লেখাটি লিখেছেন :ইন্দ্রনীল বক্সী
“There was never a good war, or a bad peace.”
-Benjamin Franklin
নাঃ ... ভুলেও ভাববেননা এ লেখা সভ্যতার সবথেকে বড় ও বিধ্বংসী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো অলৌকিক বিকল্পের গল্প বলবে । শুধু কিছু বাস্তব ও যুক্তিসম্মত বিকল্প সিদ্ধান্তের কথাই শুধু বলবে – যা নেওয়া হয়নি , যেগুলি নিলে যুদ্ধের অভিমুখে নাটকীয় পট পরিবর্তন হতো । এই বিপুল ভয়ংকর যুদ্ধ হয়তো বেশ কিছুদিন আগেই শেষ হতে পারতো , কমতে পারত উভয় পক্ষের রক্তক্ষয়ের পরিমান , প্রানহানির সংখ্যাও ।
ভুল সিদ্ধান্ত , হঠকারী সিদ্ধান্ত , মস্ত সব লোকের দূরদর্শিতার অভাব এই বিপুল , পরিকল্পিত যুদ্ধের বাজারে শুধু নিজেদের বাহিনীকেই নয় , দেশবাসীকেও ঠেলে দিয়েছিলো চরম ধ্বংসের মুখে , পরাজয়ের দিকে ... আসুন ,এর কিছু যুদ্ধ-তাত্ত্বিক কারন অনুসন্ধান করি ...
অতিঅল্প ডুবো জাহাজ – জার্মানি
যেমনটি দেখা গেছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে । জার্মান নৌ বাহিনীর মুল লক্ষ্য ছিলো বিচ্ছিন্ন ব্রিটিশ দ্বীপের সমুদ্রপথকে অবরুদ্ধ করা , যা কিনা ব্রিটেনের লাইফ লাইন । দ্বীপরাষ্ট্র সম্পূর্ন নির্ভরশীল সামুদ্রিক জাহাজ দ্বারা আমদানীকৃত জ্বালানি ,ধাতু এবং অত্যাবশ্যিক আরও বহু জিনিসের উপর ।
সেই পথ অবরুদ্ধ হলে বৃটেনের যাবতীয় উৎপাদন ব্যাবস্থা , সামরিক উৎপাদন ব্যাবস্থা পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়বে , ভেঙে পড়বে । স্থবীর হয়ে পড়বে বৃটেনের বায়ুসেনা , তাদের গর্বের নৌবহর ,স্থল সেনাও । তখন জার্মান বোমারু বিমানের লাগাতার বোমা বর্ষনে ভেঙে পড়তে বাধ্য যাবতীয় বৃটিশ প্রতিরোধ –এটাই বাস্তব।
এই কাজে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সাবমেরিন বাহিনী চরম আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিলো । তারা অসংখ্য বৃটিশ বানিজ্যতরী ডুবিয়ে দিয়েছিলো আটলান্টিক মহাসাগরে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও জার্মান নৌবাহিনী চরম চিন্তার কারন হয়ে ওঠে ব্রিটিশ রয়্যাল নৌবহরের ,কারন জার্মান তার বিপুল সম্পদ ব্যয় করছিলো বৃহৎ যুদ্ধ জাহাজ ও ক্রুজারের জন্য । কিন্তু বহু চেষ্টাতেও জার্মান নৌবহর তাদের কাঙ্খিত সাফল্য পাচ্ছিলো না । জার্মান নৌবহর প্রধান এডমিরাল রোয়েডার এক চরম ভুল করেন এসময় । জার্মান ডুবোজাহাজ বাহিনীর প্রধান ডোয়েনিৎজ বারংবার সাবমেরিন উৎপাদন বাড়াবার অনুরোধ করলেও এডমিরাল রোয়েডার তা নসাৎ করে দেন এই যুক্তিতেই যে রয়্যাল নৌবহর দাবী করছে – তারা নাকি সাবমেরিন সমস্যা প্রতিহত করার এক নতুন ও অভিনব পদ্ধতি (ASDIC) আবিষ্কার করে ফেলেছে , সেটি একটি নতুন যন্ত্র যা জলের তলায় সাবমেরিনকে চিহ্নিত করতে পারবে অনায়াসে - তাই অনর্থক সাবমেরিন বাড়িয়ে লাভ নেই । বৃটিশ নৌবহরের এমন দাবীর সত্যতা যাচাই নাকরে এরকম সিদ্ধান্ত না নিলে জল অন্য দিকেই গড়াতো ।
ফলস্বরূপ , ১৯৩৯ এ যখন যুদ্ধ শুরু হলো জার্মান নৌবহরে তখন ৩টি বড় যুদ্ধজাহাজ , ৮টি ক্রুজার এবং আরও কটি তৈরীর পথে ,এবং মাত্র ১২টি সাবমেরিন ! যা আটলান্টিক সাগরে যুদ্ধে সক্ষম । এর সঙ্গে ছিলো ৪৩টি ছোটো সাবমেরিন ,মুলতঃ উপকূল রক্ষার জন্য ও প্রশিক্ষণের জন্য । যেখানে ডোয়েনিৎজ এর দাবী ছিলো অন্তত ৩০০ আটলান্টিক সাবমেরিন , যার ১০০টি সবসময় প্রস্তুত থাকবে ।
যুদ্ধ শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেলো ডোয়নিৎজ কতটা সঠিক ছিলেন । জার্মান সাবমেরিন বাহিনী মারাত্মক বিপদের কারন হয়ে উঠলো বৃটিশ রয়্যাল নৌবহরের ,সংখ্যায় খুব কম হওয়াতেও । জার্মান সাবমেরিনের সংখ্যা এবার বাড়ানো হতে লাগলো বাস্তবতা মেনে , কিন্তু তা হতে লাগলো খুব ধীরে । এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বৃটিশ বাহিনী নিজেদের টিঁকিয়ে রাখলো এবং ক্রমাগত উন্নত করতে লাগলো তাদের সমরসম্ভারের । ১৯৪৩ নাগাদ জার্মান নৌবহরের কাছে এলো মোট ৪০০ সাবমেরিন , কিন্তু ততোদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে , তারা এবার সম্মুখীন হলো আরও উন্নত , চরমবিধ্বংসী সাবমেরিন প্রতিরোধী শক্তির সামনে – যা তাদের পরাজয়ের কারণ হলো ।
একথা বলে রাখা দরকার । যে শ্রম ও লোকবল একটি বৃহৎ যুদ্ধজাহাজ (Battleship) তৈরী করতে ও চালাতে লাগে সেই শ্রম ও লোকবলে ৫০টি আটলান্টিক সাবমেরিন তৈরী ও চালনা করা যেত । যদি এডমিরাল রোয়েডার বা হিটলার ডোয়েনিৎজকে সমর্থন করতেন যুদ্ধের আগে , অন্তত ১৫০টি মতো সাবমেরিন দিতেন ৩টি প্রায় বেকার যুদ্ধজাহাজের পরিবর্তে ১৯৪০ নাগাদ তাহলে বৃটিশরা যুদ্ধে পরাজিত হতো ১৯৪১ এর আগেই , আমেরিকা ও রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগেই জার্মানরা যুদ্ধ জিতে যেত ।
অতি অল্প ডুবোজাহাজ – আমেরিকা
এটা প্রমাণিত সত্য যে আমেরিকার বিপুল যুদ্ধ -উৎপাদন ক্ষমতা এক অন্যতম কারণ তাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভের । যুদ্ধের সময় মার্কিন নৌবহর দ্রুত এক বিপুল ও শক্তিশালী আকার ধারণ করে । কিন্তু তাদের উৎপাদনশীলতা ও সম্পদের সামান্য অংশ নিয়োজিত হয় সাবমেরিন নির্মানে । মাত্র ২৮৮টি সাবমেরিন , যা জাপানের প্রচুর বানিজ্যিক জাহাজকে ধ্বংস করে জাপানের জ্বালানী সরবরাহ বিঘ্নিত করে ও যুদ্ধ সরঞ্জাম আমদানীর অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় । ইতিমধ্যে জার্মানরা তৈরী করে ফেলেছে ১১৭০টি সাবমেরিন । আমেরিকা যদি তাদের সম্পদ ও যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনের আরো কিছুটা অংশ সাবমেরিন উৎপাদনে ব্যয় করতো ,আরো ১০০০-১৫০০ সাবমেরিন উৎপাদন করতো , যা তারা সহজেই পারতো ,তাহলে তারা জাপানের সম্পুর্ন বানিজ্যিক নৌবহর ধ্বংস করতে পারতো । জাপানের জ্বালানী ও অন্যান্য সরঞ্জাম আমদানী বন্ধ হয়ে যেত পুরোপুরি । তাদের যুদ্ধকালীন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেত । স্থবীর হয়ে যেত জাপানের বায়ুসেনা , সামরিক নৌবহর , এবং দুবছর আগেই আনবিক বোমা ছাড়াই জাপান পরাজিত হতো । ভাবুন ! আনবিক বোমার যে বিধ্বংসের অভিশাপ আজও পৃথিবী বহন করছে , হতে পারতো তা এড়ানো যেত বহু আগেই । কিন্তু তা হয়নি কিছু সিদ্ধান্তগত গাফিলতির জন্য শুধুমাত্র ।
উত্তর প্রশান্ত মাহাসাগরীয় অঞ্চলকে অবহেলা
১৯৪৪ এর শেষের দিকে শুরু হয় জাপানের একের পর এক শহরে বিধ্বংসী কৌশলগত বোমাবর্ষন যা জাপানকে কিছুদিনের মধ্যে বাধ্য করে আত্মসমর্পন করতে । কিন্তু ইতিমধ্যে যুদ্ধের মহার্ঘ তিন তিনটি বছরে পেরিয়ে গেছে । জাপান তার আগেই পিছু হটে এটা জরুরী ছিলো , যতক্ষননা মার্কিন বায়ুসেনা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপগুলিতে নিজেদের দখল কায়েম করে যতটা সম্ভব জাপানের মূ্লভূখন্ডের কাছাকাছি আসতে পারে এবং জাপানের উপর বোমাবর্ষন করতে পারে । আর এক উপায় ছিলো মার্কিনীরা উত্তর দিক দিয়ে জাপানকে যদি আক্রমন করতো । সে সুযোগ যে ছিলো তার প্রমান ১৯৪২ এর ডুওলিটল রেইড (Doolittle Raid), যখন টোকিওর উপর প্রথমবার বোমাবর্ষন করা হয় । কিন্তু আশ্চর্যভাবে তা মাত্র একবারই করা হয় ।
