‘প্রেম আর অপ্রেমের মাঝখানে
হাঁ ও না-এর মাঝখানে অনেক কিছু থাকে।
প্রেমিক মাত্র জানে
প্রেম আর ঘৃণার মাঝখানে বহুকিছু থাকে।
বোধের সমুদ্রে ভাষা,
এক ফোঁটা অশ্রুর মত মিশে যায় মাঝে মাঝে।
এক লক্ষ সূর্যের আলোতে দেখা না দেয়া এমন অন্ধকার কিছু থাকে। ...
প্রেমিক মাত্র জানে
প্রেম আর অপ্রেমের মাঝখানে
বহু কিছু থাকে ...’
পাঠকের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, হুমায়ূন আহমেদের লেখা কোন বইটা আপনার সবথেকে প্রিয়? আমার মতো অধিকাংশ পাঠকই উত্তরহীনতায় ভুগবেন বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর লেখা প্রায় ২০০টা বইয়ের মধ্যে কম করে হলেও অর্ধেক বই আমার প্রিয়’র তালিকাভুক্ত। একতৃতীয়াংশ ভীষণ প্রিয়। একদশমাংশ নিয়ে আমি নির্বাসনে যেতে চাইবো। সঙ্গ পেতে চাইলে লেখকের চেয়ে ভালো কোনো সঙ্গ হয় না। আর হুমায়ূন আহমেদের মতো কথার জাদুকর হলে তো কোনো কথাই নাই।
লেখক হুমায়ুনের আগে নাট্যকার হুমায়ূনের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের নিয়মিত দর্শক হিসেবে আমার পরিচয় শিশুদর্শক হয়ে। প্রাথমিকের গন্ডি তখনো পেরোনো হয়নি তবে ঠিকই ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। চরিত্রগুলোকে বোধহয় ভালোও বেসে ফেলেছিলাম। এখনো আমি মনে মনে মুনা চরিত্রটির জন্য শুভকামনা করি। বাকের ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা কিংবা আফসোস করি। মুনার ‘আমি তার কেউ না’ কথাটার মানে তখন না বুঝলেও এখন বোধহয় বুঝি! ‘কোথাও কেউ নেই’ এর পর একে একে নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার, সবুজ সাথী, উড়ে যায় বক পক্ষী প্রভৃতি নাটক তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
মধ্যবিত্ত সমাজের গল্প নিয়ে করা প্রথম চলচ্চিত্র ‘শঙখনীল কারাগার’ (১৯৯২) এবং মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক দ্বিতীয় চলচ্চিত্র আগুনের পরশমনি (১৯৯৪) যখন মুক্তি পায় তখন এদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে চলছে পরিবর্তনের হাওয়া। পরিচয় ঘটে পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের সাথে। সাবলীল অভিনয়, সাধারণ সিনেমেটোগ্রাফি আর দুর্দান্ত সংলাপ উপভোগ করেছিলাম পরিবার পরিজন মিলে সিনেমা হলে বসে। নব্বই দশকের হালের নতুন মুখের রোমান্টিক ঘরানার চলচ্চিত্রের বাইরের এবং ভিন্নধারার এই দুটি চলচ্চিত্র জয় করে নেয় দর্শক হৃদয়। পায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এই মাধ্যমেও হুমায়ূন আহমেদ রেখেছেন তার প্রতিভার স্বাক্ষর। নির্মাতা হুমায়ূন চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে গানও লিখেছিলেন।
