বর্তমান সময়ে চায়না টেকনোলজি ক্ষেত্রে এমন অবিশ্বাস্য অগ্রগতি অর্জন করে ফেলেছে যে এমন কোন প্রোডাক্ট নেই যা সারা বিশ্বে এতো সস্তায় সরবরাহ করে তাদের সাথে কেউ প্রতিযোগিতা করে তাদেরকে ডাউন করতে পারবে। আমার স্বল্প জ্ঞানে যতটুকু জেনেছি তা হচ্ছে তারা প্রথমে ইউরোপিয়ান কোম্পানি গুলোর প্রোডাক্ট তৈরির যে পদ্ধতি/প্রযুক্তি সেগুলো অনুসরন করে নিজেদের মত করে সাশ্রয়ী নতুন পদ্ধতি/প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে ফেলে। আমরা এখনো দেখি ইউরোপিয়ান কোন নতুন প্রোডাক্ট বাজারে আসার সাথে সাথে চায়না থেকে ও হুবুহু একই প্রোডাক্ট তৈরি হওয়া শুরু হয়ে যায়। এক সময় তাদের ইন্ডাস্ট্রিজ এর প্ল্যান্ট/মেশিনারিজ/টেকনোলজি সব ইউরোপ থেকে আনাতে হতো, আজকে তারা এমন কোন প্রোডাক্ট নেই যার সাশ্রয়ী টেকনলজি/প্ল্যান্ট/মেশিনারিজ নিজেরা তৈরি করে সারা বিশ্বে সরবরাহ করছেনা। বাধ্য হয়ে আজকে ইউরোপের জায়ান্ট টেকনোলজির কোম্পানিরা চায়নায় এসে তাদের আসন গাঁড়তে বাধ্য হচ্ছে।
আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৪২ বছর হয়ে গেছে, একই সময়ে এই এশিয়া মহাদেশের আরো অনেক দেশ আমাদের চেয়ে অতীতে অনেক পিছিয়ে থেকেও আজকে তারা এমন এক অবস্থানে পৌঁছে গেছে যে আমরা তাদের কাছে এখন নস্যি। “আমাদের দেশ কৃষি প্রধান দেশ তাই কৃষির উন্নতি মানে আমাদের উন্নতি” এরকম একটা ধ্যান ধারনা নিয়ে অনেক দিন পথ চলা হয়েছে। তারপর শিল্পায়নের ক্ষেত্রে আমরা এখন পর্যন্ত যতটুকু যা করেছি তার সবটাই অন্যদেশের সরবরাহ করা রেডিমেড টেকনোলজি/প্ল্যান্ট/মেশিনারিজের মাধ্যমে। আমাদের নিজেদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির কোন প্রোডাক্ট অন্যদেশে এক্সপোর্ট করা তো দুরের কথা নিজেদের দৈনন্দিন চাহিদার ৯৮% প্রোডাক্টই আমরা তৈরি করতে পারিনা। এজন্যই এই দেশে গতকাল যে আলু পটলের ব্যবসা করত সেও আজ ইম্পোরটার। অন্যদিকে এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড যে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন তার সবটাই হচ্ছে দরজিগিরি, এইটায় আমরা এখন বিশ্বে ফার্স্ট হতে চলেছি এবং এ নিয়ে গর্বে আমরা অস্থির। আর এর একমাত্র কারন হচ্ছে আমাদের আছে অগনিত সস্তা শ্রম।
এদেশে চাকরির অনেক অভাব বিশেষ করে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরী না পাওয়া এবং শিক্ষিত বেকার সমস্যার সমাধানকল্পে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে সবাইকে নিজেই উদ্যোগতা হবার জন্য নানারকম প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে সরকারী বা বেসরকারী নানা পর্যায়ে। চাকরী খুঁজব না চাকরী দেব এই মুলমন্ত্রে উজ্জিবিত হয়ে আমাদের দেশের বর্তমান তরুন প্রজন্মের একটা অংশ অলরেডী নানা ব্যবসা উদ্যোগ নিয়ে কাজে ও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কিন্তু এর পরেই লাগছে আসল ফ্যাকড়া। একদিকে অনেকের আছে বিজনেস আইডিয়া কিন্তু টাকার জন্য তা বাস্তবায়িত হচ্ছেনা অন্যদিকে অনেকেই হয়ত ৫/১০/২০ লাখ টাকা যে ভাবেই হোক জোগাড় করতে পারবেন কিন্তু তার কাছে নেই কোন বিজনেস আইডিয়া। এটা গেলো একটা দিক, অন্যদিকে যাদের বিজনেস আইডিয়া আছে তাদের আইডিয়ার বিবরন শুনলে অনেক সময় হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায় (যেমন অনলাইনে পাখি বিক্রি) । কিন্তু এছাড়া আর কি করার আছে কারন একজন মানুষ তার সক্ষমতার বাইরে আর কি করতে পারবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকে বাধ্য হয়ে ট্রেডিং রিলেটেড বিজনেসের প্রতি ঝুকছেন যথা দোকানদারী বা আমদানী ব্যবসা। কিন্তু আমি জানি উদ্যোগতা হবার সপ্নে বিভোর আমাদের তরুনরা যদি সাশ্রয়ী টেকনোলজি/প্ল্যান্ট/মেশিনারিজ এরেঞ্জ করতে পারেন তবে অবশ্যই মেনুফেকচারিং বিজনেসের প্রতি আগ্রহান্বিত হয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
