আজ একটা দশক শেষ হয়ে যাচ্ছে। পেছনে ফিরে তাকালে অদ্ভুত অনুভূত হয়। কত আনন্দ, কত বিষাদ, কত প্রাপ্তি, কত হতাশা। গত এক দশক আমার জীবনকে দিয়েছে প্রতি পদে পদে অদ্ভুত রোমাঙ্চকর অভিজ্ঞতা।
সেই ২০০০ সনের ঘটনা। দশকের প্রথম বছর। নটরডেম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি তখন। জীবনকে কতই না রঙ্গিন মনে হতো। থার্টি ফার্স্ট নাইটে ছোট খালার কাছ থেকে রেড ওয়াইন নিয়ে এসে পার্টি করেছিলাম। আম্মু-আব্বু সম্ভবত গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। ফাঁকা বাসায় আমার দুই প্রিয় খালাতো ভাই পার্থ-পাভেল ভাইয়া এবং আমি। চরম উন্মাতাল দুষ্টামি দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলাম এই দশককে। মনে পড়ে, সেদিন উইশ করতে ফোন দিয়েছিলাম কোন এক নারীকে। তার ব্যবহার এবং আমার সেদিনের প্রতিক্রিয়া ভেবে আজ শুধুই হাসি পায়। আজ খুব ইচ্ছে করছে তাকে ফোন দিয়ে দশ বছর আগের সে দিনের কথা মনে করিয়ে দিতে। সে কি চমকে উঠবে? সম্ভবত না। চমক ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে অনুভূতির প্রয়োজন হয় যেটা তার ভেতরে অনেক কম রয়েছে। আমার ডায়েরীর পাতায় সেদিনের বর্ণনা আজও স্পষ্ট লেখা আছে। প্রতিটা রূঢ় ব্যবহার কাটাকাটা ভাবে। তবে সত্যি বলতে আমি তাকে আমি মিস করছি না বরং থেকে থেকে কেবলই সেই ডায়েরীটাকে মিস করছি যে ছিল আমার কলেজ জীবনের সঙ্গি। যার সাথে আমি শেয়ার করছে পারতাম সব কিছু। সব আনন্দ, সব কষ্ট। কিন্তু দশকের এই শেষ বছরের শেষ দিনে আমি আমার ডায়েরী থেকে অনেক অনেক দূরে। জীবন আজ আমাকে অনেক বদলে দিয়েছে। নিয়ে এসেছে অনেক দূরে, অতলান্তিক মহাসাগরের পাড়ে, ইউরোপের এক অপরুপা দ্বীপ-দেশে।
সময় কেটে যেতে থাকে। ২০০০ সনের মাঝামাঝি সময়ে গুলশানে সদ্য সমাপ্ত সরকারী অফিসারদের জন্য তৈরী এ্যাপার্টমেন্টগুলোর একটিতে আমরা উঠি। প্রথম যে দিন মালামাল রেখে আসতে গিয়ে ছিলাম, আমার রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই পাশের বাসার পানির ট্যাঙ্কের উপর বসা এবং হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ধরা এক নারীকে দেখেছিলাম। পরবর্তিতে অনেক মজার ঘটনা ঘটেছিল তাকে নিয়ে যা এই লেখায় আনাটা অপ্রাসংঙ্গিক। শুধু এতটুকু বলব, এই নারীকে নিয়ে লেখা “সেই মেয়েটি” নামের গল্পটা আজও অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছে। হয়তো কোন একদিন শেষ করবো।
নটরডেম কলেজের প্রথমবর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। ছয় বিষয়ের পাঁচটায় পাশ করলাম কিন্তু গনিতে ফেইল। তখন বুঝি নি, কিন্তু পরবর্তিতে আমার সারা জীবনের কষ্ট হয়ে থাকলো এই ফলাফলটা। দ্বিতীয় বর্ষে উঠার পর হাতের দুই পাশে দুটা অদৃশ্য পাখা দেখতে পেলাম। সবাই যখন বলতো কলেজ জীবন হচ্ছে আনন্দময় সময়, আমার কাছে মনে হতো সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা কাল। প্রতি সপ্তাহে দুটো করে কুইজ পরীক্ষা দিয়ে আমি রীতিমত ক্লান্ত। ফিজিক্সের ল্যাব তখন চরম জ্বালাচ্ছে। বায়োলজীরটা কোন ভাবে ম্যানেজ করে নিচ্ছিলাম কিন্তু ক্যামিস্ট্রির সল্ট টেস্ট করতে গিয়ে পুরো ধরা। প্রথম চার ক্লাসে একটা লবনও মিলে নাই। দশ ক্লাসে ন্যূনতম ছয়টা লবণ মেলাতে হতো। আমার অবস্থা তখন ভয়াবহ রকমের করুণ।
এরই মাঝে কিছু বিষয় নিয়ে আমি চরম আপসেট হয়ে পড়ি। লেখাপড়ায় আর মন বসাতে পারছিলাম না। জীবনটাকে অসহ্য মনে হতে শুরু করলো। মানুষ কেন জন্ম নেয়, আমাদের বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায় ইত্যাদি নিয়ে রীতিমত গবেষণা করতাম। বলাই বাহুল্য, আমার গবেষণা আমাকে আরো উৎসাহিত করছিল এই জীবনের ইতি টেনে ফেলার জন্য!
