নুরজাহান মার্কেটের তিন নম্বর গেইটের পাশে একটা দোকান আছে যেটাতে নানান রকম মালা, দু্ল, চুড়ি আর আংটি পাওয়া যায়। দোকানটার কালেকশান বেশ ভালো। হাল ফ্যাশানের প্রায় সব ডিজাইনই সেখানে পাবেন। ফুটপাত ঘেঁষা ছোট্ট একটা দোকান। চলতি পথে দাঁড়িয়ে জাস্ট দেখার জন্য জিনিসগুলো দেখছিলাম।
পাশে দাঁড়ানো লম্বা, স্লিম, ফর্সা, চশমা পরা একটা ছেলে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে একটা মালা দেখলো। দোকানটাতে খুব বেশি দরদামের কোনো সুযোগ নেই। ছেলেটা দাম জিজ্ঞেস করে মালাটা প্যাকেট করতে বললো। দোকানদার ভেতর থেকে ইনটেক একটা মালা বের করে প্যাকেট করতে যাবে, এমন সময় ছেলেটি আপত্তি জানালো, "না, না, এটাই প্যাকেট করে দিন"। পকেট থেকে টাকা বের করে ২৫০টাকা মূল্য পরিশোধ করে প্যাকেটটা নিয়ে চলে গেল।
সহজ লভ্য ভালোবাসার এই শহরে যত্ন বড় দূর্লভ! ছেলেটার যত্ন নিয়ে মালা কেনা দেখে ভালো লাগলো বললে কমিয়ে বলা হবে। বেশ ভালো লেগেছে। মানুষ যে্খানে মুখোমুখি বসেও স্মার্ট ফোনে ব্যস্ত থাকে সেখানে অনুপস্থিত কারো জন্য এতো যত্ন করে সময় নিয়ে কোনো কিছু করা দেখতে ভালো লাগে।
ভালো থাকুক যত্নেরা, কাছাকাছি-পাশাপাশি......... চিরদিন !!!
#@#@#@#@#@#@#
সন্ধ্যা পেরোনোর বেশ খানিকটা পরে নীলক্ষেত সিগন্যাল থেকে মিরপুর লিংক বাসে উঠি, গন্তব্য বাসা। ড্রাইভারের পিছনে চতুর্থ নম্বর সিটের ডান দিকে জানালার পাশে আরাম করে বসলাম। জানালা খুলে দিয়ে কানে হেডফোন গুজে বাইরের রাস্তা দেখতে লাগলাম। একমেয়ে এসে পাশে বসে। মিনিটখানিকের মাথায় আমার হাতে মৃদু স্পর্শ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপু আপনার কাছে ৫০০টাকা ভাংতি হবে? ভাংতি টাকা নেই কিভাবে বাস ভাড়া দিবো?’। আমি সান্ত্বনা দিলাম, সুপার ভাইজার টাকা ভাংতি করে দিবে চিন্তার কিছু নেই। এবার মেয়েটি ব্যাগ থেকে স্মার্ট ফোন বের করে ফটোগ্যালারিতে গিয়ে নিজের ছবি এডিট করা শুরু করলো। তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটা সুশ্রী, চেহারার মধ্যে টিন-এজ ব্যাপারটা আছে।
বাসে যাত্রী উঠছে, সিগন্যাল তখনও চলছে। বাসে উঠলো এক ছেলে। ৯০দশকের ইন্ডিয়ান মিউজিক ভিডিওর নায়কদের মতো দেখতে। চেক শার্ট, মাথা ভর্তি চুল, কানে সাদা রংযের হেডফোন গোজা। বয়স ২৩/২৪ হবে। বাসে উঠেই একটা রয়্যাল লুক দিলো। পুরো বাসে চোখ বুলিয়ে নেয়া যাকে বলে। ইতোমধ্যে সব সীট যাত্রীদের দখলে। অগত্যা ছেলেটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। ছেলেটি দাঁড়ালো আমার পাশে বসা মেয়েটির পাশে। সেখান থেকে অনায়েসে মেয়েটির সেলফোনে ছবি এডিটিং দেখা যাচ্ছে।
সুপারভাইজার ভাড়া নিতে আসলে, মেয়েটি ৫০০টাকার নোটটি বের করে দিয়ে জনালো তার কাছে তো ভাংতি নাই! সুপার ভাইজার পরে ভাড়া নিবে বলে পেছনের দিকে ভাড়া কাটতে চলে গেলো। মিনিট ১৫ পর ফিরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো মামা ভাংতি নিবেন না? আমি পাশের জনকে দেখিয়ে দিলাম। সুপারভাইজার তাকে ৪টা ১০০টাকার নোট, ১টা ৫০টাকার নোট, ২টা ২০টাকার নোট এবং ১টা ১০টাকার নোট ফেরত দিলো। মেয়েটা বললো ভাড়া রাখেন, সুপারভাইজার হেসে দিয়ে জানালো ভাড়া হেই মামা (পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি) দিয়ে দিয়েছে। এবার আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না।