লেখককে বাঁচিয়ে রাখেন পাঠক। আর পাঠক সত্ত্বাকেও ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন লেখকরা। ঢাকার বাইরে বড় হওয়া এই আমার জন্য জাগতিক সীমাবদ্ধতা যেমন ছিল তেমনি ছিল মানবীয় উদারতা। খুব বেশি গল্পের বই, পাঠক পাঠাগার তখন ছিলো না। ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাটিকে তাই দ্বিধাহীন ভাবে পরিচিত গন্ডিতে ভাগাভাগি করে নিতে শিখেছিলাম আমরা। ঢাকার বাইরে কমবেশি সব বাসাতেই আপনি হুমায়ূনকে পাবেন। শোকেসে সাজানো হাতেগোনা কয়েকটা বইয়ের মধ্যে মুচকি মুচকি হাসছে তার দুএকটি করে বই। তাই গল্পের জাদুকরকে খুঁজে আনতে হয়নি, লেখার জাদুর বলেই লেখক হুমায়ূনের সাথে পরিচয় হয় আমাদের। সেই পরিচয়ের কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই বলে আলাদা করে দিন তারিখের বালাই নেই। হাতে কাছে পেয়ে যেতাম বলে পড়া শুরু করেছিলাম। অতঃপর বই মেলা থেকে কিনে এবং বান্ধবীদের কাছ থেকে ধার করে পড়া। প্রথম মুগ্ধতা না পড়েই, ৯৪ সালের দিকে আমার বড়বোন তার বইয়ের ভাঁজে তিথির নীল তোয়ালে নিয়ে পড়ছিল। নামটা কি সুন্দর! খুব পছন্দ হয়েছিল। তিথির নীল তোয়ালে কিংবা তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে। তখনও সেসব বই বড় হয়ে পড়তে পারার দূরত্ব নিয়ে বসবাস আমার।
৮০ কিংবা ৯০ দশকে যারা নতুন পাঠক কিংবা সাহিত্যের জগতে পথ চলতে শুরু করেছেন তাদের অনেকেরই প্রথমদিককার পড়া বইয়ের তালিকায় থাকেন হুমায়ূন। লেখার ভাষা, পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতা, হিউমার, আবেগঘন অনুভুতির প্রকাশ, খুব টাচি সংলাপ, মানুষের অন্তর্গত সৌন্দর্যের সন্ধান, জটিলতা মুক্ত সাধারণ চরিত্রের সহজবোধ্য উপস্থাপন পাঠককে দেয়া পড়ার আনন্দ। হুমায়ূনের বইয়ের প্রথম প্যারাগ্রাফটা আপনাকে স্বাগত জানাবে একটা গল্প পাঠে। সংলাপ নির্ভর গল্পে পরিমিত বর্ণনা আর চরিত্র চিত্রণে বাংলা সাহিত্যে তিনি অদ্বিতীয়। সহজবোধ্য জীবনযাপন এবং পরিচিত আবহ উপস্থাপন। চরিত্রগুলো আন্তরিক এবং সরল। বাঙালী চরিত্রে অবচেতনভাবে থাকা রোমান্টিসিজম এবং বাউন্ডুলে হতে চাওয়ার ইচ্ছা ভালো মতো ধরতে পারা এবং তা লেখায় তুলে আনা। ছিল বহুমুখী প্রতিভার ইমেজ।
দ্বন্দ্বকে পাশ কাটিয়ে তিনি লিখে গেছেন নিরন্তর। রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি থেকে যোজন দূরের হুমায়ূনের বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবনতাও লক্ষ্যনীয়। চরিত্রগুলো অন্ধকার দিক কখনোই উঠে আসেনি তার লেখায়। খেয়ালী লেখকের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর বেশিরভাগই খেয়ালী।অতিপ্রাকৃ্ত বিষয়গুলোকেও তুলে এনেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। তবে এই নন্দিত লেখক ঠিকই পাঠকের মনের রসায়নে রেখেছেন স্থায়ী দাগ। তার অনবদ্য সৃষ্টি হিমু, শুভ্র আর মিসির আলী চির অম্লান। যদিও তিনি লেখক হিসেবে নারী চরিত্রদেরকে কেবল অনুসঙ্গ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এবং খুব বেশি নারীচরিত্রকে কেন্দ্রিয় চরিত্র হিসেবেও পাওয়া যায় নি।
সমাজ পরিবর্তন নয় বরং দিনের পর দিন মধ্যবিত্ত পারিবারিক জীবনের গল্প বলে পাঠককে মুগ্ধ করে রাখা হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কের সংলাপ লিখে গেছেন, সম্পর্কের গভীরতা সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট করে লিখে যান নাই। সম্পর্কের অমিমাংসীত দুঃখবোধ নিয়ে লিখেছেন, সুখ খোঁজার রাস্তার সন্ধান দেননি। উপেক্ষা সহ্য করে অপেক্ষা করার অপরিসীম সাহস দিয়েছেন, নির্দিষ্ট করে সময়ের কোনো সীমারেখা টেনে দেননি। কিছু উপন্যাসে ডিটেইলস নেই এবং তার নির্মিত খুব বেশি চরিত্র ডিপ রুটেড না।
