প্রতিদিনের মতো বাপনের আজও মেজাজ খারাপ। আর মেজাজ খারাপ হলেই বাপনের প্রস্রাবের চাপটাও বাড়ে তরতর করে। দোতলা বারান্দার গ্রিল ধরে, কাটাকুটি করে মুত্রথলে থেকে জল ঢেলে দিলেই, ওম্.. শান্তি!
বাপনের প্রস্রাবকাণ্ডে, জনকপুর হাসপাতাল কলোনির বাসিন্দা থেকে শুরু করে রোগীদের অভিযোগ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত সিনিয়র স্টাফ নার্স শান্তা গোমেজ। পাঁচ বছর বয়েসী এই বদ ছেলের জন্য ‘সরি’ বলতে বলতে শান্তা আজ ভীষণ ক্লান্ত। তার চেয়েও সত্যি কথা, এখন ছেলের হয়ে ক্ষমা চাওয়ার আগেই সবাই আগ বাড়িয়ে বলে বসে, ‘সরি মা’।
এই তো সেদিন, এক রোগী শান্তাকে সিস্টার না ডেকে, ডেকে বসলো, ‘সরি মা’। এ ডাক শোনার পর প্রচণ্ড রাগ লাগলেও পায়ের বুড়ো আঙুল দেখে তা সামলে নেয় সিস্টার শান্তা। হাইস্কুলে থাকতে এক বান্ধবী রাগ থামানোর এ পদ্ধতি শিখিয়েছিলো তাকে। তারপর থেকেই এই ফর্মুলা এপ্লাই করে আসছে সে। তারচেয়ে বড় কথা ইদানিং সিস্টার শান্তার রাগ উবে চুবে গেছে একদমই। সেই যে বাপন, গর্ভে থাকার সময় তার বাবা নিরুদ্দেশ হয়েছিল, সেই থেকেই ক্রমহৃাসমান প্রান্তীক বিধি অনুসারে কমতে থাকে রাগের ব্যারোমিটার। আর রাগ পুঞ্জিবিত হতে হতেই তা বুঝি মরে যায়, শুকিয়ে যায়, সে জায়গায় গজিয়ে ওঠে ক্ষোভের পাহাড়। আর যতক্ষণ না ওই ক্ষোভ প্রকাশ্যে বিষবাষ্প হচ্ছে, তার আগ পর্যন্ত খালি চোখে তো তা আর দেখা যায় না !
প্রতিদিনকার রুটিন মাফিক সূচিতে আজ বাপনের ছোট্ট শিশ্ন থেকে জমাট প্রস্রাবের ফোয়ারা বর্ষিত হয়েছে মেডিকেল কলোনীর বাসিন্দা কম্পাউন্ডার ফজল মিয়ার উপর। মাত্রই গোসল সেরে বাঁশের বেড়ায় লুঙ্গী শুকাতে এসেছিলেন বেচারা। ঠিক তখনই তার মাথা তাক করে প্রস্রাব করেই বারান্দা থেকে চম্পট, বাপন। এরপর থেকেই, একহাত প্রস্রাব মাথায় নিয়ে ফজল মিয়া বাপনদের দোতলা বারান্দার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছেন। যদিও তার ভয়ানক চিৎকারে চারতলা কলোনির কারও কোনো মাথাব্যাথা নেই! এমনকি সামান্য কৌতুহল নিয়ে উঁকি দিয়েও সময় নষ্ট করতে চাইছে না কেউ। কারন এটা তো রোজকার কাহিনী, বাপনের রোজনামচা।
কম্পাউডার ফজল, হিংস্র চোখে ওপরের দিকে তাকিয়ে বললো, -ওই হালার পুত বাপন, কই লুকাইছস? বাইর হ কইছি। আর বিচার টিচার দিমু না। এবার আর রেহায় নাই, পাইলেই তোর নুনু কাইট্টা দিমু! হালার পুতে কি পাইছে! আমার মাথা পাইলেই পেচ্ছাবের ফোয়ারা চুটাও! হে...’
-‘স্যার, কি অইচে, কার ওপরে এ্যাতো চেতছেন? ওপরে তো কেও নাই?’, হাসপাতালে যাওয়ার পথে এ দৃশ্য দেখে এক রোগী জিজ্ঞেস করে।
-‘ওই আপনে কেডা? হু আর ইউ? নো কোশ্চেন যান’।
রোগী মুখটা একটু ত্যাড়া করে বিড় বিড় করে বললো, ‘হুদাই স্যার কইলাম! হালায় পাগল না তো! আকাশের দিকে তাকায় কোন হালারে গাইল পারছে, আল্লাই জানে। হালায় পাগল একটা...'
