somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীঠাকুরের একটি বিরল ছবি এবং না শোনা কিছু কথা............

১৮ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার মুনিয়ারী ইউনিয়নের কালিগ্রাম পরগনার পতিসর নামক গ্রামে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাচারী বাড়ি। নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৩৫ কি:মি: দূরে, আকা-বাকা সরু পথ ধরে এগুলে পৌছানো যাবে বিশ্বকবি রবীঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এই কুঠিবাড়িটিতে। একহারা এই পথ দিয়ে এগুলে দুইপার্শে চোখে পড়বে বিস্তৃর্ণ সবুজ মাঠ আর সোদা-মাটির ঘ্রাণ। তবে নিজেকে শক্তকরে বেধে রাখতে হবে বাহনের সাথে নইলে বন্ধুর পথটি বড়ই অবন্ধুসুলভ আচরণে ছিটকে ফেলে দিতে পারে মাটিতে কিংবা বন্ধুকে আকৃত্তিম ভালবাসায় টেনে নিতে পারে নিজের বুকে, ধুলোমাখা উষ্ম আতিথিয়তায়। প্রতি বছর এখানে কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী ও মৃত্যুবার্ষিকী আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়। বরীন্দ্র জন্মজয়ন্তীতে পতিসর পরিনত হয় এক মাহা-মিলন মেলায়। আশেপাশের গ্রামের লোকের কাছে এ এক মিলন তিথি, আত্নার মিলনের উপলক্ষ্য। দূর-দুরান্ত থেকে মেয়ে-জামাই, আত্নীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন সামীল হয় এই প্রাণের মেলায়।

পতিসর একটি ছায়া-ঘেরা নীভৃত পল্লী যেখানে সন্ধ্যার পর-পরই নেমে আসে গভীর রাত, নীরব, নীস্তব্ধ, নি:সঙ্গ, জন-মানুষহীন।পতিসরকে ছুয়ে একে-বেকে বয়ে গেছে নাগর নদী। কবি এই নদীতে তার প্রিয় পদ্মাবোটে বসে রচনা করেছিলেন তালগাছ একপায়ে দাড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উকি মারে আকাশে.... কবির সেই তালগাছটি আর নেই তবে আজও বহমান নাগর নদী। ১৯৬২ সালের এক প্রবল ঝড়ে একপায়ে দাড়িয়ে থাকা তালগাছটি ভেঙে যায়। তবে সেই ভিটেতেই নতুন করে গজে উঠা দুটি তালগাছ আজও সেই স্মৃতিকে জানান দিচ্ছে। কাচারী বাড়ির পাশেই রয়েছে বরীন্দ্র সরোবর।১৮৯১ সালের পর বহুবার জমিদার কবি নিজ মাটি ও মানুষের টানে নাগর নদীর বুক বেয়ে বজরায় চেপে ফিরে ফিরে এসেছেন এই পতিসরে। পতিসর জমিদার কবিকে মায়ার বাধঁনে বেধেঁ ফেলেছিল। আর তাই যতবারই এখানে আসতেন, থাকতেন দীর্ঘদিন।এই পতিসরে বসেই প্রেমিক কবি রচনা করেছিলেন কাব্যনাটিকা বিদায় অভিশাপ, গোরা ও ঘরে-বাইরে উপন্যাসের অনেকাংশ। গানের মধ্যে যেমন তুমি সন্ধ্যারও মেঘমালা/বধু মিছে রাগ করো না/তুমি নবরুপে এসো প্রাণে প্রভৃতি। রচনা করেছিলেন সন্ধ্যা, দুই বিঘা জমির মত বিখ্যাত কবিতা। পতিসর সেই স্হান, যেখান থেকে জমিদার কবি শেষ-বারের মত এই দেশ ও দেশের মানুষকে ছেড়ে যান। তারপর আর ফেরা হয়নি এদেশের মাটি ও মানুষের কাছে। চলে গেছেন না-ফেরার দেশে, গানের ওপারে। পতিসর সেই জায়গা যেখানে জমিদার কবি প্রথম বারের মত গড়ে তোলেন কৃষকের সহায়তায়, প্রজাগণের কল্যাণে কৃষি-ব্যাংক। সেই প্রথম গোড়পত্তন হয় কৃষকের শেষ সহায় "কৃষি ব্যাংক" ধারণার। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির টাকা থেকে ১ লাখ ৮ হাজার টাকা মুলধন হিসেবে ওই ব্যাংকে জমা দেন বিশ্বকবি। জমিদার রবী ঠাকুর সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় সেখানে সালিশী ব্যাবস্হার প্রবর্তন করেছিলেন, দুস্হের সেবায় স্হাপন করেছিলেন চিকিৎসালয়।