১৯৪১ অবধি রাশিয়া ব্যাস্ত ছিলো তার ও জাপানের মধ্যে দূর প্রাচ্যের যুদ্ধে । এবং তারপর ১৯৪১-১৯৪২ রাশিয়া মরিয়া ছিলো জার্মান আগ্রাসন প্রতিহত করতে , স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ(ফেব্রুয়ারি -১৯৪৩) শেষ হতে হতে রাশিয়া বুঝে গেছিলো এই যুদ্ধে তারা জিততে চলেছে , জাপান ও জার্মানরা হারতে চলেছে । যুদ্ধের কূটনীতিতে রাশিয়া তার সমগ্র মনোযোগ জার্মানীকে পরাজিত করাতেই দিক এবং জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ ছেড়ে দিক আমেরিকার জন্য – সেটাই ছিলো সুবিধাজনক । এতে রাশিয়ার উৎপাদানগত সমর্থনের ক্ষেত্রেও রাশিয়া লাভবান হয় । যুদ্ধে রাশিয়া বৃটিশ বায়ুসেনাকে তার এয়ার বেস ব্যাবহারের সুযোগ দেয় ,যাতে তারা জার্মানীর উপর বোমাবর্ষন করতে পারে ।কিন্তু একইভাবে আমেরিকার বায়ুসেনাকে তার দূর প্রাচ্যে অবস্থিত এয়ার বেস ব্যাবহার করতে দিতে অস্বীকার করে । অপরদিকে জাপানের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে যাতে জাপান রাশিয়ার দূর প্রাচ্যের বন্দরগুলিতে আসতে থাকা আমেরিকার রসদভর্তি জাহাজগুলি আক্রমন না করে ।
আমেরিকার আলাস্কা ও আলেটিয়ান দ্বীপের(Aleutian islands) এয়ার বেস থেকে জাপানের উপর বোমা বর্ষন করা অসম্ভব ছিলো দূরত্বের কারনে । কিন্তু রাশিয়া পূর্ব প্রান্তে ছিলো বিস্তীর্ন অঞ্চল যা জাপানের উত্তর প্রান্ত ও আলাস্কার পশ্চিম প্রান্ত , এবং এই অঞ্চল জাপানি সেনা ও নৌবাহিনীর নাগালের বাইরে । যদি কোনোভাবে আমেরিকা , কোনো প্রলোভনে রাশিয়াকে রাজি করাতে পারতো তাদের দূর প্রাচ্যের এয়ার বেস গুলি ব্যাবহার করতে দিতে আমেরিকা বৃহৎ বোমারু বিমানগুলির জন্য তাহলে প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলে এত দীর্ঘ , ব্যায়বহুল ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করতে হতোনা আমেরিকাকে জাপানকে হারাতে । ১৯৪৩ নাগাদই আমেরিকার বায়ুসেনা জাপানে পৌঁছে যেত এবং জাপান পরাজিত হতো অন্তত একবছর আগেই ।
বোঝাই যাচ্ছে উপযুক্ত সময়ে সঠিক কূটনীতিগত অবস্থান না নেওয়ার কারনে আমেরিকা ট্রেন মিস করে , এবং তার মূল্য দিতে হয় তাকে এবং বিশ্বকেও ।
যোগ্য যুদ্ধ বিমান বাতিল করা
১৯৪২ অবধি বৃটিশ বিমান বাহীনি ব্যাবহার করতো এমন একটি যুদ্ধ বিমান যা অন্য বৃটিশ ও আমেরিকান বোমারু বিমানের থেকে দিন বা রাতের যুদ্ধে অনেক বেশী পারদর্শী । যার নাম ছিলো ‘মশকিউটো’(Mosquito) । এটি ছিলো অনেক বেশী গতিসম্পন্ন , যাকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব ছিলো , এতে ছিলো পালটা প্রতিরোধ ভাঙ্গার উপযুক্ত মেশিনগান ও গানম্যান । ভারি বোমারু বিমানের থেকে বোমা নিক্ষেপে এই বিমান ছিলো অনেক বেশী নিখুঁত ও কার্যকর ।
এই বিমানের কার্যক্ষমতা প্রমানিত ইউরোপের যুদ্ধে । এই বিমান জার্মান বিমানের থেকে বেশী গতি সম্পন্ন হওয়ায় এর ক্ষতির পরিমান অন্তত ১০ ভাগ কম ছিলো ভারি বোমারু বিমানের থেকে , যদিওবা ধ্বংস হতো, তাতে থাকতো মাত্র দুজন দক্ষ বায়ু সেনা । যেখানে অপেক্ষাকৃত শ্লথ ভারি বোমারু বিমানে থাকতো সাতজন বায়ু সেনা । তাই মানব সম্পদের দিক দিয়েও ক্ষতির পরিমান কম ছিলো । একটি মসকিউটো বিমানের নির্মান খরচ ছিলো ভারি বোমারু বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ।
কিন্তু কোনো এক রহস্যজনক ও অযৌক্তিক কারনে এই মশক বিমান বাহিনীকে বৃটিশ বিমান বাহিনীর কম্যান্ড ভারি বোমারু বিমান বাহিনীকে সাহায্য করা থেকে বিরত রাখে । যদি এরকম করা না হতো , যদি এই অপেক্ষাকৃত ছোট, গতিশীল ও কার্যকর বিমানকে আরও বেশী মাত্রায় কাজে লাগানো হতো বা মূল আক্রমনকারী বিমান বাহিনী হিসেবেই ব্যাবহার করা হতো তাহলে ফলাফল অন্যরকম হতো । ফলতঃ ভারি , শ্লথ এবং বোমা বর্ষনের তেমন নিখুঁত নয় এমন বিমান ব্যাবহারে ফলে প্রায় ১০ লক্ষ টন বোমা জার্মানী জুড়ে ফেলা হলেও যার বেশীরভাগ কার্যকরী হয়নি । এবং এতে বৃটিশ বিমান বাহিনীকেও সহ্য করতে হয় ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির । এই পরিমান বোমা যদি মসকিউটো বিমান দ্বারা ফেলা হতো তাহলে ক্ষতির পরিমান কম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জার্মানীর সামরিক উৎপাদনকে আরও আগে গুঁড়িয়ে দেওয়া যেত ও জার্মানী পরাজিত হতো ।
এতো যেন টিমের সব থেকে চটপটে স্ট্রাইকারকে প্রথম এগারোয় না রেখে সাইড লাইনে বসিয়ে ম্যাচ খেলতে নামার সামিল ! অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট বোধহয় একেই বলে ।
ইতালির ‘গ্রীস’রোমাঞ্চ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুথেকেই প্রচারে প্রাধান্য পাচ্ছিলো হিটলার তথা জার্মানী । এই নিয়ে ইতালির একনায়ক মুসোলিনীর কিছু হীনমন্যতা ছিলো । জার্মানী ফ্রান্স আক্রমন ও দখল করায় মুসোলিনি আরও অধৈর্য ও মরিয়া হয়ে পড়ে নিজেকে প্রমান করার জন্য । তার ইচ্ছে ছিলো বিশ্ব জানুক জোটের আসল শক্তি ইতালি ।এই মরিয়া চিন্তা থেকেই মুসোলিনি গ্রীস আক্রমন করার হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয় । ২৮অক্টোবর ১৯৪০এ ইতালি আক্রমন করে গ্রীসকে । কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় গ্রীস সহজ ঠাঁই নয় ! গ্রীকরা প্রতি আক্রমনে ৫,৩০,০০০ ইতালীয় বাহিনীকে কার্যত পিছু হটতে বাধ্য করে । আবার প্রতি আক্রমনেও ১৯৪১ এ ইতালি বিশেষ সুবিধা করতে পারেনা , এরপর হিটলারের জার্মান নাজি বাহিনী এসে ইতালিকে উদ্ধার করে । ২৩ এপ্রিল ১৯৪১এ গ্রীস পরাজিত হয় শেষ পর্যন্ত । কিন্তু এতদিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে , ইতালির মুখ পোড়ার সাথে সাথে ইতালিকে সাহায্য করতে গ্রীসে ব্যাস্ত জার্মান বাহিনী মূল্যবান ৫ সপ্তাহ দেরী করে ফেলেছে রাশিয়াকে আক্রমন করতে , যারজন্য তাদের রাশিয়ার অসহ্য শীত পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হয় এবং কার্যত জার্মান সেনা জেতা যুদ্ধ হেরে যায় । এরজন্য রাইখের শেষ সময় হিটলার মুসোলিনিকেই দায়ী করে ।
মুসোলিনীর এই ‘হাম কিসিসে কম নেহী’ মার্কা মানসিকতা আখেরে তার এবং তার জোট সঙ্গীদের পক্ষে চরম ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায় । মুসোলিনীর ব্যাপারটা ছিলো ‘গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল’ টাইপের ।
হিটলারের ‘টোটাল ওয়ার’ ,কিন্তু ঘর বাদ দিয়ে
হিটলারের ঘোষিত ‘টোটাল ওয়ার’ ছিলো মুলতঃ অন্য দখলকৃত দেশের মাটিতেই । একথা সত্য যে জার্মান নাজিবাহিনী বিপুল শৌর্য এবং তার সঙ্গে চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় রেখেছে তাদের জেতা যুদ্ধগুলিতে । পরিকল্পনামাফিক বিভৎস গনহত্যা থেকে সীমাহীন অত্যাচারে তারা বিপর্যস্ত্য করে তুলেছিলো পূর্ব ইউরোপের মানুষদের । উল্টোদিকে মিত্র শক্তির দেশগুলি সুঠাম পরিকল্পনায় বাড়িয়ে তুলছিলো তাদের সামরিক উৎপাদন ,যা ১৯৪৪ অবধি জার্মানীর ক্ষেত্রে সেভাবে দেখা যায়নি । মিত্রশক্তির কারখানাগুলি ২৪ ঘন্টা-৭দিন উৎপাদন করছিলো , লক্ষ লক্ষ নারীও যুক্ত হয়েছিলো সেখানে কারাখানা শ্রমিক হিসেবে , যেখানে জার্মান মহিলাদের তখনও ঘরে বসিয়ে রাখা হয়ছিলো ।শুধুমাত্র বন্দিদেরকে কাজে লাগানো হতো ।