হাছায় তো উপরে তো কেউ নাই। তাতে ফজল মিয়ার রাগ আরো বাড়ে। এবার আগের চেয়েও দ্বিগুণ গর্জনে,
-‘ওই বাপনের মা, থুক্কু! ওই 'সরি মা'। আর ইংলিশ মাড়াইলে চলবো না, পোলার বিচার করো, নাইলে আমাগো হাতে তুইল্লা দাও। দ্যাহো, কিভাবে হের ডান্ডা সোজা কইরা দেই। ওই 'সরি মা' কথা কও না কে? পোলারে লইয়া চিপাই লুকাইলে চলবো না। বাইর হোন কইসি বাইর হোন। দিলোতো একবারে নাপাক কইরা...’
ছেলের এসব দুষ্টুমির জন্য শান্তা গোমেজের প্রায়ই মনে হয়, বাপনকে একদিন খুব করে শাস্তি দেবে সে। রিমান্ডে নেয়ার মতো নাইনটি ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে তার নরম শরীরে হাত তুলে তুলোধূনো করবে তাকে। রিমান্ডে নিলে নাকি শত শত বদমাশও একদম সিদা হয়ে যায়। শান্তার তাই করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ওই পর্যন্তই! শান্তার ভাবনাতেই রয়ে যায় সব। হাত তুলতে গেলেই বাপনের কালো গভীর খাদে যাওয়া চোখ দুটো থামিয়ে দেয় তার তেড়ে যাওয়া হাত। কিছুতেই হাত তুলতে পারে না সে। প্রচণ্ড রাগে ক্ষোভে, লজ্জায়, চোখ বড় বড় করে ছেলেকে বোঝায়, বকে। আবার ছেলে ঘুমিয়ে গেলে নিস্পলক চেয়ে থাকে, কাঁদে। হাত বুলিয়ে দেয় ঘুমন্ত বাপনের সারা শরীর।
এ নিয়ে কলোনির নারীকুল, শান্তাকে সমৃদ্ধ করতে নিয়মিত ফ্রি উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে..
-‘শুধু বকলেই চলবেনা দিদি! ছেলেকে না মারলে ‘ও’ আরও বিগড়ে যাবে! আপনাকে ভয় পাবেনা! মানুষকে মানুষ ভাববেনা!
-আজ অন্যের মাথায় প্রস্রাব করছে। কাল আপনার মাথায় করবে।
-এখন ‘ও’ অনেক ছোট তাই আদর করে মাফ করে দিচ্ছে সবাই। মারেন ! মাইরা ঠিক করেন!’
শান্তা ভালভাবেই জানে এটা তার অন্ধ মাতৃস্নেহ না! কারন সেই জানে বাপনের জন্ম রহস্য। তাই কেন জানি সব ঘৃণা গিয়ে পড়ে ছোট্ট বাপনের কাছে। মনে হয় এ অভিশপ্ত জীবনের জন্যই এ বাপনেই দায়ি। কি দরকার ছিলো, নার্স হয়ে সেবা ধর্ম না করে আগ বাড়িয়ে রোগীর সঙ্গে সুখ দু:খের আলাপ করতে যাওয়ার।
সেই ছয় বছর আগে বরিশালের রুপতালি হাসপাতালে স্টাফ নার্স হিসেবে কাজের একদিনকার কথা। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন। ইর্মাঞ্জেসীর বাইরে প্রচন্ড ভীড়। মটোর সাইকেল এক্সিডেন্ট করে সেই এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী পাপলু তালুকদারকে ইর্মাঞ্জেসিতে আনা হেয়েছে। দুপা’য়ের অনেক জায়গা থেতলে গেছে তার। আর সেই ভয়ানক সন্ত্রাসীর সেবার দায়িত্ব পড়লো কিনা সবচেয়ে শান্ত সিস্টার শান্তার কাঁধে। প্রথম প্রথম কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও পরে সন্ত্রাসী রোগীর মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে প্রেমে পড়ে গেল শান্তা। সবার মুখে তার একটাও সুনাম না শুনলেও পাপলুকে কখনই সন্ত্রাসী লাগতোনা