মেয়েটি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে জানতে চাইলো, আপনি ভাড়া দিয়েছেন কেন? ছেলেটি জানালো, আপনার কাছে ভাংতি ছিলো না তাই। মেয়েটা মোবাইলে টিএসসিতে বৃষ্টিতে ভিজে তোলা ছবি এডিট করতে মনোনিবেশ করলো। মিনিট খানিক বাদে বললো কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনি না। ছেলেটি বললো, সমস্যা নাই আপনার কাছে ভাংতি হলে আমাকে দিয়ে দিয়েন। মেয়েটি পার্স খুলে ৩০টাকা দিলো। ছেলেটি ৫টাকা ফেরত দিলো। মেয়েটি একটু উচু স্বরে বললো, ‘লাগবেনা, রেখে দেন’। সৌভাগ্য বসত ছেলেটি অপজিটে একটি সিট পেয়ে বসলো।
মেয়েটা সেলফোন রেখে আমার অনেক সাথে গল্প করলো। সম্ভবত সে গল্প করতে পছন্দ করে। নাম অদিতি। বিবিএ প্রথমবর্ষ দ্বিতীয় সেমেস্টার। এইচএসসিতে তার রেজাল্ট আশানুরূপ হয়নি তারপরও সে ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। কোচিং এর একভাইয়ের কাছে প্রাইভেটে পড়তো, সেই ভাইয়া ডিপার্টমেন্ট চুস করে দিয়েছে। দুই ভাইবোন। বাবা রিটায়ার্ট করেছেন, মা শিক্ষকতা করেন। হলে এখনো সিট পায়নি, শামীম স্মরনীতে খালার বাসায় থাকে। তার ব্যাচ থেকে তিনজন শিক্ষক নেয়া হবে। প্রায়শ সকালের ক্লাস ধরতে পারে না, দেরি হয়ে যায়। ভার্সিটির বাস মিস করে। আর দুপুরের খাবার একেক দিন একেক হলের ডাইনিং-এ খায়।
খেয়াল করলাম ছেলেটা তালতলা বাস স্টপেজে নেমে গেল। মেয়েটা নামলো শামীম স্মরনী। আমি বাকি পথটুকু মনে মনে গল্প সাজালাম। ভার্সিটির বাস স্টপেজে তাদের দেখা হয়ে যাবে, তারপর আলাপ। দিন-মাস বছর গড়াবে। তারপর কোনো এক অলস দুপুরে তারা এই ভাড়া দেয়া-নেয়া নিয়ে একজন আরেকজনকে পিঞ্চ করবে। বিষয়টা এমন হলে মন্দ হয় না কিন্তু………………… অথবা আমি চাই এমনটা হোক।
দুজন অচেনা মানুষের জন্য শুভ কামনা।
#@#@#@#@#@#@
গুলিস্তান পৌঁছালাম যখন ঘড়ির কাটা দুপুর ৩টা ২০ এর ঘরে। কাউন্টারে ৩:৩০এর সব টিকেট বিক্রয় হয়ে গেছে। অগত্যা ৪:৪০এর টিকেট কেটে কাউন্টারের পাশে একটা টুলের উপর বসি। একরাশ আনন্দ দিয়ে ঠিক সময়ে বাস ছাড়লো। পাশের সিটের সহযাত্রী নারী, বয়স ৩৭/৩৮; সরকারি চাকরি করেন। দেখতে সুশ্রী। পাশে বসে বার দুয়েক করা বান্ধবীর সাথের কথোপকথনে বুঝলাম অফিস মিটিংয়ে অংশ নিতে ঢাকা এসেছেন। সময়ের অভাবে বান্ধবীর বাসায় যেতে পারেননি।
৬ঘন্টার ভ্রমনে আমাদের মধ্যে ২/১টা প্রয়োজনীয় কথা হয়। সহযাত্রী ঘুমাতে বেশ পছন্দ করেন। সেলফোনে কল আসলে জেগে উঠে কথা বলে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। বাসা থেকে অন্তত ৪বার কল আসলো, ওপাশ থেকে ছেলে জানতে চাইছে 'মা কখন ফিরবা?'।
বাস থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নামার মিনিট বিশেক আগে ভদ্র মহিলা ব্যাগে রাখা একটা আপেল খেতে খেতে দুটো নম্বর কল লিষ্ট থেকে ডিলিট করে দেন। একটা ফারুক ভাইয়া নামে সেভ করা অন্যটা ফয়সাল নামে। বাসের আধাঁরে সেলফোনের উজ্জ্বল স্ক্রিনে চোখ চলে যাওয়াতে দেখলাম।
চারপাশের ছোট ছোট ঘটনা গুলোকে জীবনের সাথে রিলেট করার চেষ্টা করি। আচ্ছা, জীবনের এই সম্পর্কগুলো কী খুব জরুরি যেগুলো কল লিষ্ট থেকে ডিলিট করে দিয়ে বাসায় ফিরতে হয়। কিংবা আমরা এমন সম্পর্কে কেন থাকি যেখানে নিজের নাম কল লিষ্ট থেকে ডিলিট হয়ে যায়।"রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত" সিনেমাতে বুলবুল আহমেদ এর একটা ডায়লগ আছে, ‘যাকে বাইরের দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়, তাকে মনে ঠাঁই দাও কি করে!’