এরকম সময়ে হঠাৎ পরিচয় হলো সায়মার সাথে। পরিচয় বলা ঠিক না। পরিচয় আগেই হয়েছিল। তবে নিয়মিত কথা বলতে শুরু করি তখন থেকে। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় পাগলী এই মেয়ে। যতই গভীর ভাবে জানতে শুরু করি, ততই বুঝি এর সাথে বেশি দিন কথা বললে আমিও পাগল হয়ে যাবো। অথচ এক অপার্থিব আকর্ষণে আমি বারবার ছুটে যেতে লাগলাম ওর কাছে। খুব ভালো লাগত কথা বলতে। কিন্তু কেন সেটা জানি না। একদিন হুট করে ওদের বাসায় চলে গেলাম। সে তো ভয়ে অস্থির। ফোন দিয়ে বললাম, তুমি বারান্দায় এসে দাড়াও। তারপর সে আসলো। ওর চোখের দিকে তাকানোর পর মনে হলো এত দুষ্টামি ভরা চোখ আমি আর কোন দিন দেখি নি। মানুষটার কথা বলতে হচ্ছিল না। তার চোখই যেন কথা বলছিল। আক্ষরিক অর্থে সেদিন মনে হয়েছিল, “তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”
মানুষ প্রেমে পড়লে উদাসী হয়। আমার হলো উল্টা। আমি বেশ গোছানো হয়ে গেলাম। পরপর ছয় ক্লাসে ছয়টা লবণ মিলিয়ে আমি রীতিমত নিজের প্রতিভায় মুগ্ধ তখন! সেকেন্ড ইয়ারে সময় ছিল ছয় মাস, তার উপর অনেকটা সময় না পড়েই কাটিয়েছিলাম। তবুও টেস্ট পরীক্ষায় বেশ ভালো ভাবেই পাশ করে গেলাম। সে সময়ে নটরডেম কলেজে অনেকটা একক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম নটরডেম লেখককুঞ্জ। প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া মাসিক পত্রিকা ঢাক-ঢোল ও চিট-চ্যাট কে আবার নিয়মিত করে তুললাম সোহেল স্যারের সাহায্যে। স্যার তখন মডারেটর আর আমি প্রধান সম্পাদক। গাজী আজমল স্যারের সাথে কাজ করতাম কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন ব্লু এন্ড গোল্ড এবং অন্যান্য স্যূভেনিয়রে। নটরডেমের ৫১তম বর্ষপূর্তিও উজ্জাপন করলাম তখন। কলেজে নাকি কখনও কনসার্ট হয় না। আমরা জেমসকে নিয়ে এসে প্রমান করে দিলাম রোবটদের পাশাপাশি নটরডেমেও মানুষ পড়ে!