শান্তার। কেমন জানি, কিছু জানিনা! কিছু করিনি! করতে পারিনা টাইপ চেহারা! চেহারার সাথে তার বদনামের প্রচুর অমিল। ওই পড়াটাই শেষ পড়া। তারপর বাপ, মা বন্ধু-সহকর্মীদের কথা উপেক্ষা করে ৫ মাসের মাথায় শান্তা বিয়ে করে বসলো পাপলুকে। বিয়ের রাতেই শান্তা চায়নি বাপন আসুক। কিন্তু পাপলুর আশ্বাসে, বিশ্বাস রেখে ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় প্রশ্বাস গেল থেমে। পাপলু পালিয়েছে। কোথাও কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা তার। কেউ বলছে ক্রসফায়ারে মারা গেছে। কেউ বলছে চরে তার বউ, পোলা আছে সেখানে পালিয়েছে। তারপর অনেক থানা-পুলিশ, চরাচর স্বামীকে মরিয়া হয়ে খুঁজে ক্ষান্ত হয়েছে শান্তা। প্রশ্ন উত্তরে, কোন সদুত্তর দিতে পারেনি কেউ। মনে হয় পারবেও না। অপেক্ষা সেই কবে প্রতীক্ষা হয়ে গেছে তা জানে সময়। কারন এই সময়ের কাছে সকল জিজ্ঞাসা, প্রত্যাশা গচ্ছিত রেখেছে শান্তা।
বাপনের জন্মের এক বছরের মাথায় জনকপুর হাসপাতালে বদলি হয়ে আসে শান্তা। প্রথমদিন থেকেই সিস্টার শান্তা এবং তার নবজাত শিশুকে নিয়ে কলোনীবাসীর নানা প্রশ্নের ফিসফিসানি। নানা কৌতুহল জিজ্ঞাসা। ‘নার্স তো, কোন বাদাইমা পোলারে বিয়া করসে নিশ্চিত। মধু খাইয়া মামু সইরা গেছে।‘, ‘দেখছো শরীরের ভাঁজ। একটুও নষ্ট হয়নাই। এখন ভাই লিভ টুগেদারের যুগ।‘, ‘পোলার বাপ তো আসেনা, এমনকি কোন আত্মীয়ও আসেনা। ব্যপারটা ভাল ঠ্যাকছেনা ভাই'।
এসব ফিসফিসানি একসময় আওয়াজ হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেগুলোর উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করেনি শান্তা। আর দিতে চায়ওনা। নিজের সুখ দু:খ একান্তই নিজের। কারও সঙ্গে শেয়ার করবার নয়। শান্তা এতদিনে জেনে গেছে তার ভেতরে প্রচণ্ড একটা খুনি মন আছে। যেখানে স্নেহ, ভালোবাসা একদমই লাপাত্তা। তাইতো বাপনের প্রচণ্ড বাইরে যাওয়া, কলোনীর বাচ্চাদের সঙ্গে খেলার হাজারো আবদারকে কখনও প্রশ্রয় দেয়নি সে। বরং কড়াকড়ি ভাবেই সবার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে নিজ সন্তানকে। এমনকি অফিস যাবার সময় বাপনের শত কান্নার মাঝেও দরজায় তালা মারতে বিন্দুমাত্র হাত কাঁপেনা শান্তার। এই একটি মাত্র কারণেই বাপনের প্রতি মাঝে মাঝে মায়া উথলে পড়ে জনকপুর কলোনিবাসীর। মাফ করে দিতে ভেতর থেকে ভেতর থেকে ডাক আসে বিবেকের। তারা কোনভাবেই বাপনের বন্দিদশা মানতে পারেনা। তাই বারান্দার গ্রীলে দাঁড়িয়ে মা'কে যখন ডাকতে থাকে বাপন তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও কয়েকসেকেন্ড মন খারাপ হয়ে যায় সবার।