একটা গবেষণার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে পুরনো ম্যাগাজিন ঘাটতে গিয়ে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকাটির একটা প্রছদে আটকে গেলাম। ‘গুলতেকিনের সংসারে হুমায়ূন’। খানিকটা সময় হাতে নিয়ে গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম সাক্ষাৎকারটি।
গুলতেকিন খান আমাদের প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী। যাকে পাঠক চিনতেন গুলতেকিন আহমেদ নামে। গুলতেকিন সেই ব্যাক্তি যিনি প্রেমিকা, বন্ধু এবং স্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে। একজন খ্যাতিমান ব্যক্তির জীবনসঙ্গী হওয়ার আনন্দ ও বেদনাও তাকেই অনুভব করতে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বিড়ম্বনাও।
গুলতেকিন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের লেখার প্রথম পাঠক, নির্ভার আশ্রয়, সবথেকে বড় অনুপ্রেরণ এবং একনিষ্ঠ সমালোচক। খেয়ালী ব্যস্ততা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সৃষ্টিতে মগ্ন। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র, গান রচনা সবখানেই রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। গুলতেকিন একসময় লিখতেন। পরে বিয়ে, সংসার, বাচ্চা সামলে লেখালিখি থেকে দূরে থাকেন।
নিয়মিত এবং সংক্ষিপ্ত কলেবরের উপন্যাস/গল্প লিখে যাওয়া হুমায়ূন আহমেদকে কখনো দীর্ঘ বিরতিতে যেতে দেখা যায়নি। এক বা দুই রাতের মধ্যে একটা উপন্যাস লিখে শেষ করতেন। আশেপাশেই থাকতেন গুলতেকিন। কখনো একটি একটি পাতা লেখা শেষ হতো আর পড়ে দেখতেন তিনি। কখনো গোটা পান্ডুলিপিটা স্যার রেখে দিতেন ডাইনিং টেবিলের উপর। যেখন সকালবেলাতেই গুলতেকিন সেটা পড়তে পারেন। পরে এই পান্ডুলিপি পড়ার দায়িত্ব নেন মেঝ মেয়ে শীলা।
সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না লেখক। প্রথমে রেগে যেতেন এবং তর্ক জুড়ে দিতেন পরে গুম হয়ে বসে থাকতেন। কিছুক্ষণ পরে লেখা নিজেই চেঞ্জ করতেন লেখক বা হয়তো দশ/বারো পৃষ্ঠার লেখা ছিঁড়েই ফেলতেন। তাই গুলতেকিন মন্তব্য করতেন বুঝেশুনে। মাঝে মধ্যে পরিকল্পনার বাইরে বেরিয়ে উপন্যাস শেষ করতেন হুমায়ূন আহমেদ। লিখতে লিখতেই নাকি শেষটা অন্যরকম হয়ে যেত। ‘হুমায়ূন বলতেন কেউ একজন তাকে দিয়ে এভাবে উপন্যাস শেষ করিয়ে নেয়’।
পাঠকের আক্ষেপ দিয়ে লেখাটার ইতি টানছি। দীর্ঘদিনের প্রেমিকা, বন্ধু এবং স্ত্রী (সাবেক) গুলতেকিন খানকে বলেছিল তাঁর (হুমায়ূনের) জীবনী লিখতে। বলেছিলেন, ‘তুমি তো আমাকে খুব কাছ থেকে জানো। কাজেই আমার সম্পর্কে আমার ভাল, মন্দ সবকিছু তুমিই সবচেয়ে ভালভাবে লিখতে পারবে’।
বিচিত্রা: হুমায়ূন আহমেদের পাঠকদের জন্য খুব ইন্টারেস্টিং হবে সেটা?
গুলতেকিন: হ্যাঁ হবে। পড়াশোনা শেষ হোক আগে আমার। তারপর লিখবো হয়তো। এখনো তো অনেক সময় বাকী আছে’।
মানুষগুলো হারিয়ে যায় কিংবা লুকিয়া যায়, কিন্তু চাওয়াগুলো তো আর হারায় না। আমরা কি তেমন একটা অকপট লেখনীর মধ্য দিয়ে স্যারের জীবনীটা পেতে পারি একবার?
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১:০৬