২০০১ সনে আমাদের ফেয়ারওয়েল। জানতে পারলাম দশজনকে স্পেশাল অনারারী মেনশন দেয়া হচ্ছে। এটা মূলতঃ এক্সট্রাকারিকুলাম এ্যাকটিভিটিজ এর জন্য দেয়া হয়। বেশ গর্ব হচ্ছিল। ১২৬৫ জন ছাত্রের মধ্যে দশ জনের কোটায় ঢুকতে পারার গর্ব। কিন্তু ভাগ্য হয়তো হাসছিল তখন। হঠাৎ সোহেল স্যারের চেহারা একটু অন্যরকম হয়ে গেলো। স্যার একটা কাগজ নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলেন। আমার নাম নাকি শেষ মুহূর্তে বাদ দেয়া হয়েছে। কেন দেয়া হয়েছে সেটা জানার চেষ্টা করতে লাগলেন সোহেল স্যার। শেষ পর্যন্ত জানা গেলো আমার ফার্স্ট ইয়ারের ম্যাথে ক্রস ছিল। এই কারণে আমি বাদ। একটাও কথা বলি নি সেদিন। ফেয়ারওয়েলে না গিয়ে সোজা বাসায় চলে আসি। তারপর দরজা বন্ধ করে কেঁদে ছিলাম ঘন্টার পর ঘন্টা। ফার্স্ট ইয়ারের সেই ম্যাথ পরীক্ষা আমাকে আবার দিতে হয়েছিল। সেবার বেশ ভাল ভাবেই পাশ করি। এর পর এইচ.এস.সি-তে ম্যাথে লেটার পাবার পর শুধুই হেসে ছিলাম। তবে বুকের ভেতরের সেদিনের সেই কান্নাটা আজও আমি অনুভব করি, অনেক অনেক বেশী।
আমার আম্মুর খুব শখ ছিল ছেলে বুয়েটে পড়বে। আমার ইচ্ছে ছিল আর্কিটেকচার অথবা মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। যথারীতি কোচিং করতে শুরু করলাম। সকালে কোচিং আর রাতে বাসায় স্যারের কাছে পড়া। কোন এক বিশেষ কারণে আমার ধারণা হয়ে গিয়েছিল আমি বুয়েটে খুব সহজে চান্স পাবো। এই অতি আত্মবিশ্বাস আমার জন্য কাল হলো। আমি চান্স পেলাম না। সাথে সাথে চারপাশের মানুষের ব্যবহার বদলে গেলো। এতদিন যারা নটরডেমে পড়ি বলে সমীহ করত, তারাই এবার আস্তাকুড়ে ফেলে দিল আমাকে। আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। চরম হতাশা ঘিরে ধরল। এরকম সময়ে একদিন ডাইনিং টেবিলে হঠাৎ আব্বুর সাথে তর্ক লেগে গেলো। হাতে তখন ছুরি-কাটা ছিল। তর্কের এক পর্যায়ে আমি ছুরি নিয়ে চিৎকার করে আব্বুর দিয়ে এগিয়ে যাই। আব্বু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। পরে আম্মুকে বলেছিল, “ও কি সত্যি আমাকে ছুরি নিয়ে মারতে এসেছিল?”। আমি নিজেও জানি না কেন সেদিন ওরকম করেছিলাম। এর পর আব্বু আর কোন দিন আমাকে কিছু বলেন নি। কোন দিন বকা দেন নি বা কিছু করতে মানা করেন নি। আব্বুর এই নীরবতা এক জীবনের যন্ত্রণা হয়ে আজও আমার বুকে বাসা বেধে আছে।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে আমার তেমন কোন ধারণা ছিল না। ২০০২ সনের জানুয়ারি মাসের এক অলস দুপুরের ঘটনা। ছোট মামা হঠাৎ এসে বললেন, চলো। তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো। আমি কোন দ্বিরুক্তি না করে মামার সাথে বের হলাম। তিনি আমাকে মহাখালীর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেলেন। সেখানে ডিন স্যারের সাথে দেখা করে আমার ডকুমেন্টগুলো তাঁকে দিলেন। তিনি ডকুমেন্ট দেখে তৎকালিন ভিসি ফরাসউদ্দিন স্যারের রুমে গেলেন। একটু পর ফিরে এসে বললেন, তোমাকে একটা ফর্ম দিচ্ছি। তুমি এটা ফিলআপ করে ভর্তি হয়ে যাও। কোন সাবজেক্টে ভর্তি হবো সে বিষয়ে তিনি আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। ফর্মে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ নিজেই টিক দিয়ে দিলেন। পরবর্তিতে ২০০২ সনের ১৭ জানুয়ারী বিকেল তিনটায় আমি সি-প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বলে একটা নুতন ভাষার সাথে পরিচিত হই। আজ আট বছর পর আমার মনে হচ্ছে এখন আমি যা, সবই এ ভাষার কল্যাণে। হয়তো কম্পিউটার সায়েন্স না পড়লে আমার জীবনের একটা অধ্যায় কোন দিন উন্মোচিত হত না। হাস্যকর শোনালেও, আজ আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীতে মূলতঃ মানুষ আছে দুই ধরণের – এক. যারা কম্পিউটার সায়েন্স পড়েছে এবং দুই. যারা পড়ে নি! (চলবে)