“বন্ধুরা তোমরা মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করো না। তারা ভাল ছেলে পেলেই বিয়ে করে চলে যায়।” – ফেসবুকে প্রেমিকার প্রতি এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করে আত্মহত্যা করেছেন নটরডেম কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ মিজানুর রহমান (১৯)। মিজানুর এর আবেগ এবং ভালোবাসার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান রেখেই আজকের এই লেখা।
একটা প্রজন্মের মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ‘প্রেম করা’। প্রেম যে আসলে করা যায় না, বরং সেটা হয় এই বোধটাই তাদের নেই। নিজেকে কৃত্রিম ভাবে উপস্থান করে, অন্যের চাওয়া অনুযায়ী বদলে প্রেমিক/প্রেমিকার মন রক্ষা করে। এভাবে অন্যের জীবনে প্রয়োজনীয় হওয়া যায়, অপরিহার্য হওয়া যায়না।
আমার মনে হয়, ভালোবাসার জন্য চাই “Proper & Prepared Mind” । Proper Mind প্রয়োজন কেননা, সবার সাথে প্রেম টা ঠিক হয়না। দু’জনের চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছে-অনিচ্ছার মধ্যে কোথাও একটা কমননেস থাকতে হয়। কারো চোখ দেখে, হাসি দেখে আপনি প্রেমে পড়তেই পারেন। তাতে সুন্দর সমাপ্তি হবে এমন নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না। মানুষ আসলে আশ্রয় খোঁজে। দিন শেষে হেলান দেয়ার জন্য একজন মানুষ চায়। আমার কাছে ঠিক মানুষ টা হচ্ছেন তিনি “ যার কাছে আমার বার বার ফিরতে ইচ্ছে করে। কারনে অকারনে। ভালোবেসে- অভিমানে, ঝগড়া আর আপোষে”।
Prepared Mind এর ব্যাখ্যা টা হলো, আপনাদের মধ্যে সব কিছুই ঠিকঠাক কিন্তু সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী হল না। খুব সিম্পল, হতেই পারে। কারন আপনি যাকে ভালোবাসেন তিনি হয়তো ভালোবাসার সম্পর্কের জন্য প্রস্তুত নয়। জীবনে “On Time” টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আগেও না পরেও না। লোহা নামক প্রয়োজনীয় ধাতু টাকে গরম করে- নরম করে ঠিক সময়ে শেইপ দিতে হয়। যাকে বলা হয় On Time । আগে কিংবা পরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলেও খুব একটা ফলপ্রসু কিছু হয়না।
বাছবিচারহীন ভাবে জীবনে কিছু গ্রহন করাটা মস্তবড় বোকামী। যাকে ধারন করতে পারবেন না তাকে গ্রহন করে “ ল্যাজেগবোরে করবেন না”। আকাশ যেমন চোখের মাপে হয় না, ঠিক তেমনি মনের মাপে মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়না। এই প্রজন্মের বড্ড তাড়াহুড়া। প্রেম তো করতেই হবে তাদের। এখনো হচ্ছেনা কেন! আরো ভয়ংকর কথা তাদের মধ্যে হারানো ভয় এক্কেবারেই নেই। ভালোবাসার মানুষ কে হারানো ভয় না থাকাটা অনেক টা ‘ব্রেক লেস’ গাড়ীর মত। উদাসীনতা থেকে আর যা কিছুই হোক; ভালো কিছু যে হয়না, এটা নিশ্চিত।
জীবন আমাদের অনেক কিছু দেয়। আপনি বলতেই পারেন মিজানুর এর জীবনে গত ২৩ তারিখ যেটা ঘটে গেছে সেখানে প্রাপ্তি কি? জীবনে অপ্রাপ্তির সবথেকে বড় প্রাপ্তি হলো ‘Lesson’। দিন শেষে, একটা ভ্রমন শেষে যেটা শিখলেন, সেটাই বা কম কি।
জীবনে একজন ভালো মানুষ দেখার আগে অনেক জন খারাপ মানুষ দেখা উচিৎ। তাহলেই আপনি বুঝতে পারেন “ আপনার জীবনে আসা ভালো মানুষ টা আসলে কত ভালো”। হুমায়ূন আহমেদ এর ‘চলে যায় বসন্তের দিন’ আমাকে যতটা হতাশ করেছে, তার থেকেও আরিয়ানা ফ্যালাচি’র ‘সুন্দর আগামীকাল আসবেই’ আমাকে অনেক বেশি অনুপ্রানিত করে।
মিজানুর তার স্ট্যাটাসের দ্বিতীয় লাইনে লিখেছে, “তারা ভাল ছেলে পেলেই বিয়ে করে চলে যায়”। ভাল’র প্রতি কার না লোভ থাকে বলুন। কিন্তু আমার ভাষায় বলতে চাই, “ প্রলোভন জয় করা কি সহজ পরীক্ষা?”। সামাজিক অবস্থান আর নিরাপদ ভবিষ্যতের মোহ কাটতে সম্ভবত খুব বেশিদিন সময় মানুষের লাগেনা। তারপর…… সারা জীবনের আফসোস। কত কাছের মানুষ, শুধু প্রলোভনের কাছে হেরে গিয়ে, কত সহজেই অচেনা হয়ে যায়। হেসে, ভালোবেসে, মন থেকে। সেই মানুষ টা কে মনে রাখা মানে তো শুধু কষ্ট পাওয়া।
মানুষ যখন ভালোবাসে তখন কেবল নিজের মনের কথা শুনে। আর যখন বিয়ে করে তখন তাকে পরিবারের সবার কথা মাথায় রাখতে হয়। তাই তো প্রেম - ভালোবাসা আর বিয়ের মধ্যে যোজন যোজন দুরত্ব। বাঙ্গালী পরিবারে ছেলেরা বাবার কথা না শুনিলেই, তাকে ‘ত্যাজ্য’ করে দেয়ার হুমকী দিয়ে পথে আনা হয়। আর মেয়ে কথা না শুনিলেই বাবা ‘হার্ট এট্যাক করেন’ তারপর ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইল করে তথাকথিত পথে আনেন। একটু ভাবুন তো আপনার বাবা-মা-ই যেখানে আপনার ভালোবাসা সম্মান করেন না, মেনে নেননা, স্বীকৃতি দেননা সেই আজন্ম পরিচিত গন্ডির বাইরে পরিমিত পরিচিত একজন মানুষ আপনা কে তার জীবনে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিবেন, আপনার জন্য সব কিছু কে অগ্রাহ্য করে চলে আসবে, সেই চাওয়া টা অনেক অনেক বেশি কিছু।
আমাদের জীবনে কিছু মানুষ আসেন, যারা ভালোবেসে থেকে যান আজীবন। তারা আমাদের জন্য “উপহার” স্বরূপ। আর কিছু মানুষ আসেন যার জীবন টাকে অগোছালো করে দিয়ে চলে যান নিজ গন্তব্যে। তারা আমাদের জন্য “ শিক্ষা কিংবা অভিজ্ঞতা”। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাবেন না, প্লিজ।
তারপরও কোনো একজন কে ভালোবেসে বলতে ইচ্ছে করে -
“তোমাকে পেতে ঈশ্বরকেও বেঁচে দেবো ওই খুচরো বাজারে…………………………”
(আর কোনো মিজানুর কে হারাতে চাই না। প্রবল অভিমানে হেরে গিয়ে হারিয়ে যাওয়াটা অন্যায়। ভালো থেকো তুমি। যেখানেই আছো এবার অন্তত ‘নিজেকে ভালোবেসো’।)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩৫