somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবার একমাত্র ছোটমেয়ে বলছি…

২১ শে জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দুপুরে খাওয়ার সময় পিতৃদেবকে জিজ্ঞেস করলাম, আব্বু আলমারির কোন ড্রয়ারে তুমি টাকা রাখো? আব্বু খুব স্বাভাবিকভাবে জানতে চাইলেন, কেন? আমি তৎক্ষনাত উত্তর দিলাম- চুরি করবো। রিখটার স্কেলে ৭মাত্রার ভূমিকম্প হলে সবকিছু যেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায়; সবাই চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন আমি 'মানি হেইস্ট' সিরিজের মূলচরিত্র। সে যাই হোক, আব্বু বললেন, কত টাকা লাগবে। আমি দ্বিগুন উৎসাহে বললাম, ব্যাপারটা লাগবে'র না, ব্যাপারটা হলো আমার বন্ধু-বান্ধব সবাই বাপের পকেট থেকে টাকা চুরি করছে; এমনকি আমার ছাত্র-ছাত্রীরাও করেছে। শুধু মনে হয় আমিই করিনি। আব্বু হাসিহাসি মুখে বলে দিলেন, আলমারির বাম দিকের দ্বিতীয় ড্রয়ারে। ঠিক সেই সময়ে অতর্কিত আমার মা-জননীর চিরুনী অভিযান শুরু। আগেই বলেছি আমার মাজননী আমার ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতায় তিলকে তাল বানায়, সেই তাল চটকে তালের বড়া বানায় এবং শেষপর্যন্ত আমাকেই সেই বড়া খেতে বাধ্য করেন। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার সুরে শুরু করলেন তার মূল্যবান বক্তব্য- এখন বাপের টাকা চুরি করবা, কয়দিন পরে বলবা আম্মু তোমার গয়নার বাক্সটা কোথায়; আমার এখন গয়না চুরি করতে ইচ্ছে করতেছে। মানুষের ছেলেমেয়ে দিনে দিনে ভদ্র সভ্য হয়, মানুষ হয় (ক্ষেত্রবিশেষ রাষ্ট্রপতিও হয়) আমি হচ্ছি বেয়াদব! অথচ মাস ছয়েক আগে আমার কম্বলের নিচে শুয়ে এই মাতৃদেবী বলেছিলেন, তোমার সবকিছু তোমার আব্বুর কপি। চেহারা, কথা-বার্তা, বিবেক-বুদ্ধি, ধৈর্য-সম্মান সব। আর আজ আমি কী হলাম? বেয়াদব! আচ্ছা কোন সিরিজের নায়িকা সব থেকে বেশি পাল্টি খায় আপনারা জানেন?

আমার পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে বাবা-মা জন্য সারপ্রাইজ শপিং ডে থাকে। সন্তান বড় হলে তাদেরও তো কিছু করার আছে। তো এই রকম শপিং-ডে আসলে সেইদিনই আমার আব্বুর বাইরে যাওয়ার মুড থাকে না। ঐদিন দুপুরে না ঘুমালে তাঁর হবেই না। করোনা সংকটের আগে শেষ সারপ্রাইজ শপিং ডে গেছে জানুয়ারী মাসে। দুপুরে খাবার টেবিলে বললাম, আব্বু-আম্মু আজকে আসরের নামাজ পড়ে আমরা শপিংয়ে যাবো। আব্বুর সেই বিখ্যাত রেস্ট নেয়ার বাহানা। আর মা-জননী? আমার মধ্যবয়সী মাজননী মূহূর্তে কিশোরি হয়ে যায়। আব্বুর দিকে তাকিয়ে, এই লোকটার নিজেরও কোনো সাধ আহ্লাদ নাই, অন্যদের ব্যাপারেও তাই। আমার বাপ অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবে, ‘যার তিন-তিনটা ছেলে মেয়ে সেই মহিলার সাধ-আহ্লাদ অপূর্ণ থাকলো কোথায়!’