মিত্রশক্তি উৎপাদন করছিলো কিছু নির্দিষ্ট যুদ্ধ সরঞ্জাম ,যা সাধারন অথচ বিশ্বস্ত ও কার্যকর । উল্টোদিকে জার্মানরা একসঙ্গে বহুবিধ সরঞ্জাম উৎপাদন করছিলো । যাতে করে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছিলো , সম্পূর্ন জার্মান বাহিনীকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে তারা অসুবিধায় পরছিলো । হিটলার মশগুল ছিলেন বিভিন্ন অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের পরিকল্পনায় যা তখনও ঠিক ঠাক তৈরী হয়েই ওঠেনি । শেষ পর্যন্ত হিটলার এলবার্ট স্পিয়ার( Albert Speer)বলে একজন যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন বিশেষজ্ঞকে দায়ীত্ব দেন ,যদিও সে দায়ীত্ব নিরঙ্কুশ ছিলোনা এবং ততোদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে ।
একনায়কদের চরম ব্যক্তিগত ভুলগুলি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুই অন্যতম প্রতাপশালী ও নিষ্ঠুর একনায়ক ছিলেন হিটলার ও স্তালিন । দেশ তথা বাহিনীর যাবতীয় মূল সিদ্ধান্ত নিতেন এঁরাই । তাঁদের অধস্তনদের তাঁদের সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করা বা সমালোচনার করার অধিকার ছিলোনা একেবারেই ,সে যতই তাঁরা ভুল সিদ্ধান্ত নিননা কেন । জরুরী কারনে তাঁদের গভীররাতে ঘুম ভাঙ্গানোর অনুমতি পর্যন্ত ছিলোনা । একনায়কদের সিদ্ধান্ত বদলের কোনো অধিকার ছিলোনা কারও , এমনকি তা ভুল প্রমান হওয়ার পরেও । এরকমই কিছু ভুলের উদাহরন রইল এখানে –
১৯৪১ এর গ্রীষ্মে রাশিয়া আক্রমনের পর হিটলারের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিলো কিভাবে শীত পড়ার আগেই রাশিয়াকে সম্পূর্ন পরাজিত করা যায় । কিন্তু হিটলার মাঝপথে যুদ্ধের অভিমুখ অন্য দিকে নিয়ে যান , এবং আবার রাশিয়ায় মনোনিবেশ করেন সেপ্টেম্বরে । কিন্তু ততোদিনে বেশ দেরী হয়ে গেছে । এবং যার ফল জার্মান বাহিনীকে সামগ্রিক যুদ্ধেই ভুগতে হয় ।
জার্মানীর রাশিয়া আক্রমন করায় রাশিয়াবাসীর কাছে স্তালীনের স্বৈরাচার থেকে মুক্তির এক পথ বলে মনে হয় প্রাথমিকভাবে । জার্মান বিখ্যাত প্রচারযন্ত্রর কর্মসূচীও সেই দিকেই হওয়া উচিত ছিলো , কিন্তু হিটলার কঠিন নির্দেশ দেন তাঁর বাহিনীকে বর্নবিদ্বেষ নির্ভর কার্যকলাপের ,চরম নিষ্ঠুরতার । কিছুদিনের মধ্যেই অত্যাচারীত রাশিয়াবাসী বুঝতে পারেন স্তালিন অত্যাচারী স্বৈরাচারী হলেও ,হিটলার তার থেকেও জঘন্য । যা রাশিয়ার জনগনকে জার্মান বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে , যা হয়ে ওঠে জার্মান বাহিনীর জন্য কঠিনতম লড়াই ।
১৯৪০ এ হিটলার বৃটিশ বাহিনীকে পরাজিত করার দু-দুটি চরম সুযোগ হাতছাড়া করেন । যখন ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের মিশ্র প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে , তখন হিটলার নির্দেশ দেন জার্মান ট্যাঙ্ক বাহিনী যেন ডানক্রিক(Dunkirk) উপকূলে অবরোধকারী ৩ , ৩৮, ০০০ বৃটিশ সেনাকে আক্রমন না করে । এর কোনো ব্যাখা না দিলেও মনে করা হয় যে তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও বিমান বাহিনীর কম্যান্ডার গোয়েরিং ( Goering) এর অনুরোধেই এমন করেছিলেন তিনি । গোয়েরিং এর ইচ্ছে ছিলো তাঁর বিমান বাহিনী আকাশ থেকেই বৃটিশ সেনাকে ধ্বংস করুক । তাই জার্মান বাহিনীর সবথেকে শক্তিশালী ট্যাঙ্ক বাহিনী অল্পদূরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখেছিলো এবং বৃটিশ বাহিনীকে সুযোগ করে দিয়েছিলো কৌশলগত পিছু হটতে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে । আবার তিন মাস পর যখন জার্মান বিমান বাহিনী তুলনায় ছোট বৃটিশ বিমান বাহিনীকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে তখন আচমকা হিটলার নির্দেশ দেন বৃটিশ বিমান বাহিনীকে ধ্বংস না করে বৃটিশ জনতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে লন্ডনের উপর বোমা বর্ষনের । তাতে ফল হয় এরূপ , বৃটিশ বিমান বাহিনী নিজেদের গুছিয়ে নেয় ও প্রতি আক্রমনে যুদ্ধ জিতে নেয় । ব্রিটেন রক্ষা পায় জার্মান অনুপ্রবেশ থেকে ।
১৯৪১ স্তালিন তাঁর সামরিক গোয়েন্দা ও চরদের থেকে জানতে পারেন যে জার্মানরা রাশিয়া আক্রমন করার পরিকল্পনা করছে । কিন্তু সেই তথ্যকে তিনি গুরুত্ব দেননি । যখন জার্মান বাহিনী দোরগোড়ায় , এবং যাবতীয় তথ্য জার্মান আক্রমনকেই নির্দেশ করছে , তখনও স্তালিন তাঁর উপদেষ্টাদের নির্দেশ দেন কেউ যেন এ নিয়ে তাঁকে বিরক্ত না করে । শাস্তির ভয় আর কেউ তাঁকে এনিয়ে কোনো খবর জানায় না । শেষ পর্যন্ত যখন আক্রমন শুরু হলো তখন স্তালিনের ডেপুটি কম্যান্ডার জুকভ(Zhukov) স্তালিনের দেহরক্ষীদের বলেন যে তিনি দায়ীত্ব নিচ্ছেন স্তালিনকে ঘুম থেকে তুলে এই দুঃসংবাদ দেওয়ার । কিন্তু ততোক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেছে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের অন্যতম আক্রমনাত্মক ও শক্তিশালী সঙ্গী ছিলো জাপান । হিটলার জানতেন জাপান হয় উত্তর দিক দিয়ে আক্রমনের কথা চিন্তা করবে , যেখান তারা এক অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো রাশিয়ার পূর্বপ্রান্তে । কিংবা তারা দক্ষিন দিকে আক্রমন করবে , দক্ষিন-পূর্ব-এশিয়া এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে । কিন্তু তিনি কোনোরকম যোগাযোগের আদান প্রদান করেননি এমনকি রাশিয়া আক্রমন করার পূর্বে জাপানকে তা জানাননি পর্যন্ত । যদি তিনি তা করতেন তাহলে জাপান আরও অন্তত ৮ মাস রাশিয়াকে যুদ্ধে ব্যাস্ত রাখতো , যা জার্মান বাহিনীকে রাশিয়ার বিরাট সেনাকে পরাস্ত করে মস্কো পৌঁছতে সাহায্য করতো ১৯৪১ এর ডিসেম্বরেই । সেখানে হলোকি জার্মানীর রাশিয়া আক্রমনের ব্যাপারে অন্ধকারে থাকা জাপান রাশিয়ার সঙ্গে দুমাস আগেই এক অনাক্রমন চুক্তি করে বসে । ফলে যখন যুদ্ধক্লান্ত ও রাশিয়ার প্রচন্ড শীতে কাতর জার্মান বাহিনী মস্কো পৌঁছালো এবং ভাবলো রাশিয়ার আর কোনো বাহিনী অবশিষ্ট নেই তখন তাদের সম্মুখীন হতে হলো এক বিরাট তাজা রাশিয়ান সেনার ,যা তারা ফিরিয়ে এনেছিলো পূর্ব প্রান্ত থেকে ।
হিটলার ও স্তালিন কেউই যুদ্ধে কৌশলগত পিছুহটায় বিশ্বাসী ছিলেননা । ফলতঃ দুপক্ষেরই বহু সেনা নিহত হয় অযৌক্তিকভাবে যখন তাদের পিছু হটা জরুরী ছিলো । রাশিয়া প্রায় হেরে বসেছিলো ১৯৪১ এই কারনেই । অপরদিকে ঠিক এক বছর পর স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে হিটলারের বাহিনীকে ভোগ করতে হয় চরম ক্ষতি ।
হিটলার ১৯৪১ পর্যন্ত ছিলেন জার্মান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক । এবং তারপরেও তিনি একজন কম্যান্ডার হিসেবেই ভূমিকা পালন করে গেছেন তাঁর অন্যান্য ভুমিকাকে তাচ্ছিল্য করেই । যেখানে চার্চিল এমনকি স্তালিনও নির্ভর করেছেন তাঁর জেনারেলদের উপর । নিজেকে মিলিটারি জিনিয়াস ভাবা হিটলার জেনারেলদের উপর ভরসা করেননি , এমনকি তাঁর কিছু যোগ্য জেনারেলকে তিনি বরখাস্ত পর্যন্ত করেছিলেন , যাঁরা তার সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছিলেন বা সমালোচনা করেছিলেন । শেষে ১৯৪৪ এ যখন প্রায় পরাজয়ের দোরগোরায়, তিনি জার্মানীর অন্যতম সামরিক প্রতিভা জেনারেল গুডেরিয়ান (Guderian) কে নিয়োগ করেন কম্যন্ডার হিসেবে যাঁকে আগে তিনি বরখাস্ত করেছিলেন । কিন্তু তার পরেও হিটলার তাঁর কম্যান্ডারের উপদেশ মানেননি ।
