামীর কোমরে বাঁধা ছিলো। হঠাৎ করে তার কী যেনো হয়ে যায়, সে কাঁদে না, চোখ দিয়ে তার আগুন বের হতে চায়। সে গাভীন দুইটা গরুকে পাশ থেকে একটা চেলাকাঠ তুলে নিয়ে নিঃশব্দে পেঠাতে থাকে। সে যেনো বোবা হয়ে যায়। বাতাস ভেসে বেড়ায় কেবল হাম্বা হাম্বা চিৎকার।


তার ঘুম ভেঙে গেলো। সে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসতে গেলো পারলো না। তার শীর্ণকায় পঙ্গু শরীর দোলে উঠলো। একপাশ ভিজে গেলো। চৌকিটা কাত হয়ে ডুবে যেতে গিয়েও আবার ভেসে উঠলো। শেষবার যখন চৌকিটার একপাশ ভাঙলো তখন জরিনা দুইপাশে দুইটা বাঁশ বেঁধে দিয়েছিলো বলে আজ রক্ষা। একটা ঢোরাসাপ তার কাটা পায়ের কাছে কুণ্ডলি পাকিয়ে চুপিচাপ শুয়ে থাকে। সে শক্ত হাতে চালটা আঁকড়ে ধরে থাকে। কিন্তু সহসা প্রচণ্ড দমকা বাতাস এসে চালটা উড়িয়ে নিয়ে যায়। সে আকাশের দিকে দিকে তাকিয়ে থাকে, সে ভাসতে থাকে জলস্রোতে। সে ভাবে, এমুন ঢল বাপজানের দাদার আমলেও হয় নাই। তয় হুজুরে কইছিলো নুহনবীর আমলে চল্লিশদিন ঢল অইছিলো দুনিয়ায়। সে তার চৌকিটাকে নুহের নৌকা মনে করে স্বস্তি পায়। কিন্তু তার সেই দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়...


সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১১ দুপুর ১২:০৫
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×