জমিদারি ভাগাভাগির পূর্বে কবি আসতেন শাহজাদপুর ও শিলাইদহে। কিন্তৃ ঠাকুর পরিবারের জমিদারী ভাগাভাগির পর কবি কালিগ্রাম পরগনার জমিদারী প্রাপ্ত হন ১৮৯১ সালে। অত:পর ১৮৯১ সালের ১৫ থেকে ১৮ জানুয়ারীর কোন একদিন জমিদার কবি পাড়ি জমান তার স্বীয় প্রজাগণের নিকট, স্বীয় পরগনায় অর্থাৎ কালিগ্রাম পরগনার পতিসরে। পতিসরের সাধারণ জনগণ, কৃষক-কূল ঠাকুর পরিবারের প্রজা ছিলেন না, তারা ছিলেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রজা। আর তাই জমিদার কবি নিজেকে কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, ঘুরে বেড়িয়েছেন পতিসরের মাঠে-ঘাটে, সময় কাটিয়েছেন তার প্রিয় প্রজাকুলের সাথে, খোজ নিয়েছেন তাদের দু:খ-কষ্টের, অভাব-অভিযোগের আর নিয়েছিলেন নানা উদ্দ্যোগ, তার প্রিয় প্রজাসাধারন, প্রতিসরের হতদরিদ্র মানুষের দারিদ্র দূরিকরণের। প্রতিসরের জন-সাধারনের কাছে তিনি কোন কবি বা সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাদের অন্নদাতা, ভাগ্য বিধাতা, তাদের জমিদার, ঠাকুর পরিবারের সন্তান জমিদার বীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পতিসরের দরিদ্র-নিরক্ষর প্রজাগণের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তিনি স্হাপন করেছিলেন প্রিয় সন্তানের নামানুসারে "কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনষ্টিটিউট" যা আজও বিরাজমান। কৃষিনির্ভর গরিব প্রজাসাধারণদের আত্ননির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে সমবায়ের ভিত্তিতে চাষাবাদ ধারণারও প্রবর্তন করেছিলেন। ততকালীন সময়ে এই প্রত্যন্ত এলাকায় ট্রাকটার দিয়ে জমিচাষ শুরু করেছিলেন এই পতিসরেই।

১৯৩১ সালে বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায় ছিলেন নওগা মহকুমার প্রসাশক। সেই সময়ে এই দুই আলোকিত ব্যাক্তির কয়েকবার সাক্ষাত ঘটে এই পতিসরে। ১৯৩৭ সালে শেষ বারের মত তার প্রিয় প্রজাদের কছে আসেন জমিদার কবি। বিদায়ের শেষ দিনে রবীন্দ্রসরোবরের ঘাটে দাড়িয়ে প্রজাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন:

(পতিসরে এবং বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ কথা: ২৯ পৌষ ১৩২০ (১৯৩৭))

