কলোনীর মধ্যে ফেলে রাখা অব্যবহৃত পানির পাইপটা বুঝি আজ এক ইতিহাসের স্বাক্ষী । আশেপাশের মানুষগুলো বোধহয় বিষয়টা খেয়াল করেনি । আর করলেই বা কি, কার কি যায় আসে । এই ঢাকা শহরে এমন দিনের তো আর অভাব নেই যেদিন কারও মন ভেঙ্গে যায় তাসের ঘরের মত । পানির পাইপটার উপর স্ট্যাচুর মত প্রায় ১০-১৫ মিনিট বসে ছিল রবিন । অশ্রুসজল ছলছল চোখে তাকিয়ে দেখল লিজার চলে যাওয়া ।
বিশ্বাসই হচ্ছিল না ওর । মাত্র ১২ ঘন্টার ব্যবধানে এত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাগুলো । অধিক শোকে নাকি মানুষ পাথর হয়ে যায়! আজ তাই নিজেকে পাথর ভাবতে ইচ্ছে করছে ওর । কাল রাতেও প্রায় দেড়টা পর্যন্ত কথা হয়েছিল লিজার সাথে । কি হাসিখুশিই না ছিল সে । অথচ আজ, হায় রে নিয়তি! কত চমৎকারভাবে ধীরে ধীরে, কত সহজেই না বলে ফেলল, "নাহ, আর নয় । আমাদের মধ্যে এতদিন যে সম্পর্ক চলছিল তা এ পর্যন্তই থাকুক । এ ব্যাপারটা নিয়ে তুমি কষ্ট পেও না প্লিজ । তাহলে কিন্তু আমিও অনেক কষ্ট পাব । তুমি আমাকে পারলে ভুলে যেও । আমি আর এর বেশি কিছু ভাবতে পারছি না ।"
কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে চলল লিজা । রবিনের চাপা দীর্ঘশ্বাসগুলো বোধ হয় শুনতে পাচ্ছিল না ও । এমন এক আত্মীয়তার বেড়াজালে বন্দী দুজন যেখানে কোন শুভ পরিণতি আশা করা হয়ত বিলাসিতা ছিল । তবুও একটা চেষ্টা করার সুযোগ তো লিজা দিতে পারতো রবিনকে । রবিন তো তাকে কথা দিয়েছিল বাড়িতে জানানোর । নাহ, আর কোনো সুযোগ নয় । টানা দশটা দিন মন নিয়ে খেলার পর অবশেষে রবিনকে ছুটি দিয়ে দিল সে । জানিয়ে দিল সব শেষ ।
জীবনের প্রথম প্রেম নাকি মানুষ ভুলতে পারে না । সত্যিই কি তাই? আজ বসে বসে আপন মনে সেই হারিয়ে যাওয়া পুরনো দিনের সুখস্মৃতি রোমন্থন করছিল রবিন । শুরুটা হয়েছিল সেই জুন মাসে । রবিনের জন্মদিনের আগেরদিন লিজার সাথে ওর প্রথম পরিচয় । রবিনের বড় মামার আত্মীয় লিজা। ঐদিন রবিনদের হলে এসেছিল সবাই । মামা, মামী, লিজা সবাই একসাথে শপিং-এও গিয়েছিল । যদিও সেদিন একটা বাক্য বিনিময়ও হয়নি ওদের । রবিন এমনিতেই অনেক লাজুক প্রকৃতির । আর আগ বাড়িয়ে কথা বলা - এটা তো ওর দ্বারা এক প্রকার অসম্ভবই । তবুও ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! পরদিনই ফোনে প্রথম কথা হল লিজার সাথে । ব্যাপারটা অবশ্য হত না যদি গর্দভ রবিনটা একটু হলেও ঢাকা শহরটা চিনত । মামার সাথেই কথা বলছিল রবিন । মামাই ফোনটা লিজাকে দিয়ে বলেছিল রবিনকে ঠিকানাটা বুঝাতে । যে লোকেশনই লিজা বলে রবিনের এক কথায় উত্তর, "চিনি না" । তখনকার রবিন তো টোটালই আঁতেল টাইপের ছিল । এখন সে ঢাকা অনেক চিনেছে । কিন্তু যার কল্যানে সে তো চলে গেল আজ বহু দূরে!