আব্বুর পেটে একটা লাল তিল আছে। ছোট বেলায় আমার সমস্ত বিস্ময় ছিলো এই তিলটা। খব ছোট্টবেলা বাপের পেটের উপর শুয়ে শুয়ে খেলা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক রুটিন। জীবনের সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমি বাবার হাত ধরে গেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বিভাগ এবং হলের তিন্প্রস্থ স্লিপটা আব্বুর হাতে পূরণ করা। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে জনতা ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার সময়ও আব্বু পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সারাক্ষণ। আমি ক্যাডেটে পরীক্ষা দিয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে আব্বুর কেন জানি মত বদলে গেলো ভর্তি করা্লেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপর চুপিচুপি বলেছিলেন চেষ্টা করে দেখতো শিক্ষক হতে পারো কিনা। বিসিএস এর প্রলোভন জয় করে শিক্ষক হয়ে স্বীকার করছি শিক্ষকতা পেশায় না আসলে জীবনটা বোধহয় অপূর্ণ-ই থেকে যেত। আব্বু সবসময় বলেন আমার ছোট মেয়েটার (আমি) খুব পড়াশোনার শখ। ও যতদূর পর্যন্ত পড়তে চায়, ওকে আমি পড়াবো। এবার বুজচ্ছেন তো, আমার মেরুদন্ডটা এত শক্ত কেন?

‘হেমলোক সোসাইটি’ সিনেমায় নায়িকা কোয়েল তার বাবার সাথে থাকে না, কারণ কোয়েলের মায়ের মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। কোয়েলের বাবা সেখানে খুব সুন্দর একটা ডায়ালগ দিয়েছেন, ‘বঙ্গ সমাজে সন্তানরা বাবা-মাকে নিজেদের সম্পত্তি ভাবে। অথচ তারা ভুলে যায় বাবা-মায়েরও নিজস্ব একটা জীবন আছে। এবং সেই জীবনে তাদেরও সঙ্গ/সঙ্গী দরকার হতে পারে’। ডায়ালগটা আমার খুব প্রিয়। যেমন প্রিয় কবির সুমনের গাওয়া ‘যতবার তুমি জননী হয়েছো ততবার আমি পিতা, কত সন্তান জ্বালালো প্রেয়সী তোমার আমার চিতা। বারবার আসি আমরা দু’জন বারবার ফিরে যায়, আবার আসবো আবার বলবো শুধু তোমাকেই চাই’।

আনন্দ-আবদার ছাড়া আমি, অনেকটা চিনি ছাড়া চায়ের মতো। সবসময় আব্বা-আম্মাকে মনে করিয়ে দিই আমি তাদের একমাত্র ছোট্ট মেয়ে। জানুয়ারীতে বাসা থেকে আসার দিন দুয়েক আগে দুপুরে খাবারের টেবিলে বললাম, ঢাকা ফিরে গেলে আমার কলিগরা জিজ্ঞেস করবে, আংকেল আপনাকে কী কিনে দিলো আমি কী বলবো আব্বু? আব্বু ভাত মাখা বন্ধ করে অবাক হয়ে বললেন কী বলবা! আমি বললাম সেটাই তো জানতে চাচ্ছি, আমি তাদেরকে কী উত্তর দিবো। আব্বু বললেন আচ্ছা ভেবে দেখি। বিকেলে আম্মুকে বললেন, আমার ছোট মেয়েকে সাথে নিয়ে আড়ং থেকে একটা ড্রেস কিনে নিয়ে আসো। আমি বললাম, আর গোলাপী রঙের জুতা? আচ্ছা একজোড়া জুতাও কিনে দিও।

প্রতিবছর বাবা দিবস আসলে সবাই দেখি সোস্যাল মিডিয়াতে বাবার সাথে ছবি দিয়ে খুব ভালো ভালো কথা লিখেন। অথচ কজন সন্তান বাবার হৃৎপিন্ডের আওয়াজ শোনার জন্য তাঁর বুকে কান পাতেন? বাবাদের বুকের মধ্যে না বলা অনেক কথা থাকে, শোনার এবং বোঝার চেষ্টা করা তার সাথে সোস্যাল মিডিয়াতে ছবি দেয়ার চেয়েও জরুরি। নিজের অর্জন-উপার্জন দ্বারা বাবাকে সম্মানিত করুন। স্রষ্টার মানবিক সত্ত্বা হয়ে যিনি আমাদের আগলে রাখেন তাঁর জন্য জীবনের সেরাটুকু করা চাই-ই চাই।

বি. দ্র. ছবিটা খুব মন ছুঁয়েছে। Memorio এর পেজ থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৯:২৮
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×