"আমি বড় অসুস্হ। আর হয়তো তোমাদের কাছে আসিতে পরিব না। তোমরা আমাকে অনেক দিয়েছ। আমি তোমাদের কিছুই দিতে পারি নাই।
আমি প্রার্থনা করি,
তোমরা নিজের পায়ে দাড়াও, তোমাদের সবার মঙ্গল হোক.. তোমাদের সবাইকে এই আশীর্বাদই আমার শেষ আশীর্বাদ।
তোমরা আমার বড়ো আপনজন, তোমার সুখে থাকো।
তোমাদের সবার উন্নতি হোক.. এই কামনা নিয়ে আমি পরলোকে চলে যাবো।"

সেইদিন রবীন্দ্রসরোবরের ঘাটে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন পতিসরের প্রিয় প্রজাসাধারণ। সেদিন বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল নীভৃত এই পল্লীর স্তব্দতা ভেদ করে। বির্স্তীর্ণ সবুজ ধানের বুকে বোয়েছিল বিষাধের ঢেউ।

সেদিনের অনেক স্মৃতিই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। তাহলে সরকার কি কোন উদ্দ্যোগ নিচ্ছে না? প্রত্নতত্ত বিভাগ কি কোন বরাদ্দ পাচ্ছে না ম্লান হয়ে যাওয়া এই স্মৃতি রক্ষায়? বরাদ্দ আসছে কিন্ত সবই অপাত্রে কন্যা-দান ! একসময় পতিসরের রাজা ছিলেন কবিগুরু রবীঠাকুর যার হৃদয় ছিল অসীম অপার সাগর আর বর্তমানে পতিসরের প্রজাগন যাকে রাজা নির্বচন করেছেন উনি ছিলনে একজন মিটার-রিডার, (মিটার রিডারদের দক্ষতায় বিদ্যুত বিভাগের ভরাডুবি জগতখ্যাত) যিনি এখন এম, পি ( আর আছেন মহা পন্ডিত, ঈসরাফিল আলম সাহেব )। নতুন পান্ডিত্বের ভারে আজ তাই পুরান পান্ডিত্য ডুক্‌রে ডুক্‌রে কাদছে পতিসরের আকাশে-বাতাসে...............।

পতিসরে বসে বাংলাদেশের গ্রাম ও মানুষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর কথামালা:
"মাতৃভূমির যথার্থ স্বরূপ গ্রামের মধ্যেই, এইখানেই প্রাণের নিকেতন..
এই হচ্ছে সেই গ্রামের মাটি, যে আমাদের মা, আমাদের ধাত্রী, প্রতিদিন যার কোলে আমাদের দেশ জন্মগ্রহন করেছে।
গ্রামের মধ্যে সেই প্রাণ আনতে হবে, যে প্রানের উপাদান তুচ্ছ ও সঙ্কীর্ণ নয়।"

পতিসরে রবীন্দ্রনাথের চিরায়ত কিছু কথা:

" আমি এই পৃথিবীকে ভারি ভালবাসি।
স্বর্গের উপর আড়ি করে আমি আমার দরিদ্র মায়ের ঘর আরো বেশি ভালোবাসি-এত অসহায়, অসমর্থ. অসম্পূ্র্ণ
ভালোবাসার সহস্র আশঙ্কায় সর্বদা চিন্তাকাতর বলেই।
আমার কাছে এই গ্রামগুলি একমহু্র্তের ছবিমাএ, কিন্তৃ কত লোকের কাছে এই সমস্ত পৃথিবী।
এই প্রাচীন পৃথিবীতে কেবল সৌন্দর্য এবং মানুষের হৃদয়ের জিনিষগুলো কোনোকালেই কিছুতেই পুরোনো হয়না
এই পৃথিবীটা তাজা রয়েছে এবং কবির কবিতা কোনোকালেই একেবারে নি:শেষ হয়ে যায় না।"


(পতিসরে আপন প্রজাগণের সাথে জমিদার কবির একটি বিরল ছবি)

(তথ্যসুত্র: ড: মো: জাহাঙ্গীর আলাম, ইউএনও, আত্রাই, '০৮ইং)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:৩৭
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×