একনায়কদের এরকম গোঁয়ার্তুমি থাকে বোধহয় ! হিটলারের মত নিজেকে জিনিয়াস ভাবা , কিংবা স্তালিনের মতো শুধু সন্দেহের বশে অসংখ্য গুপ্ত হত্যা করানো , এমনকি নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসককে পর্যন্ত রেহাই নাদিয়ে ক্রমশ নিজেদের মানসিক অসুস্থার নমুনাই প্রতিষ্ঠা করেছেন ইতিহাসে ।
সবথেকে জরুরী লক্ষ্য ‘প্লোয়েস্তি’(Ploesti)
বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময় থেকেই মিত্র শক্তির যুদ্ধ – পরিকল্পনাকারীরা জানতেন যে জার্মান সেনাবাহিনী চূড়ান্তভাবে নির্ভরশীল তাদের একমাত্র তৈলক্ষেত্র ও শোধনাগার রোমানিয়ার প্লোয়েস্তির উপর । জার্মানরাও তা জানতো বলাই বাহুল্য , তাই তারা কয়লা এবং অন্যান্য পদার্থ থেকে জ্বালানী উৎপাদনের এক ব্যয়বহুল ব্যাবস্থা গড়ে তুলেছিলো । তবুও , জার্মান সেনা বিশেষতঃ বিমান বাহিনী চূড়ান্তভাবে নির্ভরশীল ছিলো প্লোয়েস্তির তেলের উপরেই । বৃটিশ ও রাশিয়ার যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা এই তথ্য জানতো ১৯৪০ থেকেই । জার্মান সেনা ও বিমান বাহিনী ছিলো প্লোয়েস্তির রক্ষার জন্য । শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪ সালে পরিকল্পনা মাফিক লাগাতার বোমাবর্ষনের মাধ্যমে প্লোয়েস্তির তৈল শীল্পকে ধ্বংস করা হয় , রাশিয়ার সেনা বাহিনী যখন জার্মানী দখল করে । জার্মান বাহিনী জ্বালানীর অভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে । কিন্তু এই কাজ আরও অনেক আগেই করা উচিত ছিলো ।
জার্মানী পোল্যান্ড দখল করে ১৯৩৯ সালে । এবং রাশিয়া আক্রমন করে ১৯৪১এ , এই ২১ মাসে রাশিয়া নিজেদের প্রস্তুত করার পাশাপাসি চেষ্টা করছিলো কিভাবে জার্মান আক্রমনকে বিলম্বিত করানো যায় । রাশিয়া জার্মানীর সঙ্গে অনাক্রমন চুক্তি করে , এবং তাদের জার্মান বিরোধী প্রচারও বন্ধ করে দেয় এই শর্তে যে তারা হিটলার বাহিনীকে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করবে । এতে রাশিয়া তার সামরিক শক্তিকে আরও পশ্চিমে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় এবং তারা আক্রমন করে লিথুনিয়া ,লাতভিয়া , এস্তোনিয়া , পোল্যান্ড এবং ফিন ল্যান্ড এবং ১৯৪০ এর জুনে যখন ফ্রান্স আত্মসমর্পন করলো , রাশিয়া বিনা যুদ্ধেই তার সঙ্গে যুক্ত করলো রোমানিয়ার প্রান্তে বেসারাভিয়া ও বুকোনিয়া ।
এরপরের চারমাসে , যখন জার্মান বাহিনী ফ্রান্স ছেড়ে ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাস্ত , বিরাট রাশিয়ান বাহিনী প্লোয়েস্তির মাত্র ১০০ মাইল দূরে অবস্থান করলো । যদি রাশিয়ান বাহিনী সঠিক পরিকল্পনা মাফিক প্লোয়েস্তি আক্রমন করতো তখন ,তাহলে তাদের বাধা দেওয়ার কেউ ছিলোনা । কিন্তু স্তালিন দ্বিধা করলেন এবং হিটলার চার মাস পর বিশাল জার্মান বাহিনী নিয়োজিত করলেন প্লোয়েস্তি রক্ষার জন্য , এবং তার ৯ মাস বাদে জার্মানী রাশিয়া আক্রমন করলো । যদি সেদিন স্তালিন দ্বিধা না করতেন তবে যুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকম হতো ।
১৯৪১এর এপ্রিলে বৃটিশ বাহিনী গ্রীসের মূল ভুখন্ড ছেড়ে বৃহৎ গ্রীক দ্বীপ ক্রেটে(Crete) স্থানান্তরিত হয় , সেখান থেকেও বৃটিশ বাহিনীর থেকে সংখ্যায় কম জার্মান প্যারাট্রুপারদের দ্বারা উৎখাত হয় , কারন তারা জার্মানদের মতো মরিয়া লড়াই করেইনি ক্রেট দ্বীপকে দখলে রাখার জন্য । যদি তারা করতো এবং ক্রেট তাদেরই দখলে থাকতো তাহলে ক্রেটের ৭০০ মাইল উত্তরে অবস্থিত প্লোয়েস্তি আক্রমন করতে পারতো তাদের ভারি বোমারু বিমান দ্বারা । যদি বৃটিশ বিমান বাহিনীর কম্যান্ডার চার্চিলকে জানাতো যে ক্রেট দ্বীপই একমাত্র জায়গা যেখান থেকে প্লোয়েস্তি আক্রমন করা সম্ভব এবং চার্চিল নির্দেশ দিতেন যেভাবেই হোক ক্রেট দখলে রাখার তাহলে জার্মান বাহিনী অনেক আগেই পরাজিত হতে পারতো ।
জার্মান বাহিনীর রাশিয়া আক্রমনের পর সিংহ ভাগ রাশিয়ার বিমান ধ্বংস হয়ে গেলেও রাশিয়ার বিমান বাহিনী বেশ বড় সংখ্যায় রক্ষা করতে পেরেছিলো ইল্যিউশিন -৪ (Ilyushin- 4) নামক দূরপাল্লার বোমারু বিমান গুলি , যা যুদ্ধের সময় পূর্ব ইউরোপ এমনকি বার্লিনেও বোমা বর্ষন করেছিলো । কিন্তু তারা সেভাবে প্লোয়েস্তির উপর আক্রমন করেনি । মূলতঃ রাশিয়ার বিমান ও নৌ বাহিনী কৌশলগতভাবে তাদের স্থল সেনাকে সহোযোগিতাই করে থাকতো । যুদ্ধস্থলের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই তারা শুধুমাত্র আক্রমন করতো । যদি রাশিয়ার বিমান বাহিনী প্লোয়েস্তির তৈলশীল্প ধ্বংসের প্রয়াস করতো তাহলে রাশিয়ায় অনুপ্রবেশকারী জার্মান বাহিনী শীতে কাবু হওয়ার আগেই তেলের যোগানের অভাবে পরাজিত হতো ।
এই জন্যই বলা হয় শত্রুর শেষ রাখতে নেই । একদিকে জার্মানরা যেমন রাশিয়ার বিমানবাহিনীর লেজটুকু রেখে দিয়েছিলো , উলটো দিকে অকারনে ভাবুক হয়ে রাশিয়া তার ক্ষমতার ব্যাবহার থেকে বিরত থেকে জার্মানীকে সুযোগ করে দিয়েছিলো আরো অনেকদূর এগোতে ।
আত্মতুষ্টি
হিটলারের বিষয় বৃটেন ও ফ্রান্সের আত্মতুষ্টি এক চরম ভুল । প্রথম দিকে হিটলারের জার্মানী দূর্বল থাকলেও ধীরে ধীরে তারা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করছিলো এবং আক্রমনাত্মক হয়ে উঠছিলো । অপরদিকে আত্মতুষ্ট বৃটেন ও ফ্রান্স তাদের বাহিনীর উন্নয়ন সাধনে বিরত ছিলো । ফলসরূপ , জার্মানী যখন ফ্রান্স আক্রমন করলো তখ ফ্রান্স একটি তুলনায় দূর্বল ও অ-আধুনিক বাহিনী। চেক রিপাব্লিককে হিটলারে হাতে ছেড়ে দেওয়ায় জার্মান বাহিনী চেক বাহিনীর অস্ত্র-শস্ত্রকেও উপযুক্ত করে ব্যাবহার করতে সক্ষম হলো যা প্রায় ৪০ কম্পানী বাহিনীর উপযুক্ত । এতে হিটলার আরো শক্তিশালী হয়ে উঠলো ।
ফ্রান্স কি ভেবেছিলো কে জানে ! আর যুদ্ধ হবে না ! ইতালি - ফ্রান্স - ইংল্যান্ড -জার্মানী গলায় গলায় ভাই ভাই হয়ে থাকবে ! যেখানে গোকূলে বাড়ছে হিটলার নামক এক আশ্চর্য ক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধন্মাদ একনায়ক !
আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা
যদিও আমেরিকা বৃটেনকে সাহায্য করছিলো এবং জাপানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিলো ১৯৪১ নাগাদ , তবুও আমেরিকার জনগন এই যুদ্ধে জড়াতে ইচ্ছুক ছিলোনা । কিন্তু জাপানের এই চিন্তা যে আমেরিকা তার নৌবহর নিয়ে জাপানের দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া অভিযানে বাধা দিতে পারে – এক বিরাট ভুল বলেই গন্য । এই চিন্তার বশবর্তী হয়ে তারা আক্রমন করে বসে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটিকে । পার্লা হারবারে আক্রমনের পর আমেরিকাও জড়িয়ে পরে যুদ্ধে । এদিকে মুসোলিনি ও হিটলার ইতিমধ্যেই রাশিয়ার ও বৃটেনের সঙ্গে যুদ্ধে চরম সমস্যায় থাকা স্বত্ত্বেও তারা আমেরিকার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষনা করে । এতে আমেরিকা যাবতীয় দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে মিত্র শক্তির হয়ে পূর্নাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং জার্মানী - ইতালি - জাপানের জোটের হার নিশ্চিত করে ।
খুঁচিয়ে ঘা করলে যা হয় আর কি ! ‘পার্ল হারবার’ সিনেমায় সেই জাপানী নৌবাহিনীর এডমিরালের কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে – “ আমরা এবার এক ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগিয়ে দিলাম ...”