প্রতি বছর আমরা হাজার হাজার কোটি টাকার ক্যাপিট্যাল মেশিনারী, ইকুইপমেন্টস, মেশিনারী পার্টস, অটোমোবাইল পার্টস, নানা রকম কঞ্জিউম্যাবল ইলেক্ট্রনিকস প্রোডাক্ট, মধ্যবর্তি কাঁচামাল এসব আমদানী করি। যদি আমরা আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে আমাদের মত করে ক্ষুদ্র পরিসরের লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে এর অন্তত ৫০% ও নিজেরা মেনুফেকচার করতে সক্ষম হই তাহলে আমার হিসাব বলে কমপক্ষে ২৫০০ ধরনের পন্যের জন্য ১ লাখ নতুন ক্ষুদ্র/মাঝারি শিল্প উদ্যোগ নেয়া যাবে যেখানে কমপক্ষে ২৫ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ আর বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার উৎপাদন/টার্নওভার আসবে এবং একই সাথে সেইভ হবে সমমুল্যমানের বৈদেশিক মুদ্রা যা আমদানী খাতে ব্যয় হয়। এখন এই প্রসেস/পদ্ধতি/টেকনলজি উদ্ভাবনের কাজটা করবে কে? সরকারের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ? উনাদের ওয়েব সাইটে গিয়ে দেখুন গত ৪০ বছরে উনারা এখন পর্যন্ত কি কি প্রসেস উদ্ভাবন!!! করেছেন। চিরতার ক্যাপসুল, হারবাল প্রসাধনী,ডায়াবেটিকের বিস্কুট, স্পিরুলিনা দিয়ে তৈরি শক্তিবর্ধক এই সবের মধ্যে উনাদের উদ্ভাবন সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এই সব জোকারি বন্ধ করা দেয়া উচিত।
এখন তাহলে আমাদের কি করা উচিৎ? এই দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটির সংখ্যা কম নয়। অনেক শিক্ষক আর প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আছেন। প্রতি বছর অনেক ইঞ্জিনিয়ার পাশ করে বের হচ্ছেন কিন্তু তারা করছেনটা কি ? নাকি হাইটেক ইন্ডাস্ট্রির টেকনোলজি সরলীকরণ করা সম্ভব না ? ভাই এসব নিয়ে একটু ভাবুন। যেখানে অটোমেশন না হলেই নয় সেখানে তো সেটা করতেই হবে। কিন্তু সব কিছুতেই অটোমেশনের চেয়ে আমি মনে করি আমাদের বেশি করে দরকার সরল টেকনোলোজির সাশ্রয়ী ক্ষুদ্র পরিসরের মেনুফেকচারিং প্ল্যান্ট যা দিয়ে আমাদের শত শত তরুণরা শিল্পোদ্যোক্তা হয়ে আমদানী বিকল্প পন্য তৈরি করে দেশের চাহিদা মিটাবে আর রক্ষা করবে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার। আর কেউ না জানুক/বুঝুক কিন্তু আমি জানি এবং বুঝি এটা ১০০% সম্ভব। যেখানে আমাদের দেশের অশিক্ষিত/স্বল্প শিক্ষিত মেকানিক্স/মিস্ত্রীরা এমন সব কিছু করছে যে নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবেনা। গিয়ারের পিনিয়ামের যে খাঁজ বা দাত থাকে তা সাধারণত মিলিং মেশিন ছাড়া করা সম্ভব না। অথচ এক জায়গায় দেখলাম জাস্ট এক্সটারনাল কিছু যোগান সেটআপ করে লেদ মেশিন দিয়েই সেই কাজটা করে ফেলছে। যারা যন্ত্রপ্রকৌশলী আছেন তারা চিন্তা করুন টেকনিক্যাল নলেজের শার্পনেস কাকে বলে। তো এটা যদি সম্ভব হয় তাহলে মাথা খাটালে সব কিছুই সম্ভব।
তবে এটা ঠিক, আমি যেমনটি করে ভাবছি তা অন্যদের কাছে হাস্যকরই শোনাবে। কারন গবেষনা বলে যে একটা জিনিষ আছে আর যাই হোক এ দেশের জন্য তা প্রযোজ্য না। এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির জন্য কোটি টাকা দিয়ে গাড়ী কেনার বাজেট থাকলেও গবেষণা খাতের জন্য কোন টাকা থাকেনা। সেদিন কোথায় যেনো দেখলাম কোন এক ভার্সিটির একটা গবেষণা প্রকল্পে গবেষকদের মাসিক ভাতা নির্ধারিত হয়েছে ২৫০০ টাকা। গোটা মানব জাতীর ইতিহাসে এই রকম অপমান জনক বিষয় আর কোথাও ঘটে কিনা আমার জানা নেই।