তবে বাপন বন্দি থাকলে বেশি খুশি হয় একটি প্রাণী। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে বাপন তার নাম রেখেছে 'আপন’'। কিন্তু 'আপন’' নামের এই ছাল-বাকলহীন নেড়ি কুকুরকে আপন ভাবা তো দূরে থাক দূর দুর-দুর করে তাড়িয়ে দেয় সবাই। প্রয়োজনে ভাতের গরম মাড় ঢেলে কুকুরটির গোঙানীর আওয়াজে খিলখিল করে দাঁতের মাড়ি বের হয়ে আসে তাদের। তারপরও ন্যাড়ি কুকুরটা কলোনির সামনের বড়ই গাছের নিচে বসে থাকে। অপেক্ষায় থাকে মনিবের। আর বাপন বারান্দায় এলেই শীর্ণকায় গলাটা উপরের দিকে করে আদুরে আওয়াজ করে সম্ভাষণ জানায় তার অস্পর্শ মনিবকে। লেজ নেড়ে আনুগত্য জানায়। যদিও বাপন আপনের সম্পর্কের মাপকাঠি স্পর্শ- অস্পর্শের্ অনেক উর্ধ্বে ওঠে গেছে সেই কবে। কুকরটিকে সবাই তাড়িয়ে দিলেও দুতালা বারান্দা থেকে বাপন তাকে আদুর গলায় ডাকে। প্রতিদিনের উচ্ছিস্ট খাবার থেকে শুরু করে মায়ের রান্না করে রেখে যাওয়া কড়াইয়ের তরতাজা খাবারও নিচে ছিটিয়ে দেয়। এমন দিল দরিয়া মনিব পেয়ে গায়ে গতরে বেশ নেওটা হয়ে উঠেছে 'আপন'।
এদিকে বেশ কদিন হলো বাপনের কোন সাড়া শব্দ নেই। কানের কাছে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক বন্ধ হয়ে গেলে যেমন শুনশান লাগে ঠিক তেমনি একটা পরিবেশ যেন হয়েছে জনকপুর কলোনীর। কয়েকদিন হয়ে গেল বাপনের প্রস্রাব নিয়ে কোন গণ্ডগোল কানে আসছে না। এই বিষয়টি প্রথম খেয়াল করেছেন তিন তলার বাসিন্দা ফজল মিয়ার বউ জাহানারা খাতুন।
কি ব্যাপার তোমার ওপর হেতে দেহি আর মুতেনা! হেতের খবর কি? কোন আওয়াজ নেই ক্যা?
হাছা কইছো তো! বেশ ভাবুক হয়ে উত্তর দিলো ফজল মিয়া। অথচ কলোনীবাসীর মধ্যে এই কম্পাউন্ডারের উপরই সবচেয়ে বেশি প্রস্রাব করেছে বাপন। তারপরও বাপহীন এই গৃহবন্দী ছেলের প্রতি তার ভেতরে যে মায়া লুকিয়ে ছিলো তা এই প্রথম বুঝতে পারলো ফজল মিয়া।
ওই দিন দুপুরেই ওয়ার্ড থেকে নেমে আসার পথে সিস্টার শান্তার সঙ্গে দেখা হলো ফজলের। সাদা শুভ্র পোশাকে বরাবরই অন্যরকম লাগে শান্তাকে। কিন্তু আজকে তাকে কেন জানি ভাবলেশহীন লাগছে, চোখের কোল জুড়ে নিদ্রাহীণ কালোর ছুপ-ছুপ। ধবধবে শুভ্র সাদা যেন ধূসর পান্ডুর রং ছড়াচ্ছে।
কি ব্যাপার দিদি, আপনি কেমন আছেন? বাপনের খবর কি? ও কি অসুস্থ্ নাকি?
জি, জি, কি বললেন? কে বলেছে বাপন অসুস্থ? কে বললো?
বেশ কয়েক সেকেন্ড পর হঠাৎ চিৎকার করে উত্তর দিলো শান্তা। প্রয়োজন অতিরিক্ত চিৎকারে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া রোগী, এটেন্ডেন্টরা পর্যন্ত থমকে দাঁড়ালো। শান্তার এরকম অস্বাভাবিক আচরণে থতমত খেয়ে ফজল বললো, না দিদি, হ্যারে আর আগের মতো মুততে দেহিনা তো, তাই কইছিলাম আর কি? আপনি হঠাৎ এতো চ্যাতলেন ক্যা দিদি? রাগে লজ্জায় ফজলের মুখ দিয়ে আঞ্চলিক ভাষা বের হয়ে এলো। যেটা অন্তত অফিস আওয়ারে সে কখনও করে না।
ফজলের সামান্য প্রশ্নে শান্তার অশান্ত আচরণ কানে কানে কানমুখ হয়ে রটে গেল পুরো জনকপুর কলোনীতে।
-এতে চ্যাতার কি হলো? ফজল ভাই কি বাজে কথা বলছে নাকি?
- সোনার চান পিতলা ঘুঘু, বদের হাড্ডি একটা পোলা! তার জন্য আবার মায়া উগলাই পড়ছে। সবকিছুতে ওর একটু বেশি বেশি।
সিস্টার শান্তা গোমেজকে নিয়ে কলোনী জুড়ে এমন সমালোচনার ঝড় উঠলেও বরাবরের মতোই নিরব শান্তা। সেদিন বাসায় ফিরেই দরজাটা বন্ধ না করেই দৌড়ে গেল রুমে। রুমের ভেতর কেমন জানি পোড়া-পঁচা গন্ধ। সেদিকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে শ্রভ্র সাদা এ্যাপ্রনটি খুলতে থাকে শান্তা। আয়নায় নিজেকে আজ তার অনেক সুন্দর লাগছে। কেমন জানি মায়া মায়া। না মায়া মায়া না! মায়া মায়া শব্দটা নেতিবাচক। কেমন জানি করুনামাখা। 'আমি সুন্দর, অপূর্ব সুন্দর'। নিজেই নিজের প্রশ্নে উত্তর দিয়ে হাসলো সে। 'এতো সুন্দর এক মানুষকে ছেড়ে কি কেউ যেতে পারে?' আবারো আয়নাকে প্রশ্ন করে শাড়ীর সব ভাঁজ খুলতে থাকে শান্তা। শান্তা নিজেও ভেবে পায়না কম্পাউন্ডার ফজলের কথায় কেন সে এতো রিয়েক্ট করলো? সে তো খারাপ কিছু জানতে চায়নি। ছেলের স্বাস্থ্য-কুশলাদি জিজ্ঞেস করেছে মাত্র।
হঠাৎ শান্তার খুব করে মনে পড়ে গেলো ছেলেকে। আধ-জড়ানো শাড়ীর আঁচল মাড়িয়ে পাগলের মতো ছুটে গেল পাশের রুমে। বাপন তখনও অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কি শান্তিময় ঘুম। এরকম নির্লোভ ঘুম কতদিন যে ঘুমায়নি শান্তা। ছেলেকে বেশ হিংসে হলো তার। বাপনের কালো শরীরটা কেমন জানি নীলাভ হয়ে গেছে। না আমার সন্তান তো কৃষ্ণকায়, নীল হলো কি কিরে?
মাথায় হঠাৎ-ই বাজখেলে গেল শান্তার। আরে গত দু'দিন ধরে তো ছেলেকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখছে সে। গতকাল রাতেও তো ছেলেকে ভাত খাওয়ার জন্য বহুবার ডেকেছে সে। বাপনটাইতো উঠলো না।
ধীরে ধীরে সবকিছু কেন জানি আবছা আবছা মনে পড়ছে শান্তার। এইতো পরশুদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে বাসায় ঢুকে দেখে পুরো বাসায় ধোঁয়া। চকেট পোড়া গন্ধ। রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে দেখে ছেলে তার মাটিতে পড়ে আছে। পাশে কারেন্টের চুলার সুইচটি খোলা পড়ে আছে। তারপর কোন রকমে ছেলেকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দেবার পর আর কিছু মনে নেই শান্তার।
তারপর হাসপাতাল, রোগী, ঘর সবকিছুই স্বাভাবিকই তো ছিলো। তবে আজ কেন তার ছেলে ঘুম থেকে ওঠছে না! ও ও বোধহয় অভিমান করেছে। শান্তা মুচকি হেসে অভিমানী ছেলেকে জোড়ে জোড়ে ধাক্কাতে থাকে।
-ওঠ বাপন ওঠ..। আর কতো ঘুমাবি? ভাত খাবি না? গোসল করবি না?
-কি নোঙরা। গোসল করতে হবে না? সন্ধ্যা হয়ে গেছে তো বাবা। পড়তে হবে তো।ওঠ না। এই...বাপন
- আচ্ছা যা কাল থেকে তোকে বাইরে খেলতে দেবো। আরে বাইরে তালা দিয়ে আটকে রাখবো না। যা...
-ওঠ না
-ওঠ
-ও বাপন...
-আমার কিন্তু রাগ উঠে যাচ্ছে। এবার না উঠলে মারবো কিন্তু। ওঠ, ওঠ বাপন
-ওই..ওঠ
বাইরে তখন গোধূলী শেষ। কলোনির বাচ্চা-কাচ্চাদের ঘরে ফেরার আওয়াজ। আছরের আযানের শব্দ হাওয়ায় বাড়ি খেয়ে খেয়ে ভেসে আসছে কানে। প্রখর দিন খুব দ্রুত নেতিয়ে পড়ছে সন্ধ্যার নিশি আভায়। কলোনির বাইরে তখন কেউ নেই। শুধু আছে একজন নিলোর্ভ প্রাণী। আপন।। বড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অস্থীরদেহে প্রচন্ড কুৎসিতভাবে ডেকে যাচ্ছে সে। যে ডাকের মানে হয়তো কেই জানেনা। এমনকি জানেনা বাপনের মূর্খ ঘুমও।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:০৬