পরিশেষ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলে আরও এরকম বহু কারন হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে , এটা নাহলে ওটা হলে ভালো হতো - এরকম । কিন্তু কয়েককোটি মানুষের প্রান নেওয়া , চরম ধ্বংসের এই মহাযুদ্ধের শেষে মানবজাতির প্রাপ্তির ভাঁড়ার দেখলে মনে হতে বাধ্য - প্রধান ভুলের কথাতো এখানে বলাই নেই ! আগ্রাসনের ভুল , একনায়কতন্ত্রের ভুল , বর্ণবিদ্বেষের ভুল , সর্বোপরি –যুদ্ধ্বচিন্তার ভুল ... যে ভুলগুলি মানবজাতি আজও বহন করে চলেছে ।
নাঃ ... ভুলেও ভাববেননা এ লেখা সভ্যতার সবথেকে বড় ও বিধ্বংসী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো অলৌকিক বিকল্পের গল্প বলবে । শুধু কিছু বাস্তব ও যুক্তিসম্মত বিকল্প সিদ্ধান্তের কথাই শুধু বলবে – যা নেওয়া হয়নি , যেগুলি নিলে যুদ্ধের অভিমুখে নাটকীয় পট পরিবর্তন হতো । এই বিপুল ভয়ংকর যুদ্ধ হয়তো বেশ কিছুদিন আগেই শেষ হতে পারতো , কমতে পারত উভয় পক্ষের রক্তক্ষয়ের পরিমান , প্রানহানির সংখ্যাও ।
ভুল সিদ্ধান্ত , হঠকারী সিদ্ধান্ত , মস্ত সব লোকের দূরদর্শিতার অভাব এই বিপুল , পরিকল্পিত যুদ্ধের বাজারে শুধু নিজেদের বাহিনীকেই নয় , দেশবাসীকেও ঠেলে দিয়েছিলো চরম ধ্বংসের মুখে , পরাজয়ের দিকে ... আসুন ,এর কিছু যুদ্ধ-তাত্ত্বিক কারন অনুসন্ধান করি ...
অতিঅল্প ডুবো জাহাজ – জার্মানি
যেমনটি দেখা গেছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে । জার্মান নৌ বাহিনীর মুল লক্ষ্য ছিলো বিচ্ছিন্ন ব্রিটিশ দ্বীপের সমুদ্রপথকে অবরুদ্ধ করা , যা কিনা ব্রিটেনের লাইফ লাইন । দ্বীপরাষ্ট্র সম্পূর্ন নির্ভরশীল সামুদ্রিক জাহাজ দ্বারা আমদানীকৃত জ্বালানি ,ধাতু এবং অত্যাবশ্যিক আরও বহু জিনিসের উপর ।
সেই পথ অবরুদ্ধ হলে বৃটেনের যাবতীয় উৎপাদন ব্যাবস্থা , সামরিক উৎপাদন ব্যাবস্থা পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়বে , ভেঙে পড়বে । স্থবীর হয়ে পড়বে বৃটেনের বায়ুসেনা , তাদের গর্বের নৌবহর ,স্থল সেনাও । তখন জার্মান বোমারু বিমানের লাগাতার বোমা বর্ষনে ভেঙে পড়তে বাধ্য যাবতীয় বৃটিশ প্রতিরোধ –এটাই বাস্তব।
এই কাজে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সাবমেরিন বাহিনী চরম আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিলো । তারা অসংখ্য বৃটিশ বানিজ্যতরী ডুবিয়ে দিয়েছিলো আটলান্টিক মহাসাগরে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও জার্মান নৌবাহিনী চরম চিন্তার কারন হয়ে ওঠে ব্রিটিশ রয়্যাল নৌবহরের ,কারন জার্মান তার বিপুল সম্পদ ব্যয় করছিলো বৃহৎ যুদ্ধ জাহাজ ও ক্রুজারের জন্য । কিন্তু বহু চেষ্টাতেও জার্মান নৌবহর তাদের কাঙ্খিত সাফল্য পাচ্ছিলো না । জার্মান নৌবহর প্রধান এডমিরাল রোয়েডার এক চরম ভুল করেন এসময় । জার্মান ডুবোজাহাজ বাহিনীর প্রধান ডোয়েনিৎজ বারংবার সাবমেরিন উৎপাদন বাড়াবার অনুরোধ করলেও এডমিরাল রোয়েডার তা নসাৎ করে দেন এই যুক্তিতেই যে রয়্যাল নৌবহর দাবী করছে – তারা নাকি সাবমেরিন সমস্যা প্রতিহত করার এক নতুন ও অভিনব পদ্ধতি (ASDIC) আবিষ্কার করে ফেলেছে , সেটি একটি নতুন যন্ত্র যা জলের তলায় সাবমেরিনকে চিহ্নিত করতে পারবে অনায়াসে - তাই অনর্থক সাবমেরিন বাড়িয়ে লাভ নেই । বৃটিশ নৌবহরের এমন দাবীর সত্যতা যাচাই নাকরে এরকম সিদ্ধান্ত না নিলে জল অন্য দিকেই গড়াতো ।
ফলস্বরূপ , ১৯৩৯ এ যখন যুদ্ধ শুরু হলো জার্মান নৌবহরে তখন ৩টি বড় যুদ্ধজাহাজ , ৮টি ক্রুজার এবং আরও কটি তৈরীর পথে ,এবং মাত্র ১২টি সাবমেরিন ! যা আটলান্টিক সাগরে যুদ্ধে সক্ষম । এর সঙ্গে ছিলো ৪৩টি ছোটো সাবমেরিন ,মুলতঃ উপকূল রক্ষার জন্য ও প্রশিক্ষণের জন্য । যেখানে ডোয়েনিৎজ এর দাবী ছিলো অন্তত ৩০০ আটলান্টিক সাবমেরিন , যার ১০০টি সবসময় প্রস্তুত থাকবে ।
যুদ্ধ শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেলো ডোয়নিৎজ কতটা সঠিক ছিলেন । জার্মান সাবমেরিন বাহিনী মারাত্মক বিপদের কারন হয়ে উঠলো বৃটিশ রয়্যাল নৌবহরের ,সংখ্যায় খুব কম হওয়াতেও । জার্মান সাবমেরিনের সংখ্যা এবার বাড়ানো হতে লাগলো বাস্তবতা মেনে , কিন্তু তা হতে লাগলো খুব ধীরে । এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বৃটিশ বাহিনী নিজেদের টিঁকিয়ে রাখলো এবং ক্রমাগত উন্নত করতে লাগলো তাদের সমরসম্ভারের । ১৯৪৩ নাগাদ জার্মান নৌবহরের কাছে এলো মোট ৪০০ সাবমেরিন , কিন্তু ততোদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে , তারা এবার সম্মুখীন হলো আরও উন্নত , চরমবিধ্বংসী সাবমেরিন প্রতিরোধী শক্তির সামনে – যা তাদের পরাজয়ের কারণ হলো ।
একথা বলে রাখা দরকার । যে শ্রম ও লোকবল একটি বৃহৎ যুদ্ধজাহাজ (Battleship) তৈরী করতে ও চালাতে লাগে সেই শ্রম ও লোকবলে ৫০টি আটলান্টিক সাবমেরিন তৈরী ও চালনা করা যেত । যদি এডমিরাল রোয়েডার বা হিটলার ডোয়েনিৎজকে সমর্থন করতেন যুদ্ধের আগে , অন্তত ১৫০টি মতো সাবমেরিন দিতেন ৩টি প্রায় বেকার যুদ্ধজাহাজের পরিবর্তে ১৯৪০ নাগাদ তাহলে বৃটিশরা যুদ্ধে পরাজিত হতো ১৯৪১ এর আগেই , আমেরিকা ও রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগেই জার্মানরা যুদ্ধ জিতে যেত ।
অতি অল্প ডুবোজাহাজ – আমেরিকা
এটা প্রমাণিত সত্য যে আমেরিকার বিপুল যুদ্ধ -উৎপাদন ক্ষমতা এক অন্যতম কারণ তাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভের । যুদ্ধের সময় মার্কিন নৌবহর দ্রুত এক বিপুল ও শক্তিশালী আকার ধারণ করে । কিন্তু তাদের উৎপাদনশীলতা ও সম্পদের সামান্য অংশ নিয়োজিত হয় সাবমেরিন নির্মানে । মাত্র ২৮৮টি সাবমেরিন , যা জাপানের প্রচুর বানিজ্যিক জাহাজকে ধ্বংস করে জাপানের জ্বালানী সরবরাহ বিঘ্নিত করে ও যুদ্ধ সরঞ্জাম আমদানীর অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় । ইতিমধ্যে জার্মানরা তৈরী করে ফেলেছে ১১৭০টি সাবমেরিন । আমেরিকা যদি তাদের সম্পদ ও যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনের আরো কিছুটা অংশ সাবমেরিন উৎপাদনে ব্যয় করতো ,আরো ১০০০-১৫০০ সাবমেরিন উৎপাদন করতো , যা তারা সহজেই পারতো ,তাহলে তারা জাপানের সম্পুর্ন বানিজ্যিক নৌবহর ধ্বংস করতে পারতো । জাপানের জ্বালানী ও অন্যান্য সরঞ্জাম আমদানী বন্ধ হয়ে যেত পুরোপুরি । তাদের যুদ্ধকালীন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেত । স্থবীর হয়ে যেত জাপানের বায়ুসেনা , সামরিক নৌবহর , এবং দুবছর আগেই আনবিক বোমা ছাড়াই জাপান পরাজিত হতো । ভাবুন ! আনবিক বোমার যে বিধ্বংসের অভিশাপ আজও পৃথিবী বহন করছে , হতে পারতো তা এড়ানো যেত বহু আগেই । কিন্তু তা হয়নি কিছু সিদ্ধান্তগত গাফিলতির জন্য শুধুমাত্র ।
উত্তর প্রশান্ত মাহাসাগরীয় অঞ্চলকে অবহেলা
১৯৪৪ এর শেষের দিকে শুরু হয় জাপানের একের পর এক শহরে বিধ্বংসী কৌশলগত বোমাবর্ষন যা জাপানকে কিছুদিনের মধ্যে বাধ্য করে আত্মসমর্পন করতে । কিন্তু ইতিমধ্যে যুদ্ধের মহার্ঘ তিন তিনটি বছরে পেরিয়ে গেছে । জাপান তার আগেই পিছু হটে এটা জরুরী ছিলো , যতক্ষননা মার্কিন বায়ুসেনা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপগুলিতে নিজেদের দখল কায়েম করে যতটা সম্ভব জাপানের মূ্লভূখন্ডের কাছাকাছি আসতে পারে এবং জাপানের উপর বোমাবর্ষন করতে পারে । আর এক উপায় ছিলো মার্কিনীরা উত্তর দিক দিয়ে জাপানকে যদি আক্রমন করতো । সে সুযোগ যে ছিলো তার প্রমান ১৯৪২ এর ডুওলিটল রেইড (Doolittle Raid), যখন টোকিওর উপর প্রথমবার বোমাবর্ষন করা হয় । কিন্তু আশ্চর্যভাবে তা মাত্র একবারই করা হয় ।
