দিনের শেষ কাপ চায়ের সাথে বসে, সারাদিনের একটা বোঝাপড়া নিজের সাথে করি। নিখুঁত মাপ জানা দর্জির মতো, ঘটনাগুলোকে মেপে, কেটে, ছেঁটে স্মৃতিতে রেখে দিই।
বলা হয়, যে মানুষ একা টেবিলে বসে খেতে পারেন তিনি ব্যক্তি জীবনে ভীষণ দৃঢ় মানুষ হন। আমি বহুদিন একা একা ঘুরি- একাই খেতে বসতে পছন্দ করি। অবশ্য এবছরই জীবনে প্রথম বার আমাকে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সাথে টেবিল শেয়ার করতে হয়েছে। প্রথমবার আমি অন্যের টেবিলে বসেছি, দ্বিতীয়বার অন্য কেউ আমার টেবিলে। এমন না মুখে স্কচটেপ এঁটে গোগ্রাসে খাবার খেয়ে উঠে এসেছি। ধীরে সুস্থে গল্প করতে করতে খাবার খেয়েছি। এবং দুটো অচেনা মানুষ যাদের ঠিকানা আমার অজানা তাদের কিছু ব্যক্তিগত আলাপ স্মৃতিতে রয়ে গেল।
এই পৃথিবীর সব মানুষই যার যার রাস্তায় নিজের মতো করে চলতে চায়; অনেকে পারে, অনেকে পারে না। সমাজের সেইসব 'না-পারা' বেশিরভাগ মানুষের আত্ম-জিজ্ঞাসা গুলো এমন, যেমন:
কেনো আমরা যা চাই সে অনুযায়ী সবকিছু ঘটে না?
কেনো একাকিত্বে ভুগতে হয়, কেনো কষ্ট পেতে হয়?
কেনো আমাকে নিঃসঙ্গ জীবন পার করতে হচ্ছে?
বাড়িতে কথা বলার সময় কেনো কেবল নিজের কন্ঠস্বরই শুনতে পাই?
ঠিক কী কারণে নীরবতার মধ্যে আমি আমার শব্দ হারিয়ে ফেলি?
কেনো বাড়িতে সবসময় কেবল নিজের পদচারণার শব্দ কানে বাজে?
কেউ কেনো ভালোবাসার কথা শুনতে চায় না?
হুমায়ুন আহমেদ এর 'কোথাও কেউ নেই' কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'কেউ কথা রাখেনি' আসলে এখন ওল্ড স্কুল। প্রত্যেকের হাতের স্মার্ট ফোন আছে। যা আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। সম্ভবত এই ক্ষুদে কালো বাক্সটিই একমাত্র বস্তু যা আমরা সারাক্ষণ বয়ে নিয়ে বেড়াই। আর এটির ব্যবহারে এত্তো এত্তো নাটকীয়তা যুক্ত হয়েছে যে, প্রায় সময় নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের বিষয়টি আমাদের মাথাতেই থাকে না।
সোস্যাল মিডিয়া বা ফেইসবুকে একটা একাউন্ট থাকলেই আর কেউ একা নই। ভার্চুয়াল জীবনকে সাধারণ চোখে দেখলে মনে হয়, এই জীবনে নেই কোনো সংকট, মাথার ওপর নেই কোনো কাজের চাপ, চিন্তার ছাপ! আছে কেবল আনন্দ, উৎসব, অনাবিল স্বাধীনতা! প্রযুক্তির এই যাদুর ছোঁয়া বাস্তবকে পাশ কাটিয়ে চলার চর্চাটাও শেখাচ্ছে।
পৃথিবীতে আমি সব থেকে ভয় পাই প্রিয় মানুষদের মুখে চাতুর্য্যতা পূর্ণ কথা। তাই বন্ধুত্বের সম্পর্কেও দূরত্ব বজায় রাখা শিখছি। যে মানুষগুলো বন্ধুত্বের পথ ধরে মন পর্যন্ত পৌঁছে, তাদের চাতুর্য্যের কারণে বিদায় জানাতে হয়।নিরবতার সাথে স্মিত হাসি দিয়ে বুঝিয়ে বলি 'আপনি একটা রিটার্ন টিকিট জিতেছেন'।
দিন শেষে নিজেকে আমি ভীষণ আশাবাদী মানুষ হিসেবে দেখি। প্রতিদিন আমি নিজের জন্য নিজেকে নিয়ে বাঁচি। কেননা হতাশাবাদী হওয়া মানেই রিজাইন দেওয়া, হেরে যাওয়া, সুযোগগুলো হাতছাড়া হতে দেওয়া, ভালোতর পৃথিবীর স্বপ্ন মুছে ফেলা।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:৪২