হমম, ভালোলাগা বোধহয় এত দ্রুত হয়না - এটা জানত রবিন । মাঝে একটা লম্বা সময় চলে গেল । কোন স্বাক্ষাতই নেই । লিজা নামে যে কাউকে রবিন চিনতো -এটা খোদ রবিনই জানতো না । কিন্তু বিধাতা বোধহয় মনে মনে হাসছিলেন । সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা তখন অত্যাসন্ন - ইংরেজীতে যাকে বলে 'নকিং অ্যাট দ্যা ডোর' অবস্থা । পি.এল চলছে ওদের । পি.এল মানে প্রিপারেটরী লিভ । বাংলায় পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক ছুটি । রোজ সকালে তাই অনেক দেরীতে ঘুম ভাঙ্গে রবিনদের । আর ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হবার আগে প্রথমেই ফেসবুকে ঢোকার বদ-অভ্যাস কোনদিনই ছাড়তে পারেনি রবিন । আগষ্টের সেই সকালটাও ব্যতিক্রম ছিল না মোটেই । লগইন করতেই ওর চোখে পড়লো একটা অ্যাড ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট । কে সেই মানুষ? - ভাবতে ভাবতে অবাক চোখে রবিন আবিস্কার করল, রিকোয়েস্টটা পাঠিয়েছে লিজা ।
অচেনা মানুষের রিকোয়েস্ট সাথে সাথেই ইগনোর করার পাত্র সে - হোক সে ছেলে অথবা কোন মেয়ে । কিন্তু যখন দেখল মিচ্যুয়াল ফ্রেন্ড ওরই বড় মামা- তখন রবিন বুঝে ফেলল, আরে এই তো সেই লিজা । সাথে সাথেই অ্যাকসেপ্ট করল ও । হায় রে রবিন!ওকি জানতো একদিন এই অ্যাকসেপ্টই তাকে দাঁড় করিয়ে দেবে আজকের এই হৃদয়-বিদারক দিনে । পরদিন ঘটল আরও মজার ব্যাপার, রবিনের সবগুলো ছবিতে কমেন্ট করেছে লিজা । সেই শুরু ... তারপর ফেসবুক, ইয়াহুতে চ্যাটিং - অবশেষে মোবাইলে কথা বলা, ম্যাসেজ পাঠানো ... রবিনদের ক্যাম্পাসেও একবার ঘুরতেও এসেছিল ও। কোন সময় যে রবিনের মনটা চুরিও করে নিল - জানতেও পারল না লিজা ।
প্রথমে রবিন অনেক ভেবেছিল । নাহ, এ হয় না । এ সম্পর্ক কেউ মেনে নেবে না । তবুও আশা ছাড়ল না ও । রবিনের রুমমেট বিপ্লব ব্যাপারটা বোধহয় কিছুটা হলেও টের পেয়েছিল । হাজার হলেও রুমমেট তো, কিছুই গোপন থাকে না । রবিন আর বিপ্লব যেন এক আত্মা দুই প্রাণ । এক্ষেত্রে বিপ্লবই সাহস যোগাল রবিনকে । পরিশেষে যেদিন ও লিজাকে মনের কথাগুলো জানালো সেদিন লিজা প্রথমে খুব অবাক হবার ভান করলেও পরে খুব স্বাভাবিক আচরণ করতে লাগল । সেদিন রবিন লিজাকে এটাও জানালো যে, সে যেন সরাসরি 'না' করে দেয় ব্যাপারটিতে যাতে ও সহজে যেন মেনে নিতে পারে । কিন্তু আফসোস! প্রতিবার এই প্রসঙ্গে লিজার উত্তর , "নাহ, আমি তো আপনাকে 'না' বলছি না ।"
এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত, লিজা সর্বদাই রবিনকে 'আপনি' বলে সম্বোধিত করতো । ঘটনাক্রমে এই 'আপনি' শব্দটাও 'তুমি' তে পরিবর্তিত হয়েছিল । কিন্তু লিজার মনে কি ছিল, কে জানে! সেই দিনগুলো বুঝি কোনোদিনই মুছে ফেলতে পারবে না রবিন । সেই স্মৃতিময় দশটা দিন। দামী ঘড়িটা যেদিন হারিয়ে গিয়েছিল সেদিন লিজার সে কি কান্না! তখন রবিনের খুব মায়া হচ্ছিল । বারবার ওর চোখের জল মুছে দিচ্ছিল সে। আর মনে মনে ভাবছিল, নতুন ঘড়ি কিনে দেবার কথা । কিন্তু ঐ মুহূর্তে যথেষ্ট টাকাও ছিল না রবিনের । বন্ধু বিপ্লবের কাছ থেকে টাকা ধার করে ওকে ঘড়ি কিনে দিয়েছিল রবিন । আর আজ সেই রবিনকেই ফিরিয়ে দিল সে ।
নাহ, আজ আর কাঁদবে না রবিন । অনেক কেঁদেছে সে । চোখে আর জল নেই । শুকিয়ে গিয়েছে বোধহয় । কার জন্য কাঁদবে ও? কেউ তো ওকে ভালোবাসে না । এখন নিজেকে খুব হালকা লাগছে ওর । এই পৃথিবী অনেক কঠিন । এখন থেকে ওকেও কঠিন হতে হবে । হতে হবে হৃদয়বিহীন পাথরের মত একজন মানুষ ।
[বি.দ্র. এই গল্পের প্রতিটি চরিত্র হয়ত কাল্পনিক, হয়ত সত্য । আজ আর ইমোটিকন দিলাম না । মনটা খারাপ তো তাই আর লিখতেও ইচ্ছে করছিল না । সবাই ভালো থাকবেন । শুভ রাত্রি । ]

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