১৯৪১ অবধি রাশিয়া ব্যাস্ত ছিলো তার ও জাপানের মধ্যে দূর প্রাচ্যের যুদ্ধে । এবং তারপর ১৯৪১-১৯৪২ রাশিয়া মরিয়া ছিলো জার্মান আগ্রাসন প্রতিহত করতে , স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ(ফেব্রুয়ারি -১৯৪৩) শেষ হতে হতে রাশিয়া বুঝে গেছিলো এই যুদ্ধে তারা জিততে চলেছে , জাপান ও জার্মানরা হারতে চলেছে । যুদ্ধের কূটনীতিতে রাশিয়া তার সমগ্র মনোযোগ জার্মানীকে পরাজিত করাতেই দিক এবং জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ ছেড়ে দিক আমেরিকার জন্য – সেটাই ছিলো সুবিধাজনক । এতে রাশিয়ার উৎপাদানগত সমর্থনের ক্ষেত্রেও রাশিয়া লাভবান হয় । যুদ্ধে রাশিয়া বৃটিশ বায়ুসেনাকে তার এয়ার বেস ব্যাবহারের সুযোগ দেয় ,যাতে তারা জার্মানীর উপর বোমাবর্ষন করতে পারে ।কিন্তু একইভাবে আমেরিকার বায়ুসেনাকে তার দূর প্রাচ্যে অবস্থিত এয়ার বেস ব্যাবহার করতে দিতে অস্বীকার করে । অপরদিকে জাপানের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে যাতে জাপান রাশিয়ার দূর প্রাচ্যের বন্দরগুলিতে আসতে থাকা আমেরিকার রসদভর্তি জাহাজগুলি আক্রমন না করে ।
আমেরিকার আলাস্কা ও আলেটিয়ান দ্বীপের(Aleutian islands) এয়ার বেস থেকে জাপানের উপর বোমা বর্ষন করা অসম্ভব ছিলো দূরত্বের কারনে । কিন্তু রাশিয়া পূর্ব প্রান্তে ছিলো বিস্তীর্ন অঞ্চল যা জাপানের উত্তর প্রান্ত ও আলাস্কার পশ্চিম প্রান্ত , এবং এই অঞ্চল জাপানি সেনা ও নৌবাহিনীর নাগালের বাইরে । যদি কোনোভাবে আমেরিকা , কোনো প্রলোভনে রাশিয়াকে রাজি করাতে পারতো তাদের দূর প্রাচ্যের এয়ার বেস গুলি ব্যাবহার করতে দিতে আমেরিকা বৃহৎ বোমারু বিমানগুলির জন্য তাহলে প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলে এত দীর্ঘ , ব্যায়বহুল ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করতে হতোনা আমেরিকাকে জাপানকে হারাতে । ১৯৪৩ নাগাদই আমেরিকার বায়ুসেনা জাপানে পৌঁছে যেত এবং জাপান পরাজিত হতো অন্তত একবছর আগেই ।
বোঝাই যাচ্ছে উপযুক্ত সময়ে সঠিক কূটনীতিগত অবস্থান না নেওয়ার কারনে আমেরিকা ট্রেন মিস করে , এবং তার মূল্য দিতে হয় তাকে এবং বিশ্বকেও ।
যোগ্য যুদ্ধ বিমান বাতিল করা
১৯৪২ অবধি বৃটিশ বিমান বাহীনি ব্যাবহার করতো এমন একটি যুদ্ধ বিমান যা অন্য বৃটিশ ও আমেরিকান বোমারু বিমানের থেকে দিন বা রাতের যুদ্ধে অনেক বেশী পারদর্শী । যার নাম ছিলো ‘মশকিউটো’(Mosquito) । এটি ছিলো অনেক বেশী গতিসম্পন্ন , যাকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব ছিলো , এতে ছিলো পালটা প্রতিরোধ ভাঙ্গার উপযুক্ত মেশিনগান ও গানম্যান । ভারি বোমারু বিমানের থেকে বোমা নিক্ষেপে এই বিমান ছিলো অনেক বেশী নিখুঁত ও কার্যকর ।
এই বিমানের কার্যক্ষমতা প্রমানিত ইউরোপের যুদ্ধে । এই বিমান জার্মান বিমানের থেকে বেশী গতি সম্পন্ন হওয়ায় এর ক্ষতির পরিমান অন্তত ১০ ভাগ কম ছিলো ভারি বোমারু বিমানের থেকে , যদিওবা ধ্বংস হতো, তাতে থাকতো মাত্র দুজন দক্ষ বায়ু সেনা । যেখানে অপেক্ষাকৃত শ্লথ ভারি বোমারু বিমানে থাকতো সাতজন বায়ু সেনা । তাই মানব সম্পদের দিক দিয়েও ক্ষতির পরিমান কম ছিলো । একটি মসকিউটো বিমানের নির্মান খরচ ছিলো ভারি বোমারু বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ।
কিন্তু কোনো এক রহস্যজনক ও অযৌক্তিক কারনে এই মশক বিমান বাহিনীকে বৃটিশ বিমান বাহিনীর কম্যান্ড ভারি বোমারু বিমান বাহিনীকে সাহায্য করা থেকে বিরত রাখে । যদি এরকম করা না হতো , যদি এই অপেক্ষাকৃত ছোট, গতিশীল ও কার্যকর বিমানকে আরও বেশী মাত্রায় কাজে লাগানো হতো বা মূল আক্রমনকারী বিমান বাহিনী হিসেবেই ব্যাবহার করা হতো তাহলে ফলাফল অন্যরকম হতো । ফলতঃ ভারি , শ্লথ এবং বোমা বর্ষনের তেমন নিখুঁত নয় এমন বিমান ব্যাবহারে ফলে প্রায় ১০ লক্ষ টন বোমা জার্মানী জুড়ে ফেলা হলেও যার বেশীরভাগ কার্যকরী হয়নি । এবং এতে বৃটিশ বিমান বাহিনীকেও সহ্য করতে হয় ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির । এই পরিমান বোমা যদি মসকিউটো বিমান দ্বারা ফেলা হতো তাহলে ক্ষতির পরিমান কম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জার্মানীর সামরিক উৎপাদনকে আরও আগে গুঁড়িয়ে দেওয়া যেত ও জার্মানী পরাজিত হতো ।
এতো যেন টিমের সব থেকে চটপটে স্ট্রাইকারকে প্রথম এগারোয় না রেখে সাইড লাইনে বসিয়ে ম্যাচ খেলতে নামার সামিল ! অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট বোধহয় একেই বলে ।
ইতালির ‘গ্রীস’রোমাঞ্চ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুথেকেই প্রচারে প্রাধান্য পাচ্ছিলো হিটলার তথা জার্মানী । এই নিয়ে ইতালির একনায়ক মুসোলিনীর কিছু হীনমন্যতা ছিলো । জার্মানী ফ্রান্স আক্রমন ও দখল করায় মুসোলিনি আরও অধৈর্য ও মরিয়া হয়ে পড়ে নিজেকে প্রমান করার জন্য । তার ইচ্ছে ছিলো বিশ্ব জানুক জোটের আসল শক্তি ইতালি ।এই মরিয়া চিন্তা থেকেই মুসোলিনি গ্রীস আক্রমন করার হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয় । ২৮অক্টোবর ১৯৪০এ ইতালি আক্রমন করে গ্রীসকে । কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় গ্রীস সহজ ঠাঁই নয় ! গ্রীকরা প্রতি আক্রমনে ৫,৩০,০০০ ইতালীয় বাহিনীকে কার্যত পিছু হটতে বাধ্য করে । আবার প্রতি আক্রমনেও ১৯৪১ এ ইতালি বিশেষ সুবিধা করতে পারেনা , এরপর হিটলারের জার্মান নাজি বাহিনী এসে ইতালিকে উদ্ধার করে । ২৩ এপ্রিল ১৯৪১এ গ্রীস পরাজিত হয় শেষ পর্যন্ত । কিন্তু এতদিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে , ইতালির মুখ পোড়ার সাথে সাথে ইতালিকে সাহায্য করতে গ্রীসে ব্যাস্ত জার্মান বাহিনী মূল্যবান ৫ সপ্তাহ দেরী করে ফেলেছে রাশিয়াকে আক্রমন করতে , যারজন্য তাদের রাশিয়ার অসহ্য শীত পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হয় এবং কার্যত জার্মান সেনা জেতা যুদ্ধ হেরে যায় । এরজন্য রাইখের শেষ সময় হিটলার মুসোলিনিকেই দায়ী করে ।
মুসোলিনীর এই ‘হাম কিসিসে কম নেহী’ মার্কা মানসিকতা আখেরে তার এবং তার জোট সঙ্গীদের পক্ষে চরম ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায় । মুসোলিনীর ব্যাপারটা ছিলো ‘গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল’ টাইপের ।
হিটলারের ‘টোটাল ওয়ার’ ,কিন্তু ঘর বাদ দিয়ে
হিটলারের ঘোষিত ‘টোটাল ওয়ার’ ছিলো মুলতঃ অন্য দখলকৃত দেশের মাটিতেই । একথা সত্য যে জার্মান নাজিবাহিনী বিপুল শৌর্য এবং তার সঙ্গে চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় রেখেছে তাদের জেতা যুদ্ধগুলিতে । পরিকল্পনামাফিক বিভৎস গনহত্যা থেকে সীমাহীন অত্যাচারে তারা বিপর্যস্ত্য করে তুলেছিলো পূর্ব ইউরোপের মানুষদের । উল্টোদিকে মিত্র শক্তির দেশগুলি সুঠাম পরিকল্পনায় বাড়িয়ে তুলছিলো তাদের সামরিক উৎপাদন ,যা ১৯৪৪ অবধি জার্মানীর ক্ষেত্রে সেভাবে দেখা যায়নি । মিত্রশক্তির কারখানাগুলি ২৪ ঘন্টা-৭দিন উৎপাদন করছিলো , লক্ষ লক্ষ নারীও যুক্ত হয়েছিলো সেখানে কারাখানা শ্রমিক হিসেবে , যেখানে জার্মান মহিলাদের তখনও ঘরে বসিয়ে রাখা হয়ছিলো ।শুধুমাত্র বন্দিদেরকে কাজে লাগানো হতো ।
মিত্রশক্তি উৎপাদন করছিলো কিছু নির্দিষ্ট যুদ্ধ সরঞ্জাম ,যা সাধারন অথচ বিশ্বস্ত ও কার্যকর । উল্টোদিকে জার্মানরা একসঙ্গে বহুবিধ সরঞ্জাম উৎপাদন করছিলো । যাতে করে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছিলো , সম্পূর্ন জার্মান বাহিনীকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে তারা অসুবিধায় পরছিলো । হিটলার মশগুল ছিলেন বিভিন্ন অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের পরিকল্পনায় যা তখনও ঠিক ঠাক তৈরী হয়েই ওঠেনি । শেষ পর্যন্ত হিটলার এলবার্ট স্পিয়ার( Albert Speer)বলে একজন যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন বিশেষজ্ঞকে দায়ীত্ব দেন ,যদিও সে দায়ীত্ব নিরঙ্কুশ ছিলোনা এবং ততোদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে ।
একনায়কদের চরম ব্যক্তিগত ভুলগুলি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুই অন্যতম প্রতাপশালী ও নিষ্ঠুর একনায়ক ছিলেন হিটলার ও স্তালিন । দেশ তথা বাহিনীর যাবতীয় মূল সিদ্ধান্ত নিতেন এঁরাই । তাঁদের অধস্তনদের তাঁদের সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করা বা সমালোচনার করার অধিকার ছিলোনা একেবারেই ,সে যতই তাঁরা ভুল সিদ্ধান্ত নিননা কেন । জরুরী কারনে তাঁদের গভীররাতে ঘুম ভাঙ্গানোর অনুমতি পর্যন্ত ছিলোনা । একনায়কদের সিদ্ধান্ত বদলের কোনো অধিকার ছিলোনা কারও , এমনকি তা ভুল প্রমান হওয়ার পরেও । এরকমই কিছু ভুলের উদাহরন রইল এখানে –
১৯৪১ এর গ্রীষ্মে রাশিয়া আক্রমনের পর হিটলারের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিলো কিভাবে শীত পড়ার আগেই রাশিয়াকে সম্পূর্ন পরাজিত করা যায় । কিন্তু হিটলার মাঝপথে যুদ্ধের অভিমুখ অন্য দিকে নিয়ে যান , এবং আবার রাশিয়ায় মনোনিবেশ করেন সেপ্টেম্বরে । কিন্তু ততোদিনে বেশ দেরী হয়ে গেছে । এবং যার ফল জার্মান বাহিনীকে সামগ্রিক যুদ্ধেই ভুগতে হয় ।
জার্মানীর রাশিয়া আক্রমন করায় রাশিয়াবাসীর কাছে স্তালীনের স্বৈরাচার থেকে মুক্তির এক পথ বলে মনে হয় প্রাথমিকভাবে । জার্মান বিখ্যাত প্রচারযন্ত্রর কর্মসূচীও সেই দিকেই হওয়া উচিত ছিলো , কিন্তু হিটলার কঠিন নির্দেশ দেন তাঁর বাহিনীকে বর্নবিদ্বেষ নির্ভর কার্যকলাপের ,চরম নিষ্ঠুরতার । কিছুদিনের মধ্যেই অত্যাচারীত রাশিয়াবাসী বুঝতে পারেন স্তালিন অত্যাচারী স্বৈরাচারী হলেও ,হিটলার তার থেকেও জঘন্য । যা রাশিয়ার জনগনকে জার্মান বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে , যা হয়ে ওঠে জার্মান বাহিনীর জন্য কঠিনতম লড়াই ।
১৯৪০ এ হিটলার বৃটিশ বাহিনীকে পরাজিত করার দু-দুটি চরম সুযোগ হাতছাড়া করেন । যখন ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের মিশ্র প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে , তখন হিটলার নির্দেশ দেন জার্মান ট্যাঙ্ক বাহিনী যেন ডানক্রিক(Dunkirk) উপকূলে অবরোধকারী ৩ , ৩৮, ০০০ বৃটিশ সেনাকে আক্রমন না করে । এর কোনো ব্যাখা না দিলেও মনে করা হয় যে তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও বিমান বাহিনীর কম্যান্ডার গোয়েরিং ( Goering) এর অনুরোধেই এমন করেছিলেন তিনি । গোয়েরিং এর ইচ্ছে ছিলো তাঁর বিমান বাহিনী আকাশ থেকেই বৃটিশ সেনাকে ধ্বংস করুক । তাই জার্মান বাহিনীর সবথেকে শক্তিশালী ট্যাঙ্ক বাহিনী অল্পদূরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখেছিলো এবং বৃটিশ বাহিনীকে সুযোগ করে দিয়েছিলো কৌশলগত পিছু হটতে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে । আবার তিন মাস পর যখন জার্মান বিমান বাহিনী তুলনায় ছোট বৃটিশ বিমান বাহিনীকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে তখন আচমকা হিটলার নির্দেশ দেন বৃটিশ বিমান বাহিনীকে ধ্বংস না করে বৃটিশ জনতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে লন্ডনের উপর বোমা বর্ষনের । তাতে ফল হয় এরূপ , বৃটিশ বিমান বাহিনী নিজেদের গুছিয়ে নেয় ও প্রতি আক্রমনে যুদ্ধ জিতে নেয় । ব্রিটেন রক্ষা পায় জার্মান অনুপ্রবেশ থেকে ।
১৯৪১ স্তালিন তাঁর সামরিক গোয়েন্দা ও চরদের থেকে জানতে পারেন যে জার্মানরা রাশিয়া আক্রমন করার পরিকল্পনা করছে । কিন্তু সেই তথ্যকে তিনি গুরুত্ব দেননি । যখন জার্মান বাহিনী দোরগোড়ায় , এবং যাবতীয় তথ্য জার্মান আক্রমনকেই নির্দেশ করছে , তখনও স্তালিন তাঁর উপদেষ্টাদের নির্দেশ দেন কেউ যেন এ নিয়ে তাঁকে বিরক্ত না করে । শাস্তির ভয় আর কেউ তাঁকে এনিয়ে কোনো খবর জানায় না । শেষ পর্যন্ত যখন আক্রমন শুরু হলো তখন স্তালিনের ডেপুটি কম্যান্ডার জুকভ(Zhukov) স্তালিনের দেহরক্ষীদের বলেন যে তিনি দায়ীত্ব নিচ্ছেন স্তালিনকে ঘুম থেকে তুলে এই দুঃসংবাদ দেওয়ার । কিন্তু ততোক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেছে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের অন্যতম আক্রমনাত্মক ও শক্তিশালী সঙ্গী ছিলো জাপান । হিটলার জানতেন জাপান হয় উত্তর দিক দিয়ে আক্রমনের কথা চিন্তা করবে , যেখান তারা এক অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো রাশিয়ার পূর্বপ্রান্তে । কিংবা তারা দক্ষিন দিকে আক্রমন করবে , দক্ষিন-পূর্ব-এশিয়া এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে । কিন্তু তিনি কোনোরকম যোগাযোগের আদান প্রদান করেননি এমনকি রাশিয়া আক্রমন করার পূর্বে জাপানকে তা জানাননি পর্যন্ত । যদি তিনি তা করতেন তাহলে জাপান আরও অন্তত ৮ মাস রাশিয়াকে যুদ্ধে ব্যাস্ত রাখতো , যা জার্মান বাহিনীকে রাশিয়ার বিরাট সেনাকে পরাস্ত করে মস্কো পৌঁছতে সাহায্য করতো ১৯৪১ এর ডিসেম্বরেই । সেখানে হলোকি জার্মানীর রাশিয়া আক্রমনের ব্যাপারে অন্ধকারে থাকা জাপান রাশিয়ার সঙ্গে দুমাস আগেই এক অনাক্রমন চুক্তি করে বসে । ফলে যখন যুদ্ধক্লান্ত ও রাশিয়ার প্রচন্ড শীতে কাতর জার্মান বাহিনী মস্কো পৌঁছালো এবং ভাবলো রাশিয়ার আর কোনো বাহিনী অবশিষ্ট নেই তখন তাদের সম্মুখীন হতে হলো এক বিরাট তাজা রাশিয়ান সেনার ,যা তারা ফিরিয়ে এনেছিলো পূর্ব প্রান্ত থেকে ।
হিটলার ও স্তালিন কেউই যুদ্ধে কৌশলগত পিছুহটায় বিশ্বাসী ছিলেননা । ফলতঃ দুপক্ষেরই বহু সেনা নিহত হয় অযৌক্তিকভাবে যখন তাদের পিছু হটা জরুরী ছিলো । রাশিয়া প্রায় হেরে বসেছিলো ১৯৪১ এই কারনেই । অপরদিকে ঠিক এক বছর পর স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে হিটলারের বাহিনীকে ভোগ করতে হয় চরম ক্ষতি ।
হিটলার ১৯৪১ পর্যন্ত ছিলেন জার্মান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক । এবং তারপরেও তিনি একজন কম্যান্ডার হিসেবেই ভূমিকা পালন করে গেছেন তাঁর অন্যান্য ভুমিকাকে তাচ্ছিল্য করেই । যেখানে চার্চিল এমনকি স্তালিনও নির্ভর করেছেন তাঁর জেনারেলদের উপর । নিজেকে মিলিটারি জিনিয়াস ভাবা হিটলার জেনারেলদের উপর ভরসা করেননি , এমনকি তাঁর কিছু যোগ্য জেনারেলকে তিনি বরখাস্ত পর্যন্ত করেছিলেন , যাঁরা তার সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছিলেন বা সমালোচনা করেছিলেন । শেষে ১৯৪৪ এ যখন প্রায় পরাজয়ের দোরগোরায়, তিনি জার্মানীর অন্যতম সামরিক প্রতিভা জেনারেল গুডেরিয়ান (Guderian) কে নিয়োগ করেন কম্যন্ডার হিসেবে যাঁকে আগে তিনি বরখাস্ত করেছিলেন । কিন্তু তার পরেও হিটলার তাঁর কম্যান্ডারের উপদেশ মানেননি ।
একনায়কদের এরকম গোঁয়ার্তুমি থাকে বোধহয় ! হিটলারের মত নিজেকে জিনিয়াস ভাবা , কিংবা স্তালিনের মতো শুধু সন্দেহের বশে অসংখ্য গুপ্ত হত্যা করানো , এমনকি নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসককে পর্যন্ত রেহাই নাদিয়ে ক্রমশ নিজেদের মানসিক অসুস্থার নমুনাই প্রতিষ্ঠা করেছেন ইতিহাসে ।
সবথেকে জরুরী লক্ষ্য ‘প্লোয়েস্তি’(Ploesti)
বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময় থেকেই মিত্র শক্তির যুদ্ধ – পরিকল্পনাকারীরা জানতেন যে জার্মান সেনাবাহিনী চূড়ান্তভাবে নির্ভরশীল তাদের একমাত্র তৈলক্ষেত্র ও শোধনাগার রোমানিয়ার প্লোয়েস্তির উপর । জার্মানরাও তা জানতো বলাই বাহুল্য , তাই তারা কয়লা এবং অন্যান্য পদার্থ থেকে জ্বালানী উৎপাদনের এক ব্যয়বহুল ব্যাবস্থা গড়ে তুলেছিলো । তবুও , জার্মান সেনা বিশেষতঃ বিমান বাহিনী চূড়ান্তভাবে নির্ভরশীল ছিলো প্লোয়েস্তির তেলের উপরেই । বৃটিশ ও রাশিয়ার যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা এই তথ্য জানতো ১৯৪০ থেকেই । জার্মান সেনা ও বিমান বাহিনী ছিলো প্লোয়েস্তির রক্ষার জন্য । শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪ সালে পরিকল্পনা মাফিক লাগাতার বোমাবর্ষনের মাধ্যমে প্লোয়েস্তির তৈল শীল্পকে ধ্বংস করা হয় , রাশিয়ার সেনা বাহিনী যখন জার্মানী দখল করে । জার্মান বাহিনী জ্বালানীর অভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে । কিন্তু এই কাজ আরও অনেক আগেই করা উচিত ছিলো ।
জার্মানী পোল্যান্ড দখল করে ১৯৩৯ সালে । এবং রাশিয়া আক্রমন করে ১৯৪১এ , এই ২১ মাসে রাশিয়া নিজেদের প্রস্তুত করার পাশাপাসি চেষ্টা করছিলো কিভাবে জার্মান আক্রমনকে বিলম্বিত করানো যায় । রাশিয়া জার্মানীর সঙ্গে অনাক্রমন চুক্তি করে , এবং তাদের জার্মান বিরোধী প্রচারও বন্ধ করে দেয় এই শর্তে যে তারা হিটলার বাহিনীকে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করবে । এতে রাশিয়া তার সামরিক শক্তিকে আরও পশ্চিমে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় এবং তারা আক্রমন করে লিথুনিয়া ,লাতভিয়া , এস্তোনিয়া , পোল্যান্ড এবং ফিন ল্যান্ড এবং ১৯৪০ এর জুনে যখন ফ্রান্স আত্মসমর্পন করলো , রাশিয়া বিনা যুদ্ধেই তার সঙ্গে যুক্ত করলো রোমানিয়ার প্রান্তে বেসারাভিয়া ও বুকোনিয়া ।
এরপরের চারমাসে , যখন জার্মান বাহিনী ফ্রান্স ছেড়ে ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাস্ত , বিরাট রাশিয়ান বাহিনী প্লোয়েস্তির মাত্র ১০০ মাইল দূরে অবস্থান করলো । যদি রাশিয়ান বাহিনী সঠিক পরিকল্পনা মাফিক প্লোয়েস্তি আক্রমন করতো তখন ,তাহলে তাদের বাধা দেওয়ার কেউ ছিলোনা । কিন্তু স্তালিন দ্বিধা করলেন এবং হিটলার চার মাস পর বিশাল জার্মান বাহিনী নিয়োজিত করলেন প্লোয়েস্তি রক্ষার জন্য , এবং তার ৯ মাস বাদে জার্মানী রাশিয়া আক্রমন করলো । যদি সেদিন স্তালিন দ্বিধা না করতেন তবে যুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকম হতো ।
১৯৪১এর এপ্রিলে বৃটিশ বাহিনী গ্রীসের মূল ভুখন্ড ছেড়ে বৃহৎ গ্রীক দ্বীপ ক্রেটে(Crete) স্থানান্তরিত হয় , সেখান থেকেও বৃটিশ বাহিনীর থেকে সংখ্যায় কম জার্মান প্যারাট্রুপারদের দ্বারা উৎখাত হয় , কারন তারা জার্মানদের মতো মরিয়া লড়াই করেইনি ক্রেট দ্বীপকে দখলে রাখার জন্য । যদি তারা করতো এবং ক্রেট তাদেরই দখলে থাকতো তাহলে ক্রেটের ৭০০ মাইল উত্তরে অবস্থিত প্লোয়েস্তি আক্রমন করতে পারতো তাদের ভারি বোমারু বিমান দ্বারা । যদি বৃটিশ বিমান বাহিনীর কম্যান্ডার চার্চিলকে জানাতো যে ক্রেট দ্বীপই একমাত্র জায়গা যেখান থেকে প্লোয়েস্তি আক্রমন করা সম্ভব এবং চার্চিল নির্দেশ দিতেন যেভাবেই হোক ক্রেট দখলে রাখার তাহলে জার্মান বাহিনী অনেক আগেই পরাজিত হতে পারতো ।
জার্মান বাহিনীর রাশিয়া আক্রমনের পর সিংহ ভাগ রাশিয়ার বিমান ধ্বংস হয়ে গেলেও রাশিয়ার বিমান বাহিনী বেশ বড় সংখ্যায় রক্ষা করতে পেরেছিলো ইল্যিউশিন -৪ (Ilyushin- 4) নামক দূরপাল্লার বোমারু বিমান গুলি , যা যুদ্ধের সময় পূর্ব ইউরোপ এমনকি বার্লিনেও বোমা বর্ষন করেছিলো । কিন্তু তারা সেভাবে প্লোয়েস্তির উপর আক্রমন করেনি । মূলতঃ রাশিয়ার বিমান ও নৌ বাহিনী কৌশলগতভাবে তাদের স্থল সেনাকে সহোযোগিতাই করে থাকতো । যুদ্ধস্থলের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই তারা শুধুমাত্র আক্রমন করতো । যদি রাশিয়ার বিমান বাহিনী প্লোয়েস্তির তৈলশীল্প ধ্বংসের প্রয়াস করতো তাহলে রাশিয়ায় অনুপ্রবেশকারী জার্মান বাহিনী শীতে কাবু হওয়ার আগেই তেলের যোগানের অভাবে পরাজিত হতো ।
এই জন্যই বলা হয় শত্রুর শেষ রাখতে নেই । একদিকে জার্মানরা যেমন রাশিয়ার বিমানবাহিনীর লেজটুকু রেখে দিয়েছিলো , উলটো দিকে অকারনে ভাবুক হয়ে রাশিয়া তার ক্ষমতার ব্যাবহার থেকে বিরত থেকে জার্মানীকে সুযোগ করে দিয়েছিলো আরো অনেকদূর এগোতে ।
আত্মতুষ্টি
হিটলারের বিষয় বৃটেন ও ফ্রান্সের আত্মতুষ্টি এক চরম ভুল । প্রথম দিকে হিটলারের জার্মানী দূর্বল থাকলেও ধীরে ধীরে তারা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করছিলো এবং আক্রমনাত্মক হয়ে উঠছিলো । অপরদিকে আত্মতুষ্ট বৃটেন ও ফ্রান্স তাদের বাহিনীর উন্নয়ন সাধনে বিরত ছিলো । ফলসরূপ , জার্মানী যখন ফ্রান্স আক্রমন করলো তখ ফ্রান্স একটি তুলনায় দূর্বল ও অ-আধুনিক বাহিনী। চেক রিপাব্লিককে হিটলারে হাতে ছেড়ে দেওয়ায় জার্মান বাহিনী চেক বাহিনীর অস্ত্র-শস্ত্রকেও উপযুক্ত করে ব্যাবহার করতে সক্ষম হলো যা প্রায় ৪০ কম্পানী বাহিনীর উপযুক্ত । এতে হিটলার আরো শক্তিশালী হয়ে উঠলো ।
ফ্রান্স কি ভেবেছিলো কে জানে ! আর যুদ্ধ হবে না ! ইতালি - ফ্রান্স - ইংল্যান্ড -জার্মানী গলায় গলায় ভাই ভাই হয়ে থাকবে ! যেখানে গোকূলে বাড়ছে হিটলার নামক এক আশ্চর্য ক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধন্মাদ একনায়ক !
আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা
যদিও আমেরিকা বৃটেনকে সাহায্য করছিলো এবং জাপানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিলো ১৯৪১ নাগাদ , তবুও আমেরিকার জনগন এই যুদ্ধে জড়াতে ইচ্ছুক ছিলোনা । কিন্তু জাপানের এই চিন্তা যে আমেরিকা তার নৌবহর নিয়ে জাপানের দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া অভিযানে বাধা দিতে পারে – এক বিরাট ভুল বলেই গন্য । এই চিন্তার বশবর্তী হয়ে তারা আক্রমন করে বসে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটিকে । পার্লা হারবারে আক্রমনের পর আমেরিকাও জড়িয়ে পরে যুদ্ধে । এদিকে মুসোলিনি ও হিটলার ইতিমধ্যেই রাশিয়ার ও বৃটেনের সঙ্গে যুদ্ধে চরম সমস্যায় থাকা স্বত্ত্বেও তারা আমেরিকার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষনা করে । এতে আমেরিকা যাবতীয় দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে মিত্র শক্তির হয়ে পূর্নাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং জার্মানী - ইতালি - জাপানের জোটের হার নিশ্চিত করে ।
খুঁচিয়ে ঘা করলে যা হয় আর কি ! ‘পার্ল হারবার’ সিনেমায় সেই জাপানী নৌবাহিনীর এডমিরালের কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে – “ আমরা এবার এক ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগিয়ে দিলাম ...”
পরিশেষ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলে আরও এরকম বহু কারন হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে , এটা নাহলে ওটা হলে ভালো হতো - এরকম । কিন্তু কয়েককোটি মানুষের প্রান নেওয়া , চরম ধ্বংসের এই মহাযুদ্ধের শেষে মানবজাতির প্রাপ্তির ভাঁড়ার দেখলে মনে হতে বাধ্য - প্রধান ভুলের কথাতো এখানে বলাই নেই ! আগ্রাসনের ভুল , একনায়কতন্ত্রের ভুল , বর্ণবিদ্বেষের ভুল , সর্বোপরি –যুদ্ধ্বচিন্তার ভুল ... যে ভুলগুলি মানবজাতি আজও বহন করে চলেছে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:১৫