ভাবতে হবে....
#@#@#@#@#@#@
বেলা ১১টার দিকে বন্ধুকে কল দিলাম,
কিরে কেমন আছিস?
গরীব আছি।
অনেকদিন তোকে দেখি না, বিকালে ইয়ালো ক্যাফেতে চলে আয়।
খাওয়াবি?
হুম কাঙ্গালি ভোজের আয়োজন করছি।
আচ্ছা, বিকালে হাজির হবোনে।
মিনিট পাঁচেক বাদে বন্ধুর কল;
বান্ধবী একটা বিরাট সমস্যা হয়ছে।
কী?
একটা সোয়েটার আর একটা চাদর বাদে আমার তো সব কাপড় ময়লা।
আমি এখন অফিসে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছি। ফোনটা রাখ।
দুই মিনিট পরে;
বান্ধবি, আমি কি একটা ময়লা গেঞ্জি পরে তার উপর চাদর গায়ে দিয়ে আসবো? মনে কর, সকালে তো ঝড় বৃষ্টি হইছে। একটা মানুষের তো শীত শীত লাগতেই পারে।
আমি খুবই ব্যস্ত আছি। ফোন রাখ।
আরে শোন না, আরেকটা অপশন আছে। আমি সোয়েটারটা গায়ে দিয়ে আসি। দামী জায়গায় খাওয়াবি। ওয়েটাররে বইলা এসির ঠান্ডাটা একটু বাড়াই নিলাম। আরামসে দুই-তিন ঘন্টা গল্প করা যাবে। আর মনে কর যে, বাইর হওনের আগে তুই আমারে একটা শার্ট গিফট করলি, ঐটা পইরা রিকশা চইড়া বাসায় চলে আসলাম।
আগামি ছয় মাস তুই আমারে কল দিবি না। আর আজকের দাওয়াত ক্যানসেল।
তাইলে তুই কল দিলে কি ধরবো?
নাআআ
#@#@#@#@#@#
আমার বর্তমান ঠিকানা যেখানে সেখানে কিছু আসবাবপত্রের শোরুম আছে। নির্ধারিত স্টপেজে ঠিক একই জায়গায় রোজ কিছু সময় (মিনিট কয়েক) জ্যামে বসতে হয়। বাসের বাদিকের জানালা দিয়ে আমি আগ্রহ নিয়ে আসবাব দেখি।একসেট সোফা যেটা কালো রংয়ের ভেলভেটের কাপড় দিয়ে মোড়ানো, প্রতিদিন খুব মনোযোগ দিয়ে দেখি। কতদিন সোফাসেটার সাথে দেখা হয়েছে হিসেব রাখিনি। হঠাৎ সেদিন দেখি সেটটা নেই। সেখানে অন্য সোফা। বুকের ভেতরটা একটু হাহা করে উঠলো। রোজ দেখতাম তো তাই মায়া পড়ে গিয়েছিল। বিনা নোটিশে বিদায় বলেই হয়তো ঐ হাহাকারটুকু হয়েছিল। এখন আর দোকানটার দিকে আমি তাকাই না। হুট করে যেকোনো বিচ্ছেদই খারাপ সেটা হোক সোফাসেট কিংবা ভালোবাসার মানুষ!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০২১ রাত ১০:২৭